শেষটা_সুন্দর পর্ব___১৪
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

ভেড়ানো দরজার পাল্লায় হাত দেওয়ার আগেই নির্ঝরের কানে ধুপধাপ পা ফেলার শব্দ এলো। অদৃশ্য দৃষ্টি দিয়ে সে যেন পেছনের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ দেখতে পেল। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার। দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত সামনে সটান করে অস্ফুটস্বরে বলল,

‘স্টপ দেয়ার!’

নির্ঝরের এক হাত সামনে এসে তরী দাঁড়িয়ে পড়লো। অদ্ভুত কোমল দৃষ্টিতে নির্ঝরের বাড়িয়ে রাখা হাতের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। নির্ঝর হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,

‘লাফালাফি করছো কেন?’

তরীর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। সে যে নির্ঝরকে একটু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তা কি নির্ঝর বুঝে গেছে? বুঝতে পারলে বাঁধা দিচ্ছে কেন? এর একটাই উত্তর। নির্ঝর তাকে ভালোবাসে না। এই অমোঘ সত্যিটা আবিষ্কার করতে পেরে মুহূর্তে তার ভেতরটা বিষাদে ভরে গেল।

দৃষ্টি নত করে বলল,

‘আপনি যান।’

‘আমি এমনিতে যাবো। কিন্তু তুমি ঠান্ডা মাথায় শুনে নাও, আমি যাওয়ার পর নাস্তা করে মনোযোগ দিয়ে দিয়ে পড়তে বসবে।’

তরী শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো। গলার স্বরে কাঠিন্য ঢেলে বলল,

‘ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।’

‘ভাবতে হবে না মানে? আমি যাওয়ার পর আবার লাফালাফি করবে তা তো হতে দেয়া যায় না। তরী, কান খুলে শুনে রাখো। তোমায় ভালো একটা রেজাল্ট করতে হবে। না হলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। ‘

‘আপনি কি আমার রেজাল্ট ধুয়ে পানি খাবেন?’

‘রেজাল্ট ধুয়ে যদি পানি বের হয়, তাহলে আমি সেই পানিও খাবো। কিন্তু তোমাকে রেজাল্ট ভালো করতে হবে মানে করতে হবে!’

নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াল। দরজার ছিটকিনির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ গলার স্বর উঁচু করে বলল,

‘তোমার ন্যুনতম সেন্সটুকু নেই তরী? আমি ঢাকার পাবলিক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সাথে ফরেন অ্যাম্বাসিতে জব করছি। আর তুমি এখন পর্যন্ত কলেজ পাস করে উঠতে পারোনি। বুঝো না তুমি আমাদের মধ্যকার গ্যাপটা?’

এতক্ষণে তরীর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘আপনার পা ধরে ঝুলে পড়েছিলাম যে আমায় বিয়ে করুন?’

‘নাহ! ওটা করোনি তুমি। ওই একটা জায়গা আমার উইক পয়েন্ট। ভেবেছিলাম তোমায় পড়াশোনা শিখিয়ে আমাদের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলবো। কিন্তু তুমি তো তুমিই!’

নির্ঝর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। দরজা সরিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল।

নির্ঝর বের হয়ে যেতেই তরী রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। ফ্লোরে বসে কিছুক্ষণ অঝোর ধারায় কান্না করলো। ভেবেছিল, কোথায় এখন একটু ঘর সংসার করবে! কিন্তু নির্ঝর তো তাকে খোঁটা দিয়ে গেল। সে যে পড়াশোনায়, সবদিক দিয়ে তার থেকে অনেক পিছিয়ে তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। অপমানে তরীর কান্না দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘শয়তান, জাহান্নামী ছেলে! ইন্টারে তোর থেকে ভালো রেজাল্ট না করলে আমি জীবনে ভাত খাব না!’

_____________

অফিস শেষে নির্ঝর বাসায় ফিরলো না। ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। মন ভালো নেই তার! সকালবেলা একটু বেশিই রুডলি ব্যবহার করা হয়েছে তরীর সাথে। তরীর কাছে পার্সোনাল ফোনও দেয়নি যার সাহায্যে খোঁজ নিবে। সকাল থেকে তার মাথার মধ্যে সারাক্ষণ একটা জিনিস ঘুরছে, তরী ঠিক আছে তো? একটা সেকেন্ডের জন্য মেয়েটার ভাবনা থেকে মুক্তি মেলে না!

সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগে। চারিদিকে রঙ বেরঙের আলো জ্বলে উঠেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। সাথে ভ্যাপসা গরম। নির্ঝর শার্টের ইন খুলে ফেলল। হাতা ফোল্ড করে বুকের কাছে দুটো বাটন খুলে দিল। মাথার চুলগুলো একবার নেড়েচেড়ে আবার হাঁটায় মনোযোগ দিল।

হেঁটে অফিস থেকে একটু দূরের কফিশপে ঢুকলো সে। ক্লান্ত শরীর ও মন! দুটোই একটু সামলে নেওয়া দরকার। সামনের কয়েক টেবিল অতিক্রম করতে কর্ণারের দিকে একটা টেবিলে চোখ গেল তার। মোটামুটি স্বাস্থ্যের একটা মেয়ে বসে আছে। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বের হতে হবে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোতে মেয়েলি একটা সুর তার নাম ধরে ডেকে উঠলো। চোখ বন্ধ করে মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। জোরপূর্বক গম্ভীর মুখে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল।

মেয়েটি অত্যন্ত খুশি হয়ে হাত নেড়ে বলল,

‘হাই নির্ঝর! হোয়াট অা প্লেসেন্ট সারপ্রাইজ!’

নির্ঝর তেমন আগ্রহ পেল না। মেয়েটি তার অফিসে কাজ করে। টিকেট ম্যানেজিং অফিসার! একটু গায়ে পড়া স্বভাবের! একটু নয়, অনেক বেশি। এই যে আকস্মিক দেখা হওয়ার মতো বিব্রত অবস্থাটা মেয়েটির জন্য প্লেসেন্ট সারপ্রাইজ হলেও তার জন্য সেটা মোটেও প্লেসেন্ট না! চেয়ার টেনে বসে পড়লো নির্ঝর। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘হ্যালো মিস……. ‘

‘তাসপিয়া! তাসপিয়া নাম আমার। ভুলে গেছেন?’

‘মনে রাখিনি কোনোদিন। ভোলার প্রশ্নই আসে না!’

নির্ঝরের গা ছাড়া কথায় তাসপিয়ার মুখ কালো হয়ে গেল। নির্ঝরের এমন আচরণের সাথে পূর্ব পরিচিত বলে তেমন গায়ে মাখলো না। কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,

‘কিছু অর্ডার করুন!’

‘তার প্রয়োজন হবে না। আমাকে উঠতে হবে এখন মিস। আমার বউ অনবরত ফোন করছে।’

‘বউ? আপনি বিয়ে করেছেন?’

‘এত অবাক হচ্ছেন কেন? আমি কি বিয়ে করতে পারি না? আমাকে কি ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হয়? আমার উপর কি বিয়ে নাজায়েজ? নাকি ভেবেছিলেন আমি কখনো বউ পাবো না?’

নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। তাসপিয়া অগোছালো দৃষ্টি মেলে কোনোরকমে বলল,

‘আপনি বিয়ে করেছেন অফিসের কাউকে জানাননি কেন?’

‘অফিসে জয়েন করার সময় তো কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ হইনি যে আমি বিয়ে করলে সবাইকে জানাতে হবে! ভালো থাকেন মিস। আমি যাই এখন। বুঝতেই পারছেন, বউকে যমের মতো ভয় পাই। ছেলে হলে আমার ব্যাপারটা বুঝতেন। আসি!’

নির্ঝর হাত নেড়ে তাসপিয়ার থেকে বিদায় নিল। বড় বড় পা ফেলে কফিশপের বাইরে এলো। কিছুদূর এগিয়ে রিকশায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ফোনের লক প্যাটার্ন খুলতে তরীর ঘুমন্ত মুখের ছবি ভেসে উঠলো। ছবিটা জীবন ভাইয়ার বিয়ের আগের রাতে লুকিয়ে তুলেছিল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো জুম করা ছবিটির দিকে। এই একটা মুখ! এই একটা মুখ দেখে কখনো ক্লান্তি আসে না। বার বার, হাজারবার, প্রতিটা সেকেন্ড দেখতে ইচ্ছে করে।

নির্ঝর বাসায় ফিরলো রাত নয়টার পর। ডোর বেল বাজাতে দরজা খুললেন তার মা। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,

‘আজ এতো দেরি করলি কেন?’

‘ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছিল মা। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল। ভাত দাও তো মা এখন।’

শুধু হাতটা ধুয়ে ডাইনিং এ বসে পড়লো নির্ঝর। এক ফাঁকে জেনে নিল সবার ডিনার শেষ। তার মানে তরীও খেয়েছে। আড়চোখে সে বার কয়েক নিজের রুমের দিকে তাকালো।

খাবার বেড়ে দিতে দিতে নাহিদা বেগম বললেন,

‘তরীকে বকাঝকা করেছিস পড়ার জন্য?’

‘হাউ ফানি! বকাঝকা করবো কেন?’

‘আরে আজ সারাটা দিন বই নিয়ে বসে আছে।কিছুতেই বই রেখে দিবে না। জোর করে সময় মতো খাইয়েছি। মানে পড়ার জন্য একেবারে জান দিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। সত্যি করে বলতো নির্ঝর। বকাঝকা করিসনি তো?’

নির্ঝরের ভেতরটা পুলকে ভরে গেল। তরী পড়াশোনা করছে ভেবে কিছুটা স্বস্তি মিলল। আয়েশ করে ভাতের লোকমা মুখে পুড়ে খেল। স্মিত হেসে বলল,

‘আমি কিছুই বলিনি মা। হয়তো সুমতি ফিরেছে।’

‘চুপচাপ খা এখন। তোর বাবাকে গরম পানি দিয়ে আসি। আর তরীকে পড়াশোনার জন্য ধমকা-ধামকি করবি না। মনে থাকে যেন!’

‘ঠিক আছে।মনে থাকবে মা!’

খাওয়া শেষে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে রুমে ঢুকলো নির্ঝর। নিঃশব্দে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। রুমের পরিবেশ শোকতপ্ত আকাশের মতো বিষণ্ণ। নির্মল চোখ মেলে সে বিছানার দিকে তাকালো। সারা বিছানাময় বই, খাতা, নোটস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে তরী পড়ছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা মুখস্থ করছে। দিনশেষে তরীর মুখ দেখে মনে শান্তি ফিরে পেল। সে নিঃশব্দে তরীর দিকে এগিয়ে গেল। তরীর সামনে দিয়ে বার কয়েক পায়চারি করলো। তরী চোখ তুলে তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত!

বাধ্য হয়ে নির্ঝর আলমারি থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মিনিট পাঁচেকের ভেতর সে শুধু হাতে মুখে পানি দিয়ে বের হলো। টিশার্টের বুকের উপরের বোতামটা লাগিয়ে সে আবার তরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘বসার জন্য একটু জায়গা চাই আমার।’

তরী কোনো প্রতিত্তর করলো না। কয়েকটা বই খাতা সরিয়ে নির্ঝরের বসার মতো জায়গা বের করলো। নির্ঝর তার মুখ বরাবর বসে পড়তে তরী কয়েকটা খাতা তার দিকে এগিয়ে দিল। নির্ঝরের দিকে তাকালো না। আগের থেকে বেশি মাথা নিচু করে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিল।

নির্ঝর খাতাগুলো হাতে তুলে দেখলো এগুলো হোমওয়ার্ক। ইংরেজি গ্রামারের উপর অনেকগুলো প্রশ্ন সে করতে দিয়েছিল সেগুলো। খাতা থেকে চোখ সরিয়ে সে গভীর মনোযোগে তরীর দিকে তাকালো। কোমল স্বরে ডাক দিল,

‘তরী?’

তরী পূর্বের ন্যায় কোনো উত্তর দিল না। আলাদা খাতায় কিছু লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তরীর এই নিস্পৃহ ভাব নির্ঝর নিতে পারলো না। আরো দুবার ডাকলো। কিন্তু তরী যেন মিউট হয়ে গেছে। তরীর নিরব আঘাতে বুকের ভেতর পুড়ে উঠলো তার। সাথে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে। মনে মনে বলল,

‘এত তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিলে তরীরানি? আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারলে না? অথচ আমায় দেখো! সাত-সাতটা বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। শুধু তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি। তোমার মুখে ভালোবাসি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি। তোমার অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক জেনেও মুখ ঘুরিয়ে নেইনি। আর তুমি আমার একটুখানি ধমকে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছো না! আমায় এক পলকের জন্য দেখছো না? এত সহজে বিমুখ হয়ে রইলে? আমারও তো কষ্ট হয়!’

বুকের অতলে বিষণ্ণতার প্রচ্ছন্ন একটা রেশ থাকলেও সে নিটোল বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,

‘লেখালেখি বাদ দাও তরী! আর পড়তে হবে না আজ। ঘুমিয়ে পড়ো।’

তরীর মধ্যে ঘুমানোর কোনো ব্যস্ততা দেখা গেল না। আগের মতো নির্বিকার ভাবে খাতায় লিখতে লাগলো। নির্ঝরের ভেতরটা বিষাদে ছেয়ে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে তরী আজ অন্তত পড়া ছেড়ে উঠবে না। অথচ তরীর মুখটা কেমন শুকনো শুকনো। ঘুমিয়ে পড়া উচিত এখন। সে কালবিলম্ব না করে সামনের দিকে এগিয়ে এলো একটু। খপ করে শক্ত হাতে তরীর চলমান হাতটা ধরে বলল,

‘বারণ করেছি না? আর পড়তে হবে না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো!’

(চলবে)

আমি কিন্তু আপনাদের সবার মন্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়ি। ভালোবাসা সবার প্রতি।🤎

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here