#শাপলার_মৃত্যু (পর্ব-৭) (১৮+ সতর্কতা)
জাফর হোসেনকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
আপনার মেয়েকে খুন করা হয়েছে। আর আপনি নিশ্চিন্ত মনে পোলাও মাংস খাচ্ছেন?
হোসেন খুব স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিল,
আমি যদি এহন মন কালা কইরা বইসা থাকি, আমার মাইয়ারে কি ফিরা পামু?
জাফর বলল,
ফিরে পাবেন না ঠিক আছে। তাই বলে কি আপনাদের মাঝে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না?
হোসেন বলল,
না। যা চইলা গেছে তা নিয়া পইড়া থাকার মত মানুষ আমি না।
নিরূপমা আঁড়চোখে তাঁকাল মনোয়ারার দিকে। মনোয়ারা উঠোনে চেয়ার পেতে বারান্দায় ফিরে গেছে। মেঝেতে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কিন্তু সে জাফর বা নিরূপমা কারো দিকেই তাকাচ্ছে না। সে উদাস ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে দিগন্তে। মনোয়ারার চেহারার মাঝে শূণ্যতা ছেয়ে আছে। নিরূপমা ধীর পায়ে মনোয়ারার কাছে গেল। উঁচু বারান্দায় তার পাশেই বসল। মনোয়ারা তার স্বভাব মত শাড়ির আঁচল ঠিক করল। নিরূপমা নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
ভালো আছেন?
মনোয়ারা উত্তর দিল,
জি ভালো।
নিরূপমা বলল,
শাপলার খুনিকে আমরা যত দ্রুত সম্ভব ধরে ফেলব।
মনোয়ারা হেসে বলল,
ওর খুনিরে ধরবার পারবেন না।
নিরূপমা অবাক হয়ে বলল,
কেন? কেন ধরতে পারব না?
ওরে কোনো মানুষ খুন করে নাই। খুন করছে ভূত। সাদা শাড়ি পরা ভূত।
সাদা শাড়ি পরা ভূত?
ভূত বলে কিছু নাই।
আফনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনেগো এইডাই মনে হইব। কিন্তু এ গ্রামে একটা ভূত আছে যে সাদা শাড়ি পইরা ঘুইরা বেড়ায়।
নিরূপমা দেখল মনোয়ারার চোখ জোড়া চকচক করছে। সে বোঝার চেষ্টা করল মনোয়ারা মনগড়া কোনো কাহিনী শোনানোর চেষ্টা করছে কিনা! কিন্তু মনোয়ারা কেন মনগড়া কাহিনী নিরূপমাকে শোনাবে? তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য?
হাজারটা প্রশ্ন মাথায় চড়কির মত ঘুরপাক খাচ্ছে নিরূপমার। মাথা ব্যাথা করছে তার। চারিদিকে এত সাসপেক্ট! মোমেন, মকবুল এমনকি হোসেন নিজেও সাসপেক্টদের তালিকাভুক্ত। বারবার কোনো একটি ক্লু সে অনিচ্ছায় এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ক্লু টা কি?
জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে নিরূপমা বাড়ি ফিরল। ফ্রেশও হল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিল। টানা দুই ঘন্টা ঘুমানোর পর মাথাব্যাথার নিবৃত্তি ঘটল। নিরূপমা রোজকার মতোই এক মগ কফি নিয়ে স্টাডি রুমে ঢুকল।
সাদা রঙের বোর্ডে কালো মার্কার দিয়ে তিনজন সাসপেক্টের নাম লিখা।
মকবুল, হোসেন এবং মোমেন।
প্রতিটি সাসপেক্টের নিচে খুনের মোটিভ কি হতে পারে তা উল্লেখ করা। নিরূপমা প্রায় ঘন্টা দেড়েক নিজের স্টাডি রুমে কাটালো। এরপর বেশ ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়ে এল।
****
পরদিন সকাল।
নিরূপমার ঘুম ভাঙ্গল জাফরের ফোন পেয়ে। সে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
হ্যাঁ জাফর। বল।
একটা দুঃসংবাদ আছে ম্যাডাম।
কি দুঃসংবাদ?
আরেকটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে।
কি বলেন? কোথায়?
গ্রামের পূর্ব-দক্ষিণে একটি ছোট্ট জঙ্গলের মত আছে। সেখানে পাওয়া গেছে।
মেয়ের বয়স?
শাপলার বয়সী ম্যাডাম।
নিরূপমা চুপ করে রইল। ফোনের অপর পাশের নীরবতার কারণ বুঝতে পেরে জাফর বলল,
ম্যাডাম, আপনার আজকে আসার দরকার নেই। আমি ক্রাইম সীন স্টাডি করে আপনাকে ইনফরমেশন পাঠিয়ে দেই?
এভাবে হয়না জাফর। আমি যাবো। তুমি গাড়ির ব্যবস্থা কর।
জাফর বলল,
জি ম্যাডাম৷
***
গ্রামের লোকেরা ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
পর পর দুটি খুন হয়ে গেল। এরকম ঘটনা এ গ্রামে আগে কখনো হয় নি। লাশের চারিপাশে পুলিশ হলুদ ফিতা দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দিয়েছে।
নিরূপমা এসে ক্রাইম সীন পর্যবেক্ষণ করল। এই মেয়েটিকেও মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে শাপলাকে খুন করা হয়েছিল।
নিরূপমা এবং জাফর মিলে উপস্থিত লোকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করল। সবার একই কথা, একাজ কোনো অশরীরীর। সাদা শাড়ি পরে নদীর পারে সে ভেসে বেড়ায়। সেই ভূত বা প্রেতাত্মাই এভাবে খুন করছে।
জাফর নিরূপমাকে আলাদা ডেকে ফিসফিস করে বলল,
ম্যাডাম, কি মনে হয়? পর পর দুটো খুন তাও আবার একই ভাবে। গ্রামের এই বাচ্চা মেয়েগুলো কোনো সিরিয়াল কিলারের পাল্লায় পড়ল না তো?
নিরূপমা বলল,
বুঝতে পারছি না, জাফর। তবে এটুকু বুঝতে পারছি এ গ্রামের মেয়েগুলো ভয়ংকর বিপদের মাঝে আছে। এরা কেউ নিরাপদ নয়।
জাফর বলল,
ম্যাডাম, বিষয়টা তো সবাইকে জানানো উচিত।
চিন্তিত স্বরে নিরূপমা বলল,
সেতো আমিও জানি জাফর! কিন্তু, গ্রামের প্রতিটি মানুষ পরপর দুটি খুনের কারণে ভয়ে অস্থির। এর মাঝে যদি একথা উল্লেখ করে বলা হয় পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।
তাহলে ম্যাডাম কি করা যায়?
রাতে যদি এখানে পুলিশের টহলের ব্যবস্থা করা হয়?
ভালো হয় ম্যাডাম।
ঠিকাছে আমি রাইসুলদার সাথে এ বিষয়ে কথা বলছি।
নিরূপমার সাসপেক্টদের তালিকায় এবার একজন আগন্তুক যুক্ত হল। স্টাডি রুমের সেই সাদা বোর্ডে মকবুল, হোসেন এবং মোমেনের পাশে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন যুক্ত হল। যার মোটিভ নিরূপমার অজানা।
****
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রাইসুল গ্রামে পুলিশের টহলের ব্যবস্থা করে দিলেন। অবশ্য তার প্রয়োজন ছিল না। গ্রামের লোকেরা বেশ সচেতন হয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগেই আজ বাজার একদম ফাঁকা। অন্যদিন দু একটি দোকান খোলা থাকে। রেডিওতে অশ্লীল সব গান বাজিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত তাশ খেলা চলে। সেসকল দোকানের মালিকেরাও আজ সূর্য তার নীড়ে ফেরার আগেই বাড়ি ফিরে গেছে।
কোলাহলময় এই গ্রাম যেনো মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে!
শুকতারার দেখা তখন পূর্ব আকাশে মিলছে। একটু পরেই ফযরের আজান দিবে। টহল শেষে পুলিশরাও বেশ ক্লান্ত। চোখ বুজে এসেছে সবার। এরই মাঝে একজন কনস্টেবলের বাথরুম চাপলো। সে পুলিশের জীপ থেকে নেমে পাশেই একটি গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে লাগল।
ঠিক এমন সময় সে দেখল,
নদীর ধারে সাদা শাড়ি পরিহিত একটি অবয়ব হাঁটছে। অবয়বটি দেখে ঠাহর করা যাচ্ছে না সে পুরুষ নাকি নারী। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে পা ফেলে হাঁটছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভাসছে!
কনস্টেবল দৃশ্যটি দেখে মারাত্মক ভয় পেল এবং উক্ত স্থানেই জ্ঞান হারালো।
চলবে….
ধরনঃ থ্রিলার
লেখিকা, আতিয়া আদিবা