শিশির_কণা
শামসুল ইসলাম
(পর্বঃ-৮)
।
-” আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না, আমার মা তোমাকে মেনে নিতে চাচ্ছেন না। তোমার নানা বাড়ি থাকাটা আমার মা অনেক অপছন্দ করেছেন।তোমার বাবা নেই এটাই অপছন্দের মুল কারণ, আমাকে ক্ষমা করে দিও সাথে যা খরচাদি হয়েছে সব পরিশোধ করে দিব। ভালোথাকো।”
আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো, কিছুক্ষণের ভিতরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।
রাত প্রায় ১১.৩০ দিকে আমার জ্ঞান ফিরলো। পাশে আম্মু বসে কাঁদছেন। খেয়াল করলাম, চোখ দুইটা রক্তজবার মতো লাল হয়ে গেছে। তারমানে তাঁদের আর শুনতে বাকি নেই আমার কপাল পুড়ছে।
মণি আমার জ্ঞান ফিরে পাওয়া দেখে দ্রুতবেগে কাছে এসে বললো-
-” কণাপু, কঠিন পরিক্ষা নিচ্ছেন আল্লাহপাক তোমাকে। ধৈর্যবতী হও ইনশাআল্লাহ্ ভালো কিছু পাবে। তোমাকে বলেছিলাম বিয়ের আগে ছেলের সাথে ফোনে এতো কথা বলোনা, এটা শরিয়তে বৈধতা নেই। আল্লাহপাক তোমাদের বিয়ে চাননি তাই হয়নি, মানা করা সত্বর তুমি কথা বলেছো। এখন তাঁর প্রতি তোমার একটা অনুভুতি সৃষ্টি হয়েছে যা তোমার একাকীত্বে কুরে কুরে খাবে। কখনোই উচিৎ না বিয়ের পুর্বে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা।”
আমার ইচ্ছে হচ্ছে না কথা বলতে, আম্মু আমার দিকে চেয়ে আছেন কিন্তু কোনো কথা বলছেন না। অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন।
এক সপ্তাহে শিশিরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম, ছোট্ট সংসার সহ ভবিষ্যৎকাল ভেবে বসে ছিলাম। যা নিমিষে একটা দমকা হাওয়ায় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
আজ ঈদের দিন ছিলো, সারাদিন অনেক আনন্দ হাসি ঠাট্টা করেছি। নানাবাড়ি বিয়ের ষৎ রঁজন চলেছে, ফোনে শিশিরের সাথে অন্ততপক্ষে আট দশবার কথা হয়েছে। কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম যা নিমিষে শেষ। আজ ঈদের দিন খুশির দিন, এই খুশির দিনে হয়তো পৃথিবীতে আমার থেকে আর কেউ নেই এতোটা অখুশি।
আম্মু মণিসহ নানা নানি মামা মামি সবাই কম বেশি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আমাকে বুঝাচ্ছেন এসব ভাগ্যের লিখন না যাই খণ্ডন। নিছক ভাগ্য বলেই চালিয়ে নিলাম, তবুও মনের ভিতরে খচখচে ভাবটা দুর করতে পারলামনা।
কেউ আমাকে একাকিনী হতে দিচ্ছে না, সবাই ভাবছে হয়তো আমি আত্মহত্যার পথ আবার বেচে নিবো। তাই সারাক্ষণ আমার পাশে চৌকিদারির মতো কেউ না কেউ আছেনই।
সত্যিই আমার এখন আর দুঃখ হচ্ছে না, সমাজের মানুষের কাছে আমি নিছক কীটপতঙ্গের ন্যায়। সভ্যসমাজের অসভ্য আচরণে সব শয়ে গেছে আমার। এইজন্য মনে হয় খোদাতায়ালা আমাকে এক অপার শক্তি সাহস ও ধৈর্যবতী করেছেন। আমি কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছি নিছক ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভেবে।
★★★
আমি অতি চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম, সারাদিন সারাবাড়ি হাসিঠাট্রা আড্ডাবাজির মাধ্যমে সময় অতিবাহিত হতো। সেই কণা আমি এখন সর্বক্ষণ মুখ গুমরা করে থাকি। আমার মুখে সমস্ত হাসি উবে গেছে, যদিও হাসি সেটা শুকনো যা রসকষহীন।
পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। আমার এমন পরিবর্তন সকলের ভিতরে ভাবনা সৃষ্টি করেছে, দেখা হলেই সাতপাঁচ বুঝিয়ে সমব্যথায় সমব্যথী হতে চাই সকলে, যা আমার চরম অপছন্দ। কখনোই কারোর করুণা অভ্যর্থী হতে পছন্দ করি না, সর্বদা নিজের উপরে নির্ভরশীল।
দেখতে দেখতে আমার পরিক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। ফলাফল মোটামুটি আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে, বিয়ে ভাঙার পরপরই সবাই অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার জন্য। কিন্তু আমার আর ইচ্ছা নেই এসবের প্রতি গতজীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় একদম দুমড়ে মুচড়ে গেছি যা সহজে ভুলার নই।
আমার ফলাফলে সবাই আনন্দিত সাথে আমিও, যখন সবাই অনুরোধ করলো এখানো সময় আছে কোচিং এ ভর্তি হওয়ার তাই আমি রাজি হলাম।
ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং যশোর শাখাই ভর্তি হই, আম্মু আমাকে মেসে উঠিয়ে দিয়ে আসলেন। কোচিং এ ক্লাস নিয়মিত করি ক্লাসটেষ্ট সহ সাপ্তাহিক মাসিক পরিক্ষাগুলোতে বরাবরের মতই ভালো করি। দেখতে দেখতে পরিক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফর্ম কিনলাম। নিয়েত করলাম মেস ছেড়ে বাড়িতে থেকেই পরিক্ষাগুলোতে যোগদান করবো।
বাড়িতে চলে আসলাম, পড়াশোনার তুমুল ধুমবয়ে যাচ্ছে। আমার মনে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেই চান্স আমার হবেই হবে।
মণি আমাকে বললো-
-” প্রস্তুতি কেমন?”
-” অনেক ভালো, কোচিং এ বরাবরের মত আমি টপ লেভেলে থেকেছি, চান্স আমার হবেই হবে।”
-” আপু আল্লাহর নাম নিতে পারতে সাথে, এবং তোমার অহংকারী আত্মবিশ্বাস কিন্তু ভালো নই।”
-” আরে রাখ তোর ধর্মের বুলি!! আমি আর আল্লাহকে বেশি বিশ্বাস করি না, কারণ তিনি আমাকে প্রতিটা পদেপদে সর্বশান্ত করে দিয়েছেন। আমার প্রতিটা স্যার বলেছে আমার চান্স কেউ ঠেকাতে পারবেনা ”
-” আপু তুমি কিন্তু ভুল করছো! আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাবান্দীদের বেশি পরিক্ষা করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। যে এটা থেকে ধৈর্যধারণ করবে তাকে আল্লাহপাক উত্তম পুরস্কার দান করবেন।”
-” যা যা! এখান থেকে, পড়তে দে আমায়।”
মণি রাগ করে উঠে গেলো। দেখতে দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্ষা চলে আসলো আগামী শুক্রবার। পরিক্ষাটা বড় মামার সাথে দিয়ে আসলাম, পরিক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। সবার সাথে প্রশ্ন মিলালাম, অকপটে সবাই বললো তোর চান্স কে ঠেকাই!!
দুদিন পর, আজ বিকালে ফলাফল প্রকাশ হবে। উৎসুক জনতার মতো চেয়ে আছি ফলাফল প্রত্যাশী হয়ে, এক মারফতে জানতে পারলাম ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তারকাছে আমার ক্রমিক নং সহ পিন নাম্বার দেওয়া আছে। সে জানালেন আমার ফলাফল নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এক মামাতো ভাইকে দিয়ে কম্পিউটারের দোকানে পাঠালাম, সে ফিরে এসে জানালো আমার মেরিট লিস্টে নাম নেই এমনকি ওয়েটিং লিস্টেও নেই।
আমার সমস্ত অহংকার মনে হচ্ছে ধুলায় মিশে গেলো। আমি গত দুই শিশিরের দেওয়া কষ্টের মতো এই ঢাবি আমাকে ছ্যাকা দিলো। ভুক্তভোগী ছাড়া এটা অনুভব করার ক্ষমতা আর কারো নেই।
একে একে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্ষা দিলাম, কোথাও চান্স হলো না। পরিশেষ গরিব হতভাগাদের বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলাম কেমিস্ট্রিতে।
আমি যেদিন যশোর এমএম কলেজে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়ে বাড়ি আসলাম, সেদিন মণি আমাকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-
-” আপু ফ্রিতে কিছু উপদেশ শুনাবো?”
-” বল?”
-” অহংকার পতনের মুল, দেখেছো সেদিন অহংকার করে বলেছিলে তোমার চান্স সুনিশ্চিত। কিন্তু আজ কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তোমার কপালে জোটেনি।
চান্স দেবার মালিক একমাত্র আল্লাহপাক তুমি নও, তবে তোমার পরিশ্রম সেটা সফলতা বয়ে আনবে।
অহংকারের পরিণতি খুব ভয়াবহ।
আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেনঃ-
“সূরা লোক্মান, আয়াত: ১৮
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِى ٱلْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
অর্থঃ অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।”
এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম)
এই দুইটা কথা মাথায় রেখো কাজে দিবে।”
আমি চুপচাপ মণির কথা অন্তরে গেঁথে নিলাম, উপলদ্ধি করলাম অহংকারের বশে নিজের প্রতি জুলুম করেছি। যার ফলাফল আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
★★★
বাড়ি থেকেই কলেজে যাতায়াত করছি।
মেসে উঠার নিয়েত নাই, প্রতিদিন সাথে করে আম্মু অথবা মামারা কেউ আমাকে প্রধান রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেই।
এভাবে প্রথম বর্ষ পার করলাম, সামনে দ্বিতীয় বর্ষের পরিক্ষা পড়াশোনার চাপে সময় খুবদ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, সবগুলো প্রস্তাব এড়িয়ে গেছি বিয়েশাদী করবো না বলে।
নিজের একান্ত ইচ্ছা, পড়াশোনা নিজের পায়ে দাড়াবো। এসমাজের প্রতিটা মানুষের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবো, আমরা অবহেলিত নই।
আজ কলেজে দ্রুতবেগে যেতে হবে, ফরম ফিলাপের শেষ তারিখ আজ। বাড়িতে কেউ নেই আমাকে এগিয়ে দিয়ে আশার মতো।
দো’আ কালাম পড়ে নিলাম, সাথে আইতাল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁক দিয়ে বের হলাম।দ্রুতপায়ে হাটছি, বেশ কিছুক্ষণ পথ অতিক্রম করার পর দেখি ড্যানি একা দাড়িয়ে আছে।
অমানুষকে দেখে আমার জান খাঁচাছাড়া, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়।
ঘাড় নিচ করে পথ অতিক্রম করছি, হঠাৎ বেয়াদব আমার পথ আগলে ধরছে।
আমাকে বললো-
-” কি সুন্দরী, আমার নামে থানাই মামলা করতে গেছিলে শুনলাম?”
-” পথ ছাড়ুন??”
-” যদি না ছাড়ি কি করবে?”
-” খুব খারাপ হবে কিন্তু?”
-” শুনে রাখ! তোর সাথে আমার বহুত বোঝাপড়া আছে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছি না জনসম্মুখে। তোকে বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাক পাঠাবো, বিয়ে করে তোর জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ছাড়বো। দেখি তোর কোন বাবা রক্ষা করে, প্রস্তুতি নে আমার বউ নই দাসী হওয়ার জন্য।”
-” তোর মতো কুকুর শিয়ালের বউ হতে আমার বয়ে গেছে।”
আলিফ লাইলার শইতানদের মতো দুষ্টু অট্টহাসি দিয়ে-
-” হা হা হা তোর দেমাগি ছুটিয়ে দিবো মনে রাখিস, যা বউ কলেজে যা।”
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, ঠাসঠাস করে তাঁর বাম কানের নিচে চড় বসিয়ে দিলাম। ড্যানি সবসময় নেশার ঘোরে মাতাল হয়ে থাকে, আমার এক থাপ্পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আমি ভয়ে হাটা শুরু করি দ্রুতপায়ে।
আমার ভিতরে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েগেছে, নাজানি শইতানটা মারা গেছে। সমস্ত পথ দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় অতিক্রম করেছি।
কলেজের কাজকাম সমাপ্ত করে বাড়িতে আসলাম, দেখি সবার মোন খারাপ। মহা দুশ্চিন্তায় আছে, আম্মু আমাকে দেখেই বললো-
-” আমি জানতাম আজ কোনো অঘটন ঘটবে, তো তাঁকে মারার দরকার কি?
কথা না বাড়িয়ে চলে গেলে পারতি। এখন গ্রামে শালিস বসবে, তাঁরা কি আমাদের এমনি এমনি ছেড়ে দিবে?
আমি ধৈর্যধরে থাকতে পারছিনা, তোর কর্মকাণ্ড দেখে। সামনে থেকে আপাততঃ দুর হ।”
আম্মুর মুখে এসব শুনে আমার মাথাই আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে গেলাম।
★★★
আসরের আযানের পর গ্রামের স্কুলমাঠে আরুজ মাতব্বর শালিস ডাকলেন। আমার শরির হিম হয়ে যাচ্ছে, ভয়ে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠছে।
গ্রামের সবাই ধারনা করেছেন, আজ আমাকে চরম শাস্তিভোগ করতে হবে।
আরুজ মাতব্বর বলা শুরু করলেন-
-” আসলে গিরামের মধ্যির ব্যাপার, এ নিয়ে বেশি লাপালাপি করা জাবেনা। তাই কতি চাচ্ছি, ড্যানি যেহেতু বিচার চেয়েছে তাঁর ইচ্ছা মতো শাস্তি দিক মেয়েকে। এব্যাপারে আর কেরুর মতামোত ইছে নাকি?”
গ্রামের কেউ নেই আরুজ মাতব্বরের উপরে কথা বলার, যারকারনে সবাই চুপ।
ড্যানি বললো-
-” আব্বু যেহেতু সম্মতি দিয়েছেন, তাহলে সকলের সামনে বলছি আমি কণাকে বিয়ে করতে চাই।”
আমার মাথার ভিতরে চক্কোর দিয়ে উঠলো তাঁর মুখে এমন কথা শুনে।
আরুজ মাতব্বর বললেন-
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালোকথা, মেয়েডার বাপটাপ নেই ভালো হবেনে, যেদিকে আমার শইতান পুলাডা যদি মানুষ হয় তালিতো বেশি ভালোকথা। যাইহোক শুভ কাজে দেরি কত্তি নেই, আজ রাত্তিরিই বিয়ে।”………(চলবে)