শেষটা_সুন্দর পর্ব___০৯
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
তরী ওয়াশরুমের দরজা অল্প একটু সরিয়ে বাইরে উঁকি দিল। চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো, নির্ঝর রুমে নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে ভেজা কাপড়ে বাইরে বের হলো। কাপড়ের ব্যাগটা চোখে পড়ছে না। উপরে উঠার সময় নির্ঝর ব্যাগটা হাতে নিয়েছিল। কোথায় রেখেছে কে জানে!
সে ভেজা কাপড়ে সম্পূর্ণ রুম হেঁটে হেঁটে নিজের ব্যাগটা খুঁজলো। না পেয়ে অাধ খোলা আলমারির দিকে এগোল। আলমারির পাল্লা সরাতে তার বিগত বছরগুলোর ড্রেস চোখে পড়লো। একটা তাকে তার কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখা। ব্যাগটা আশপাশে নেই! তরী অবাক হলো না। সে অবাক হওয়ার মুডে নেই। মাথার মধ্যে এখনো ঘুরছে কিছুক্ষণ আগে করা নির্ঝরের কাজটি। সে আনমনে একবার ডান হাতটা ঘাড়ে বুলাল।
কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে খুব দ্রুত একটা থ্রি পিস হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
ভেজা কাপড়গুলো ধুয়ে বালতিতে রাখতে বাইরে থেকে ধাড়াম করে কিছু পড়ার আওয়াজ কানে এলো তরীর। সেই সাথে নির্ঝরের ব্যথাতুর কন্ঠের আর্তনাদ। চমকে উঠলো সে। দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা খুলে সামনে তাকাতে চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো। নির্ঝর চিৎপটাং হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। চোখ মুখ কুঁচকে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে!
সে এক দৌঁড়ে এগিয়ে গেল। ঝুঁকে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালো। নিজের হাসি চেপে রেখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি এভাবে ফ্লোরে শুয়ে আছেন কেন?’
নির্ঝর ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া চোখ মেলে তরীর দিকে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘ফ্লোরে ভিটামিন-ই আছে। যেটা মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। সেজন্য শুয়ে আছি। কোনো সমস্যা?’
‘না। সমস্যা থাকবে কেন?’
‘ঘাড়ত্যাড়া ডিঙি, তোমার মস্তিষ্ক সুবিধার না! আমার পাশে শুয়ে ভিটামিন-ই শোষণ করো।’
‘ আমার কোনো ভিটামিন ফিটামিন দরকার নেই। আপনি শুয়ে থাকুন।’
নির্ঝর ঠাস করে উত্তর দিল,
‘দরকার আছে! তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা। তোমার মস্তিষ্ক ভিটামিনজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। ফ্লোর এভাবে ভিজিয়ে রেখেছ কেন?’
তরী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিনি। সেজন্য ভেজা কাপড়ে রুমে ঢুকেছিলাম। সহজে খুঁজে না পেয়ে রুমে বার কয়েক চক্কর দিতে হয়েছে।’
‘মহান কাজ করেছ। তা আমাকে আগেভাগে অবগত না করার জন্য ধন্যবাদ। আগে থেকে সতর্ক হলে ভিটামিন শোষণ করতে পারতাম না।’
‘আজ থেকে নিয়মিত ফ্লোর ভিজিয়ে রাখবো তাহলে। কি বলেন?’
নির্ঝর কিছু বলল না। দূর্বল শরীর নিয়ে দু হাত ফ্লোরে শক্ত করে চেপে উঠার চেষ্টা করলো। এ কি তার কপালে জুটলো? দেখা হওয়ার পর থেকে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে। ব্যথা দিয়ে যাচ্ছে। কোথায় এখন একটু….. তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল।
খুব শীঘ্রই সে মুখটা থমথমে করে ফেলল। ফ্লোর থেকে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে দেখে তরী হাত বাড়িয়ে বলল,
‘আমি কি একটু ধরবো? হাত? মানে সাহায্য করবো?’
‘না! তুমি সাংঘাতিক। কেমিস্ট্রি ল্যাবে যেমন তেজস্ক্রিয় পদার্থ গুলোর সংরক্ষণের বোতলে বিভিন্ন সাংঘাতিক চিহ্ন দিয়ে তার ক্ষতিকারক সম্পর্কে অবগত করে রাখা হয়, তোমারও তেমনি কপালে সিলমোহর করে দেওয়া উচিত “বিপদজনক ও সাংঘাতিক! দূরে থাকুন!” বুঝতে পেরেছ?’
‘তো দূরে থাকেন না? বাঁধা দিয়েছে কে?’
‘দূরেই তো রয়েছি। আমার দূরে থাকা তো তোমার সহ্য হচ্ছে না। সেজন্য ফ্লোরে পানি ঢেলে রেখেছ। ‘
‘আপনার চোখ কোথায় থাকে? মেয়েদের গলা, ঘাড় খুঁজে বেড়ায় সবসময়?’
বিড়বিড় করে বলে তরী সরে আসলো। নির্ঝর ততক্ষণে বসে পড়েছে। সে ফ্লোরে দু হাত রেখে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানার কাছে আসলো। কোনোরকমে বিছানায় উঠে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। তাকে একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ভেজা চুলগুলো ছেড়ে তরী বেলকনি থেকে বের হলো। নির্ঝর চোখের উপর হাত রেখে আঙুলের ফোঁকর দিয়ে তরীর দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। রোজ স্বপ্নে দেখা মেয়েটা এভাবে তার রুমে, তার চোখের সামনে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেমন বিশ্বাস হতে চায় না। এই গত পরশু রাতে যখন লুকিয়ে ছবি তুলেছিল তখন কত ভয় ছিল বুকের ভেতর। একটু ছুঁয়ে দিতে গিয়ে কতবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কত হাজার বার আবার এগিয়ে গিয়েছে। অথচ মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটা তার বউ হয়ে গেল। তার অর্ধাঙ্গিনী! ঠিক অর্ধাঙ্গিনী নয়। সম্পূর্ণাঙ্গিনী!
তরী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একবার একবার পেছন ঘুরে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝর সঙ্গে সঙ্গে দু চোখ বন্ধ করে ফেলল। একটুপর চোখ খুলে দেখলো তরী আয়নার সামনে বসে পড়েছে। মাথার চুলে খুব মনোযোগ দিয়ে সিঁথি তুলছে।
নির্ঝর কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে সে দৃশ্য দেখলো। সচকিত হতে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘নৌকা! রাতে ঘুম হয়নি তোমার। আমার পাশে এসে ঘুমিয়ে পরো।’
তরী চট করে বলল,
‘না!’
‘তোমার কথার মধ্যে এত নেগেটিভি ছড়াও কেন? সবসময় শুধু না না না! একটু পজিটিভ মাইন্ডেড হতে পারো না?’
তরী কিছু বলল না। নির্ঝর একটা হাই তুলে পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ দিল। কঠোর গলায় বলল,
‘নো মোর টক। পাশে এসে শুয়ে পড়ো। ও হ্যাঁ!খবরদার। ঘুমের ঘোরে কিন্তু “হায় আশিক, হায় আশিক” অর “হায় বাটন ফোন, হায় বাটন ফোন” করতে পারবে না। আমি কিন্তু এসব টলারেট করতে পারবো না। ‘
নির্ঝরের আর কোনো কথা তরীর কানে এলো না। সে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ নির্ঝরের পিঠের দিকে চেয়ে রইলো। তার সবকিছু এখনো কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের কোনো স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে অল্প সময়কে অনেক দীর্ঘ মনে হয় বলে এ স্বপ্নটা ভাঙছে না। অনেক বড় স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কিন্তু তার অপর মন জানে এটা স্বপ্ন নয়। এই যে এতকিছু ঘটলো, ঘটছে সব বাস্তব।
সে আয়নার সামনে থেকে উঠে পরলো। আরেক নজর নির্ঝরের দিকে চেয়ে রুমের বাইরে পা রাখলো।
___________
তরীর ঘুম হালকা হতে পাশ ফিরতে নিল। পারলো না। নিজেকে কারো বাহু বন্ধনে আবদ্ধ মনে হলো। মস্তিষ্কের থ্যালামাস কাজ করতে তড়িৎ গতিতে চোখ খুলল সে। চোখ খুলতে নির্ঝরের ঘুমন্ত মুখের প্রতিচ্ছবি দৃষ্টিপটে ভেসে উঠলো। তাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। তরীর গা গুলিয়ে উঠলো। সে তো ড্রয়িং রুমের সোফায় ঘুমিয়ে ছিল। নির্ঝরের বিছানায় এলো কি করে?
নির্ঝরের গরম নিঃশ্বাস তরীর কপালের কাছটাতে আছড়ে পরছে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। ভেতরে রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে যেতে শুকনো ঢোক গিলল। তারপর খুব সাবধানে পিঠের কাছে জড়িয়ে রাখা নির্ঝরের হাতটা সরাল তরী। আস্তে করে উঠে বিছানা ছেড়ে নামলো। নির্ঝরের পিঠের নিচে থাকা ওড়নাটা একটু একটু করে টেনে বের করে গায়ে জড়ালো। কয়েক পা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার পেছন ফিরে এলো। নির্ঝরের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে তার প্রথম বারের মতো মনে ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল, ততটা খারাপ নয়।
রান্নাঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। তরী সরে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। ধবধবে সাদা একটা বিড়াল ইতিউতি করছে। তাকে দেখে দীর্ঘক্ষণ নীল চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো।
তরী মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘কাছে আয়!’
বিড়ালটা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তরী ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরতে নিতে এক লাফে রান্নাঘরের খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ডেকচিতে গরম পানি তুলে দিল। চা বানাবে! তার গ্রামের বাড়ির মোড়ে মজনু চাচা চা বিক্রি করতো। ছোট্ট খুপড়ির মতো দোকান ছিল। কি ভালো চা বানাত মজনু চাচা! চায়ের উপর দুধের সর ভাসতো সবসময়। আবার কবে না কবে মজনু চাচার হাতের চা খেতে পারবে ভেবে তরীর মন খারাপ হয়ে গেল।
____________
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তরীর আশিকের কথা মনে পড়লো। আশিকের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কলেজে যাওয়ার চতুর্থ দিনে। তার ক্লাসের ক্যাপ্টেন বড় ভাইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। হুট করে আশিককে সে দেখতে পায়। আশিকের চেহারায় একটা বাচ্চামো ছিল যা দেখে তরী ভেবেছিল ছেলেটা হয়তো তাদের ক্লাসের। সেজন্য সে সালাম দেয়নি। পরক্ষণে তাকে এক বড় ভাই ধমক দিয়েছিল, সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও সালাম কেন দিল না। তারপর সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সালাম দিয়েছিল। প্রথম দিনই আশিকের তার প্রতি তাকানো অদ্ভুত দৃষ্টি লক্ষ্য করেছিল সে। এরপর মাঝে মধ্যে কলেজে দেখা হতো। মাস তিনেক আগে তাকে প্রোপোজ করতে সে রাজি হয়ে যায়। আশিকের কোনো কিছুতে তার কখনো সন্দেহ জন্মেনি। অথচ কেন যে ছেলেটা তাকে বিয়ে করতে এলো না কে জানে! তরীর চোখের কোণে পানি জমে উঠলো।
পেটে হালকা ক্ষুধার অস্তিত্ব টের পেতে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে দুটো খেল সে। সাথে চায়ের কাপ খালি করার পর নির্ঝরের কথা মনে হলো। সে তো বাড়িতে একা নয়। আরো একটা মানুষ আছে। অথচ ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেছে।
বাড়তি চা টুকু কাপে ঢেলে রুমে ঢুকলো তরী। নির্ঝর মাথা কাত করে শুয়ে আছে। স্টিচের জায়গায় ব্যান্ডেজ খুলে যাওয়ার মতো হয়েছে। সে চায়ের কাপ বিছানার কাছের সেন্টার টেবিলে রেখে ব্যান্ডেজে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর মুখটা ঘুরাল। তরী আহত স্বরে বলল,
‘মাথার ওষুধ খাচ্ছেন না আপনি?’
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নির্ঝর ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
‘হুঁ! গতকালের সব মেডিসিন তো বড় মায়ের বাসায় রেখে এসেছি। এখানে ব্যথার আর জ্বরের যে মেডিসিন গুলো ছিল সেগুলো খেয়েছি।’
‘ব্যান্ডেজ খুলে যাচ্ছে।’
‘খুলবে না? যা দৌঁড়ানি খাইয়েছ আমায়! আমার ছাব্বিশ বছর বয়সের সব হাঁটার দূরত্ব একত্রে করলেও এত হবে না।’
‘আপনি ডাক্তারের কাছে যান। ‘
তরীর কন্ঠস্বরে কেমন অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। নিজের অজান্তে নির্ঝর হেসে ফেলল। বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপে নিয়ে তাকে চুমুক দিল। মুখ তুলে তরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও তো! আমার সাথে হসপিটালে যাবে। ‘
(চলবে)
আসসালামু আলাইকুম। এতদিন গল্প না দেওয়ার জন্য দুঃখীত। আগামী তিনদিন দু পর্ব করে দিয়ে পুষিয়ে দিবো। আজ রাতে বোনাস পার্ট পাচ্ছেন ইনশাআল্লাহ। 🤎