#শৈবলিনী—২৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★দিনের শেষে বাসায় পা রাখতেই চাচাকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল নূর। ভয় হতে লাগলো তার। তবে কী সত্যিই চাচা গ্যারেজের জমি বিক্রি করে দিয়েছে? সেটাই কী বলতে এসেছে আজ? শেষমেশ আমি পারলাম না আমার বাবার স্মৃতিকে বাঁচাতে? ভাবতেই অন্তর ভারী হয়ে এলো নূরের। ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। কম্পিত পায়ে এগুলো সে ভেতরে। নূরকে দেখে লতিকা বেগম খুবই খুশিখুশি মনে বলল,
–এসেছিস মা, আয় বয়। একটা খুশির খবর আছে। আল্লাহ মেহেরবানী করেছে আমাদের ওপর।
নূর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–মানে? কী খুশির সংবাদ?
নূরের চাচা তখন বলে উঠল,
–আমি বলছি। আসলে তোর বাবার সাথে জমি বদল করে আমি যেটা নিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ সেই জমির এক বড়ো গায়েক এসেছিল। আর ওই জমির জন্য আমাকে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে। যা তোমাদের গ্যারেজের ওই জমির চেয়েও অনেক বেশি। আর এই টাকায় আমার সব ঋণও শোধ হয়ে যাবে। তাই আর এখন তোমাদের গ্যারেজের জমিন টা বিক্রি করছিনা আমি। যেহেতু আমার ভাগের জমিনটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি তাই এই জমিন এখন তোমাদের। তোমরা চাইলে নিজের নামে রেজিষ্ট্রেশনও করে নিতে পারো।
নূরের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। সেকি ঠিক শুনছে? তারমানে ওর বাবার স্মৃতিটা সহিসালামত থাকবে! অনাবিল আনন্দে নূরের চোখে পানি চলে এলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে নূর বলল,
–সত্যিই বলছেন চাচা? সত্যিই এই জমিন আর নিবেন না আপনি?
–নারে মা,আমি ইচ্ছে করে এমনটা করতে চাইনি। আসলে বিপদে পড়ে এমন করছিলাম। এখন যখন অন্য উপায়ে আমার বিপদ কেটে যাচ্ছে তাহলে আর তোদের কেন ক্ষতি করবো? আমিতো আর দুশমন না তোদের।
–আমি কী বলে যে আপনার শুকরিয়া জানাব বুঝতে পারছিনা। এই জমিন আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে কতবড় উপকার করলেন তা বলে বুঝাতে পারবোনা। ওটা শুধু গ্যারেজ না। আমার বাবার শেষ স্মৃতি। ওটা খোয়া গেলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারতাম না আমি। অনেক অনেক ধন্যবাদ চাচা। আপনার এই উপকার আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
–আরে আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে? ধন্যবাদ তো ওই কাস্টোমারকে দেওয়া উচিত। যে দূত হয়ে এসে আমাদের সবার বিপদ উদ্ধার করলো।
ইভান পাশ থেকে বলল,
–কিন্তু কে ছিলেন উনি? আর এতটাকা বেশি দিয়ে জমিন নিলেন কেন?
–কী জানি চিনিনা তাদের। আসল মালিক আসেনি। শুধু তার লোক এসে টাকা দিয়ে জমি কিনে নিয়েছে। উনারা নাকি ওই জমিনে কোনো ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান করবেন। জায়গাটা নাকি তাদের জন্য পারফেক্ট। তাই বেশি দাম দিয়ে কিনেছে। আমিও আর ওসব বেশি ঘাটতে যায়নি। আমার টাকা আসলেই হলো।
নূর মনে মনে সেই ব্যাক্তির জন্য দোয়া করলো। আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখে। আজ তার জন্যই আমাদের উপর থেকে এতবড় বিপদ কেটে গেল। তার সব মনকামনা যেন আল্লাহ পূরণ করেন।
একটু পরে ফ্রেশ হতে রুমে এলো নূর। খুশি যেন ধরছেনা তার। কারো সাথে খুশি শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। হঠাৎ আদিত্যর চেহারা সামনে ভেসে উঠল নূরের। কেন যেন তার সাথে এই খুশি শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নূর মাথা ঝাকিয়ে নিজের খেয়ালটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। আজকাল মগজে তার ভাইরাস ধরে গেছে। যখন যা খুশি খেয়াল নিয়ে আসে।
___
আদিত্য নিজের রুমে বসে বসে ভাবসে, নূর নিশ্চয় এতক্ষণে খুশির সংবাদ টা জেনে গেছে। ওর লোকগুলো তো দুপুরেই জানাল কাজ হয়ে গেছে। তাহলে এতক্ষণে নূর নিশ্চয় খবর পেয়ে গেছে। আচ্ছা নূর কী এটা শুনে অনেক খুশি হয়েছে? ইশশ,আমি যদি তার ওই খুশিভরা মুখটা দেখতে পেতাম একবার। আমার নূর খুশি হলে পুরো পৃথিবীটাই যেন খুশিতে ভরে ওঠে। তার খুশিতে নেচে উঠে প্রকৃতি। একদিন তার খুশির কারণ আমি হবো। তার অনুভূতি জুড়ে শুধুই আমি হবো। সেইদিন হবে এই অপেক্ষার অবসান। সুখের প্রলয়ে ভেসে যাবো আমরা। সেইদিন খুব বেশি আর দূরে নেই। আমাদের প্রণয়ের সময় জলদিই আসবে।
আদিত্যর ভাবনার মাঝেই কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাশে ফিরে তাকালো আদিত্য। রেহনুমা এসেছেন ছেলের কাছে। আদিত্যর পাশে বেডের ওপর এসে পা ঝুলিয়ে বসলেন তিনি। আদিত্য মুচকি হেসে বলল,
–মা তুমি! কিছু বলবে?
রেহনুমা নরম সুরে বলল,
–কেন? দরকার ছাড়া বুঝি আসতে পারি না?
–কেন আসতে পারোনা। আরে তোমার অধিকারতো আমার উপর সবচেয়ে বেশি। তুমি যা চাও তাই আমার জন্য সবকিছুর উর্ধ্বে।
রেহনুমা আদিত্যর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন।
–সত্যিই? আমি যাই বলবো তা রাখবি তুই?
–অবশ্যই। তুমি চাইলে জানও দিয়ে দিবো।
–জান দিতে হবেনা। শুধু আমার একটা কথা মানলেই হবে।
–বলোনা মা।
–তোকে ওই মেয়ের খেয়াল মাথা থেকে বের করতে হবে।
চমকে উঠল আদিত্য। তীব্র বেগে ঝটকা খেল সে। মনে হলো যেন ভুল কিছু শুনলো সে। ওর মা কী নূরের কথা বলছে? আদিত্য চকিত নজরে তাকিয়ে বলল,
–মানে? কী বলছ তুমি মা? ওই মেয়ে বলতে কী তুমি নূরকে বুঝাতে চাইছ?
রেহনুমা গম্ভীর স্বরে বলল,
–হ্যাঁ ওই মেয়ের কথাই বলছি। দেখো এখন হয়তো আমার কথা তোমার কাছে ভালো লাগবেনা। মনে হতে পারে আমি তোমার খুশি চাইনা। কিন্তু আসলে তানা। মা সবসময় তার সন্তানের মঙ্গলই চায়। তুমি এখন হয়তো বুঝতে পারছনা। তবে পরে ঠিকই বুঝতে পারবে আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। প্রেম আর বিয়ে এক জিনিস না। প্রেম আজ আছে তো কাল ব্রেকআপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ে অন্য জিনিস। এটা সারাজীবনের ব্যাপার। বিয়ে শুধু তোমার সাথে হবেনা, সমাজে তাকে এই বংশের বউ হিসেবে জানা যাবে।তাই অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন ফ্লো ফ্লোতে তোমার ওই মেয়েকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু পরে সারাজীবন তোমার এই সিদ্ধান্তে পস্তাতে হবে।যখন এমন জীবনসঙ্গিনী নিয়ে তোমাকে সমাজে লজ্জিত হতে হবে। জীবন হেল হয়ে যাবে তোমার।আর আমি মা হয়ে তা কীভাবে হতে দিবো। ছেলেমেয়ে ভুল করলে মা বাবার দায়িত্ব তাদের সঠিক পথ দেখানো। তাই বলছি,আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। ওই মেয়ে কোন দিক দিয়েই তোমার আর এই পরিবারের যোগ্য না। বউ হওয়া তো দূরে থাক। তাকে পুরোপুরি নারীই মনে হয়না। আর এমন গুন্ডি টাইপ মেয়ে কখনো এবাড়ির বউ হতে পারে না। তাই ওই মেয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোমার হয়তো মনে হতে পারে আমি কোনো সুযোগ দিচ্ছি না তোমাকে। কিন্তু এমন না। সবকিছু জেনেও তোমার কথা ভেবে আমি নিজে ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওকে সুযোগ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম সে যদি নিজেকে বদলাতে পারে তাহলে আমি মেনে নিবো তাকে। কিন্তু ওই বেয়াদব মেয়ে উল্টো আমাকেই শুনিয়ে চলে গেল। ভাবো কতবড় উশৃংখল মেয়ে।
রেহনুমার এতক্ষণ ধরে সব চুপচাপ শুনলেও শেষের দিকে এসে আর চুপ থাকতে পারলোনা আদিত্য। সে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
–এক মিনিট, এক মিনিট! মা তুমি নূরের সাথে দেখে করতে গিয়েছিলে? তাও আবার আমার জন্য ওকে বদলাতে হবে এটা বলার জন্য? লাইক রিয়েলী! হাউ কুড ইউ মা! মা তোমার কাছ থেকে অন্তত এটা আশা করিনি আমি। আমিতো তোমাকে উন্নত চিন্তাধারার মানুষ ভেবেছিলাম। শেষমেশ তুমিও বাকিদের মতোই একই মনমানসিকতার পরিচয় দিলে? তুমি কাকে বদলাতে বলছ মা, নূরকে? কিন্তু ও যদি বদলে যায় তাহলে আমার নিজের কাছেই তো সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগবে। কারণ ও এমন বলেই ওকে আমি ভালোবাসি। ওর এই ইউনিক চরিত্রই আমার পছন্দ। তাহলে ও কেন নিজেকে বদলাবে? জাস্ট বিকজ ও মেয়ে বলে ওকে অন্যের জন্য নিজেকে বদলাতে হবে? কেন? আমি জেনে অবাক হচ্ছি তুমিও বাকিদের মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য আর দেখানোতে বিশ্বাস করো। তাইতো তুমি আজ খাটি হিরাকে হলফ করতে ব্যার্থ হলে। নূর শুধু নামেই নূর না। ও সত্যিকারের নূরের আলো।
–আমার থেকে তুমি বেশি মানুষ চেনোনা আদিত্য। এসব মেয়েদের আমার ভালো করেই চেনা আছে। ওই মেয়ে…
আদিত্য এবার শক্ত গলায় বলল,
–প্রথমত ওর একটা নাম আছে। ওই মেয়ে না,ওর নাম নূর। তো নূর বলেই ডাকো। আর হ্যাঁ তুমি যতোই যুক্তি দাও তবে সরি টু সে, তুমি নূরকেও একবিন্দুও চিনতে পারোনি, মা। দুনিয়ার সব কৃত্রিমতার মাঝে ও প্রকৃতির এক অনন্য রুপ। ও কিন্তু চাইলে তোমার কথা আমাকে বলতে পারতো। কিন্তু ও বলেনি। কারণ ও চায়নি তোমার সাথে আমার মনমালিন্য হোক। আর এটাই হলো আমার নূর। যে ওকে চিনতে পারবেনা আমার মতে তারচেয়ে বড় অন্ধ আর কেউ নেই। আমি তোমার কোনো কথার কখনো অবাধ্য হইনি, মা। তবে তোমার এই কথা আমি মানতে পারবোনা। এটা আমার হাতেই নেই। আমি একবার আমার নিঃশ্বাস নেওয়া ভুলতে পারি। তবে নূরকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভবের চাইতেও অসম্ভব।
রেহনুমা এবার কড়া গলায় বলল,
–দেখ তোমার চোখে এখন মায়াজাল পরে আছে তাই ভালো মন্দ বুঝতে পারছনা। ব্যাপার না,সময় নাও। দেখ ফ্যান্টাসী পূরণ করতে চাইলে কিছুদিন প্রেম করতে পারো। তবে সারাজীবন ওই মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যত চিন্তা করার কথা ভুলে যাও।
বলেই উঠে চলে গেলেন রেহনুমা। আদিত্য স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে এটা তারই মা। এতটা অযাচিত উপদেশ কীভাবে দিতে পারলো ওর মা? কিন্তু মাকে কীভাবে বুঝাবে যে, তার উপরে যে এখন তার কোনো আয়ত্ত নেই। সবটা দখল করে বসে আছে নূর। নূরকে ছাড়া বেঁচে থাকার ভাবনাটাও যে মৃ,ত্যু সমান। দুই হাতে মাথার চুল টেনে মাথা চেপে ধরলো আদিত্য। অনেক বড় চিন্তায় পড়ে গেল সে। এমনিতেই নূর এখনো পর্যন্ত ওর ভালোবাসায় ধরা দেয়নি। তারওপর মায়ের কথা শুনেতো নিশ্চয় আরও শক্ত হয়ে যাবে ও। এসব কী হচ্ছে। এখন সব সামলাবে কী করে ও?
__
পরদিন অনেক খুশিমনে ভার্সিটিতে পৌঁছাল নূর। নূরের প্রাণবন্ত চেহারা দেখে গিয়াস তার বিশেষ টিপুনির ঝুলি থেকে একটা আইটেম পেশ করে বলল,
–কীরে ডাইনোসরদের দাদাী আম্মা, এমন ফেয়ার এন্ড লাভলীর অ্যাডের মতো চকচক করতাছস কেন? কোনো ডাকাত গ্যাং জয়েন করছস নাকি? যাক শেষমেশ তোর প্রতিভার প্রদর্শন করতে এক্কেরে ঠিক প্রফেশনে গেছস। এই প্রফেশনে ফিউচার অনেক ব্রাইট তোর। দেশ বিদেশে তোর সুনাম ছড়িয়ে পরবে। আম সো প্রাউড অফ ইউ ইয়ার।
শিখা হেঁসে উঠে বলল,
–হ্যাঁ ইয়ার,তোকে আজ খুশি খুশি লাগছে। ঘটনা কী?
নূর হাসিমুখে বলল,
–ঠিকই বলেছিস আজ সত্যিই অনেক খুশি আমি। আসলে বাবার গ্যারেজ টা বেচে গেছে। সেটা আর খোয়া যাবেনা।
নূর ওদের সবটা বলল।সব শুনে শিখা খুশি হয়ে বলল,
–ওয়াও ইয়ার এটাতো সত্যিই অনেক খুশির খবর।আম সো ফর ইউ।
গিয়াসও সানন্দে বলল,
–আরে খুশি মানে, জব্বর খুশি। খুশিতে আয় একটু হাগাহাগি করি।
শিখা নাকমুখ শিটকে বলল,
–সালা গ্যাসের বাচ্চা গ্যাস,মুখের ঢাকনা খুললে শুধু দুর্গন্ধই বের করবি নাকি?
–ওমা,এখানে দুর্গন্ধের কী দেখলি তুই? কোলাকুলির ইংলিশ হাগাহাগিই তো হয়। ক্রিয়েটিভির কোনো কদরই দিতে জানিস না তোরা।
নূর হেঁসে দিয়ে বলল,
–আচ্ছা মন খারাপ করিসনা, আজ আমি অনেক খুশি। আয় তোর ভাষায়, হাগাহাগি করি।
নূর,শিখা আর গিয়াস তিনজন একসাথে আলতো করে ফ্রেন্ডলি ভাবে জড়িয়ে ধরলো। আর ঠিক আদিত্যর প্রবেশ ঘটলো ভার্সিটিতে। গাড়ির ভেতর থেকে সে এই হাগাহাগির দৃশ্য দেখতে পেল। কাল রাতে মায়ের কথায় এমনিতেই মুড অফ ছিলো আদিত্যর। ভেবেছিল এখানে এসে নূরকে দেখলে তার মুড ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে তার মুড ঠিক হওয়ার বদলে আরও হাজার ডিগ্রি হাই হয়ে গেল। চোয়াল কটমটে হয়ে এলো তার। যদিও সে জানে এটা কেবলই ফ্রেন্ডলি হাগ। তবুও সহ্য হচ্ছে না আদিত্যর। কথা যখন নূরের আসে তখন আদিত্য দুনিয়ার সবচেয়ে হিংসুটে ব্যক্তি হয়ে যায়। কারোর সাথে শেয়ার করতে পারে না সে নূরকে। আমার কাছে আসলে তো যেন কাটাপ্পা মামা হয়ে যান উনি। যেন আমি তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। একটু ভালো করে কথা বলাও তারজন্য দায় হয়ে যায়। অথচ বাকি দুনিয়ার সাথে তার কতো খাতির। এক আমিই শুধু তার চোখের কাটা। মনে মনে ভীষণ রাগ জন্মালো নূরের প্রতি। সাথে রাগের পাহাড় জন্মালো ওই গিয়াসের ওপর। এর একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
ক্লাস শেষে যথারীতি আদিত্যর ভ্যানিটিতে এলো নূর। তারমাঝে এখনো খুশির প্রসন্নতা বিরাজ কর ভেতরে এসে দেখলো আদিত্য সোফায় দুই হাত ছড়িয়ে হেলান দিয়ে মাথা উপরের দিকে রেখে চোখ বুজে বসে আছে। নূর আদিত্যর সামনে এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতির জানান দিলো। আদিত্য সেই অবস্থাতেই চোখ খুলে তাকালো। নূরকে দেখে ছোট্ট করে বলল,
–বসো।
নূর সোফায় গিয়ে বসলো। আদিত্য আবারও চোখ বুজলো।নূর খেয়াল করলো আদিত্যকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে আজ। এমনিতেতো ওকে আসতে দেখলেই তার চেহারায় প্রফুল্লতা ছেয়ে যায়। নানান দুষ্টুমী ভরা কথায় নূরকে বিরক্ত করে ফেলে। তো এমন চুপচাপ রয়েছে কেন? শরীর কী খারাপ করেছে উনার? নূর আস্তে করে বলল,
–শরীর খারাপ নাকি আপনার? এভাবে বসে আছেন কেন?
ধীর গতিতে চোখ মেললো আদিত্য। নূরের দিকে ঘাড় কাত করে শান্ত তবে ভারী গলায় বলল,
–কেন? আমার কোনো কিছুতে তোমার যায় আসে বুঝি?
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে?
আদিত্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেঁসে বলল,
–বাদ দাও তুমি বুঝলে তো কথাই কী ছিলো।
আদিত্যর কথার মাঝে একরাশ অভিমান, অভিযোগ আর হতাশা প্রকাশ পেল। নূরের কেন যেন ভালো লাগছেনা আদিত্যকে এভাবে দেখে। কোথাও কিছু খচখচ করে বিঁধছে। আজ সে এতো খুশি কিন্তু উনার কী হয়েছে? লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? তার কী কোনো কারণে মন খারাপ? নূর না পেরে বলেই উঠল,
–কী হয়েছে বলুন তো? মন খারাপ আপনার?
আদিত্য এবার সোজা হয়ে বসলো। তারপর নূরের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ইনটেন্স নজরে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–হলেই বা কী করবে? তুমিতো আমার মনটাকে জুতোর নিচে থেঁতলে ফেলো। তখন কী একবারও মায়া হয় তোমার? তাহলে ভালো মন্দ জেনে কী করবে তুমি?
আদিত্যর এভাবে কথা বলা নূরের কেমন সহ্য হচ্ছে না। খারাপ লাগার পাহাড় জমছে যেন। বুকের মাঝে হু হু করছে। নূর জিজ্ঞেস করলো,
–হয়েছে কী আপনার? এভাবে কথা বলছেন কেন?
আদিত্য এবার ক্ষিপ্ত হয়ে নূরের দুই বাহু চেপে ধরে নিজের কাছে এনে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–তো কীভাবে বলবো বলো? কীভাবে বললে তুমি বুঝতে পারবে আমার ভেতরের অস্থিরতা? কীভাবে বললে আমার মনের আওয়াজ শুনতে পাবে তুমি? বলোনা কীভাবে? দুনিয়ার সবার সাথেই তোমার ভাব। শুধু আমার সাথেই যতো তোমার তিক্ততা। আমাকে দেখলেই তোমার চোখে যেন রাজ্যের যতো বিতৃষ্ণা এসে হাজির হয়। অথচ তোমার ওই হ্যাবলা বন্ধুকে যখন তখন জড়িয়ে ধরে গলায় গলায় ভাব করছ। কেন? আমার শরীরে ঘাঁ পঁচাড়ি আছে? তাহলে আমাকে এতো কেন উপেক্ষা করো তুমি? বলো? কেন, ড্যাম ইট কেন?
আদিত্যকে আজ কেমন অন্যরকম লাগছে। কেমন উন্মাদের মতো লাগছে তাকে। আর হ্যাবলা বলতে কী গিয়াসের বলছেন উনি? এবারে নূর যেন একটু একটু বুঝতে পারলো। লোকটা হয়তো আমাকে তখন গিয়াসকে হাগ করতে দেখেছে। সেকারণেই এমন পাগলামি করছে। কিন্তু এতে রাগার কী হলো তাই বুঝতে পারছেনা নূর। তবে লোকটার এমন অস্থিরতা নূরের ভালো লাগছে না। বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। ভেতরের স্বত্তাটা যেন বলছে, সেকি কোনোভাবে লোকটাকে শান্ত করতে পারে না?
নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য হঠাৎ নূরের মাথাটা তার বুকের বাম পাশে চেপে ধরে আবেগী কন্ঠে বলল,
–জানতে চাইলে, শোনো নূর,কান পেতে শোনো। শোনো কী বলে আমার প্রতিটা হৃদয়স্পন্দন। শুনতে পারছ হৃদপিণ্ডের কোলাহল? দেখ কেমন প্রতিটি ক্ষণে তোমার নামের মালা জপছে ওরা। প্রতিটি নিঃশ্বাস শুধু তোমার নামেই বের হচ্ছে।
হঠাৎ এমন হওয়ায় থমকে গেল নূর। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার কেন যেন এবার রাগ হলোনা। আদিত্যর কথা অনুযায়ী সত্যিই সে কান পেতে শুনতে পেল আদিত্যর হৃৎস্পন্দন। কী সুন্দর সুরে সুরে ধাবিত হচ্ছে। যেন বীণার সুর বাজছে। নূর মোহিত হয়ে যাচ্ছে এই মধুর ধ্বনিতে। হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। আদিত্যর হৃদয়ের সুর তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অজান্তেই নূরের হাত দুটো চলে গেল আদিত্যর পিঠে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আবেশে লুকালো যেন আদিত্যের বুকে। চোখ বুজে বিমোহিত হয়ে আদিত্যর বুকে লেপ্টে থেকে তার হৃৎস্পন্দনের আলোড়ন শুনতে লাগলো। আদিত্যও সুখের আবেশে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো নূরকে। হাজার বছরের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে যেন শ্রাবণের ঘোর বর্ষা নামলো। সব রাগ ক্ষোভ মুহুর্তেই গলে পানি হয়ে গেল। প্রিয়তমার আলিঙ্গনে হৃদয় হলো সিক্ত,প্রশান্তিময়। মুহুর্তটা এখানেই থেমে যাক। নূর এভাবেই ওর বুকে ঘর করে থাক। আর কোনো চাওয়া নেই আদিত্যর।
হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লো। ঘোর কাটলো নূরের। চোখ খুলে ছিটকে সরে এলো সে। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে । কী হয়ে গিয়েছিল আমার? কী করছিলাম আমি এসব? নূর তাকাতে পারছেনা আদিত্যর দিকে।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। আদিত্য যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের খোঁজ পেল। তা হলো নূরের লজ্জা রাঙা মুখ। এই মেয়ে লজ্জাও পায়? আদিত্য বাঁকা হেসে নূরের মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বলল,
–ওয়াও, তো মিস নূর লজ্জাও পেতে জানে। এটাতো চমৎকার হয়ে গেল। বাট আই লাভ দিস অলসো।
নূর অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
–হোয়াট রাবিশ, এমন কিছুই না। মনে হচ্ছে আজ কোনো কাজ নেই। তাই গেলাম আমি।
বলেই তড়িঘড়ি করে উঠে চলে যেতে নিলো নূর। কিন্তু পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো আদিত্য। হাত ধরে বলল,
–কোথায় যাচ্ছো? ভুলে গেছ আমি না তোমার প্যাসেঞ্জার? তো আমাকে না নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
নূর পেছনে না ঘুরেই বলল,
–কিন্তু আমিতো আজকেই শেষ টেক্সি এনেছি। আজকের পর আর চালাবোনা।
আদিত্য শুনে খুশি হলো। তারমানে নূর তার গ্যারেজ পেয়ে গেছে। আদিত্য উঠে গিয়ে নূরের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
–তো আজকেই শেষবার আমাকে তোমার প্যাসেঞ্জার হতে দাও।
মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো নূর। দুজন বেড়িয়ে গেল। টেক্সিতে পুরো রাস্তা আদিত্য অপলক তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। সেটা বুঝতে পেরে নূরের কেমন যেন লজ্জা লাগছিলো।তাকাতে পারছিলনা আদিত্যর পানে।আর নিজের এই অদ্ভুত কাজের জন্য নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছে নূর। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের দুই গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারতে। আজাইরা হুদাই এমন লজ্জার মতো ন্যাকামো মার্কা জিনিস ওর সাথে কেন হচ্ছে? এভাবেই একসময় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল ওরা। আদিত্য নামার একটা চকলেট বের নূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এটা মিছরি কিউটিপাই-এর জন্য। ওকে দিও প্লিজ।
নূর সৌজন্যমূলক হেঁসে চকলেট টা হাতে নিলো। আদিত্য নামার জন্য এক পা নিচে নামিয়ে হঠাৎ আবার ঘুরে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–আচ্ছা শোনো,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও ভালো কথা। তবে বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করতে যেওনা। না মানে দিনকাল তো ভালো না। দেখা গেল কখন কার কু নজর পরে গেল। আর তোমার বন্ধুই গুম হয়ে গেল। আর তুমি নিশ্চয় এটা চাইবেনা তাইনা? ওকে বাই দেন।
বলেই নেমে গেল আদিত্য। আদিত্যর হুমকি বুঝতে বেগ পেতে হলোনা নূরকে। বেচারা গিয়াস যে ভীতু এটা শুনলেই ও তিনবার করে কোমায় চলে যাবে।আর এই লোক কিনা এমন ছেলেকে নিয়েও হিংসে করছে। ভাবতেই হাসি পাঁচ্ছে নূরের। নিজে নিজেই হাসলো নূর। লোকটা সত্যিই পাগল। এই পাগল লোকটা ধীরে ধীরে আমাকেও পাগল করে দিচ্ছে। বশিভূত করছে যেন আমাকে। এসব ভাবনা চিন্তা আর ভালো কিছু অনুভূতির আলিঙ্গন নিয়ে বাড়ি ফিরলো নূর। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আজ তার জীবনে কতবড় বিপদ আসতে চলেছে। ভয়াবহ এক অঘটন হতে চলেছে। যা তার রুহ কাঁপিয়ে দিবে।
চলবে……