#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_১৮

লিভিং রুমের এক কোনায় ভয়ে আড়ষ্ট দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতা।তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা,আইদা আর আদীব।বাড়ির সবার মুখের অবস্থা থমথমে বিরাজমান।নোমান কিংবা আরাফ কেউ এখনো বাড়ি ফিরে নি।নিয়াজ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে সোফার উপর তার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস হয়নি হৃদিতার।নিরাবতা কাটিয়ে মুখ খুলেন আরাফের বাবা জহির।

– আরাফ কোথায়?সে কাকে বলে বাড়ির বাইরে রাত পার করছে, ঘরে তার বিবাহিত স্ত্রী?
জহির থামলো তার কথার উল্টো পিঠেই সহসা জবাব দিলো নিয়াজের বাবা জাবেদ,
– দেখো এখন আমার ছেলে খারাপ হয়ে যাবে।সবাই বলবে নিয়াজ নেশা করে।হ্যা এটা সত্য কিন্তু তাই বলে বাড়ির কোন সদস্যর ক্ষতি আমার নিয়াজ করেনি আমার তো মনে হয় এই মেয়ের দোষ নিশ্চই আরাফ ঘরে নেই তাই ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ছেলেকে নিজের রুমে ডেকেছে।নিশ্চই ভেবেছিল আরাফকে যেভাবে ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেবে ঠিক সেই কাজ নিয়াজের সাথেও করবে।
– কেন বলেছেন এইসব উদ্ভট কথা।আপনার ছেলে কি দুধে ধৌয়া তুলসি পাতা।আপনার ছেলের ঠিক কতটা নিম্ন শ্রেণির তা আমি এই বাড়িতে অল্প কয়েকদিন থেকেই বুঝে ফেলেছি।

মাইশার তীক্ষ্ণ জবাবে সবাই বেগবান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।তানিয়া মাইশার কথায় রাগ ঝেরে বলে,

– এই মেয়ে তোমাকে না বলা হয়েছে আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তুমি ঢুকবে না।কথা কি কানে যায় না তোমার?
– সরি, তবে চুপ থাকতে পারলাম না যেখানে অন্যায় সেখানেই মাইশা।আর মেয়েদের নির্যাতন সেনসেটিভ বিষয় অন্তত সবাই এই নরপশুটার দলে ভিড়লেও আমি ভিড়বো না।
মাইশা উওর শুনে সবাই চুপ থাকে। তখনি কপালে হাত দিয়ে বাড়ি ঢুকে আরাফ।কিন্তু রাতের তিনটায় লিভিং রুমের সবার উপস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে নিলনা সে।সবার মাঝে হৃদিতাকে খুঁজতে থাকে তার দু চোখ।মাইশার পাশে বিদ্ধস্ত অবস্থায় হৃদিতাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। মুখে,হাতে গলায় তার আচড়ের দাগ ভাসমান।
– কিরে কি হয়েছে তোর?
আরাফ প্রশ্নে দেরি হলো কিন্তু হৃদিতার হুমড়ি পরে কাদঁতে দেরি হলোনা।আরাফকে ফুফিঁয়ে কেঁদে উঠে। তার কান্নায় ছমছমে পরিবেশ হয়ে যায় এনায়েত মঞ্জিলে।

তখন রাতে নিয়াজ হৃদিতার রুমে ঢুকে ধস্তাধস্তি শুরু করলে,নিজেকে ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করে হৃদিতা।ততক্ষনে নিয়াজের নখের দাগ তার শরীরে আছড়ে যায়।উপায়ন্তর না পেয়ে নিয়াজকে ধাক্কা দেয় হৃদিতা তখনি ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মাথা গিয়ে ঠেকে নিয়াজের। কাচঁ ভাঙ্গার শব্দে আরো একবার জেগে যায় বাড়ির সবাই।কাশতে কাশতে হৃদিতা নিচে নেমে এলেই তাকে ঝাপটে ধরে নেয় মাইশা।নিয়াজের বেগতিক অবস্থা দেখে দ্রুত ব্যান্ডেজ করে দেয় জাহিদ।তারপর লিভিং রুমে শুরু হয় বিচারকার্য।পুরোটা সময় লজ্জায় বাকরুদ্ধ ছিলেন হুমায়রা।

হৃদিতা শ্বাস আটকে আসা কান্নায় আরাফের পাগল হওয়ার মতো অবস্থা।বাড়ির সব মুরব্বিদের উপেক্ষা করে আজ মাইশা তেলে বেগুনে জ্বলে।উঠেছে। আরাফের কাছ থেকে হৃদিতাকে একটানে সরিয়ে এনে ধমক সুরে বলে,

– বিয়ে করে ছিলে কেন,যদি একটি মেয়ের নিরাপত্তাই না দিতে পারো।যতসব!
আরাফ মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।আজকে যা হলো তা হৃদিতার চরিত্রে আঘাত পড়লো।সোফার উপর নিয়াজকে দেখেই ছুটে এসে তার কলার টেনে ধরলো আরাফ।সঙ্গে সঙ্গে সবার আরাফকে পেছন থেকে আটকে ধরে।আরাফ নিয়াজকে মারতে নিয়েই আইদার বাবা জসীম এসে তাকে বাধঁ দেয়।

– দেখ নিয়াজের দোষ একা আমি দিচ্ছি না।হৃদিতাকে কে বলেছিল দরজা খুলতে আমার তো এই মেয়েটাকেই সন্দেহ হয়।
তানিয়ার যুক্তিহীন অভিমতে আরাফ আর মাইশার রাগে শরীর থরথর করে কাপঁতে থাকে।এক হাতে হৃদিতাকে হেচঁকা টেনে কাছে এনে তানিয়ার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,

– এই বাড়িতে ন্যায় বিচার কোন দিন হয়নি আর হবে ও না।আমার হৃদিতা কেমন তা আমি ভালো করেই জানি।অন্তত আপনার কাছ থেকে তার চরিত্র সম্পর্কে আমি জানতে চাই না।মেনেই নিলাম দোষটা আমার বউয়ের তবে আইদা!আইদা কি দোষ করেছিল?তার সাথে নিয়াজ এমং নোংরা ব্যবহার করে কেন?সাবধানে থাকবেন চাচি,আজ হয়তো হৃদিতা বাইরের মেয়ে বলে তাকে সঙ্গ না দিয়ে চরিত্রহীন ছেলের প্রতি দল গড়ছেন।বলা তো যায় না কবে আপনার মেয়ের উপর নেকড়ের আঁচড় পড়ে।

আরাফ হৃদিতাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায় সবাই এদিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখনীতে পলি আনান

হৃদিতার নিশব্দে দুচোখ দিয়ে পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে আরাফ তার হাতে, পায়ে গালে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আরাফের ছোঁয়াও এই মূহুর্তে তার বড্ড বিষাক্ত লাগছে।হঠাৎ করেই আরাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় হৃদিতা।অবাক হয়ে আরাফ তার দিকে তাকালে সে ঝাঝালো গলায় বলে,
– কোথায় ছিলি তুই?নেশা করতে গেছিস আর আজ নেশা করিস নি?সজ্ঞানে কীভাবে আছিস?
আরাফ দীর্ঘ ছাড়লো,
– শাকীল এক্সিডেন্ট করেছে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম।
হঠাৎ করেই পরিবেশটা যেন গুমুট হয়ে যায়। হৃদিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে চোখ মুছে বলে,
– শ..শাকীল ভাইয়ার কি হয়েছে?
– বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। নাফিসা ভেঙ্গে পরেছে রে তাদের কাছেই ছিলাম।কিন্তু আমি জানতাম না এমন কিছু হবে।আর ফোনেও চার্জ ছিল না পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল আমি তোকে ফোন করেও জানাতে পারলাম না।মাফ কর আমায়।

হৃদিতা আবারো কেঁদে দেয়।আরাফের কলার খামছে ধরে বুক ভাসাতে থাকে আরাফের।হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে আরাফ মনে মনে বলে,
– চিন্তা করিস না।ভালো কিছু হবেই দেখিস। একদিন এ বাড়ির প্রত্যাকটা কাল সাপের মৃত্যু আসবে। আসতে হবেই!

পরের দিন খুব ভোরে কেউ যেন আরাফের রুমের দরজায় করাঘাত করছে।ক্লান্ত আরাফ ঘুমিয়ে আছে। তার পাশে হৃদিতা নিদ্রাহীন রাত্রিযাপন করেছে।দরজায় কারো আসার শব্দে হৃদিতা উঠে যায়।মনে ভয় থাকা শর্তেও সাবধানতা অবলম্বন করে দরজা খুলে। কিন্তু দরজার বাইরে আরাফের মাকে দেখতে পাবে ইহজন্মেও সে আশা করেনি।
– আপনি?

মায়মুনা হৃদিতার প্রশ্নে উওর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে রুমে ডুকে দ্রুত দরজা আটকে দেয়।
– আরাফ কি গভীর ঘুমে?
– জি আন্টি!
মায়মুনা চকিতে তাকালো হৃদিতার দিকে।হৃদিতার মাথা টেনে কপালে নিজের অধর ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
– আন্টি না মা ডাকিস।আমার মেয়ে নেই।
হৃদিতা চমকায়!এই মহিলা কাল রাতেও তার বিপক্ষে ছিল তবে হঠাৎ করেই রুপ পাল্টালো কেন?এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তিনি হৃদিতার হাতে একটি চেক তুলে দেন।
– এটা কেন মা!এত টাকা।
– চুপ কর আর আস্তে কথা বল আরাফ উঠে যাবে।এখানে পাচঁ লক্ষ টাকা আছে।বলা তো যায় না কখন তোরা কোন বিপদে পড়িস। বিপদ তোদের চারিদিকে উৎ পেতে আছে মা।তোদের নিজেদের কোন সঞ্চার নেই আমি জানি তাই এটাই তোদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
– কিন্তু কিসের বিপদ?

– আহ!এত কথা বলছিস কেন আমার কথা গুলো মন দিয়ে শোন। এই বাড়িতে যা তোরা প্রকাশ্যে দেখিস তা কিন্তু সত্যি নয় আবার যা আড়ালে ভাবিস তা কিন্তু সত্যি নাও হতে পারে।আরাফ আমার অনেক কষ্টের সন্তান।আমার বিয়ের নয় বছর পর আরাফ হয়েছে মানে বুঝতে পারছিস।খুব অল্প বয়সেই আমার শাশুড়ী আমায় এই বাড়িতে আনে।কোন দিন কোন আদর যত্নে ত্রুটি রাখে নি।আমি ছিলাম শিক্ষিত ধাঁচের মেয়ে।বিয়ের পরে এবং আগে পড়াশোনাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।যার দরুনে স্বামীর হাতে হাত রেখে এত বড় ব্যবসা সামলাচ্ছি।কিন্তু ছেলেটাকে আমি আমার মত গড়ে তুলতে পারিনি রে।

যাই হোক আমার শেষ কথা একটাই তুই আমার ছেলেকে তোর আচঁলে বেঁধে রাখবি।কি হলো অবাক হচ্ছিস শাশুড়ী হয়ে এমন কথা বলছি বলে?আমাকে যেমন শাশুড়ী মানিস তেমন বন্ধুও ভাবতে পারিস।যেকোন প্রয়োজনে আমার কাছে আসবি তবে একটা কথা এই বাড়ির কারো সামনেই তোর সাথে আমি ভালোভাবে কথা বলতে পারবো না।আগে যেমন রুট বিহেব করেছি আবারো করবো।তুই মনে কষ্ট নিস না মা।আমার ছেলেটাকে দেখে রাখ তার সংসারের হাল ধর তোর নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যা।আমি যে এখানে এসেছি তোকে চেক দিয়েছি এইসব কিচ্ছু আরাফকে জানাবি না। টাকার চেকটা তোর কাছেই রাখ গোপনে।আমি আসি।

মায়মুনা দ্রুত রুম ত্যাগ করেন।এদিকে হৃদিতা স্থির হয়ে গেছে।একটু আগে কি হলো তার হিসাব মেলাতে পারছে না সে।

কেটে যায় বেশ কিছু দিন।অনেক চিন্তা ভাবনার পর হৃদিতা সিধান্ত নিয়েছে আরাফকে সে হারাবে না।প্রভা তার জীবনে ফিরে এলেও না। যেখানে আরাফ আর তার ভালোবাসা সত্য তাহলে সেখানে অন্য ব্যাক্তির হস্তক্ষেপে কেন মানবে হৃদিতা।দুজন দুজনের অনুভূতি ভালোবাসা প্রকাশ না করলেও কাজে কর্মে প্রকাশ পাইয়ে দিচ্ছে।

মাইশা আর নোমানের সম্পর্ক বেশ উন্নতি হয়েছে।অতীতে মাইশাকে বাড়ির সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও নোমানের কিচ্ছু যায় আসতো না।কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উলটো মাইশাকে কেউ কটাক্ষ ভাবে কথা বললেই প্রতিবাদ করে নোমান।বাড়িরে বর্তমানে মাইশার রাজ্যত্ব বিদ্যমান।সবাই জানে বাড়ির সিংহ নোমানের হবু স্ত্রী মাইশা।সেখানে কার বা সাধ্য আছে মাইশাকে অবজ্ঞা করার।

নিয়াজ সেদিনের পর সুস্থ হয়ে আবারো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।সেদিনের পরের দিন নিয়াজের সাথে তুলকালাম ঝগড়া হয় আরাফের।বাড়ির কেউ আরাফকে ঠান্ডা করতে না পারলেও হৃদিতার একবার চোখ ইশারায় আরাফ ঠান্ডা হয়ে যায়।তাদের ব্যাপারটা দেখে দূর থেকে আড়ালে মিটিমিটি হাসে মায়মুনা

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।হৃদিতার অপেক্ষায় আরাফ থাকতে থাকতে রাতের প্রায় নয়টা বেজে গেছে এখনো টিউশন থেকে বাড়ি ফিরে নি হৃদিতা।হৃদিতার মোবাইল বন্ধ,পরিচিত সবার নাম্বারেই ফোন করা শেষ আরাফের, কিন্তু হৃদিতার খোঁজ নেই।
ক্রমশ চিন্তা বেড়েই চলেছে একপর্যায়ে হৃদিতা যেখানে পড়ায় যেখানে গিয়ে যানতে পারে হৃদিতা আগেই চলে গেছে।তবে হৃদিতা কোথায়?নিয়াজ কোন ক্ষতি করে দেয়নি তো?মুখে হাত দিয়ে মাঝ রাস্তায় থেমে যায় আরাফের গাড়ি।তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসা বন্ধুরাও থেমে যায়।
– কি রে আরাফ। থেমে গেলি কেন? হৃদিতাকে খুঁজবি না?
– আমি হৃদিতাকে খুঁজে পাবো তো?
আরাফের প্রশ্নে মুখ কুচকায় শাকীল।
– কেন পাবি না আজব!
– যদি নিয়াজ ভাই তার কোন ক্ষতি করে দেয়?
আরাফের উওরে নিশ্চুপ হয়ে যায় শাকীল আর লিবান।
#চলবে….

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here