#শেষ_শ্রাবণ
পর্বঃ৫ (অন্তিম পর্ব)
শ্রাবণ এখন সারাদিন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে আর মা মা বলে চিৎকার করে। সোহেলী যতোই বলে,”শ্রাবণ মা নয় ভাবী মা বলো।” শ্রাবণ ততই মা বলে ডাকে। সোহেলী কপট রাগ দেখায় তখন আর শ্রাবণ হাসতে থাকে। আমি দুই ভাইবোনের কাণ্ড দেখে হাসি। ওরা সবসময় আমার মন ভালো রাখার চেষ্টা করে। বাবাও বাদ যান না। যখনই মন খারাপ করে একা একা বসে থাকি শ্রাবণকে কোলে নিয়ে বাবা বাইরে চলে যান। ফিরে আসেন হাতভর্তি আইসক্রিম, ফুচকা, হাওয়াই মিঠাই নিয়ে। আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে উঠতে পারিনা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। বাবা বলেন,”আমাদের খেতে ইচ্ছা করছিলো তাই এনেছি,তাই না রে শ্রাবণ?” শ্রাবণ বাবার দিকে তাকিয়ে তখন খিলখিল করে হাসে। এইতো আমার ঘর, আমার সংসার। যেখানে আমি চাইলেও মন খারাপ করে থাকতে পারিনা। সেই দুর্ঘটনার পরে এই মানুষ গুলোই আমাকে দু’হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন সবসময়।
তবে পরিবর্তন বেশি যে মানুষটার হয়েছে তা সাজ্জাদের।ওই ঘটনার পর থেকে শ্রাবণের উপর থেকে তার রাগ আশ্চর্যজনকভাবে কমে গেছে। কিন্তু তার এই দুর্বলতা কোনোভাবেই আমাদের বুঝতে দিবে না। এই যেমন, সে আজকাল মাঝে মাঝেই লুকিয়ে শ্রাবণ এক মনে খেলা করে তা দেখতে থাকে। কখনো আমি সামনে পড়ে গেলে ঝট করে সরে যায় নাহয় অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”এদিকে একটা কাজে যাচ্ছিলাম আর কি।”
আমি হাসি চেপে রেখে বলি,”আচ্ছা তাই নাকি? তো যাও কাজে, দাঁড়িয়ে কি দেখছো?” সাজ্জাদ আমতা আমতা করতে থাকে আর আমি তো হাসি থামাতেই পারিনা। লোকটা ভাঙবে তবু মচকাবে না।
এইতো সেদিন, সাজ্জাদ অফিস থেকে ফিরলো সন্ধ্যার পর। আমি তখন রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছি। বাড়ি ফিরেই আমাকে ডাকাডাকি শুরু করলো। আমি ঘরে আসতেই আমার চোখ চড়কগাছ। সাজ্জাদ ঘরভর্তি করে বাচ্চাদের খেলনা এনেছে। খেলনা গাড়ি,বেলুন,ব্যাট বল আরো কতো কিছু তার ঠিক নেই। আমার তো মাথায় হাত। কি হলো সাজ্জাদের? শরীর ঠিক আছে তো? আমি সাজ্জাদের সামনে যেয়ে হা করে ওকে দেখতে থাকি। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাজ্জাদ অন্যদিকে তাকায়, আমার চোখের দিকে তাকাতে পারে। অপ্রস্তুত ভাবে কিসব বলতে থাকে কথা জড়ায় যায়।
“আসলে হয়েছে কি রুমকি জানো তো। আমি অফিস থেকে কেবলই বের হয়েছি। সামনে দেখি একজন বয়স্ক মানুষ এসব খেলনা বিক্রি করছে। মায়া লাগলো মানুষটার জন্য। কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি কাছে যেতেই লোকটা আমাকে বললো সে নাকি কয়দিন ধরে খেতে পারেনা, এই খেলনাগুলো না বিক্রি হলে তার ঘরের বাজারটাও হবে না। তাই ভাবলাম, কিনে নিয়ে যাই আর কি। লোকটার একটু উপকার হোক। আর কিছুই না। তুমি যা ভাবছো তা না আসলে।”
আমি তো কোনোভাবে হাসি থামাতে পারিনা। মুখ টিপে হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বললাম,”কি ভাবছি আমি?”
সাজ্জাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকালো। কোনো কথা বলতে না পেরে মাথা চুলকাতে লাগলো। ওর এই অবস্থা দেখে আমি আর পারলাম না। অট্টহাসি শুরু করলাম। সাজ্জাদ রাগী রাগী মুখ করে আমার দিকে তাকালো। রাগ চেপে বললো,”এতো হাসির কি আছে বুঝলাম না তো। যা সত্যি তাই বললাম।”
আমি হাসতে হাসতেই বললাম,”তা বেশ, আমাদের সামনের বাড়িটায় বেশ কিছু বাচ্চা আছে। ওদের দিয়ে আসি খেলনাগুলো।”
সাজ্জাদ চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকালো। তাড়াহুড়ো করে বললো,”আহা রুমকি, কি বলো এসব? আমাদের বাড়িতেও তো বাচ্চা আছে। খামোখা সামনের বাড়ির বাচ্চাদের কেনো দিতে হবে?”
আমি কিছু বলিনা,এক দৃষ্টিতে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সাজ্জাদ অন্যদিকে ফিরে বলে,”না মানে বললাম আর কি। সেদিন দেখলাম খেলার কিছু না পেয়ে চেয়ার টেবিল ধরে টানাটানি করছে। এতো শব্দ করে না ছেলেটা কি আর বলবো। আমার তো মাথা ধরে গেলো। তাই ভাবলাম খেলনাগুলো দিয়ে খেলুক। শব্দ তো আর হবে না।”
“আচ্ছা বুঝলাম। তাহলে শ্রাবণকে নিয়ে আসি? ওর জন্য এনেছো ওর হাতেই দাও। ও খুশি হবে।”
সাজ্জাদ এক লাফ দিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,”হ্যা নিয়ে আসো ওকে, সমস্যা নেই।” এরপর আমাকে মিটমিট করে হাসতে দেখে বলে,”রুমকি একদম হাসবা না। খালি কথায় কথায় হাসবে। মাথার সমস্যা হয়ে গেছে তোমার। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। যাও ওকে আনতে হবে না। তুমি নিয়ে যাও খেলনাগুলো, ওকে নিয়ে দিয়ে আসো।”
আমি কোনো কথা না বলে হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। এরপর সোহেলীর ঘরে যেয়ে ওকে সব জানাই। ওর ও আমার মতো একই অবস্থা। কোনোভাবে হাসি থামে না। এরপর আমি আর সোহেলী মিলে একটা প্লান করি। আমরা ঠিক করি শ্রাবণকে একা সাজ্জাদের কাছে রেখে আমরা চলে আসবো, সামনে থাকবো না। কিন্তু দরজার বাইরে আড়ি পাতবো আর লুকিয়ে দেখবো কি করে দুইজন। সোহেলী চিন্তিত মুখ করে বলে,”কিন্তু ভাবী একটা সমস্যা আছে যে।”
“আবার কি সমস্যা?”
“শ্রাবণ তো ভাইয়াকে ভয় পায়। ভাইয়ার আশেপাশে থাকতে চায়না। ও কি ভাইয়ার সাথে একা থাকতে চাইবে?”
আমি সোহেলীর কাঁধে হাত রাখি। একটু হেসে বলি,”সোহেলী, বাচ্চারা খুব ভালো করে বুঝতে পারে কে ওদের ভালোবাসে আর কে বাসে না। তাই যখন সাজ্জাদ শ্রাবণের উপর রেগে ছিলো শ্রাবণ ওকে ভয় পেতো। কিন্তু এখন আমার মন বলছে শ্রাবণ সাজ্জাদকে আর ভয় পাবে না। কারণ সাজ্জাদের ভিতর শ্রাবণের জন্য অদ্ভুত এক মায়া আমি দেখতে পাচ্ছি। এ মায়ার নাম কি জানো সোহেলী?”
সোহেলী আস্তে করে বলে,”কি নাম ভাবী?”
আমি সোহেলীর দিকে তাকিয়ে বলি,”রক্তের টান।” সোহেলী কান্নাভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাবার ঘরে যেয়ে দেখি বাবা খাটে শুয়ে গল্পের বই পড়ছেন আর শ্রাবণ বাবার পাশে বসে একমনে খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি করছে। আমি একটু উঁকি দিয়ে তাকাই ওর খাতার দিকে। সেদিকে তাকাতেই আমার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা নোনাপানি ঝড়ে পড়ে। আমার কান্না দেখে সোহেলী দৌড়ে আসে। চিৎকার করে বলে,”কি ব্যাপার ভাবী? কাঁদছো কেনো তুমি?” সোহেলীর চিৎকার শুনে বাবা গল্পের বই থেকে মুখ তুলে তাকান। তিনিও অস্থির হয়ে যান। ছুটে আসেন আমার কাছে,”কি ব্যাপার মামণি? কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো? সাজ্জাদ কিছু বলেছে?”
আমি মুখে কিছু বলতে পারিনা। হাত উঁচু করে শ্রাবণের খাতার দিকে দেখাই ওদের। বাবা সেদিকে তাকিয়ে খাতাটা হাতে তুলে নেন। সোহেলী আর বাবার চোখেও পানি ততক্ষণে।
খাতায় শ্রাবণ নিজেকে এঁকেছে, তার দুই পাশে দুইজন মহিলা। একজন শাড়ি পড়া অন্যজন সালোয়ার কামিজ। আমি শাড়ি পড়ি আর সোহেলী সালোয়ার কামিজ,বুঝলাম আমাদের এঁকেছে। আমাদের পিছনে এঁকেছে বাবাকে,পাঞ্জাবি পড়া। একটু দূরে শার্ট প্যান্ট একজনকে এঁকেছে যার দিকে শ্রাবণ তাকিয়ে আছে। আমরা বুঝলাম ওটা সাজ্জাদ।,কিন্তু ছবির সাজ্জাদ অন্যদিকে তাকানো।
বাচ্চামানুষের আনাড়ি হাতের আঁকা কিন্তু কি অদ্ভুত ভাবে বাড়ির সবকিছু এক ছবিতে এঁকে ফেলেছে। আমি শ্রাবণকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকি। আমার কান্না শুনে সাজ্জাদ ছুটে আসে এ ঘরে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি ব্যাপার? রুমকি এভাবে কাঁদছো কেনো?” আমি উত্তর দিই না। সাজ্জাদ সোহেলী আর বাবার কাছে যায়। কেউ উত্তর দিতে পারে না। সবার চোখে পানি। সাজ্জাদ এবার ছুটে শ্রাবণের কাছে আসে। আমার কাছ থেকে ছুটিয়ে নিয়ে শ্রাবণকে বুকে চেপে ধরে। চিৎকার করে বলে,”কি হয়েছে তোর? আমাকে বল। কোথায় খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বল। আমি আর তোকে বকা দিবো না কখনো। আর রাগ করবো না। শুধু বল তোর কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
শ্রাবণ সাজ্জাদের এই রূপের সাথে পরিচিত না। আর ও বুঝতেও পারছে না সাজ্জাদ হঠাৎ এমন করছে কেনো? সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। আমরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সাজ্জাদের দিকে। সবচেয়ে বেশি অবাক বাবা। তিনি আস্তে করে যেয়ে পিছন থেকে সাজ্জাদের কাঁধে হাত রাখেন। সাজ্জাদ পিছনে ঘুরে বাবাকে বলে,”বাবা তোমরা কাঁদছিলে কেনো? কি হয়েছে শ্রাবণের? ওর কি শরীর খারাপ? আমি এখনই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।”
বাবা পাঞ্জাবির কোণায় চোখ মুছে বলেন,”শান্ত হও সাজ্জাদ। শ্রাবণের কিছু হয়নি,ও ভালো আছে।”
সাজ্জাদ এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে এভাবে পাগলের মতো কাঁদছিলে কেনো ওকে জড়িয়ে রুমকি? তোমার মাথা আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। কখন কাঁদো কখন হাসো কোনো ঠিক নেই।”
কান্নার মধ্যেও আমার হাসি পেলো। আমি বুঝতে পারছি সাজ্জাদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে। তার দূর্বলতা আমরা বুঝতে পেরেছি বলে তার মেজাজ চড়ে যাচ্ছে।
আমি শ্রাবণের খাতাটা সাজ্জাদের হাতে তুলে দিলাম। সাজ্জাদ খাতাটা হাতে নিয়ে একমনে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আমি, বাবা আর সোহেলী তাকিয়ে আছি সাজ্জাদের দিকে। আর শ্রাবণ তো কিছুই বুঝতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে এসে আমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে পড়েছে।
সাজ্জাদ হঠাৎ খাতাটা রেখে শ্রাবণকে আমার আঁচলের তলা থেকে বাইরে এনে তার সামনে এনে নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। শ্রাবণ অন্য সময় সাজ্জাদকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু আজ সে সাজ্জাদের সামনে দাঁড়িয়ে একটুও ভয় পাচ্ছে না। শুধু অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাজ্জাদের দিকে।
সাজ্জাদ শ্রাবণের মুখটা দুই হাত দিয়ে আলতো করে ধরে। তার চোখে অঝোরে পানি। আস্তে করে বলে,”শুধু ভাবী মা কে ডাকলে হবে? আমি ভালো না রে তাইনা? ভাইজান বলে একটু ডাকবি রে আমাকে? একবার ডাক।”
শ্রাবণ একবার আমার দিকে তাকায় একবার বাবার দিকে। ভাইজান আবার কি? এতো কঠিন শব্দ সে কোনোদিন শোনেনি।
সাজ্জাদ অসহিষ্ণু হয়ে আবার বলে,” কি রে শ্রাবণ? রাগ করে থাকবি? একটু ডাকবি না আমাকে? এই যে দ্যাখ আমি কান ধরে বসলাম তোর সামনে। একটু ডাক না আমাকে।”
আমি আর সোহেলী ক্রমাগত কাঁদছি। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে শ্রাবণ সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। সেই টোল পড়া হাসি, একদম যেনো আম্মার হাসি। সাজ্জাদ একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে সামনে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না। শ্রাবণকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে। শ্রাবণ কাঁদলে বাবা যেমন হাতের উলটো পিঠ দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দেয়, ঠিক তেমনি ছোট্ট শ্রাবণও সাজ্জাদের চোখের পানি মুছে দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকালো।
সোহেলী ছুটে এসে দুইভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আমি চোখ মুছে অন্যদিকে তাকাই। এই সুখের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায়না। বুকের মধ্যে ব্যথা করে। আস্তে আস্তে হেঁটে বাবার কাছে এসে দাঁড়াই আমি। বাবা বললেন,” আমার চোখে কি যেনো পড়েছে মামণি বুঝলে? শুধু পানি পড়েই যাচ্ছে। তুমি একটু থাকো ওদের কাছে। আমি যাই।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। তার ঘরে যে তারার মেলা আজ বসেছে, এই দৃশ্য দেখে তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না।আমি তাকে আর ডাকিনা।আজ সে কাঁদুক,অনেক দিনের কষ্টকে চোখের পানির মধ্যে দিয়ে বের করে দিক।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি।মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে আম্মা মুচকি মুচকি হাসছেন আমাদের দিকে তাকিয়ে। তার ছোট্ট নীড়ে আজ চাঁদের হাট বসেছে,কিন্তু শুধু তিনি নেই আমাদের মাঝে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, এ সুখ যেনো আমার ঘরে সারাজীবন বিরাজ করে। তোমরা সারাজীবন এভাবেই থেকো। একটু পালটে যেও না।
(সমাপ্ত)