শেষটা_সুন্দর পর্ব____২৯
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
‘নির্ঝর রে! তরী! তরীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই দুপুরবেলা পরীক্ষা দিয়ে আর ফেরেনি।’
মমতাজ বেগমের উদ্বিগ্ন স্বরের কথাটা কর্ণকূহরে প্রবেশ করতে কপাল কুঁচকে গেল নির্ঝরের। কয়েক সেকেন্ড লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের কোথাও ভাঙন শুরু হলো। একের পর এক বর্শাঘাতে জর্জরিত হয়ে গেল যেন! আতংকে হাত পা অবশ হয়ে এলো। নিজের আত্মার ভেতরে অসহ্য দম বন্ধ করা অনুভূতি। ভেতরে এলোমেলো হয়ে গেল। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠতে সে ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়লো।
মমতাজ বেগমের গালে শুষ্ক পানির রেখা। তিনি নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। তরীর বাবা-মা কান্নাকাটি শুরু করেছে। সবাই ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় অন্তত একজনকে শক্ত থাকতে হবে। কঠোর হতে হবে। তরীকে খোঁজার সব পথ অবলম্বন করতে হবে। তিনি লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নির্ঝরের সামনে বসে পড়লেন। নির্ঝরের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললেন,
‘নির্ঝর এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তরীকে খুঁজতে হবে।’
নির্ঝর লাল লাল চোখে মমতাজ বেগমের দিকে তাকালো। রক্তলাল চোখ দুটো সিক্ত হয়ে উঠেছে। চোখের কোণে পানি জমেছে। সেই সাথে জমেছে কাউকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয়। নির্ঝর ভাঙ্গন ধরা হৃদয় সামলে কিছু বলার চেষ্টা করলো। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে বের হলো,
‘তরী! তর….’
মমতাজ বেগম নির্ঝরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চেঁচিয়ে কাজের লোককে পানি আনতে বললেন। পরক্ষণে সান্ত্বনার সুরে বললেন,
‘নির্ঝর। বাবা, এত ভেঙে পড়ে না। আমি বলছি তরীর কিছু হবে না। ওকে আমরা ঠিকঠাক খুঁজে বের করবো।’
‘বড় মা! আ-আমায় আগে থেকে বলেননি কেন?’
‘আগে বলবো কিভাবে? তুই তো রাস্তায় ছিলি। তাড়াহুড়ো করে আসতে নিয়ে অারেক অঘটন ঘটিয়ে ফেলতি।’
‘বড় মা তরী…….’
নির্ঝর দু হাতে মাথা চেপে ধরলো। অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকালো। তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মন দরজায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। তরী ঠিক আছে তো? সেই দুপুর বেলা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার পর অলরেডি ছয়-সাত ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এতক্ষণ তরী কি অবস্থায় আছে, কোথায় আছে চিন্তা করে পাগলপ্রায় অবস্থা। সে মাথার চুল টেনে ধরলো একের পর এক! দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। মমতাজ বেগমের দিকে চেয়ে বলল,
‘বড় মা! আমি তরীকে খুঁজতে বের হচ্ছি। ইমিডিয়েটলি তরীকে খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে বড় মা।’
‘মোটামুটি সব জায়গা খোঁজা শেষ। কোনো আত্মীয় বাড়ি বাদ রাখিনি। আশপাশের সব জায়গায় খুঁজেছি। কোথায় খুঁজবি তুই?’
‘জানি না! শুধু জানি তরীকে খুঁজে বের করতে হবে। ও খুব কষ্টে আছে বড় মা। আমি আসছি!’
নির্ঝর উঠতে নিতে মমতাজ বেগম কাঁধ চেপে ধরে পুনরায় বসিয়ে দিলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়েসী মহিলার কাছে থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে নির্ঝরের সামনে ধরলেন। মমতা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
‘পানিটুকু খা। আর ধীরে সুস্থে যা।’
নির্ঝর পানির গ্লাস ধরলো না। মমতাজ বেগমকে ঠেলে সরিয়ে দৌঁড়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। নির্ঝর বের হয়ে যেতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মেয়েটা কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে!
____________
মধ্যরাত! কালো রঙের গাড়িটা ব্রিজের মাঝ বরাবর থামলো। হেডলাইটের আলো নিভিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো নির্ঝর। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে ব্রিজের সামনে দাঁড়ালো। তাকে অস্থির দেখাচ্ছে। ভেতরটা হাহাকারে পরিপূর্ণ। তরীকে সারা সিলেট তন্নতন্ন করে খুঁজেও সে পায়নি। আস্তে ধীরে সে নির্জন রাস্তায় বসে পড়লো।
নিশুতি রাতে আকাশে রূপালি চাঁদ খলখলিয়ে হাসছে। তার সে হাসির আলোয় পুরো পৃথিবী ভেসে চলেছে। ফকফকে জোসনা চারিদিকে। কূটোটি পর্যন্ত স্পষ্ট চোখে পড়ছে। অথচ এই জোসনার এত আলোয় নির্ঝর জলজ্যান্ত মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজে পাচ্ছে না তার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীকে! তার শ্বাস প্রশ্বাসকে।
নিজেকে কঠোর রাখার করুণ প্রয়াসের কাছে হার মানলো সে। এতক্ষণ নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেও আর পারলো না। অস্পষ্ট থাবাগুলো ভেতরে ভেতরে তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে। তীক্ষ্ণ ছুরির মতো ফালাফালা করে দিচ্ছে। সে আর সহ্য করতে পারলো না। বাচ্চাদের মতো দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। এত কষ্ট হচ্ছে কেন বুকের ভেতর?
নিস্তব্ধ রজনী ক্রমেই গম্ভীর হয়ে উঠছে। না পাওয়ার বেদনা আর হাহাকারে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। এতক্ষণ খলখলিয়ে হাসতে থাকা চাঁদও যেন লজ্জা পেয়েছে। দুঃখ পেয়েছে। তার আলো কমে আসছে। চারিদিকে বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। শব্দহীন পরিবেশে শুধু নির্ঝরের আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হৃদয় উগ্লে কান্না করার শব্দ বের যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ পর আস্তে আস্তে নির্ঝরের কান্নার বেগ কমে এলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলার কাছের ডেলাটা যেন প্রবল আগ্রাসী হয়ে শ্বাস নেওয়ার পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে। সে মুখ অল্প হাঁ করে টেনে টেনে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ।
একটু স্বাভাবিক হতে সে উঠে দাঁড়ালো। গাড়ির কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। পাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে বুঝতে পারলো তরীর ব্যাপারে কেউ কোনো খোঁজ জানায়নি! ফোনের লক প্যাটার্ন খুলে সে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। একের পর এক তরীর ছবি স্ক্রল করতে থাকলো। তরীর ছবির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বুকের ঝড়টা আরো বেসামাল হয়ে পড়লো। অশান্ত হৃদয় আরো একবার ভেঙে চূড়ে টুকরো টুকরো হতে থাকলো। বুকের পাড় ভেঙে মন নদীতে গুড়িয়ে গেল যেন। সে আর সহ্য করত না পেরে ধাম করে ফোনটা চোখের সামনে থেকে সরাল।
নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। ভেতরটা শূন্য। মনে হচ্ছে এত বড়ো ধরায় তার পাশে কেউ নেই। সুনশান, নির্জন রাস্তাঘাট যেন তাকে নিয়ে উপহাস করছে। উপহাস করছে প্রকৃতি। এরা কি জানে সে তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে ফেলেছে? তার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত সব যাকে ঘিরে সেই মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছে?
কিছু সময় পর সরে আসতে নিতে গাড়ির ভেতর সাজিয়ে রাখা গোলাপগুলোর দিকে চোখ পড়লো। মুহূর্তে পুনরায় তার চোখের কোণ জলে ছেয়ে খেল। তীব্র হাহাকারে ভেতরটা কেঁদে উঠলো। সে প্রায় হুমড়ি খেয়ে গোলাপ গুলো দুহাতে নিল। গোলাপগুলো শুকিয়ে গেছে। বর্ণ নেই, গন্ধ নেই! তার মতো দুঃখে জর্জরিত মনে হচ্ছে।
গোলাপগুচ্ছ হাতে সে ব্রিজের কিনারে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাকাতে শ্যাওলা জমা সবুজ জল নজরে এলো। চাঁদের আলো পড়ে ঝিকঝিক করছে। সেই পানির দিকে কয়েক মিনিটের জন্য চেয়ে রইলো সে। তারপর হাতের ফুলগুলো ফেলে দিল। বাতাসের উর্ধ্বমুখী বেগের সাথে যুদ্ধ করে খুব দ্রুত সেগুলো পানিতে পৌঁছাল। ঝুপ করে পানিতে পড়ার শব্দ কানে এলো। ক্ষণিকের জন্য তার মনে হলো ফুলের সাথে সাথে নিজেও পানিতে ঝাপ দিলে কেমন হয়? পরক্ষণে নিজেই নিজেকে বকা দিল। তার অনেক কাজ সামনে। তরীকে খুঁজে বের করতে হবে। তরীর দুঃখ ঘোচাতে হবে। তরীকে বিপদ মুক্ত করতে হবে। কিন্তু কোথায় খুঁজবে তরীকে?
ফোন বাজার শব্দ কানে এলো নির্ঝরের। দ্রুত পকেট হাতড়ে ফোন হাতে নিল। রিসিভ করে হন্তদন্ত কন্ঠে বলল,
‘হ্যালো!’
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বলছে,
‘থানায় মিসিং কেস ফাইল করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে পুলিশ খোঁজা শুরু করবে।’
নির্ঝর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ নির্গত করতে পারলো না। তার বুকের উত্তাপ কি কেউ টের পাচ্ছে? তরী কি ফিল করছে না যে তার জন্য একজন পুড়ে পুড়ে অলরেডি ভস্ম হয়ে গেছে? আর কত পুড়াবে? ঠিক আর কত পুড়লে সে তরীকে পাশে নিয়ে একটা দীর্ঘস্থায়ী বসন্তের স্বপ্ন বুনতে পারবে। একটা দীর্ঘস্থায়ী বসন্ত একত্রে কাটাতে পারবে। আর কত পুড়লে? আর কত পুড়লে শুধু তরীকে পাশে পাবে? কত পুড়লে?
নির্ঝরকে নিরব দেখে ফোনের ওপাশ থেকে ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো,
‘খবর নিয়ে জানতে পারলাম আশিক ঢাকাতে। কখন বা কবে গেছে সে বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি।’
‘ঢাকার কোথায় আছে?’
‘গুলশানে।’
‘আমি আজ রাতেই ঢাকা যাচ্ছি।’
বলে নির্ঝর ফোন কেটে দিল। গাড়িতে উঠার আগে সে ফোন টিপে ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠাল বড় মায়ের ফোনে। তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িতে বসার পর একবারের জন্য তার মনে পড়লো সারাদিন, সারারাত কিছুই পেটে পড়েনি তার! পরক্ষণে ক্ষুধা ছাপিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘কোথায় তুমি তরীরাণী? প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। না হলে তোমার কাছে আমায় নিয়ে যাও। প্লিজ!’
সাই করে কালো রঙের গাড়িটা উল্টো পথে চলা শুরু করলো। পেছনে ফেলে গেল কিছু স্মৃতি, কয়েক ফোঁটা চোখের জল আর কিছু আহাজারি। গাড়িটা অদৃশ্য হতে জোৎস্না স্নান করা প্রকৃতি যেন বিলাপ করে বলা শুরু করলো,
‘তুমি যাকে ভেঙে চূড়ে ভালোবাসবে সে-ই তোমার কাছে থাকবে না। হয়তো নিজে থেকে সরে যাবে, না হলে প্রকৃতি দায়িত্ব নিয়ে দূরে সরিয়ে দিবে।’
__________
তরী ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। মস্তিষ্ক সচল। কিন্তু হাত-পা নাড়াতে পারছে না। কিছু সময় পর বুঝতে পারলো সে শুধু হাত-পা নয়, সমস্ত শরীর নাড়াতে পারছে না। প্যারালাইজড্ হয়ে গেছে সে। বুঝতে পারছে যতদিন বেঁচে থাকবে আর কোনোদিন সে হাঁটতে পারবে না, চলতে পারবে না,শরীর নাড়াতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। বুক কেঁপে উঠলো তার। চোখ ফেটে অশ্রু বের হয়ে কানের পৌঁছাল। তবুও সে চোখ খুলতে পারছে না। প্রাণপণ চেষ্টা করেও হাত নাড়াতে পারছে না। এক পর্যায়ে চিৎকার দিতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার কন্ঠনালি কেউ কেটে নিয়েছে। সে আর কোনোদিন উঁহু, আঁহা করতে পারবে না। ব্যথা পেলে গলা ছেড়ে কাঁদতে পারবে না। ভয়ে, আতংকে আচমকা চোখ খুলল তরী!
তার চোখের সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। এতটা অন্ধকার যে চোখ খুলেও মনে হচ্ছে সে চোখ বন্ধ করে আছে। মাথাটা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। শরীর ব্যথায় টনটন করছে। মাথার পেছনের অংশে চিনচিনে ব্যথা। সে ডান হাতটা সেখানে স্পর্শ করতে চমকে উঠলো। দ্রুত পা নাড়ালো। দুই হাত চোখের সামনে মেলে ধরলো। তার মানে সে প্যারালাইজড্ হয়ে যায়নি। হাত-পা নাড়তে পারছে। মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার।
খুব দ্রুত হাসি মিলিয়ে গেল।দূর্বল, ব্যথাতুর শরীর টেনে অতি কষ্টে উঠে বসলো সে। মাথা চেপে ধরে সব মনে করার চেষ্টা করলো। শুধু এটুকু মনে পড়ছে যে সে তার কলেজের একটা রুমে ছিল আশিকের সাথে। কিন্তু অন্ধকার হলেও টের পেল এটা ক্লাসরুম নয়। তাহলে কোথায় সে এখন? আশিক তাকে কোথায় বন্দী করে রেখেছে?
পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তার। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার তীব্রতা টের পেল। সেই সাথে পানি পিপাসার। পেটে হাত দিয়ে চমকে উঠলো সে। ক্ষুধার মাত্রা অনুযায়ী সে একবেলা না খেয়ে নয়, মিনিমাম দুই বা তিনদিন ধরে অভুক্ত সে। কত সময় কেটে গেছে এর মধ্যে? নির্ঝর কি তার খোঁজ করছে না? করলে তার কাছ অবধি পৌঁছাচ্ছে না কেন? নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল সে।
দরজা খোলার শব্দে দূর্বল শরীর নিয়ে সে সে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। বিস্ফারিত নয়নে লক্ষ্য করলো অন্ধকার রুমে পুরুষ অবয়ব!
(চলবে….)