#শৈবলিনী—১১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে গৃহে কদম রাখতেই আজ বাড়ির আভ্যন্তরীণ বাতাবরণ কিছুটা পরিবর্তন দেখতে পেল আদিত্য। অন্যান্য দিনের তুলনায় বাড়িটা কেমন যেন বেশিই পরিপাটি আর সাজানো মনে হচ্ছে। মুখরোচক খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে পুরো বাড়ি। এগিয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবারের দীর্ঘ মেনু দেখে নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে, ভ্রু জোরা উঁচু করে কৌতুহলি মনোভাব প্রকাশ করলো আদিত্য। এমন ঘটা করে আয়োজনের হেতু জানতে খাবার পরিবেশনের কাজে ব্যাস্ত থাকা রেহনুমার উদ্দেশ্যে আদিত্য বলে উঠলো।
–কী ব্যাপার মা! হঠাৎ এতো গ্রান্ড আয়োজন কী উপলক্ষে শুনি? আজতো কারোর বার্থডেও না। আর তোমার আর বাবার বিবাহবার্ষিকীও না। তাহলে এতো আয়োজন কীসের?
–তোর মায়ের সাথে হওয়া ওই বিয়ে নামক নির্মম দূর্ঘটনাকে আবার সেলিব্রেটও করবো? ওটাকে তো আমি আমার জীবনের কালো দিন, শোক দিবস হিসেবে পালন করি। রাস্তায় রাস্তায় ব্যানার ঝুলিয়ে দিতে চাই, কাঁদো বাঙালি কাঁদো।
পেছন থেকে বাবার উক্তি শুনে আদিত্য মৃদু হেঁসে বলল,
–কিন্তু বাবা,তোমার দুঃখে জাতি কেন কাঁদতে যাবে?
–আরে কাঁদবে না! এটাতো সব স্বামীর জন্য শোক দিবস? দিনের পর দিন স্ত্রীর হাতে নিপিড়ন হওয়া দুঃখিয়ারী স্বামী দের শোক দিবস। আরে এটাতো আন্তর্জাতিক ভাবে ঘোষনা করা দরকার। বিশ্ব শোক দিবস হিসেবে পালন করা দরকার।
হাসলো আদিত্য।রেহনুমা চোয়াল চিবিয়ে বলল,
–দেখ আজকে আমি একদম আমার মুড নষ্ট করতে চাচ্ছিনা। তাই তোমার এই গার্বেজ টাইপ জোক্স আর আনকালচার কথাবার্তাসহ নিজেকে শাট ডাউন করে ফেল।
আদিত্যর বাবা মুখ বাকিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। আদিত্য আবারও জানতে চাইলো।
–কিন্তু মা, অকেশন টা কী তাতো বললে না।
আহানা ফোনের স্ক্রিনে নজর টিকিয়ে রেখেই আসতে আসতে বলল,
–কী আবার হবে, আজ মায়ের ছোট নবাব রায়বাহাদুর, মহামান্য আদ্র মহারাজ আসছেন। তার আগমনেই এতো জমকালো আয়োজন।
আদিত্য ভ্রুকুটি উঁচু করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
–ওওও তাই তো বলি, আজ মায়ের আদরের দুলাল আসছে বলে এতো আয়োজন। বাহ্, ভালোই। আমাদের এমন কপাল কোথায়?
–হ্যাঁ ভাইয়া, মা শুধু এখন হাতি দ্বারা সেলামি দেওয়ার কাজটাই বাদ রেখেছে। বাসা নোংরা হওয়ার ভয় না থাকলে মা হয়তো সেটাও করে দিতো। আদ্র মহারাজ আসবে আর দুই পাশে দুই হাতি তারওপর ফুলচন্দনের বর্ষণ করবে। ওয়াহ,কী সিন।
–হ্যারে আন্নি ঠিকই বলেছিস।এই আমাদের মতো গরীবের কোনো কাজ নেই এখানে। চল আমরা দুইজন গলাগলি দিয়ে দুঃখ ভাগ করে নেই।
আন্নি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–ও প্লিজ ভাইয়া, আমরা সবাই জানি মায়ের প্রথম মহারাজা আর অলটাইম ফেবারিট তো তুমিই। এখানে অবহেলিত কেউ থাকলে সে হলো এই আমি, এক জনমদুখিনী বেচারি।
–হ্যা,কারণ তোকে তো পুরাণ সরকারি হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনেছে মা। তোকে যে পালছি,আমাদের পরিবারের সদস্য করে রেখেছি এটাই তো তোর সাতজনমের সৌভাগ্য। তোরতো সকাল বিকাল আমাদের পা ধুয়ে পানি খাওয়া উচিত।
আহানার উদ্দেশ্যে উক্ত কথাগুলো বলতে বলতে দরজা দিয়ে এগিয়ে এলো আদ্র। আহানা দুপাটি দাঁত বের করে ফেক হাসি দেখিয়ে বলল,
–ট্রাই সামথিং নিউ ব্রো। এসব চাইল্ডিশ জোক আর কতবার মারবি। ফরেন টুর গিয়েও দেখি তোর জোক্স আপডেট হয়নি। ইউ আর ভেরি ডিসপয়েন্ট মি ব্রো।
আদ্র আহনার মাথায় আলতো চাটি মেরে বলল,
–চুপ,বেশি কথা বলা শিখে গেছিস।
এরপর হাসিমুখে আদিত্যকে হাগ করে বলল,
–হাউ আর ইউ ভাইয়া।
আদিত্যও মুচকি হেঁসে বলল,
–আম গুড, তোর টুর কেমন হলো?
–অসম ভাইয়া।
আদ্র এবার বাবা মায়ের সাথেও কুশলাদি বিনিময় করলো। রেহনুমা ছেলের মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে বলল,
–নিশ্চয় খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিসনি। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছিস একেবারে।
আহানা আদিত্য দিকে হালকা ঝুঁকে বিরবির করে বলল,
–মায়েদের এই ডায়লগ টা একেবারে এভারগ্রীন হিট। গ্রামীন মা বলো আর শহুরে ক্লাসি, সবাই এই ডায়লগ দিবেই। ইটস কম্পালসরি।
রেহনুমা আদ্রর উদ্দেশ্যে বলল।
–আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে আয় ডিনারের জন্য। আদি, তুইও যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আর হ্যাঁ, আসল কথাটা তো বলতেই পারলাম না। আসলে আজ শুধু আদ্রর জন্য এতো আয়োজন হয়নি। আজ ডিনারে গেস্ট আসছে। তাই এতটা আয়োজন।
আদিত্য প্রশ্ন করলো।
–গেস্ট? কে গেস্ট?
–ইটস সারপ্রাইজ, আসলেই দেখতে পাবি। এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয়।
–ওকে মা, এজ ইউর উইশ। তাহলে আবিরটাকেউ একটু ডেকে নেই। তোমার হাতের খাবার আবার ওর খুব পছন্দ।
–ঠিক আছে আসতে বল।
আদিত্য উপরে যেতে যেতে আবিরকে ফোন লাগিয়ে বলল,
–শোন মাগনা খাবার খাইতে চাইলে লুঙ্গির কাছা টাইট দিয়ে দৌড় দিয়া আয়।
–কস মি মামা! লুঙ্গি ছাড়াই আইতাছি আমি।
–ওই না,লুঙ্গি ছাড়া আসিস না। কাপড় চোপড় পড়ে আসিস।
–আরে কাপড় চোপড় হলো মোহ মায়া। এগুলোকে সিরিয়াসলি নিতে নেই। দুনিয়াতে কি নিয়ে এসেছ, আর কি নিয়ে যাবে। ল্যাং,টাই এসেছ, আর ল্যাং,টাই যেতে হবে। তাহলে এসব মিছে মায়ায় কেন পড়ে আছি আমরা।
–ও বাবা বদনাদেব, প্রবচন বন্ধ করে জলদি আয়।
–অক্ষুনি টপকাইতাছি।
ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আদিত্যর। লিভিং রুমের সোফায় সামাইরা আর ওর মাকে বসে থাকতে দেখে আদিত্যর ফুরফুরে মেজাজ টা হঠাৎই তিক্ত হয়ে গেল।মায়ের সেই সো ক্লড গেস্ট যে এরাই সেটাও বোধগম্য হলো তার। আর মা ঠিক কোন উদ্দেশ্যে এদের দাওয়াত করেছে এটাও বুঝতে বেগ পেতে হলো না আদিত্যের। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে, তার এই প্রয়াস যে সম্পূর্ণই বৃধা যাবে। তার ছেলে যে এখন অন্য কারোর কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। আদিত্যর জীবনে অন্য কারোর চুল পরিমাণ জায়গা নেই। আর সামাইরাকে কর্মক্ষেত্রের বাইরে এমনিতেও পছন্দ না তার। সেখানে এমন কিছু তো কল্পনাতেও না। মনে মনে বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে সামনে এগিয়ে গেল আদিত্য। সামাইরা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
–হায় আদিত্য।
আদিত্যও সৌজন্যমূলক বলল,
–হেলো।
–বাইদাওয়ে, বাসার ক্যাজুয়াল লুকে কিন্তু তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।
এবারও জোরপূর্বক স্মিথ হাসলো আদিত্য। ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে ওদের দেখছে রেহনুমা। দুজনকে কতসুন্দর মানিয়েছে। সামাইরা আদিত্যর লাইফ পার্টনার হিসেবে একদম পারফেক্ট।সুন্দর, ক্লাসি আর সোফিসটিকেটেড।
কিছুক্ষণ পর আবিরও এসে উপস্থিত হলো সেখানে। আর যথারীতি তাকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল আহানার। যার আভাস শুধু আবির ছাড়া আর কেউই পেলনা। তাইতো আগুনে ঘি ঢালতে সন্তর্পণে আহানার পানে চোখ টিপ মেরে দিলো সে। বিপরীতে পেল তার কাঙ্ক্ষিত উত্তপ্ত দৃষ্টি। বাঁকা হাসলো আবির।ঘিয়ের পরিমাণ আরও বাড়াতে এগিয়ে গেল সমাইরার দিকে। উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
–আরে সামাইরা মাই জান, হাউ আর ইউ? দিন দিন তোমার বিউটি তো একেবারে কাতিলানা হয়ে যাচ্ছে।
আবির সামাইরার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
–আন্টি, সামাইরার বাবা কী বারুদের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে?
–নাতো।কেন?
–তানাহলে এমন এটম বম কীভাবে পয়দা করলো!
হেঁসে উঠলো সবাই। সামাইরা ঢং করে বলল,
–ওহ আবির, তুমি একটু বেশি বেশিই বলো। আমি এতটাও সুন্দর না।
বিরক্তির প্রলয় উপচে পড়ছে আহানার মাঝে। মুখ ভেঙিয়ে বিরবির করে বলল,
–মরণ, ঢং দেখে বমি আসে। আসছে তো এখানে ভাইয়াকে ফুসলাতে। আবার ঢং দেখ, যেন কচি খুকিটি। এইসব মেয়েরা আবিরের মতো অসভ্য ক্যারেক্টরলেস ছেলেদের জন্য একদম পারফেক্ট। আমার ভোলাভালা ভাই এর খপ্পরে না পড়ে তাই ভালো।
এবারে আদ্র এগিয়ে এসে আবিরকে হাগ করে বলল,
–আরে আবির ব্রো,হোয়াটস আপ ম্যান।
–আরে হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ম্যাসেঞ্জার এইসব পড়ে হবে। আগে বল আমি যে তোরে ফরেন মাইয়ার নাম্বার আনতে কইছিলাম আনছোস? আমার বিশ্ব প্রেমিক হওয়ার যাত্রায় তুইও অবদান রাখতে পারছিস। ইতিহাসের পাতায় তোর নামও উল্লেখ থাকবে। কতবড় সৌভাগ্য তোর ভাবতে পারছিস!
আহানা পাশ থেকে তিরস্কার স্বরূপ বলে উঠলো।
–এমন অসভ্য চিন্তাধারা নিজ পর্যন্তই রাখুন। আমার ভাইকে ওইপথে নেওয়ার দরকার নেই।
আবির ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁকা হেসে একবার তাকালো আহানার পানে। তারপর রেহনুমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
–আন্টি সরি টু সে, আপনার মেয়ে কিন্তু আপনার মতো ক্লাসি আর বুদ্ধিমান হয়নি।আমি মাঝে মাঝে ভাবি আপনার মতো এমন সম্ভ্রান্ত রমনীর মেয়ে এতো ডাম্প কীভাবে হলো? টু ব্যাড।
আহানা তেতে উঠে আবার কিছু বলতে যাবে কিন্তু রেহনুমা থামিয়ে দিয়ে সবাইকে খাবার টেবিলে বসতে বললো। খাবার টেবিলে এসে সামাইরা রেহনুমার মন জোগাতে তার হাত থেকে খাবারের বোলটা হাতে নিয়ে নম্র ভাবে বলল,
–আপনি বসুন না আন্টি, আমি সার্ভ করছি সবাইকে। এমনিতেই অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছেন আপনি।
সামাইরার টেকনিক কাজে দিলো।রেহনুমা মুগ্ধ হলো তার আচরণে। সামাইরার মা আরও একটু বাহবা দিয়ে বলল,
–আমার মেয়েটা এমনই। বড়দের কষ্ট কিছুতেই দেখতে পারে না সে। মায়ায় ভরপুর একেবারে মেয়েটা।
আহানা বলে উঠলো।
–সেই আন্টি,আপনার মেয়ের মতো মানুষ আছে দেখেই এখনো দুনিয়াতে মায়া জীবিত আছে। নাহলে তো দুনিয়া থেকে মায়া মোহাব্বত উঠেই যেত। মায়ার দেবি সামাইরা মাতার ক্ষয় হোক,থুক্কু জয় হোক।
আহানার তিরস্কার বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসলো সবাই। রেহনুমা সামাইরাকে বলল,
–আরে না তোমাকে করতে হবে না। তুমি বরং আদিত্যর পাশ গিয়ে বসো।
আদিত্যর রাগ হচ্ছে ভীষণ। তবে মায়ের জন্য কিছু বলছেনা ও। মাকে ভীষণ ভালোবাসে আদিত্য। মায়ের কোনো কথার অবাধ্য হয়না সে কখনো। চুল পরিমান কষ্টও সে মাকে দিতে পারেনা। তাইতো ভেতরের রাগ বাইরে আসতে না দিয়ে আপাতত ডিনারে মন দিলো। দ্রুত খানা শেষ করে উঠে যেতে নিলেই রেহনুমা হঠাৎ বলে উঠলো।
–আদি, সামাইরাকে তোর রুম ঘুরে দেখা একটু।
–মা, রুমের আবার কী দেখার আছে? সবার মতোই সাধারণ একটা রুম।
–আরে তাতে কী হয়েছে? সামাইরা প্রথম এসেছে। ওকে একটু ঘুরে দেখা আমাদের বাড়িটা।
সামাইরা মনে মনে আনন্দিত হচ্ছে। যাক আদিত্যর মা যেহেতু ওকে আদিত্যর সাথে চাচ্ছে তাহলে আর বেশি সমস্যা হবে না আদিত্যকে পেতে। আদিত্য মেজাজ চরম খিঁচড়ে আসছে। সাহায্যের জন্য আবিরের পানে তাকালো সে। আবির বুঝতে পেরে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ আন্টিতো ঠিকই বলেছে। সামাইরাকে বাড়ি ঘুরে দেখানো তো জরুরি। শুধু বাড়ি কেন আজতো সবাই মিলে ছাঁদে জম্পেশ আড্ডা হবে। তাইনারে আদ্র?
–হ্যাঁ হ্যাঁ অফকোর্স ভাই। চলো যাই সবাই।
সমাইরার মনে মনে ভীষণ বিরক্তি লাগছে। কোথায় আদিত্যের সাথে একটু একা সময় কাটাবে তানা এখন গুষ্টি সমেত আড্ডায় বসবে। আদিত্য চোখের ইশারায় থ্যাংকস জানালো আবিরকে। আদিত্য কোনো বাহানা দিয়ে চলে আসবে আড্ডা থেকে।
___
গাড়িতে বসে আদিত্য একটা ল্যাপটপের ব্যাগ জিদানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এটা নূরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার। তবে সে যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে,এটা আমি দিয়েছি।
–কেন স্যার, আপনার কথা জানলে কী হবে?
–তেমন কিছুই না। শুধু তোমার ছবির ওপর মালা ঝুলে যাবে ব্যাস।
শুকনো ঢোক গিললো জিদান। এদের দুজনের প্রেমকাহিনীর মাঝে বেচারা জিদানকে কেন বলির পাঠা বানাচ্ছে? এখনো তো বিয়েও করলাম না। আমার হবু বউটা বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে। কী আর করার! স্যারের জন্য নাহয় এই জীবন কুরবান করে দিলাম।
আদিত্য কাল নূরের ওর ল্যাপটপের দিকে তাকানো দেখে মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছিল। তাই শিখার সাথে কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল, নূরের একটা ল্যাপটপের দরকার। সরাসরি দিলে নূর ইহকালেও নিবে না। কিন্তু আদিত্য যে ওর নূরের জন্য এটা করতে চায়। ব্যাস জিদান কোনোভাবে এটা ওর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারলে হয়।
__
আধাঘন্টা ধরে মুখের ঢাকনা খুলে হা করে তাকিয়ে আছে শিখা আর গিয়াস। নূর বিরক্ত হয়ে বলল,
–হইছে ম্যানহোলের ঢাকনা বন্ধ কর এবার। এতো অভার রিয়্যাক্ট করার মতো আহামরি কিছু হয়নি।
শিখা আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো।
–আহামরি কিছু না! দ্য সুপারস্টার সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য তোকে “আই লাভ ইউ” বলেছে এটা আহামরি কিছু না! তাহলে তো আমি বলবো তুই আহামরি শব্দের ডেফিনেশনই জানিস না। আরে এটাতো ব্রেকিং নিউজের চাইতেও বেশি বড়ো ধামাকা নিউজ। যাকে দেশে বিদেশের লাখো মেয়েরা পাওয়ার জন্য মাথা খুঁটছে। সেই আদিত্য কিনা আমাদের লেডি ডন নূরকে ভালোবাসে। ও মাই গড! আমি পাগল হয়ে যাবো। কী শুনাইলি তুই ইয়ার।
–চুপ করবি তুই। এসব ভালোবাসা টালোবাসা কিছুই না। ওসব হলো সব লুচ্চামির ধান্দা। ভেবেছে বাকি মেয়েদের মতো আমিও তার জালে ফেঁসে যাবো। তবে সে জানে না এই নূর কী জিনিস। ত্রিশ দিন পরও যখন আমার কোনো পরিবর্তন দেখবেনা তখন বুঝবে কার সাথে লাগতে এসেছিল।
–কী বলছিস! দেখ সবাইকে এক নজরে দেখা কিন্তু ঠিকনা। হতে পারে উনি সত্যিই তোকে ভালোবাসে। তাকে সুযোগ না দিলে কীভাবে বুঝবি তুই?
–বুঝতে চাইও না আমি। আমার জীবনে এসবের কোনো জায়গা নেই তা ভালা করেই জানিস তুই। এইসব প্রেম পিরিতির ক্যাচাল আমার জন্য না।
এবারে গিয়াস বলে উঠলো।
–ওসব তো ঠিক আছে। আমি ভাবছি তোকে আই লাভ ইউ বলে ওই বেচারা এখনো বেঁচে আছে কীভাবে? এতক্ষণে তার কবরে ফুল গজানোর কথা। ফাস্ট ইয়ারের কথা মনে আছে তোর শিখা? এক সিনিয়র ভাই আমাদের লেডি ডনকে আই লাভ ইউ বলার দুঃসাহস দেখিয়েছিলো তারপর বেচারার কী হাল করেছিলো আমগো নূর আফায়!
–মনে নেই আবার, বেচারার নাকে এমন ঘুষি মেরেছিলো যে,এখন তার সর্দি নাকের বদলে মুখ দিয়ে বের হয়।
–আহারে বেচারা, কোনোদিন নিজের বউকেউ আই লাভ ইউ বলবেনা।
হইছে এসব ফালতু আলাপ ছাড়। আমি শুধু ত্রিশ দিনই তার সামনে যাবো। তার একদিন পারও হয়ে গেছে। অতঃপর আর মাত্র উনত্রিশ দিন আছে। দিন শেষ হলে তার সাথে সাক্ষাৎও শেষ। এখন চল ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ করে আবার ওই নায়কের কাজ করতে হবে। তিনজন উঠে ক্লাসের দিকে যেতে লাগলো। তখনই হঠাৎ শিখা খেয়াল করলো দূর থেকে কেউ একজন ওকে হাতের ইশারায় ডাকছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো এটা আদিত্যর সেই সেক্রেটারি। এই ব্যাটা আবার আমাকে ডাকছে কেন? মতলব কী এটার? শিখা নূর আর গিয়াসকে এগুতে বলে নিজে জিদানের দিকে এগিয়ে গেল। জিদানের সামনে এসে কোমড়ে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–এইযে মিঃ, কী ব্যাপার হ্যাঁ? এমনে ইশারা করছেন কেন? কাহিনি কী? ফিদা টিদা হয়ে গেলেন নাকি আমার ওপর?
–আরে না না কিযে বলেন, আসলে আপনার একটু সাহায্য লাগতো।
–,কী সাহায্য?
–আসলে স্যার এই ল্যাপটপ টা নূর ম্যামকে দিতে চায়। কিন্তু তার কথা না জানিয়ে। আমি ভেবে পাচ্ছিনা কীভাবে দিবো। আপনিতো উনার বান্ধবী তাই আপনি যদি একটু হেল্প করতেন তাহলে খুব উপকার হতো।
শিখা কথাটা শুনে খুশিই হলো। আদিত্য বোধহয় নূরকে সত্যিই ভালোবাসে। তাইতো এভাবে লুকিয়ে ওর হেল্প করছে। শিখা কিছু একটা ভেবে বলল,
–হুম ঠিক আছে আমার কাছে আইডিয়া আছে, শুনুন।
শিখা জিদানকে প্ল্যান বুঝিয়ে দিলো। ওরা একটা ফেক লটারির আয়োজন করবে।যে জিতবে সে ল্যাপটপ টা পাবে। সেখানে শিখা নূরকে নিয়ে গিয়ে মিছে লটারি খেলবে। আর ওদের প্ল্যান অনুযায়ী নূরই সেটা জিতবে আর ল্যাপটপ টা পেয়ে যাবে। জিদানেরও ভালোই লাগলো প্ল্যান। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। দেখতেও মন্দ না। আবির স্যার বলেছিলো, মেয়ে পাইলেই কিসমত ট্রাই করতে। এটার ওপর ট্রাই করা যায়।
প্ল্যান অনুযায়ী শিখা এক ক্লাস শেষ হলেই নূরকে নিয়ে ফেক লটারির ওখানে যায়। আর যথারীতি নূর জিতে ল্যাপটপটা পেয়ে যায়। ল্যাপটপ টা পেয়ে নূর খুব খুশি হয়ে যায়। খুশিতে ল্যাপটপটা বুকের মাঝে চেপে ধরে। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে শীতল হয় আদিত্যর হৃদয়। কবে যে,আদিত্যকেউ এভাবে জড়িয়ে ধরবে নূর সেই অপেক্ষারই প্রহর গুনছে আদিত্য। এই তৃষ্ণার্থ হৃদয়ের পিপাসা সেদিনই মিটবে।
__
–কাজ হয়ে গেছে স্যার। ল্যাপটপ নূর ম্যামের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আর সে বুঝতেও পারেনি এটা আপনি দিয়েছেন।
–হুম জানি। থ্যাংক ইউ জিদান।
ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ হাতে তালির শব্দ পেয়ে সামনে তাকিয়ে চমকে যায় দুজনেই। নূর ভ্যানিটির দরজায় এসে ওদের কথপোকথন শুনে ফেলেছে। অবস্থার প্রগাঢ়তা বুঝতে পেরে জিদান মাথা নিচু করে দ্রুত গতিতে বেড়িয়ে গেল। নূর আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–ওয়াও, কাউকে ছোট করার ট্যালেন্ট কেউ আপনার কাছ থেকে শিখুক। চমৎকার গুণ আপনার।
–নূর তুমি আবারও ভুল বুঝছ আমাকে।তোমাকে ছোট করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। আমি শুধু কোনোভাবে তোমাকে হেল্প করতে চাইছিলাম।
–কেন? কেন হেল্প করবেন আপনি আমার? দুনিয়াতে সার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সাহায্য করে না। আজ আপনিও আমাকে সাহায্য করছেন আপনার সার্থের জন্য। আপনি হয়তো ভাবছেন এসব করে আমার মন জয় করতে পারবেন তাহলে বলে দেই আপনি ভু…..
আদিত্য এবার রেগে গিয়ে বলল,
–শাট আপ নূর,জাস্ট শাট আপ। সিরিয়াসলি নূর? তোমার সত্যিই মনে হয় আমি এতোটা নিচু মনমানসিকতা বহন করি? তোমাকে পাওয়ায় জন্য আমি এসব চিপ ট্রিকস করবো? এতটাই জঘন্য আমি?
–তাহলে কেন করলেন এসব? আপনি কে আমার? আপনি আমার কোনো আপনজন নন যে, আপনি আমাকে এসব এক্সপেন্সিভ জিনিস গিফট করবেন।
আদিত্য নূরের খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ চোখ রেখে মায়াময় কন্ঠে বলল,
–তো বানাও আমাকে আপনজন। কারণ আমার জন্য তো তুমি আমার আপনের চেয়েও আপনজন। একবার তুমিও আমাকে আপন করেই দেখনা।জানি, হয়তো তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা। তবে কথা দিচ্ছি, মনের দরজা খুলে একবার আমার ভালোবাসাকে প্রবেশ করতে দাও। এতোটা ভালোবাসবো যে, নিজের সিদ্ধান্তে কখনো পস্তাতে হবেনা তোমাকে।
আদিত্যর হৃদয় নিংড়ানো কথায় নূরের ভেতরটা অজান্তেই হালকা নড়ে উঠলো। চোখ সরিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বলল।
–বন্ধ করুন আপনার এসব ফিল্মি ডায়লগ। একটা কথা মনে রাখবেন, কথার কথা যদি আপনি আমার প্রেমিকও হতেন তবুও আমি কখনো আপনার কাছ থেকে এমন এক্সপেন্সিভ গিফট গ্রহণ করতাম না। আমার কাছে সবার আগে আমার সেল্ফ রেসপেক্ট।
আদিত্য মনে মনে বলল,
–এইজন্যই তো তোমাকে এতো ভালোবাসি নূর।কারণ তুমি সবথেকে আলাদা,আমার শৈবলিনী।
নূর খনিক দম নিয়ে বলল,
— এনিওয়ে, এখন যখন নিয়েই ফেলেছি তাই জিনিসের অবজ্ঞা করবোনা। কষ্ট করে টাকা ইনকাম করতে হয়। তাই অর্থের মূল্য আমার কাছে অনেক। তবে এভাবে নিতে পারবোনা। এমনিতেও আপনার সাথে কাজ করে যে পেমেন্ট পেতাম তা দিয়ে আমি ল্যাপটপই কিনতে চেয়েছিলাম। তাই যে কয়দিন আপনার কাজ করে দিবো তারজন্য আর আপনাকে কোনো টাকা দিতে হবে না। ল্যাপটপের বদলে সেটা শোধ হয়ে যাবে।
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিত্য। যাক তবুও মেয়েটা ল্যাপটপ তো রেখেছে। ফিরিয়ে দেইনি এটাই অনেক। নূর বলল,
–আজকে মুডটা বিগড়ে গেছে। তাই আজ আর কোনো কাজ করতে পারবোনা। আজ যাই, কাল আসবো।
আদিত্য মলিন মুখে বলল,
–ঠিক আছে।
আদিত্যর এমন লটকানো চেহারা দেখে হঠাৎ কেমন হাসি পেল নূরের। তবে সে হাসি খুব সন্তর্পণে নিজের মাঝেই চাপিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হলো নূর। দরজা পর্যন্ত যেতেই পেছন থেকে ডাক পড়লো আদিত্যর। পেছনে না ফিরেই দাঁড়িয়ে গেল নূর । আদিত্য বলল,
–মানুষের জীবনে বসন্ত তখন আসে যখন প্রকৃতিতে ফুল ফোটে। আমার জীবনে বসন্ত সেদিন আসবে যেদিন তোমার সম্পূর্ণ আগমন ঘটবে। সেদিনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে বসে রবো আমি। বসন্তের বাহার হয়ে একদিন অবশ্যই আসবে তুমি নূর।
ঘাড় ঘুরিয়ে আদিত্যর পানে তাকালো নূর। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–ভুল ভাবছেন।আপনার অপেক্ষার অবসান কখনো হবার নয়। তাই বৃথা চেষ্টা বাদ দিন।
–খেদ নেই তাতে। এই জীবনকালের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তও অপেক্ষা করবো। পরজনম বলতে যদি কিছু থেকে থাকে সেই জনমেও তোমার অপেক্ষায় রবো। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার অপেক্ষাতেও অসীম সুখ আছে।
নূর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
–এসব সস্তা ফিল্মি ডায়লগ শুধু সিনেমাতেই চলে। বাস্তব জীবনে না। বলা যতো সহজ, করাটা ততই কঠিন।
–যাচাই করেই দেখ। দেখ সত্য না মিথ্যা।
–আগুন নিয়ে খেলছেন আপনি। সময় থাকতে শুধরে যান। নাহলে পুড়ে যাবেন।
আদিত্য চোখের নজরে গভীরতা এনে বলল,
–সেই ঘৃণা কেমন ঘৃণা, যা ধ্বংসাত্মক না হয়।
সেই ভালোবাসা কেমন ভালোবাসা,যা মর,ণাত্নক না হয়।
প্রতিত্তোরে যেন কথা হারিয়ে ফেলল নূর। নজর ফিরিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেল সে। এই লোকের মায়াজালে পা দিবে না সে।
চলবে….