#শৈবলিনী—-৩৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ঘন্টা দুই তান্ডব চালিয়ে তুফান থেমে গিয়ে সর্বশান্ত সৈনিকের ন্যায় বিমুঢ় হয়ে বসে আছে নূর। তার রঙিন ভুবনটা মুহূর্তেই কালবৈশাখী ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল।শূন্যতার এক পাহাড় এসে ভড় করলো তার ওপর। নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে তার। বুকের যন্ত্রণাদায়ক পীড়া মুমূর্ষু করে দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার আশায় আস্তে আস্তে উঠে জানালার পাশে এসে জানালা খুলে দাঁড়াল সে। জানালা খুলতেই বৃষ্টির ঝাপসা এসে লাগলো মুখে। এরমাঝে কখন বৃষ্টি নেমেছে টেরই পায়নি সে। কীভাবে পাবে,দিনদুনিয়ার কোনো আলোড়ন শুনতে পাচ্ছে না সে। তার ভেতরের আর্তনাদ যে তার সব বোধশক্তি কেঁড়ে নিচ্ছে। জানালা খুলে বৃষ্টির ঝাপসা পেয়ে চোখ বুজতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের আদিত্যর সাথে কাটানো বৃষ্টিতে ভেজা সেই মুহূর্ত টা। ছিটকে চোখ খুলে ফেললো নূর। বুকের পীড়ন যেন আরও অসহনীয় হলো। আজকে এই বৃষ্টিও অসহ্য লাগছে তার। এই বৃষ্টির ফোটা যেন টগবগে গরম তেলের মতো তার শরীরকে ঝলছে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে তার। সহ্য করতে না পেরে জানালাটা আবারও আটকাতে চাইলো সে। হঠাৎ নিচের দিকে নজর যেতেই থমকে গেল তার হাত। বৃষ্টির মাঝেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই পুরুষটিকে চিনতে সে ভুল করলোনা। কীভাবে ভুল করবে! এইতো সেই ব্যক্তি যে,ওর মনটাকে একটু আগেই নির্মম ভাবে হ,ত্যা করেছে। সেই লোক এখন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে ওর জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে এখানে কী করছে? কী চায় সে? এখনও কী খেলা শেষ হয়নি? আরও কী খেলা বাকি আছে তার? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে কী প্রমাণ করতে চাইছে? যা খুশি করুক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। এই ধোঁকাবাজের ফাঁদে আর পা দিবোনা আমি। জানালা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো নূর।

নিচ থেকে সবকিছুই দেখতে পেল আদিত্য।দেখতে পেল নূর ঠিকই ওকে দেখতে পেয়েছে। আর ওকে দেখেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও সে নড়লো না। সে কেন এসেছে জানে না।কেন দাঁড়িয়ে আছে জানে না।নূরকে কী বলবে জানে না। কী করবে তাও জানে না। শুধু জানে নূরকে দেখতে চায় সে। নূরের কথা শুনতে চায় সে। দরকার হলে ইচ্ছেমতো যতখুশি গালি দিক নূর ওকে। তবুও তা শুনতে চায় আদিত্য। চাইলে ওকে মারতে মারতে জান বের করে দিক নূর, তবুও চায় নূর আসুক। সে যে অপরাধ করেছে তারজন্য সব মেনে নিতে রাজি সে।নূরের হাতে খু,ন হতেও রাজি। শুধু নূর এসে ওর সাথে কথা বলুক। নূরের ওই নিরবতা যে আদিত্যর দম বন্ধ করে দিচ্ছে। গলা চিপে ধরেছে। একবার শুধু নূরকে দেখতে চায় সে। নূরের সব নারাজি সহ্য করতে রাজি, কিন্তু নূরের ওই নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারছেনা আদিত্য। কিছুতেই না।

নূর জানালাতো আঁটকে দিয়েছে। কিন্তু নিজের অশান্ত মনকে কীভাবে শান্ত করবে। যে বেহায়া মন গলা কা,টা মুরগির মতো ছটফট করছে। দেখতে চাইছে ওই ছলনাময় লোকটাকে।নিজের অবাধ্য মনের এই বেহায়াপনার জন্য নিজের ওপরই ঘৃণা হচ্ছে নূরের। ওই লোকটাকে ভালোবাসার মতো অন্যায়ের জন্য নিজেকে গলা টি,পে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।এতো চালাক হয়েও এতবড় বোকামির জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ শাস্তিতে দন্ডিত করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। ভেতরের হৃদপিণ্ডটা টেনে বের করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওই লোকটার জন্য জমা অনুভূতি গুলোকে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চাইলেও এসব করতে না পারায় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে তার। অস্থিরতায় এক জায়গায় টিকতে পারছেনা নূর। অশান্ত মন তাকে একমুহূর্তও শান্তি দিচ্ছে না। ঘন্টা খানিক নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলোনা নূর। আদিত্য আছে না নেই জানার জন্য আবারও জানালা হালকা একটু খুলে নিচে তাকালো। দেখতে পেল ঝুম বৃষ্টির মাঝে এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ব্যক্তিকে। বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থা তার। তবুও একচুলও নড়ছেনা সে। নূর আবারও জানালা আঁটকে দিলো। যা খুশি করুক। ওই ছলনায় আর ভুলবেনা নূর।
__

ঘন্টাখানিক হলো আদ্রর রুমে রেখে গেছে অমালিয়াকে। তখন থেকেই খাটের এক কোনে হেলান দিয়ে বিষন্ন মনে বসে আছে সে। নিজের বিয়ে নিয়ে কতশত স্বপ্ন ছিলো তার। আর আজ এমনভাবে তার বিয়ে হলো যেন কোনো অন্যায় করে ধামাচাপা দেওয়ার মতো। এসবকিছুর জন্য কোথাও না কোথাও সে নিজেই দায়ী। আপুর কথা যদি আগেই মেনে নিয়ে নিজের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আনতাম তাহলে হয়তো আজ এসব হতোনা আমার সাথে। আপুর কথা তখন অমান্য করার শাস্তি পাচ্ছি আজ। আর আজকের পর হয়তো সেই আপু আর কখনো কিছু বলবেইনা। হয়তো আর অধিকার দেখিয়ে শাসনও করবেনা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়লো অমালিয়ার। নড়েচড়ে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। দরজা খুলে আদ্র ঢুকলো। তাকে দেখতেই মাথায় আগুন ধরে গেল তার। মনে পড়ে গেল ভয়াবহ সেই রাতের কথা। যে রাতের ভয়াবহতা হয়তো তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এই লোকটাকে দেখলেই তার ক্ষত বারবার সতেজ হয়ে যাবে।

আদ্রর ক্ষেত্রেও বিষয়টা খুব একটা সহজতর না। অমালিয়ার সামনে এভাবে থাকা তার কাছেও প্রচুর অস্বস্তিকর ব্যাপার। নেশার ঘোরে সেদিন অতবড় অন্যায় করে ফেললেও এখন সেটা নিয়ে তার মাঝে অপরাধবোধের সীমা নেই। পরিবারের সাথে সাথে সে নিজেও নিজের কাছেই ঘৃণিত হয়ে গেছে। অপরাধ বোধে সে অমালিয়ার দিকে তাকাতেও পারছেনা। কোনরকমে মাথা নুইয়ে কাবার্ডে গিয়ে নিজের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।কতক্ষণ ইতস্তত করতে করতে চুপচাপ আস্তে করে গিয়ে বিছানার একপাশ ঘেঁষে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ পেছন শরীরের নিচ থেকে চাদর সজোরে টান দিলো কেউ। যার দরুন আদ্র বিছানা থেকে উল্টে গড়ে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে হাতে হালকা ব্যাথাও পেল সে। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে উঠে সামনে তাকালে অমালিয়াকে চাদর হাতে রাগী মনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। বুঝতে পারলো তাকে ফেলে দেওয়ার কাজ সেই করেছে। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
–হোয়াট দ্য…. তুমি আমাকে ফেলো দিলে কেন? চাদর লাগলে কাবার্ড থেকে নাও। শরীরের নিচ থেকে টান দেওয়ার কী দরকার?

অমালিয়া চোখ মুখ শক্ত করে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
–তোমার কী মনে হয়? তোমার মতো জঘন্য লোককে আমি আমার পাশে ঘুমুতে দিবো? তুমি যদি ভেবে থাকো আমি এই বিয়ে তোমার সাথে সংসার করার জন্য করেছি তাহলে সেই আশা মাটি চাপা দাও। তুমি কী ভেবেছ, এসবের পরও তোমার সাথে সাধারণ স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক করবো আমি! কক্ষনো না। কান খুলে শুনে রাখো। শুধু সমাজের সামনে নিজের সম্মান রক্ষার্থে আমি এই বিয়ে করিনি। আমি এই বিয়ে করেছি আমার সাথে তোমার করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আইন তোমাকে কী শাস্তি দিতো। তোমার মা বাবা ক্ষমতার জোরে হয়তো তোমাকে বাঁচিয়েও নিতো। তাইতো আমি নিজে হাতে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি এখন থেকে সারাটা জীবন শাস্তি পাবে। তোমার লাইফ হেল করে দিবো আমি। কখনো শান্তিতে থাকতে দিবোনা তোমাকে। সারাজীবন জ্বলতে হবে তোমাকে। না আমাকে ছাড়তে পারবে আর না পারবে আমার সাথে থাকতে। আর এটাই হবে তোমার সর্বোচ্চ শাস্তি।এখন যাও, যেখানে খুশি সেখানে নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করো। কিন্তু খবরদার আমার পাশে শোয়ার চিন্তাও করবেনা।

আদ্র ভারী লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অমালিয়ার কথার কোনরকম জবাব দিলোনা সে। বলার মতো তেমন কোনো শব্দই নেইযে তার কাছে। সে যা করেছে তারজন্য এটাতো তার প্রাপ্য। পাপের শাস্তিতো তাকে ভোগ করতেই হবে। লোকে ঠিকই বলে, পাপ ছাড়েনা বাপকে। আইনের হাত থেকে বাচলেও, এই জেলখানার শাস্তি থেকে আর কীভাবে বাঁচবে। তাইতো সেই চেষ্টাও করতে চায়না আর। এতে করে যদি কিছু পাপ কম হয়। তাই চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে রুমের ডিভানের দিকে এগিয়ে গেল সে। ডিভানের কাছে এসে অমালিয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
–জানি আমি যা করেছি তা মাফ করার নয়।তাই মাফ চাইবো না । তুমি যতো পারো শাস্তি দাও। যতক্ষণ না তোমার আত্মতুষ্টি হয় ততদিন শাস্তি দাও। তবে যেদিন মনে হবে আমাকে শাস্তি দিয়ে তুমি তোমার ক্ষত কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছ সেদিন পারলে এই অপরাধীকে ক্ষমা করে দিও। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো।

অমালিয়া তার মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। এই লোকটার সামনে তার কান্নাও দেখাতে চায়না সে। হঠাৎ আদ্র আবার বলে উঠলো,
–আর হ্যাঁ আরেকটা অনুরোধ করতে চাই তোমাকে। তুমি জানো কিনা জানিনা, তবে ভাইয়া কিন্তু নূর আপুকে ভালোবাসে। সেদিন ভাইয়া আমাদের জানিয়েছিল সে বিয়ে করলে তাকেই করবে। কিন্তু আমাদের এসব ঘটনার কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। আমার জন্য ভাইয়া এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন আবার আমার জন্য সে তার ভালোবাসাকেও হারাক সেটা আমি একদমই চাইনা। তাই পারলে তুমি একটু আপুকে বুঝিয়ে বোলো যে, ভাইয়া এসব ইচ্ছে করে করেনি। আমার আর মায়ের চাপে পড়ে সে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে। ভাইয়াতো আমাকে পুলিশে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু আমার কথা ভেবে মা ভাইয়ার কাছে অনেক কান্নাকাটি করে। মায়ের আকুতির কাছে আটকে গেছে ভাইয়া। তাই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে সে। প্লিজ এই বিষয় টা একটু নূর আপুর কাছে ক্লিয়ার করো তুমি। নাহলে এতো এতো অপরাধের ভার নিয়ে বাঁচতে পারবোনা আমি।

অমালিয়া চমকে গেল। মুখ চেপে ধরে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো সে। অজান্তে সে এটা কী করে ফেললো? আদিত্য আপুকে ভালোবাসে? কিন্তু আপুতো নিশ্চয় আজকের এসবের কারণে আদিত্যকে ভুল বুঝবে। ওর আপুকে ভালো করেই জানে ও। সে একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা কেউ বদলাতে পারবেনা। আজ আমার জন্য আপু আর আদিত্যর সম্পর্ক হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। এখন কী করবো আমি? আপুতো আর আমার মুখও দেখতে চায়না,কথা বলাতো দূরের কথা। তাহলে তাকে কীভাবে বুঝাবো আমি? আজ একটা অঘটন সবার জীবনটাকে কেমন বদলে দিলো। সব আমার কারণে হয়েছে। আমার জন্য আজ আপুর জীবনটাও উলোটপালোট হয়ে গেল। এখন কী হবে? কে জানে এসবকিছু কোন দিকে মোড় নিবে।
__

আরও দুই ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে।রাত তখন দুইটার কাছাকাছি। ঝুম বৃষ্টির শব্দ এখনো থামেনি।মেঘেরও যেন আজ নূরের মতো কষ্ট হচ্ছে। তাইতো কান্না থামছেই না তাদের । মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত আবারও পরাজিত হলো নূর। অশান্ত মনের দায়ে আবারও জানালাটা হালকা খুলে নিচে তাকালো সে। এখনো যায়নি ওই ব্যক্তি। জিদ্দি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির মাঝে। গত প্রায় তিনঘণ্টার বেশি সময় ধরে একটানা ভিজছে সে। এসব করে কী প্রমাণ করতে চায়ছে সে? নাহ,এভাবে আর চলবেনা। ওই বেঈমান পুরুষকে বোঝাতে হবে তার এসব ড্রামার কোনো প্রভাব আর পড়বেনা। এই নূর একবার বোকা হয়েছে, বারবার হবে না।

দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত মজবুত করলো সে। অখন্ডিত পাথরে রুপ নিলো। যে পাথরে নেই কোনো অনুভূতির লেশমাত্র। নিজেকে তৈরি করে ছাতাটা বের করে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো নূর। মেইন গেট খুলে সোজা আদিত্যর সামনে এসে দাঁড়াল সে। বৃষ্টিতে একটানা ভিজে আদিত্যর অবস্থা শোচনীয়। চোখ দুটো লাল ডগডগ করছে। মুখমন্ডল একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আদিত্যর এই হাল নূরের বুকের ভেতর হাজারও পীড়ন দিলেও চেহারায় তার বিন্দুমাত্র ছায়াও আনতে দিলোনা নূর। চোখ মুখ এতটা শক্ত করে রেখেছে যেন,আদিত্য কোনো অপরিচিত লোক। তাকে সে চেনেই না। নূরের এই কঠোর চাহুনিই যথেষ্ট আদিত্যর হৃদয়ে র,ক্ত,ক্ষরণের জন্য। শেষমেশ নূর এলোতো ঠিকই। কিন্তু এই নূর যে ওর নূর না। এ যে পাথরের কোনো মূর্তি মনে হচ্ছে। যার কাছে আদিত্যর ডাক হয়তো পৌঁছাবেও না।

নূর আদিত্যর পানে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো,
–মিঃ সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য। এখানে কি আপনার কোনো মুভির শুটিং চলছে? যদি তা না হয়ে থাকে। তাহলে আপনার এই অতিরঞ্জিত ড্রামার কারণ জানতে পারি কি? এক্সুয়ালি, তারও দরকার নেই। তবে শুধু বলবো, এটা একজন অতি সাধারণ ভদ্র পরিবারের বাড়ি। তাই এখানে এভাবে মাঝরাতে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে, আমাদের যা একটু সম্মান বাকি আছে সেটারও হানী করার যদি আপনার মনকামনা থেকে থাকে তাহলে অতি দুঃখের সাথে বলতে চাই এটা আমি হতে দিবোনা। ভালোই ভালোই এখান থেকে যান। নাহলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো। হ্যাঁ জানি আপনাদের অনেক টাকা আছে,অনেক ক্ষমতা আছে। এসব পুলিশ টুলিশ পকেটে নিয়ে ঘোরেন। অপরাধ করেও, রায় কীভাবে নিজের হিতে আনতে হয় তা ভালো করেই জানেন। তবুও নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতো আমার সামর্থ্য মতো চেষ্টাতো আমি করবোই।

আদিত্য নিশ্চুপ ব্যাথা ভরা করুন চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। কী বা বলার আছে ওর। প্রথমত নূরের মিঃ নায়কের বদলে ওর পুরো নাম ধরে ডাকাটাই ছিলো বিষাক্ত তীর তীব্র বেগে হৃদপিণ্ডে বিঁধে যাওয়ার মতো ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক। আজ যেন নিজের নামটাই সবচেয়ে তিক্ততা পূর্ণ মনে হচ্ছে। যে নাম নূরের মুখে আজ সবচেয়ে বেশি বিশ্রী লাগছে শুনতে। আর নূরের এই তিক্ত বাক্যগুলো মনে হচ্ছে উত্তপ্ত গরম লাভার মতো হৃদপিণ্ড জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তবুও শুনবে সে। নূরের সব ক্রোধ বর্ষিত হোক তার ওপর। নূর ওর ক্রোধের অগ্নিতে দগ্ধ করে দিক ওকে। সব সয়ে যাবে ও। নূরের বিশ্বাস ভাঙার অপরাধে সে মেরে ফেললেও ক্ষতি নেই। তবুও যেন নূর ওকে ছেড়ে না যায়। নূরের দেওয়া সেই শাস্তি কীভাবে মেনে নিবে ও? শুধু এই শাস্তিটাই যেন নূর ওকে না দেয়।

নূর ওর কথা শেষ করে চলে যেতে নিলেই, আদিত্য তীব্র আবেগ আর মায়া ভরা কন্ঠে করুন সুরে ডাকলো নূরকে। না চাইতেও থমকে গেল নূরের পা। বুকের মাঝে মুচড়ে উঠলো। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে আসছে সব। তবুও সব নিজের মাঝেই দমিয়ে রেখে শক্ত চোখে আবারও আদিত্যর পানে ফিরে তাকালো। আদিত্য অপরাধী সুরে বলে উঠলো,
–আমি জানি নূর,আমি তোমার অপরাধী। তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি। তুমি যা চাও শাস্তি দিতে পারো আমাকে।শুধু একবার আমার কথা….

আদিত্যর বাক্য শেষ হওয়ার আগেই নূর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
–এক মিনিট,এক মিনিট মিঃ আদিত্য। আই থিংক আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। নিজেকে বোধহয় একটু বেশিই ইম্পর্ট্যান্স দিয়ে ফেলছেন। নূর কারোর ওপর এতটাও ডিপেন্ড হয়না যে,কেউ ওর ইমোশন নিয়ে খেলতে পারে। আপনি ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসুন। আর হ্যাঁ, আপনার হয়তো আজকের ডেটটা মনে নেই। তবে আমার মনে আছে। আজ সেই দিন যেদিনে আপনার দেওয়া ত্রিশ দিনের সমাপ্তি হলো।

আৎকে উঠলো আদিত্য। আজ ত্রিশ দিন শেষ হয়ে গেছে? ওরতো মাথায়ই ছিলোনা। কিন্তু নূর কেন মনে করিয়ে সেটা? কী বলতে চাইছে সে। ভয়ে অন্তর শুঁকিয়ে আসছে আদিত্যর। আদিত্যর ভয়কে সত্য করে দিয়ে নূর বলে উঠলো।
–তো আপনার দেওয়া আজ ত্রিশ দিন শেষ হলো। আর আপনার প্রতি আমার কোনোরকম ফিলিংস হয়নি। তো এখন আপনার কথা অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ পুরো হয়ে গেল। ওয়াদা পূরণ করার ক্ষেত্রেতো আপনার ট্রাক রেকর্ডের কথা বলতেও চাচ্ছিনা। তবে আশা করি অন্তত এবার নিজের কথা রাখবেন। আর আপনার শর্ত অনুযায়ী আর কখনো আমাকে জ্বালাতে আসবেন না। আপনার সাথে এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। ভালো থাকবেন। আর পারলে এর পরের বার কাউকে কোনো ওয়াদা করবেন না। গুডবাই মিঃ সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য।

আদিত্যর হৃদপিণ্ডে তীব্র বেগে সহস্র খানেক বাজ ফেলিয়ে চলে গেল নূর। সত্তাটাকে মে,রে ফেলে লাখো তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে রেখে গেল ওকে। অসার হয়ে আসা শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়লো আদিত্য। আজ সে সত্যি সত্যিই চিরতরে হারিয়ে ফেললো নূরকে। এখন এই মৃ,ত হৃদয়টাকে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে ও? নূর ওকে এতো কঠিন শাস্তি দিয়ে গেল! এরচেয়ে তো ওর জানটা বের করে নিয়ে গেলেও পারতো। এখন এই জীবনের বোঝা ও কীভাবে বয়ে বেড়াবে। শরীরটা এবার আরও নিস্তেজ হয়ে গেল। কোনোরকমে একবার অস্পষ্ট সুরে নূরের নাম নিলো। তার পরপরই ঢলে পড়লো মাটিতে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here