#শৈবলিনী—২১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বেলা তখন দ্বিপ্রহর প্রায়।রোদের তাপ নেই আজ। বরং আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা চলছে। ছায়া আছন্ন হয়ে আছে চারপাশ টা। একটা ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের মাঠের কোণে গাছতলায় বসে আছে নূর, শিখা আর গিয়াস। ক্যাম্পাসে আসা হবেনা ভেবে দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে আসেনি নূর। তাই একটা ক্লাস অ্যাটেন্ড করে আর করলোনা নূর। ওর সাথে শিখা আর গিয়াসও যোগ দিয়েছে। নূর ঘাসের উপর এক পা ভাজ করে আরেক পা মেলে দিয়ে, দুই হাত পেছনে ঘাসের উপর ভর দিয়ে ঘাড়টা হালকা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে আকাশপানে আনমনে তাকিয়ে আছে। সাদা মেঘ গুলোকে কালো মেঘগুলো কেমন ঢেকে ফেলেছে। কালো মেঘ কী সাদার মেঘের তুলনায় বেশি শক্তিশালী? তাই কী তারা এভাবে সাদা মেঘগুলোকে এভাবে আয়ত্তে করে নিয়েছে? তবে কী সাদা মেঘ পরাজিত কালোর কাছে? নাকি সাদা কালোকে সম্মতি দিচ্ছে তার কাছে যাওয়ার? সে নিজেই চাইছে কালো মেঘ তাকে জড়িয়ে নিক? ক্ষণিকের মেহমান জেনেও তাকে সবটুকু অধিকার অর্পণ করতে চাইছে? জেনে বুঝে নিজেকে শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে দিতে চাইছে? এতে কী সে সুখী হবে? সেতো জানে এই সন্ধি স্থায়ী নয়। ক্ষাণিক পরেই ঘটবে বিচ্ছেদ। সেই অনাগত চিরন্তন সত্য জেনেও কী সে এই মোহে আবদ্ধ হবে? তার কী ভয় হয়না? নূরের কল্পনায় সাদা মেঘ যেন প্রতিত্তোরে বলল,কেন ভয় হবে? মানুষতো জানে তার একদিন মৃ,ত্যু হবেই। তাই বলে কী মানুষ বেঁচে থাকতে ভয় পায়? তাহলে পরে হারানোর ভয়ে আমি বর্তমান কেন হারাবো?
–কীরে আসমানে কী দেহস? আলাদীনের জিনি উড়তাছে নাকি আকাশে? খালি চোখে পরপুরুষ গো এমনে দেখতে নাই। নজর লাইগা যাইবো তো।
গিয়াসের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলো নূর। মাথা ঝাঁকাল সে। কী ভাবছিলো এসব আবোলতাবোল? ওদের মহল্লার গফুর পাগলের মতো পাগল হয়ে গেল নাকি ও? মাথায় ডায়রিয়া হয়ে গেছে নির্ঘাত। সব দোষ ওই মিঃ নায়ক বেটার। আজকাল আমার ব্রেইনটাকে কচুখেত বানিয়ে দিয়েছে। নাজানি কীসব চলতে থাকে। মা ঠিকই বলে সঙ্গদোষ বড় দোষ। এই সঙ্গদোষ আজকাল বেশিই প্রভাব ফেলছে আমার ওপর। নূরকে এমন আনমনা দেখে শিখা জিজ্ঞেস করলো,
–কী হয়েছে বলতো? তোকে এমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন? আর তুই না বললি আজ আসবিনা? তো এলি কী করে?
নূর ফোঁৎ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ওদের সবটা খুলে বললো।সব শুনে শিখা তৃপ্তীময় একটা হাসি দিয়ে বলল,
–দেখেছিস আমি বলেছিলাম না। আদিত্য ভাইয়া বাকিদের মতো না। আর না ওনার ভালোবাসা বাকিদের মতো বানোয়াট। জানি তুই মানবি না। তবুও বলবো, ভাইয়াকে একটা চাঞ্চ দিয়ে দেখ।
–প্লিজ শিখা তুই ভালো করেই জানিস এসব আমার জন্য না। আমার লক্ষ্য আলাদা। যে লক্ষ্যে এসবের জায়গা নেই।
–হুম জানি। তবুও তোর কাছে একটা অনুরোধ রইলো। কখনো যদি তোর মন তোকে ডাক দিয়ে কিছু বলতে চায় তাহলে মনের কথাটা একটু শুনিস প্লিজ।
নূর আর জবাব দিলো না। কী জবাব দিবে? এই জবাব যে সে নিজেই জানে না। আর জানতেও চায়না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো হয়। যা ভেতরে কোনো এক গোপন জায়গায় দাফন করে রাখতে হয়। যাতে নিজ পর্যন্তও পৌঁছাতে না পারে সে উত্তর। নাহলে যে সব এলোমেলো হয়ে যায়। নিয়মের মধ্যে বাঁধা জীবনটা তখন নিয়মের বাইরে চলে যায়। আর নূরের নিয়মের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। নাটাই ছিঁড়া ঘুড়ি হওয়ার অনুমতি নেই তার। অনুমতি নেই দিশাহীন পাখি হওয়ার। কিছুতেই না।
___
রোজকার সময় অনুযায়ী আজও নূর এসে আদিত্যর কাজে হেল্প করলো। সব কাজ শেষে আদিত্য শুটিংয়ে প্যাকআপ করে নূরের সাথে বের হলো বাসার উদ্দেশ্যে। তবে আদিত্যর মাথায় চলছে অন্য ফন্দি। আজ সে নূরের সাথে এই একাকী মুহুর্তটা আরও দীর্ঘ করতে চায়। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়না সে। এরজন্য আজকে নাহয় একটু ছলচাতুরীই করলো। নূর যেহেতু ওর বাড়ির ঠিকানা জানে না। সেটারই সুযোগ নিলো। নূরকে ভুল পথে নিয়ে গেল সে। ঘন্টাখানিক চালিয়েও যখন আদিত্যের বাড়ি পৌঁছাল না। তখন নূর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
–আপনি সঠিক ঠিকানাই বলেছেন তো?
আদিত্য আমতাআমতা করে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই বলেছি।
–কিন্তু এটাতো কোনো আবাসিক এলাকা মনে হচ্ছে না। এটাতো কোনো নদীর কিনারা মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ ওই আসলে, আমার না মাঝে মধ্যে মন অস্থির হলে এখানে আসতে ইচ্ছে হয়। এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মনটা অনেক ফ্রেশ হয়ে যায়। আজ যেহেতু গাড়ির বদলে তোমার টেক্সি ব্যবহার করছি। তাই তেমাকেও নিয়ে আসতে হলো। তাছাড়া তোমাকে এখানে আনার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। সত্যিই বলছি।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আপনিতো সত্যির দেবতা। মিথ্যে কখনো আপনার মুখ দিয়ে বেরই হয়না। আপনার কী মনে হয়, আমাকে কী এতটা বোকা মনে হয়?
আদিত্য মেকি হেসে বলল,
–না না, কি যে বলোনা। তোমাকে বোকা বলার সাধ্য কার আছে। আমার এতো জলদি মরার শখ নেই। দেখ মাত্র পাঁচ মিনিট। এরবেশি নিবো না আই প্রমিজ।
–ঠিক আছে যান।
–তুমিও আসোনা আমার সাথে।
–আমি গিয়ে কী করবো? আমার মন একদম শান্তশিষ্ট আছে। যান আপনি গিয়ে মনের আইসক্রিম করে আসেন।
–ও বুঝতে পেরেছি। তুমি আসলে ভয় পাচ্ছ। ভুত,পেত্নী এসে তোমাকে খেয়ে না ফেলে সেই ভয় পাচ্ছ তাইনা? কিন্তু তুমি কেন ভয় পাচ্ছ। তোমার চেয়ে ভয়ংকর কিছু আছে নাকি। ভুতেরা বরং উল্টো তোমাকে দেখেই মাটির সাত স্তর গভীরে নিজেদের কোয়ারান্টাইন করে নিবে।জানো ভুতের বাচ্চারা যখন কাঁদে তখন মা ভুত বলে,”চুপ হয়ে যা, নাহলে নূর চলে আসবে”।
নূর মুখ ভেঙিয়ে বলল,
–হা,হা,হা ভেরি ফানি। নূর কাউকে ভয় পায় না।
–তাহলে বাইরে এসে দেখাও। কিন্তু জানি তুমি পারবেনা। তাই গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে সীটের নিচে ঢুকে লুকিয়ে থাকো।
বলেই দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল আদিত্য। বাইরে এসে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। নূরও সাহসিকতার প্রমাণ দিতে খট করে বেড়িয়ে এলো। আদিত্যর পাশে এসে বলল,
–নূর কোনো কিছু ভয় পায়না। এই কথাটা কাগজে লিখে ফেবিকল আঠা দিয়ে ভালো করে চিপকিয়ে নিন।
আদিত্য কিছু না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মনে মনে আওড়ালো, ভয় পাবে নূর, একদিন তুমি শ্বাসরুদ্ধকর ভয় পাবে।আর তোমার সেই হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া ভয়ের কারণ হবে এই আদিত্য।
নূর এবারে আশেপাশের পরিবেশ টা লক্ষ্য করলো। সামনে একটা বিশাল বিলের মতো জলাশয়ের ভরা জায়গা। আর তার পাশ দিয়েই বিশাল বিশাল কাশফুলের বন। শীতল বাতাসে ঢেউ খেলছে কাশফুলের বনগুলো। এতো সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মুহুর্তেই নূরের সব বিরক্তি যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। মন মস্তিষ্ক বিশুদ্ধতায় ভরে উঠল। লোকটা ঠিকই বলেছে। জায়গাটা সত্যিই মনকাড়া। আদিত্য পাশ থেকে বলে উঠল,
–তুমি আমাকে তোমার একটা স্পেশাল জায়গা দেখিয়েছিলে।তাই আজ আমিও তোমাকে আমার একটা স্পেশাল জায়গায় নিয়ে এলাম।
আদিত্য মায়াবী চোখে নূরের পানে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে ওর হাতের মাঝে নিজের হাতটা দিয়ে নূরের হাত ধরে নূরকে সামনের দিকে নিয়ে গেল। নূরও কেন যেন বিনাবাক্যে চলল আদিত্যর সাথে। আদিত্য নূরকে নিয়ে এসে বিলের একেবারে কিনারায় এসে নূরকে সহ নিজেও ঘাসের উপর বসলো। দিনের বেলা মেঘের আনাগোনা থাকলেও এখন আকাশ পরিস্কার। চন্দ্রের শশিপ্রভায় আলোকিত হচ্ছে প্রকৃতি। চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে পানির মাঝে।প্রকৃতির এই অপরুপ চিত্র উপভোগ করছে নূর। আর আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার নূরকে। চাঁদের রুপালি আলোয় নূরকে লাগছে মায়াহরিণী। যে মায়াহরিণীর মায়ায় আদিত্য আবেশিত হয় বারংবার। ওই চোখের গহ্বরে তলিয়ে যায় বারংবার। বারংবার ঘায়েল এই রমনীতে। তবুও বারংবার এই নারীকেই চায় আদিত্য। অন্তহীন চায় তাকে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চায় তাকে।চায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে। নিজেকে বিলীন করতে চায় শুধু এই নারীতে।
আদিত্যর মুগ্ধতার মাঝেই নূর বলে উঠল,
–ওয়াও,কত সুন্দর পদ্ম ফুটেছে পানিতে।
নূরের কথা অনুযায়ী আদিত্য ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই বিলের মাঝে কয়েকটি পদ্ম ফুটে আছে। আদিত্য একবার নূরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে পদ্মটার দিকে। চোখের কোন চকচক করছে তার। আদিত্য নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে নিচে রাখলো। তারপর জুতা জোড়া খুলল।এবং কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে সামনের পানির মাঝে নেমে গেল। আদিত্যর কান্ড দেখে নূর বিস্মিত হয়ে বলল,
–আরে আরে কী করছেন আপনি? পানিতে নামছেন কেন?
আদিত্য জবাব না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো। ধীরে ধীরে গলা পানির মাঝে নেমে গেল। তারপর একসময় পানির মাঝে সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল সামনে। অতঃপর সেই পদ্ম ফুলের কাছে গিয়ে একটা পদ্ম ছিঁড়ে নিয়ে এলো। ফুল নিয়ে আবার সাঁতরে ফিরলো সে। কিনারে উঠে আসতে আসতে ভেজা চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিলো। সারা শরীর থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে। নূরের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পদ্ম ফুলটা সযত্নে এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। হাসিমুখে বলল,
–এটা তোমার জন্য নূর। আমার ভালোবাসার প্রথম পদ্ম। সরি,একটু ফিল্মি লাইন হয়ে গেল। তাই চাইলে স্কিপ করতে পারো।
নূর অবাক, বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–আপনি কী পাগল?
–সেটাতো তোমাকে দেখার পর থেকেই হয়ে গেছি। তুমি আজ জানলে? এখন এই ফুলটা আগে নাও। আচ্ছা নিতে হবে না দাঁড়াও।
আদিত্য এবার পদ্ম ফুলটা নূরের কানের পিঠে চুলের মাঝে গুঁজে দিলো। ফুল গুঁজে দিয়ে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আদিত্যর ওই মায়া ভরা চাহুনিতে নূরও মায়ায় পড়ে গেল। আদিত্য মায়াময় কন্ঠে বলে উঠলো,
–আমি বলবোনা এই ফুলে তোমাকে সুন্দর লাগছে। উহুম,দুনিয়ার কোনো জিনিস তোমার সৌন্দর্যকে তাদের দ্বারা আরও উত্তম করতে পারবেনা। এতো স্পর্ধা কারোর নেই। বরং এই ফুলটাই তোমার সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়ে গেল। ওর জনম সার্থ আজ। কারণ সে নূরের অঙ্গে শোভা পেয়েছে। যে নারী নিজেই নিজের তুলনা। তুমি জানো সবাই আমাকে বলে আমি অনেক ভাগ্যবান। কারণ আমি আমার জীবনে এতো সফলতা পেয়েছি । তাদের কথায় আমি তেমন বিশ্বাস করতাম না। তবে আজ আমি বিশ্বাস করি নূর। বিধাতা আমাকে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের অধিকারী করেছে। কারণ আমার জীবনে তোমার আগমন ঘটেছে। তুমি জানো, এখন এই মুহুর্তে আমার মরে গেলেও আপসোস নেই। কারণ আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছি। এটাই আমার কাছে সর্বসুখের কারণ।
নূরের ভেতর কোথাও একটা ভেঙে পড়ছে। অন্তর্দেশে অসহ্য পীড়ন অনুভব হচ্ছে তার। হঠাৎ যেন কেমন শক্তিহীন দূর্বল হয়ে পড়ছে সে। আদিত্যর ওই মায়ার সমুদ্রে যেন না চাইতেও ডুবে যাচ্ছে সে। আদিত্য নূরের আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–আমি জানি, তুমি আমাকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছ নূর। তবে আজ একটা অবাধ্য আবদার করতে চাই নূর। প্লিজ মানা করোনা। তোমার এই মায়াবী ললাটে একটু স্পর্শ করতে চাই আমি।
চকিত চোখে তাকালো নূর। সে চাইছে মানা করতে। কিন্তু কন্ঠনালী কেন যেন তার এই সিদ্ধান্তে সহমত প্রকাশ করছে না।শব্দকোষ গুলো হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল। মুখ যেন তার হরতালে বসে গেছে। খুলছেনা কিছুতেই। নূরের নীরবতাকে সম্মতি ভেবে নিলো আদিত্য।দুই হাতে নূরের মাথাটা ধরে, নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে নূরের ললাটের মাঝ বরাবর অধর ছুঁইয়ে গভীর ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো আদিত্য। হৃদপিণ্ড ঝংকার দিয়ে উঠল নূরের। কেঁপে উঠল সারা অঙ্গ। দুই হাতে মাটির ঘাস খামচে ধরলো নূর।নিঃশ্বাস থেমে গেল যেন। এ কেমন অনুভুতি হচ্ছে তার? তারতো এমুহূর্তে অত্যন্ত রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু এই অনুভূতিটা তো রাগ জাতীয় কিছু না। এটা তবে কোন নাম না জানা অনুভূতি? যে অনুভূতি পীড়াদায়ক। তবে এই পীড়ায় কষ্ট নেই, বরং কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। কপালে চুমু দেওয়া শেষে নূরের কপালে কপাল ঠেকালো আদিত্য। চোখ বুজে ঘনঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তীব্র নেশালো আর আবেগ ভরা কন্ঠে আদিত্য বলে উঠল,
–ভালোবাসি নূর। সত্যিই ভালোবাসি। যতটা সত্য এই পৃথিবী,যতটা সত্য এই নির্জন রাত,যতটা সত্য আকাশের ওই চন্দ্রটা, ঠিক ততটাই সত্য তোমাকে ঘিরে আমার অন্তহীন ভালোবাসা। যতটা ভালোবাসলে নিজেকেই ভুলে যাওয়া যায়।যতটা ভালোবাসলে নিজের নিঃশ্বাসও তার নামে করে দেওয়া যায়। ঠিক ততটা বা তার চেয়েও ভালোবাসি তোমাকে নূর।
হৃদপিণ্ডে অসহনীয় ব্যাথা শুরু হলো নূরের।ভেতরটা কেমন চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। হঠাৎ তার কেমন কান্না পাচ্ছে। আর এখানে বসে থাকতে পারছেনা সে। অনেক প্রচেষ্টা করে কোনরকমে সে বলল,
–পাঁচ মিনিট শেষ হয়ে গেছে। আমাদের এখন যাওয়া উচিত।
চোখ খুলে তাকিয়ে নূরকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো আদিত্য। মুচকি হেঁসে বলল,
–আর কিছু সময় প্লিজ। আচ্ছা চলো তোমাকে একটা গান শোনাই। আজকের এই স্পটে মুহুর্তে একটু গান গাইতে ইচ্ছে করছে আমার। গাই?
–মানা করলে কী আপনি শুনবেন? তো করুন যা ইচ্ছে।
–ওয়াও, কতো ভালো করে বুঝে গেছ আমাকে। দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ সো মাচ। তো এতো করে ইনসিস্ট করছ তাহলে কি করে মানা করি বলো।
আদিত্য হঠাৎ ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নূরের পানে তাকিয়ে থেকেই গেয়ে উঠল,
♬ আজকের এই নিশি, ভালোবাসি, ভালোবাসি
নিকষ মেঘে তোমার ওই চোখ
দেখেছি আজ এই আমি
মৃদু বাতাস বলে, ছিলে সেই তুমি
তোমারই মোহে হারাই আমি
নিজেকে যে খুঁজি ফিরি
তোমার প্রেমের সুখ সারি
যখন দাঁড়াও এসে,ভুলে যাই সবই
হৃদয়ের সব কথা,বলে দেই আমি
তোমারই যে চিরদিনই
রবো আমি তোমারই
হোওও আজকের এই নিশি ভালোবাসি ভালোবাসি
নিকষ মেঘে তোমার ওই চোখ
দেখেছি আজ এই আমি ♬ ♬
আর বসে থাকার শক্তি পাচ্ছে না নূর। মনে হচ্ছে তুফানে সব তছনছ করে দিবে। নূর উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
–আপনার প্রতিভার প্রদর্শন শেষ হলে এবার চলুন। এখানে কেউ অস্কার দিতে আসবেনা।
স্মিথ হাসলো আদিত্য। অস্কারের থেকেও বেশি কিছু পেয়েছে আজ সে।
এদের এই সুন্দর মুহুর্তের মাঝে কেউ জানতেই পারলোনা দূর থেকে কেউ একজন দেখছে তাদের। শুধু দেখছেনা, ক্যামেরায় বন্দি করছে দুজনের এই বিশেষ মুহুর্ত।
__
–স্যার, স্যার উঠেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠেন।
সকাল সকাল ঘুমের মাঝে এমন বেসুরো আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ অবস্থায়ই কপাল কুঁচকে এলো আদিত্যর। বিরক্তিকর চেহারা করে চোখ মেলে তাকালো সে। তাকাতেই সামনেই আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গেল জিদানকে। যেন এই মুহুর্তে সে ভুত পেত্নীর সাথে বোর্ড মিটিং করে এসেছে। আদিত্য উঠে বসে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কী হয়েছে? সকাল সকাল তুমি এখানে কী করছ? আর এভাবে আমার ঘুম নষ্ট করছ কেন?
জিদান শঙ্কিত কন্ঠে বলল,
–স্যার, আজকের ব্রেকিং নিউজ দেখলে আপনার ঘুমতো দূরে থাক। ঘুমের শশুর শাশুড়ীও লেজ গুটিয়ে পালাবে।
–হোয়াট? কী বলছ এসব? কীসের ব্রেকিং নিউজ?
জিদান তার ফোন ঘেটে আজকের ব্রেকিং নিউজটা বের করে দেখালো আদিত্যকে। ফোন হাতে নিয়ে নিউজ টা দেখতেই হকচকিয়ে উঠল আদিত্য। মুহুর্তেই ঘুমের লেশ মেশ সব উড়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আদিত্যর নূরকে দেওয়া সেই চুমুর মুহুর্ত। সাথে মসলা মেশানো কাহিনি তো আছেই। চমকে গেল আদিত্য। অন্যসময় হলে সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু এটা নূরকে নিয়ে হয়েছে। আর নূর নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নিবেনা। খুবই বাজে ভাবে ঘটনা মোড় নিয়েছে। নাজানি মেয়েটা কী ভাববে ওর ব্যাপারে। কী করে সামলাবে ওকে এবার।
চলবে……..