#শেষ_শ্রাবণ
পর্বঃ২
সন্ধ্যায় আমি কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছি। সাজ্জাদ এখনো বাড়ি ফেরেনি। সোহেলী কিছুক্ষণ আগে ইউনিভার্সিটি থেকে এসে নিজের জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে ঘরে গেছে। বাবা আম্মা ঘরে। আম্মার শরীরটা ইদানীং বেশ খারাপের দিকে। প্রায়ই হাঁপানির টান ওঠে। চেহারায় আগের সেই লাবণ্যের কিছুই নেই।তার পছন্দ মতো রান্না করার চেষ্টা করি আমি আমার সাধ্যমতো। কিন্তু তেমন কিছুই মুখে তুলতে পারেন না। প্রায়ই দেখি বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাবা তখন মায়ের হাতটা ধরে বসে থাকেন,কেউ কোনো কথা বলেন না। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কারণ শরীরের অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা যায়,মনের অসুস্থতা কাটানোর কি উপায়?
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। শ্রাবণ মাস পড়েছে কয়েকদিন হলো। ভাবলাম এমন বৃষ্টির দিনে লুচি,মুরগির মাংস বেশ ভালো লাগবে। কারণটা অবশ্য আম্মা। আম্মা খুব পছন্দ করেন লুচির সাথে মুরগির মাংস। সাজ্জাদ ও খুব পছন্দ করে। আমি আজ চিন্তা করেছি বাবা, আম্মা, সাজ্জাদ আর সোহেলীকে একসাথে বসিয়ে খেতে দিবো। সাজ্জাদ সোহেলীর কোনো বারণ শুনবো না আজ। একটু কঠোর আজকে আমি হবোই। এসব ভাবছিলাম আর নাস্তা রেডি করছিলাম। এরমধ্যে বাবা এসে কিচেনের সামনে দাঁড়ান।
“মামণি একটু আমাদের ঘরে চলো তো। তোমার আম্মার শরীরটা যেনো কেমন করছে।” আঁৎকে উঠলাম আমি শুনে। বললাম,”কি বলছেন বাবা? কি হয়েছে আম্মার?”
বাবা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললেন,”জানিনা মামণি,আমার মনে হয় এখনই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।”
আমি তাড়াতাড়ি করে হাত ধুয়ে বাবার পিছু পিছু আম্মার ঘরের দিকে ছুটলাম। যেয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম আম্মা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন আর জোরে জোরে সূরা পাঠ করছেন। তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে,ঘামে ভিজে আছে। আমার হাতপা কাঁপতে থাকে ভয়ে।কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নিজেও একদমই অনভিজ্ঞ। আমি বাবার দিকে তাকাই। তিনি ছুটে যেয়ে আম্মার হাত ধরে বলেন,”অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার?আমি আছি তো,কিচ্ছু হবে না তোমার।আমি কিচ্ছু হতে দিবো না তোমার। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাবো তোমাকে।একটু সহ্য করো আর আল্লাহকে ডাকো।”
আম্মার কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,”আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বাচ্চাটা কে তুমি দেখো সাজ্জাদের বাবা।” বাবা শব্দ করে কাঁদতে থাকেন শুনে। আমি ছুটে আম্মার কাছে গিয়ে বসি, বললাম,”এসব বলবেন না আম্মা। আপনার কিচ্ছু হবে না। এগুলো বলে আমাদের সাহস কমিয়ে দিবেন না আপনি। আমি আপনার ছেলেকে ফোন দিচ্ছি এখনই। ও অফিসের গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।” আম্মাকে বাবার কাছে রেখে আমি সাজ্জাদকে ফোন করি। একবার,দুইবার, তিনবার। নাহ, সাজ্জাদ ফোন তুলছে না। আমি বার বার চেষ্টা করতে থাকি। ফোনটা বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। রাগে আমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে। কি করবো দিশা না পেয়ে আমি সোহেলীর দরজায় ধাক্কা দিই।
“সোহেলী তাড়াতাড়ি এসো। দেখো মা কেমন করছেন।”
দরজা খুলে বের হয়ে আসে সোহেলী। আমাকে দিশাহারা দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভীত হয়ে বলে,”কি হয়েছে ভাবী? এমন করছো কেনো তুমি?”
আমি শব্দ করে কেঁদে দিই,কথা জড়ায় যায় আমার। শুধু বলি,”আম্মা যেনো কেমন করছে সোহেলী,তোমার ভাইয়াকে ফোন দিলাম, সে রিসিভ করছে না।” এটুকু শুনেই সোহেলী ছুটে আম্মার ঘরের দিকে গেলো,পিছু পিছু আমিও গেলাম। যেয়ে দেখলাম আম্মার অবস্থা আরো খারাপের দিকে। বাবা তার হাত পায়ের তলা মালিশ করে দিচ্ছেন। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি,বললেন,”সাজ্জাদ কি বললো মামণি? সে কি আসছে?” আমি বললাম,” না বাবা, ও ফোন তুলছে না। অনেক বার চেষ্টা করেছি।” বাবা আর কোনো কথা না বলে পাঞ্জাবির উপর চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি পিছন থেকে ডাকলাম,”বাবা কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
বাবা বললেন,” দেখি কিছু পাই কিনা, অটোরিকশা বা সিএনজি। তোমরা একটু বসো তোমাদের আম্মার কাছে।”
“কিন্তু বাবা বাইরে তো অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এখন আপনি বাইরে যাবেন?”
বাবা চোখ মুছে যেতে যেতে বললেন,” আমার আর কিছু করার নেই। তোমরা শুধু ওর খেয়াল রেখো।” এই বলে হনহন করে বেরিয়ে যান তিনি। আমি আবার ফিরে আসি আম্মার কাছে। যেয়ে দেখি আম্মা ছটফট করছেন আর সোহেলী তার পাশে বসে কান্না করছে অঝোরে।
এই প্রথম এভাবে আম্মার জন্য কাঁদতে দেখলাম সোহেলীকে। ছোট একটা বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে যাচ্ছে সে। আমি তার পাশে যেয়ে তার মাথায় হাত রাখলাম। সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে।বললো,” ভাবী আমি এতোদিন অনেক অন্যায় করেছি মায়ের সাথে। কোনোভাবে ব্যাপার টা মেনে নিতে পারিনি আমি। কিন্তু আজকে মায়ের এই অবস্থা দেখে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এই সব কিছুর জন্য হয়তো আমরাই দায়ী। মা কি আমাকে ক্ষমা করে দিবে? বলো না ভাবী, মা আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে তো? আর কষ্ট দিবো না আমি মা কে,কোনোদিন না।”
আমি বললাম,”এখন এগুলো বলার সময় নয় সোহেলী। শুধু আল্লাহকে ডাকো এখন। তিনি আম্মাকে আমাদের মধ্যে সুস্থ করে ফিরিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ।”
আম্মা তার এই অবস্থার মধ্যেও মেয়েকে দেখে একটু হাসতে চেষ্টা করেন। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে ডাকেন। সোহেলী বাচ্চা মেয়ের মতো মায়ের বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকে, আর আম্মা নিজের শত কষ্টের মধ্যে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমার চোখ ফেটে কান্না আসে। ছুটে বারান্দায় যেয়ে রাস্তার দিকে তাকাই। বাবা আসছেন কিনা দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু বৃষ্টির বেগ এতো বেশি, এর মধ্যে কোনো যানবাহন দূরে থাক, তেমন কোনো মানুষই দেখা যাচ্ছে না। আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। সাজ্জাদকে আবার ফোন দিই আমি, এবার ফোন সুইচড অফ বলে। আমি আর নিতে পারছিনা এতো দুশ্চিন্তা, মায়ের ফর্সা মুখখানা যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে। একবার সেদিকে যাচ্ছি আরেকবার বারান্দায় আসছি। সোহেলী সরিষার তেল দিয়ে আম্মার পায়ের পাতা মালিশ করতে থাকে জোরে জোরে। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার নিজের মা কে একটা ফোন দেওয়া দরকার ছিলো এতোক্ষণ। আমাদের বাড়ি এখান থেকে বেশি দূর না। আমার ভাইয়ার নিজের গাড়ি আছে। ধুর, এতোক্ষণ কেনো মনে এলো না এই কথা? অধিক দুশ্চিন্তার সময় মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। দুইবার রিং হওয়ার পর মা ফোন ধরে। আমি বলি,”মা ভাইয়া কোথায়?”
মা উদ্বিগ্ন হন, বলেন,” কি হয়েছে মা? তোর কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো? কোনো সমস্যা?”
“মা বেশি কথা বলার সময় নেই। আম্মার অবস্থা খুব খারাপ। সাজ্জাদও বাড়ি ফেরেনি,ফোন ও সুইচড অফ। এই বৃষ্টির মধ্যে বাবা বের হয়েছেন সিএনজি খুঁজতে। ভাইয়াকে বলো এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে এ বাড়ি চলে আসতে। আম্মাকে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।”
মা অস্থির হন শুনে। বলেন,” কিন্তু তোর ভাইয়া তো গাড়ি নিয়ে ঢাকার বাইরে গেছে আজ বিকালে,বন্ধুদের সাথে পিকনিক আছে।”
যে ভরসাটুকু ছিলো তাও শেষ হয়ে গেলো। আমি মায়ের কথা আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। মা হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন আমার কানে আর কিছু যাচ্ছে না। আমি আবার ছুটে আম্মার কাছে আসি। আম্মা এবার কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। সোহেলী ভীতু ভীতু চেহারা নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে বললো,”ভাবী, মা এমন নিস্তেজ হয়ে গেলেন কেনো? কি করবো আমরা এখন?” আমি সোহেলীকে শান্ত হতে বললাম, আম্মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তার দশ মিনিটের মাথায় বাবা ফিরলেন। একদম ভিজে গেছেন তিনি। পরনের পাঞ্জাবি, চাদর ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। এসেই বললেন,”মামণি আর দেরী করা যাবে না। একটা অটোরিকশা পেয়েছি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে করে তোমার আম্মাকে নিয়ে যেতে হবে রাস্তা পর্যন্ত। সাজ্জাদ ফিরেছে?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,”না বাবা ওর ফোন বন্ধ।” বাবা আর কিছু বললেন না। নিজেই আম্মাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। বললেন,”তোমরা আসো, আমি যাচ্ছি।”
সোহেলী বললো সে ও যাবে, তার মা কে এভাবে পাঠিয়ে একা বাড়ি থাকতে অস্থির লাগবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার দিকে তাকালাম, বুঝতে পারলো কিন্তু কিছুদিন আগে বুঝলো না, জানিনা সাজ্জাদ কোনোদিন বুঝবে কিনা। আমরা যে পোশাকে ছিলাম তাই পড়েই রওনা দিলাম। যাওয়ার আগে সাজ্জাদের ফোনে একটা ম্যাসেজ দিয়ে গেলাম,”আম্মাকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আসতে পারো।”
বাবা ড্রাইভারের পাশে বসেছেন। আমি আর সোহেলী আম্মাকে নিয়ে পিছনে। আম্মার মাথাটা আমি আমার বুকে চেপে রাখি,সোহেলী আম্মার পায়ের পাতা মালিশ করতে থাকে। বাবা বার বার ঘুরে আম্মাকে দেখছেন। আমি আম্মার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখি,কোনোভাবেই যেনো তিনি সাহস না কমান। আজ এতো দীর্ঘ কেন মনে হচ্ছে রাস্তাটা? বৃষ্টির বেগ প্রবলভাবে বেড়েছে।আমি একমনে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকি।
প্রায় পঁচিশ মিনিট পর আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। আম্মার অবস্থা খুব খারাপ তখন। তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না,নড়াচড়া করার শক্তিও তার নেই। জরুরি বিভাগে ভর্তি করানো হয় তাকে। আমরা ভিজিটর কাউন্টারে এসে বসি। সোহেলী সমানে কেঁদে যাচ্ছে। বাবা এসে তার মাথায় হাত রাখে। সে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে অনেক কথা বলে, বোঝা যায়না। বাবা শুধু শক্ত করে ধরে রাখেন মেয়েকে। আমি বাবার হাত ধরে একটা চেয়ারে এনে বসাই। ভয় হয়, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় এই মানুষটার কিছু না হয়ে যায়।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর ডাক্তার এসে জানান রোগীকে নরমাল ডেলিভারি করানো সম্ভব না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সিজারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখনই ডিসিশন না জানালে জীবন ঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে। বাবা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন। হয়তো তার নেওয়ার ক্ষমতা আর নেই। আমি বাবাকে বলি,”বাবা আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না। ডাক্তাররা তাদের কাজ করে যান। ইনশাআল্লাহ আম্মা সুস্থ হয়ে যাবেন।” বাবা নীরবে চোখের পানি ফেলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে বলেন,”বেশ তবে আপনারা ব্যবস্থা করুন। শুধু একটা কথা, আমার স্ত্রীর সুস্থতার সাথে কোনো কমপ্রোমাইজ করবেন না।” আমি বুঝতে পারি বাবা কি ইঙ্গিত করলেন। ডাক্তার বললেন,”দেখুন আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে। একে তো পেশেন্টের বয়সটা একটু বেশি, তার উপর বেবি প্রি ম্যাচিওর, উনার ডেলিভারি ডেট এখনো আসেনি। এনাফ ক্রিটিকাল প্রেগ্ন্যাসি।তাই এখনই কিছু বলতে পারছি না আমরা। তবে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবো।” বাবা চুপ করে সব শুনেন,কিছু বলেন না।
আমি আর বাবা যেয়ে কাউন্টারে সব ফর্মালিটিজ শেষ করে আসি। আমার জমানো কিছু টাকা ছিলো, আমি সাথে নিয়ে এসেছিলাম বুদ্ধি করে, সেই টাকাটাও লাগলো এখন। বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন,”তোমার এতো ঋণ, আমি তো শোধ করতে পারবো না মা।” আমি তার হাতটা ধরে বললাম,”তবে আর মা বলে ডাকেন কেনো বাবা? মা হয়ে এটুকু সাহায্য যদি না করতে পারি তবে আর কি। শুধু একটাই চাওয়া আমার, আপনার আর আম্মার হাত সবসময় আমাদের মাথার উপর রাখবেন। কোনোদিন আমাদের ভুল বুঝে চলে যাবেন না।” বাবা কিছু বলেন না, শুধু আমার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলেন।
আম্মাকে অপোরেশন রুমে নেওয়া হয়েছে পনেরো মিনিট হলো। আমি আর সোহেলী বসে আছি, সোহেলী সমানে কেঁদে যাচ্ছে, আমি তাকে স্বান্তনা দিতে যেয়েও দিতে পারছি না, কি বলেই বা স্বান্তনা দিবো? বাবা একটুও বসেন নি, করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছেন। আমি আবার ও সাজ্জাদকে ফোনে ট্রাই করলাম, এখনো সুইচড অফ। আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
তারপর প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর অপোরেশন রুমের দরজা খুলে ডাক্তার বের হয়ে আসেন। বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে যান সেদিকে, আমি আর সোহেলীও যাই বাবার পিছু পিছু।
ডাক্তার বলেন,”কংগ্রাচুলেশনস, আপনার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে।” আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি। বাবা অস্থির হয়ে বলেন,” আর আমার স্ত্রী কেমন আছে ডাক্তার?” ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা আরো অস্থির হয়ে যান, বলেন, “কি হলো ডাক্তার,কথা বলছেন না কেনো? কিছু বলুন প্লিজ।” ডাক্তার আস্তে করে বলেন,” উনার অবস্থা বেশি ভালো না, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, আমরা রক্তের ব্যবস্থা করেছি। তবুও শরীর বেশ দূর্বল উনার। সারভাইভাল চান্স ফিফটি ফিফটি। ” এই বলে প্রস্থান করেন তিনি। বাবা কিছু বলেন না। কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়েন। আমি আর সোহেলী এসে বাবার দুই হাত ধরি। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের এখন।
কতোক্ষণ আমরা এভাবে বসে ছিলাম জানিনা। বেশ কিছুক্ষণ পর নবজাতকের কান্নার শব্দে উঠে দাঁড়াই আমি আর সোহেলী। নার্স একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে অপরেশন রুম থেকে বের হলো। সোহেলীর কাছে আম্মার ওড়না ছিলো। কিন্তু সে এগিয়ে যাচ্ছে না দেখে তার কাছ থেকে ওড়নাটা নিয়ে আমি ছুটে গেলাম। বাচ্চাটা সমানে কেঁদে যাচ্ছে। আম্মার ওড়না পেঁচিয়ে কোলে নিলাম তাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, মায়ের ওড়নার গন্ধটাও মনে হয় চিনে গেছে এক নিমিষে বাচ্চাটা। ওড়নাটা আঁকড়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো আমার দিকে। আমি হেসে দিলাম সেদিকে তাকিয়ে। সোহেলী ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বললাম,”কোলে নিবে তুমি?” সোহেলী আস্তে করে বললো,” আগে বাবাকে দেখাও ভাবী।”
আমি বাবার কাছে যেয়ে দাঁড়ালাম, তিনি তখনও ঝিম ধরে বসে আছেন শূণ্যের দিকে তাকিয়ে। “বাবা” আমি ডাকতেই বাবা তাকালেন আমার দিকে। আমি ওড়নায় জড়ানো বাচ্চাটিকে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ওকে কোলে নিয়েই শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্না দেখে আমি আর সোহেলীও চোখের পানি ঠেকাতে পারলাম না। বাচ্চাটি যেনো বুঝতে পারলো সে পরম নির্ভরতার আশ্রয়ে এসে গেছে। স্বস্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। বাবা আজান দিলেন ওকে কোলে নিয়েই।
প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তার এসে জানালেন আম্মাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। তবে শরীরের অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল। স্যালাইন চলছে। আমাদের সাথে দেখা করতে চান তিনি। আমি সাজ্জাদকে ফোন দিলাম। এবার সাজ্জাদ ফোন ধরলো। সে জানালো মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে সে, জরুরি কাজে অফিসের বাইরে যেতে হয়েছিলো তাকে, এরপর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায়,বৃষ্টির জন্য বাসায় ফিরতেও দেরী হয়। বাসায় এসে মাত্রই ফোন চার্জে দিয়ে আমার টেক্সট দেখেছে সে। আম্মার শরীর কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে আমি তাকে সব জানাই। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসতে বলি। সাজ্জাদ ছোট্ট করে বলে,”আসছি।”
আম্মাকে দেখে চমকে উঠি আমি। যদিও মুখটা বেশ মলিন লাগছে তার। তবুও চেহারার মধ্যে এমন কিছু ছিলো যা মুগ্ধ করে দেয়। অনেকদিন পর আম্মার এই লাবণ্য আমি দেখতে পেলাম। কেনো জানি অজানা একটা আশংকায় বুক ধক করে উঠলো আমার।
আম্মা কথা বলতে পারছেন না। হাতে স্যালাইনের সুঁচ। কোনোরকমে ইশারা দিয়ে বাচ্চাটিকে কাছে চাইলেন তিনি। আমি এগিয়ে গেলাম তার কাছে। পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। এরপর কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে আমার হাতটি ধরলেন। আস্তে আস্তে বললেন,” শ্রাবণের অঝোর ধারার রাতে আমার ছেলে পৃথিবীতে এসেছে। তার নাম রেখো শ্রাবণ।” আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানালাম। এরপর আরো আস্তে করে বললেন,”ওকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি, ওর কোনো অযত্ন তুমি হতে দিও না মা গো। তাহলে আমি যে শান্তি পাবো না।” আমার বুক কেঁপে ওঠে। কি বলছেন আম্মা এসব?কোথায় যাবেন তিনি?আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোহেলীকে কাছে ডাকলেন তিনি। সোহেলী এসেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আম্মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”বোকা মেয়ে,কেঁদো না। তোমার মা কে ক্ষমা করে দিও,তার জন্য তোমাদের অনেক সম্মানহানি হয়েছে। তোমাদের রাগ আমার উপরে। ও নিষ্পাপ শিশু, তোমাদেরই রক্ত। ওর কোনো দোষ নেই। কখনো অবহেলা করো না ওর।” সোহেলী কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে,”ভাবী মা এসব কি বলছে?আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। কোথায় যাবে মা? ও ভাবী।” চিৎকার করতে থাকে সে। আমি কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে সোহেলীকে জড়িয়ে ধরি। বাবা এতোক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথা নিচু করে। আম্মা আস্তে করে আমাদের যা যা বলেছেন উনি কিছু শুনতে পান নি। আম্মা বললেন,”সাজ্জাদ আসেনি?” আমি মাথা নিচু করে বললাম,”আম্মা ও আসছে,পথেই।” আম্মা মুচকি হাসলেন। এরপর বললেন,”তোমাদের বাবার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমরা বাইরে অপেক্ষা করো। শ্রাবণ আমার কাছে থাকুক।” সোহেলী কিছুতেই যাবে না মা কে ছেড়ে। আমি তাকে বাইরে নিয়ে আসলাম জোর করে। বাবার সাথে আম্মার কি কথা হয় আমরা জানিনা। মিনিট পাঁচেকের মাথায় কেবিন থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে আসলেন বাবা। আমরা পিছন থেকে ডাকলাম, বাবা কোনো কথা শুনলেন না। ডাক্তার নিয়ে দুই মিনিটের মাথায় ফিরলেন তিনি। আমরাও পিছু পিছু গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন আম্মা আর নেই। রাত ১২.৪৫ মিনিটে আম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
চলবে….