#শৈবলিনী—৩০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★নূরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটার বেশি বেজে গেল। সকলে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আদিত্য সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওর রুমে চলে যেতে চাইলো। সিঁড়ির দিকে উদ্যত হতেই হঠাৎ লিভিং রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। আদিত্য পাশে তাকিয়ে দেখলো ওর মা রেহনুমা সোফায় গুরুগম্ভীর ভাবে বসে আছে। আদিত্যর উদ্দেশ্যে তিনি থমথমে মুখে বললেন,
–আদি, এতো রাত করে কোথাথেকে আসছ জানতে পারি কী?
আদিত্য বলল,
–আজ শুটিংয়ে কাজ একটু বেশি ছিলো তাই দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি এখনো বসে আছ কেন? আমি খাবার খেয়ে এসেছি। তোমাকে খাবার দেওয়ার জন্য বসে থাকতে হবে না। যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।
রেহনুমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–বাহ্ তো এখন মিথ্যেও বলা শিখে গিয়েছ? এতো পদন্নোতি হয়েছে তোমার? ওই মেয়েটার কাছ থেকে ভালো শিক্ষাই লাভ হচ্ছে তাহলে।
আদিত্য বুঝতে পারলো তার মা এখন আবারও নূরের টপিক নিয়ে পড়বে। যা আদিত্যর মোটেও ভালো লাগবেনা। তাই আদিত্য ক্লান্ত স্বরে বলল,
–প্লিজ মা! নট নাও। আম ভেরি টায়ার্ড। আই নিড সাম রেস্ট। উই টক এবাউট লেটার।
বলেই আদিত্য আবার চলে যেতে চাইলো। কিন্তু তা হতে দিলোনা রেহনুমা। তিনি রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলেন,
–দাঁড়াও আদি,পরে নয় এখুনি কথা হবে। আমি চোখের সামনে ছেলের বরবাদী সহ্য করবোনা। তোমাকে আমি ভাবার সময় দিয়েছিলাম। তবে মনে হচ্ছে না সে ব্যাপারে তুমি বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করছ।তুমিতো উল্টো ওই মেয়ের পেছনে নিজের ক্যারিয়ারও শেষ করে দিচ্ছো। আমি সব জানি। আজ চারদিন হলো তুমি শুটিং-এ ঠিকমতো যাচ্ছোনা। ওই মেয়ের পেছনে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছো। তোমার মাথা খেয়ে ফেলেছে ওই মেয়েটা। তাই এখন আমাকেই শক্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো মায়ের দিকে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
–মা তোমাকে আগেও বলেছি, ওর একটা নাম আছে। সেই নাম নিয়ে কথা বললে নিশ্চয় তোমার সম্মান হানি হবে না। আর সিদ্ধান্ত নিয়েছ মানে? কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি? তোমার সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য যদি আমাকে নূরের কাছ থেকে দূরে সরানে হয়ে থাকে। তাহলে বলবো এই সিদ্ধান্ত আমার পক্ষে মানা সম্ভব না। অন্তত আমার জান থাকতে সম্ভব না।
–ও আচ্ছা, তো আজ দুদিন আগে আসা ওই মেয়েটা তোমার কাছে তোমার মায়ের চাইতেও বেশি জরুরী হয়ে গেল? এখন আর মায়ের কী দরকার তাইনা?
–মা প্লিজ, ডোন্ট ডু দিস টু মি। তুমি ভালো করেই জানো আমার কাছে তুমি কী। তাই প্লিজ এসব অযথা তুলনা করে নিজেকে ছোট করোনা। তুমি নূরকে ভুল বুঝছ মা। ওর মতো খাটি সোনা তুমি হাজার খুঁজেও পাবেনা। ওকে একবার কাছ থেকে জানতে পারলে তুমিও ওর প্রেমে পড়ে যাবে। এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। তোমার ছেলে এতো বোকা না। সে মানুষ চিনতে ভুল করে না। আমি ভুল কাওকে ভালোবাসিনি মা। তোমার ছেলের ওপর কী এতটুকুও ভরসা নেই তোমার?
–এতসব জানি না আমি। ওই মেয়ে তোমার যোগ্য না। আর এটার জন্য কারোর কাছে জাস্টিফেকিশনের প্রয়োজন নেই আমার। তোমার চাইতে বেশি অভিজ্ঞতা আছে আমার। তাই সাফ সাফ শুনে রাখো। ওই মেয়ের কথা ভুলে যেতে হবে তোমার।
–পারবোনা, মা।
–ঠিক আছে,তাহলে তুমি চুজ করো। মা চাই নাকি ওই মেয়েটা? কারণ যেকোনো একটাই তুমি নিতে পারবে। মনে রাখবে একটা সিলেক্ট করলে আরেকটা চিরতরে হারাতে হবে তোমাকে।
আদিত্য স্তব্ধ, আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–মা! এরচেয়েতো সহজ হতো তুমি আমার জানটাই চেয়ে নিতে। বিনাবাক্যে দিয়ে দিতাম।
–আমার যা বলার বলে দিয়েছি। বাকিটা এখন তুমি চিন্তা করে দেখ।
বলেই চলে গেলেন রেহনুমা। রাগে দুঃখে সামনের টি টেবিলে লাথি মেরে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলে আদিত্য। অশান্তিতে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। কেবলই মনে হচ্ছিল এতো সাধনার পর হয়তো নূরের মনে জায়গা করতে সক্ষম হয়েছে সে। কিন্তু তার আগেই তার মা এমন কঠোর হয়ে বসলো। এখন কী করবে ও? মা কে কীভাবে মানাবে ও? আজ ভীষণ অভিমান হচ্ছে মায়ের প্রতি। ওর মা কখনো এমন করতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। সেতো ভেবেছিল মা সন্তানের সবকিছু না বলতেই বুঝে যায়। তাহলে ওর মা কেন আজ ছেলেকে বুঝতে পারছে না? ছেলের খুশির কী কোনো দাম নেই তাঁর কাছে? ছেলের আকুলতা কী তাঁর চোখে পড়ছে না? তিনি কী একবারও বুঝতে পারছেন না নূরকে ছাড়া আমি নিঃশ্ব হয়ে যাবো? ছেলের কষ্টে কী উনার মন কাঁদছে না? একবারও সোসাইটির কথা বাদ দিয়ে শুধু ছেলের খুশী প্রাধান্য দিতে পারছেন না উনি? আমার চেয়ে কি সোসাইটির স্টাটাস বজায় রাখাটাই বেশি জরুরি হয়ে গেল তার কাছে? এতটা কঠোর কীভাবে হতে পারলো ওর মা?
___
মাঝখানে একদিন কেটে গেছে। আদিত্য-নূর দুজনেই প্রাণপণে চেষ্টা করছে অমালিয়ার অপরাধীকে খোঁজার। নূরকে একা ছাড়ছেনা সে।তবে নূরের অগোচরে আদিত্য ওর গ্যাং এর লোককেও অপরাধীকে খোঁজার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। একবার অপরাধী পেলে তাকে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবে আদিত্য। আজ আবরও আদিত্য এসেছে নূরের বাসায়। অমালিয়ার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছে, সেদিন তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নূরও সেখানে উপস্থিত। আদিত্য অমালিয়ার পাশে বসে নরম সুরে বলল,
–অমালিয়া, মাথায় একটু জোর দিয়ে ভাবার চেষ্টা করো, সেদিন কোথায় নিয়ে গিয়েছিল ওরা? কিছুতো দেখেছ তুমি। ওখান থেকে পালিয়ে আসার সময় আশেপাশে এমন কিছু কী ছিলো যাতে বোঝা যায় জায়গাটা কোথায়? যেকোনো ছোট্ট ক্লুও আমাদের জন্য হেল্পফুল হবে। প্লিজ একটু মনে করার চেষ্টা করো।
অমালিয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুন সুরে বলল,
–ওইসময় আমার কোনো জ্ঞান ছিলোনা। কোথায় আছি সেটা দেখার সময় ছিলোনা আমার। কোনোভাবে শুধু পালিয়ে আসার চিন্তায়ই মাথায় ছিলো। অন্য কিছু দেখা বা ভাবার পরিস্থিতিতে ছিলাম না তখন।
–তবুও ভেবে দেখ। কিছু না কিছুতো মনে পড়বেই। এমুহূর্তে যেকোনো কিছুই আমাদের কাজে দিতে পারে। একটু জোর দিয়ে ভাবো।
আদিত্যর কথামতো অমালিয়া ভাবার চেষ্টা করলো সেদিন রাতের কথা। কিছুক্ষণ ভাবার পর কিছু একটা মনে আসলো তার। সে চকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–হ্যাঁ মনে পড়েছে।
–হ্যাঁ, বলো কী?
–সেদিন যখন আমি বের হচ্ছিলাম। পাশের কিছুদূর থেকে অনেক জোরে জোরে জিকির আজগরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তারমানে পাশেই কোথাও মাজার ছিলো। আর হ্যাঁ ওই জায়গাটা একটু নিরিবিলি আর কোলাহল থেকে দূরে ছিলো। তাইতো আমার বাসায় পৌঁছাতে সময় লেগেছিল। ওই জায়গাটা গাছগাছালিতে ঘেরা ছিলো। যেমনটা কোনো ফার্মহাউসে থাকে। হতে পারে ওটাও কোনো ফার্মহাউস ছিলো। তাইতো আর কোনো লোকজন ছিলোনা ওখানে।
–এইতো পেরেছ। মাজারের পাশে ফার্মহাউস। এবার আর ওই জায়গা খুঁজে বের করতে সময় লাগবেনা। আর একবার জায়গা খুঁজে পেলে ওই অপরাধীকেও দ্রুতই খুঁজে পাওয়া যাবে।
অমালিয়ার কথা বলা শেষে নূরের সাথে বেড়িয়ে এলো আদিত্য।বাসার মেইন দরজার বাইরে এসে আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–তুমি চিন্তা করোনা নূর। আমি আজই ওই জায়গা খুঁজে বের করবো। আর খুব জলদিই ওই অপরাধীকেও খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করবো। ট্রাস্ট মি নূর, আমি…
–আই ট্রাস্ট ইউ।
কথার মাঝেই নূরের বলা এই বাক্য শুনতেই থমকে গেল আদিত্য। চমকিত চোখে তাকালো নূরের পানে। সে কি ভুল শুনলো? কনফার্ম হতে আদিত্য শুধালো,
–কী বললে তুমি? সে ইট অ্যাগেইন?
নূর আদিত্যর আরও নিকট এগিয়ে গেল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
–আই ট্রাস্ট ইউ। আমি জানি আপনি আপনার কথা রাখবেন। ওই অপরাধীকে ঠিকই খুঁজে বের করবেন। পুরো বিশ্বাস আছে আপনার ওপর। তাই একদম নিশ্চিত থাকবো আমি।
আদিত্য যেন সপ্তম আসমানে ভাসছে। লক্ষ তারার মেলা জমলো তার হৃদপিণ্ডে। স্থির হয়ে গেল সে। নূর ওর ওপর বিশ্বাস করছে। আর নিজ মুখে সেটা নির্দ্বিধায় বলছেও আবার। আদিত্য কী করবে এখন? এই হঠাৎ পাওয়া অনাবিল খুশির প্রলয়টাকে কীভাবে সামলাবে সে? খুশিতে জ্ঞান না হারিয়ে ফেললে হয়। নূরের বিশ্বাস জয় করেছে সে। নূর ট্রাস্ট আদিত্য। এটা শুনতেও কতো মোহময় লাগছে।খুশিতে মন চাচ্ছে বুর্জ খলিফার ওপর চড়ে ডান্স করতে। ইশশ,আদিত্য পাগল না হয়ে যায়। নিজের উথাল-পাতাল মনোভাবকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে আদিত্য নূরের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলল,
–তুমি জানো না নূর, তুমি আজ কতো বড়ো একটা উপহার দিলে আমাকে। আই প্রমিজ ইউ নূর, তোমার এই বিশ্বাস আমি কখনো ক্ষুন্ন হতে দিবোনা।
বলেই হাতের মুঠোয় ধরে রাখা নূরের হাতের ওপর চুমু খেল আদিত্য। আবেশিত হলো নূর।বিমোহিত হলো হৃদমাঝার। চুমু দেওয়া শেষে নূরের হাত ছেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আদিত্য। নূর দরজার সাথে হেলান দিয়ে বিমোহিত নজরে তাকিয়ে রইলো আদিত্যর পানে। আজ আদিত্য নূরের পানে তাকালে নির্ঘাত ঘায়েল হয়ে যাবে। আজ বাড়ি ফেরা হবেনা তার। না হবে কোনো কাজ তার দ্বারা। তাইতো আর পেছনে না ফিরে চলে গেল আদিত্য। পেছনে রেখে গেল বিমোহিত নূরকে। যে আজ নিমগ্ন হয়েছে অনুভূতির অন্তরালে। যে অনুভূতি থেকে সে নিজেকে শত শত গজ দূর রেখেছিল। আজ সেই অনুভূতির উত্তাল পবনে ভাসিয়েসে নিজেকে। হঠাৎ যেন রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে পুরো দুনিয়া। সুখময় সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে নূর।এই সমুদ্রে ডুবে ম,র,তেও সুখ। সবকিছুই হঠাৎ ভালো লাগছে নূরের কাছে। ওইযে রাস্তায় দুইজন লোক মারামারি করছে সেটাও ভালো লাগছে নূরের, তারের ওপর বসে থাকা ওই কাকটাকেও ভালো লাগছে, ভালো লাগছে পাশের বাড়ির জমিলা আন্টির চিল্লানোর আওয়াজও। সামনের ব্যাচেলর বাসায় সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে ♬ না না কারতে পেয়ার হায় মে কারগায়ি কারগায়ি, আই অ্যাম ইন লাভ, আই অ্যাম ইন লাভ, আই অ্যাম ইন লাভ….. শিরোনামে কি বেহুদা একটা গান বাজছে, সেটাও ভালো লাগছে নূরের। সবকিছুই ভালো লাগছে তার।সেতো ওই গানটা নিজেও গুনগুন করে গাইতে লাগলো। ♬ আই অ্যাম ইন লাভ, আই অ্যাম ইন লাভ। মা,তা,ল মা,তা,ল লাগছে নিজেকে। নূর দৌড়ে চলে এলো নিজের রুমে। কেমন পাগল পাগল লাগছে তার। অনুভূতির প্রগাঢ়তা তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। কী করবে সে এখন? এভাবে চলতে থাকলে তো হার্ট ব্লাস্ট হয়ে যাবে ওর। কারোর সাথে এই অনুভূতি শেয়ার করতে পারলে বোধহয় একটু হালকা লাগতো ওর। কিন্তু কাকে বলবে! শিখা, হ্যাঁ শিখাক বলতে পারে ও। ফোন খুঁজে নিয়ে ফটাফট শিখার নাম্বারে ফোন দিলো নূর। শিখা ফোন রিসিভ করতেই নূর ঝট করে বলে উঠলো,
–আই অ্যাম ইন লাভ, শিখা। আই লাভ হিম, আই লাভ মিঃ নায়ক।
শিখা বেচারি খেতে বসেছিল। চিকেনের রানের পিচটা মাত্রই দাঁতের নিচে কামড় দিয়েছিল সে। ঠিক সেই সময়ই নূরের এই বিস্ফো,রক শুনে বেচারি শক খেয়ে পুরো স্ট্যাচু হয়ে গেল। তার এই অবস্থা দেখে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা ওর পরিবারের লোকজন হতবাক হয়ে গেল। সবাই বারবার জানতে চাইলে “কি হয়েছে? ” কিন্তু শিখার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ওর মা ভাবলো গলায় হয়তো হাড্ডি আঁটকে গেছে। তাই তিনি উঠে গিয়ে দুম করে শিখার পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। কিল খেয়ে বেচারির পিঠ বাঁকা হয়ে গেল। মুখ থেকে চিকেন পিচটা পরে গিয়ে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো,
—আআআআআ…ও মাগোওওও… মরে গেলাম গোওওও…
শিখার চিৎকার শুনে ওর মা, ওর বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
–শুনছ শিখার বাবা,মেয়ে নাকি মরে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।না না অ্যাম্বুলেন্সে কাজ হবে না। ঢাকার জ্যাম কোনো অ্যাম্বুলেন্স মানে না। তুমি এক কাজ করো, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। ইমার্জেন্সি বিভাগে ফোন করে ওটি বুক করতে বলো জলদি। আমার মেয়েকে কিন্তু যে করেই হোক বাঁচাতেই হবে। নাহলে তোমার বংশ নির্বংশ করে দিবো আমি। বাড়িতে আ,গু,ন লাগিয়ে দিবো।
শিখার বাবা ভয়ে লুঙ্গির গিট ধরে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। গিট টাইট দেওয়ারও সময় নেই এখন। তাই গিট ধরে যেতে যেতে বলল,
–না না এক্ষুনি ফোন করছি। দরকার হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেই ফোন লাগাচ্ছি এখুনি।
বেচারি শিখা এসব দেখে বিনা অপারেশনেই কোমায় চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। একেতো নূরের দেওয়া শক। তারওপর ওর ফ্যামিলির এই পাবনার পাগলা গারদ টাইপ কাহিনি দেখে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। মানে এই পাগল ফ্যামিলি ওর কপালেই ছিলো? এতো হা,ম,লা একজন ব্যক্তি কীভাবে নিতে পারবে? অতঃপর শিখা ব্লাস্ট হয়ে গেল। ভুমিকম্পের মতো ধরণী কাঁপানো গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠলো সে,
–আআআআআআআআ……
পুরো বাড়ি বিস্ফোরণের মতো কেঁপে উঠল শিখার চিৎকারে। যে যেখানে ছিলো ভয়ে সেখানেই বসে পড়লো। কাজের বুয়াটা ভয় পেয়ে আওড়াতে লাগলো,
–ও মাগোওওও কেয়ামত আইসা গেছে গো। আর বাঁচুম না। মেমসাব, আমার ভুল ত্রুটি মাফ কইরা দিয়েন।
শিখার মা বলল,
–আরে তুই মাফ চাচ্ছিস কেন? তুই আবার কখন ভুল করলি?
–ভুল করছি মেমসাব, সেদিন আপনার হিরার লকেট টা আমিই চুরি করছিলাম। আমারে মাফ কইরা দিয়েন। আর সাহেব যে আমারে মাঝে মাঝে চোখ টিপ দিয়া ঘরে ডাকে সেটাইওতো আপনারে কইনাই। সবকিছুর জন্য আমারে মাফ কইরা দিয়েন। এমনিতেও এখন সবারই মরতে হইবো। তাই এসব মনে রাইখা কী লাভ তাইনা?
শিখার মা অগ্নমূর্তির ন্যায় কুখ্যাত নজরে তাকালো তার স্বামীর দিকে। বেচারা শিখার বাপ ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঠাস করে মাটিতে পড়ে গেল। বউয়ের হাতে খু,ন হওয়ার চেয়ে নিজেই উপরে চলে যাওয়া সহজ পন্থা মনে হলো। শিখার মা এবার রাগে কটমট করে বুয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তখনই শিখা চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
–ব্যাসসসসস,বন্ধ তোমাদের এই পাগলামি। এখানে কে সবচেয়ে বড়ো পাগল তার কোনো কম্পিটিশন চলছেনা৷ তাই নিজেদের ট্যালেন্ট প্রদর্শন বন্ধ করো প্লিজ। আমার কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি। এখন গিয়ে যার যার কাজ করো সবাই।
বেচারি বুয়া ফাইসা গেল মাইনকার চিপায়। শুধু শুধু ভয় পেয়ে সব বলে দিলো সে। এখন পৃথিবীতে কেয়ামত হোক না হোক,ওর ওপর কেয়ামত নামবে তা নিশ্চিত।
অন্যদিকে এসব কান্ড থেকে বেখবর, নূর ফোনের ওপাশ থেকে বারবার বলে যাচ্ছে,
–এই শিখা কী হলো কথা বলছিস না কেন? আর এতো আওয়াজ কীসের হচ্ছে? এই শিখা কী হয়েছে?
শিখা এবার সব রাগ ফোনে ঝাড়লো। ফোন কানে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
–ওই নূর ফুর চুরচুর। হা,রা,মির নানী শাশুড়ি।ডা,ই,নির খালা শাশুড়ী। পে,ত্নী,র ফুফু শাশুড়ী। তোর মাথার জায়গায় মাথা আছে,নাকি মাথার জায়গায় খালি পাতিল রাখা আছে? তুই কী আমাকে খু,ন করার জন্য পরিকল্পনা করছস? আজ দূর্বল হৃদয়ের মানুষ হলে নির্ঘাত পটল খেতে যেত। শালী, এত্তবড় একখান ব্লাস্ট করার আগে অন্তত প্রস্তুতিতো নিতে দিবি? জানিস তোর কারণে এখানে ওয়ার্ল্ড ওয়ার প্রো ম্যাক্স শুরু হয়ে গেছে।
নূর হাসিমুখে বলল,
–ইয়ার, কী করবো। আমার ভেতরের অনুভূতি গুলো না কেমন ভলকে উঠছিলো। কাউকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। আর তুই ছাড়া আমার এসব কথা শেয়ার করার মতো আর কে আছে?
এবার রাগ উড়ে গিয়ে ইমোশনাল হয়ে গলে গেল শিখা। আপ্লূত কন্ঠে বলল,
–অঁওওওওওওও… আমগো লেডি গব্বর সিং তাহলে শেষমেশ প্রেমে পড়েই গেল। আমি জানতাম আদিত্যকে ভালো না বেসে তুই থাকতেই পারবিনা। আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ ইয়ার। তোর জীবনে এমন একটা কিছুই আমি চেয়েছিলাম। আচ্ছা তাহলে আদিত্যকে বলেছিস?
–না, এখনো বলিনি। তুই তো বর্তমান সিচুয়েশন জানিসই। ভাবছি লিয়ার কেসটা সমাধান হলে তারপর বলবো।
–হুম বলে দিস। বেচারা অনেক ধৈর্য ধরে বসে আছে। আর অপেক্ষা করাস না।
–হুমম, একবার এই ঝামেলাটা শেষ হলেই তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিবো।
কথা শেষে ফোন রেখে দিলো নূর। শিখা ঠিকই বলেছে। তাকে আর অপেক্ষায় রাখবেনা নূর। তাকে জানিয়ে দিবে যে, তার সাধনা সফল হয়েছে। জিতে গেছে সে। হেরে গেছে নূর। মন হারিয়েছে ওই নায়কের মাঝে।
___
–আদ্রওওওওওও…..
আদিত্যর হুংকারপূর্ণ ডাকে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল যেন। ধড়ফড়িয়ে গিয়ে পরিবারের সবাই দৌড়ে নিচে এসে জড়ো হলো। আদিত্যর ভয়ংকর,বিধ্বংসী চোখ মুখ দেখে আৎকে উঠল প্রায় সকলে। আজপর্যন্ত আদিত্যকে এতটা ভয়ংকরী রুপে কেউ দেখিনি। আদিত্যর বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে বললে,
–কী হয়েছে আদি? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? এতো রেগে আছ কেন তুমি?
আদিত্য চোখ মুখ তিব্র কঠিন করে বলল,
–বাবা আদ্র কোথায়?
–আদ্র? কেন? আদ্রর কী হয়েছে?
এবার আদিত্যর মাও চিন্তিত হয়ে বলল,
–আদি বাবা এমন করছ কেন? কী হয়েছে?
–মা, আদ্র কোথায়?
–আদ্র? আদ্রকে দিয়ে কী করবি তুই?
আদিত্য এবার ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–আমি বলছি আদ্র কোথায়? ডাকো ওকে এক্ষুনি।
বলতে বলতেই আদ্রকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখলো আদিত্য। আদিত্যর চিল্লানির আওয়াজ শুনে সেও নেমে এসেছে। আদ্রকে দেখতেই আদিত্যর চোখে যেন র,ক্ত টগবগ করতে লাগলো। কপালের রগ ফুলে ফেঁপে উঠল। আদিত্যর এই ভয়ানক চাহুনি দেখে ভয় পেয়ে গেল আদ্র। তবে কী ওর ভাই সব জেনে গেল? ভয়ে পা এগুচ্ছে না তার। এগুনোর দরকারও হলোনা আর। তার আগেই আদিত্য ছুটে গিয়ে হিংস্র বাঘের ন্যায় হামলে পড়লো আদ্রর ওপর। এক হাতে কলার টেনে ধরে আরেক হাতে নাক বরাবর সজোরে ঘুষি মেরে দিলো। ঘুষি খেয়ে আদ্র নিচে পড়ে গড়তে গড়তে সিঁড়ির নিচে গিয়ে পড়লো। আদিত্য দৌড়ে গিয়ে আদ্রকে দুই হাতে টেনে তুলে আবারও মারতে লাগলো। মাথায় যেন র,ক্ত উঠে গেছে আদিত্যর। আদিত্যর হঠাৎ এই আক্রমণ দেখে পরিবারের বাকি সদস্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। সবাই দ্রুত এসে আদিত্যকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আদিত্য কিছুতেই থামছেনা। মারতে মারতে র,ক্তা,ক্ত করে দিয়েছে আদ্রকে। রেহনুমা এবার ভীষণ রেগে উঠে আদিত্যর হাত ধরে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–আদি!!!!! পাগল হয়ে গেছ তুমি? নিজের ভাইকে এমন জা,নো,য়া,রের মারছ কেন? ওকে কী মে,রে ফেলতে চাও তুমি? তুমি কী ভুলে গেছ ও তোমার ভাই?
আদিত্য ক্রুদ্ধ কন্ঠে আপসোসের সহিত বলল,
–আই উইশ মা, আই উইশ আমি ভুলে যেতে পারতাম এই জা,নো,য়া,রটা আমারই ভাই। আজ নিজের ওপরই ঘৃণা হচ্ছে এটা ভেবে যে,ও আমার ভাই।
–কী যা তা বলছ! কী এমন করেছে ও যারজন্য ওকে এভাবে মারছ?
— কী করেছে? জানতে চাও কী করেছে? তো শোনো তোমার এই গুণধর পুত্র একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তার ই,জ্জ,ত হরণ করেছে। সোজা কথায় ধ,র্ষ,ণ করেছে। হি ইজ আ ব্লা,ডি রে,পি,স্ট।
আদিত্য কথায় বাজ পরলো সবার ওরপ। পুরো পরিবার স্তব্ধ হয়ে গেল।
চলবে……