#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[২২]

সালেহা বেগম পানি পানি করে ডেকে উঠলেন। মাঝরাত। ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে আনহা। মাকে পানি পানি জপতে দেখে উঠে দাঁড়ায় টেবিলের কাছ থেকে পানি নিয়ে মাকে তুলে বসায়। পানি খাইয়ে আবার শুইয়ে দেয়। সালেহা ঘুমিয়ে পড়ে। ফোন হাতে নিতেই চক্ষুচড়ক গাছ। এতগুলো কল দিয়েছে কে? নাম্বারটা অপরিচিত।
শেষ কলটা কখন দিয়েছে চেক করতেই দেখা গেল পাঁচ মিনিট আগেই। কল ব্যাক করল আনহা। সাথে সাথেই তুলল ওপাশের ব্যক্তি। বিশ্রী গালিগালাজ দিতেই আনহা বুঝে ফেলল লোকটা কে হতে পারে?
চাপাস্বরে আনহা জিজ্ঞেস করল,
‘ এখানে কেন কল দিয়েছ সিফাত? এই নাম্বার ট্যাক করলে তুমি ধরা পড়ে যেতে পারো সেই ভয় নেই তোমার?
‘ তোকে খুন করব আমি। হাতের কাছে পায় তোকে তোর এমন অবস্থা করব তুই ভাবতে ও পারছিস না। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম একদম ভালো হবেনা। ভাগ্যিস আমি ওই ট্রাকের ড্রাইভার আর লোকটাকে নিজের পরিচয় দেইনি নইলে তো আমি ধরা পড়ে যেতাম। আমার সাথে একদম ভালো করলি না তুই।
একপ্রকার হুমকি দিয়ে কল কাটল সিফাত। হাউমাউ করে কেঁদে দিল আনহা। রুমের বাইরে বের হলো যদি মা জেগে যায়। সাহিলের মুখোমুখি হঠাৎ। আনহাকে দেখে সাহিল হাসতে চেয়েও পারল না। কাঁদছে কেন আনহা?
সাহিল কাছে এসে আনহাকে দেখল। কি হয়েছে বোন? কাঁদছিস?
আনহা ঝাপটে জড়িয়ে ধরল সাহিলকে।
‘ আমার খুব ভয় লাগছে ভাইয়া। সিফাত আমাকে হুমকি দিল। বলল,
‘ আমাকে নাকি খুন করবে। ও পারেনা এমন কোনো কাজ নেই ভাইয়া। খুব নিষ্ঠুর মানুষ।
সাহিল আনহাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ লোকটা কোথাকার? তোর সাথে কিভাবে পরিচয়?
‘ গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিলাম আগে। তখন থেকে।
সাহিল বোনের হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল। তুমি এতরাতে কোথায় গিয়েছিলে? এখন ফিরছ?
সাহিল বলল,
‘ মাকে দেখতে এসেছিলাম, ঘুম?
আনহা বলল,
‘ হ্যা।
সাহিল বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
‘ চিন্তা নেই। ভাই আছি। ও লোকটাকে আমি খুঁজে বের করব। একটু সময় দে।

একটা মাস পার হলো। সালেহা বেগম সুস্থ হলো ঠিক কিন্তু কাউকে ভালো করে চিনতে পারেনা আনহাকে ছাড়া। অপারেশন দেওয়া হলো তার পরের মাসে। ট্রাকের সাথে আঘাত লাগায় মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। সেই তখন যখন আনহা খুব ছোট্ট ছিল। টেনের স্টুডেন্ট ছিল। গার্মেন্টেসে চাকরি করত সালেহা। একমাত্র মেয়েকে মানুষ করাই তখন তার লক্ষ্য ছিল।

গর্ভের সন্তান নিয়ে মাঝরাতে তিনি বের হয়ে গিয়েছিলেন আহমেদ বাড়ি থেকে। তখন মাত্রই নতুন বাড়িতে উঠেছিলেন। সাগর সাহেবে সেদিন অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই মেরেছিলেন। ঘুমন্ত ছেলে মা বাবার ঝগড়া দেখে ঘুমিয়েছিল সোফায়। শুকনো মুখটাতে আদর দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে সালেহা বিদায় নিয়েছিল আহমেদ বাড়ি থেকে। গর্ভের সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে তো খুন করবে ফেলবে সাগর সাহেব। এই নারী বিদ্বেষী লোক পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। সালেহা সেই ভয়ে পালিয়েছিল। তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য যা করতে হয় সে করবে। এক বৃদ্ধা মহিলার হাতে গিয়ে পড়েছিল সালেহা। সেদিন বাইরে ভারী বৃষ্টিপাত। বাপের বাড়িতে শুধু সৎ মা আর সৎ ভাই ছিল। তাদের কাছে যাওয়ার জো নেই। তারা কোনোমতে নিজেদের পেট চালায়। বৃদ্ধা মহিলা সালেহাকে আশ্রয় দেয়। বৃদ্ধার এক মেয়ে ছিল শুধু। সেই মেয়ের সাথে পাশের বিল্ডিং তোলা ইট ভাটায় কাজ করত সালেহা। কোনোমতে নিজের ঔষধ খরচ চালানোর জন্য।

আনহা জন্ম নেয় । ধীরে ধীরে বড় হয়। বৃদ্ধা মারা যায়। বৃদ্ধার মেয়ের বিয়ে হয়। সালেহা সেখান থেকে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বের হয় জীবিকার উদ্দেশ্যে। অনেক কষ্টে গার্মেন্টসের চাকরি পায়। শুরু হয় বেঁচে থাকার,মেয়েকে মানুষ করার লড়াই। চটপটে আনহা যতই বড় হয় সালেহার কাছে তার প্রশ্নঝুড়ি তার ততই বড় হয়। তার কেন বাবা নেই? একটা পরিবার নেই? সালেহা ততদিনে জানতে পারে সাহিলকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে সাগর সাহেব। এত জঘন্য মানুষ নিজের ছেলেকে পর্যন্ত নিজের কাছে রাখতে পারল না।
আনহা যতই বড় হয় চিন্তা ততই বাড়তে থাকে সালেহার। গার্মেন্টেস থেকে বের হয়ে কিভাবে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছাবেন সেই অপেক্ষায় থাকত। সেদিন ও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া। সামনে আনহার এসএসসি পরিক্ষা। ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে দূরে ছিটকে পড়ে সালেহা। পাগলের মতো থাকে কয়েকমাস। অনেকে বলেছিল মেয়েটার জন্য বেঁচে গিয়েছে সালেহা। শুরু হয় আনহার যুদ্ধ। এবার তার লড়াই শুরু। মায়ের কাছ থেকে কোনোদিন বাবার বাড়ির ঠিকানা শুনতে চাইনি আনহা। মা বুক কিলাতে কিলাতে কাঁদত জিজ্ঞেস করলে। বলত, আমি তোর বাপ, আমি তোর মা। কিন্তু যখন সালেহা পাগল হয়ে যায় তখন আনহা বেরিয়ে পড়ে বাবার খোঁজে। খোঁজ পায়না। শেষমেশ মায়ের জায়গায় নিজেই শুরু করে চাকরি। পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি,মাকে সামলানো, রান্নাবান্না সবকিছু এক হাতে সামলেও হাসিখুশি থাকত আনহা। কোনোকিছুই তাকে ভাঙতে পারেনা। সেই মাকে আবার সুস্থ করার লড়াই শুরু। বাড়ি ভাড়া, মায়ের ঔষধ খরচ, নিজের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়ার খরচ সবকিছু মিটিয়ে মায়ের অপারেশনের টাকা জমাতে পারেনা আনহা। এভাবে পার হয় আর ও কয়েকবছর। মাকে নিয়ে এভাবেই যেতে থাকে। অনার্স পড়াকালীন হঠাৎ করে পরিচয় হয় এক যুবকের সাথে। ফোনে কথা বলা থেকে শুরু প্রেম। এই প্রেমের আড়ালেই লুকোনো ষড়যন্ত্র। সিফাত নানান কাজে ব্যবহার করে আনহাকে। শেষমেশ পাঠায় জায়িদকে খুন করতে। বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে এমনটা বুঝানোর জন্য গায়ে হলুদের সাজে আনহাকে রাতের ট্রেনে তুলে দেয় সিফাত। যে ট্রেনে জায়িদ ছিল। এদিকওদিক তাকিয়ে খেয়াল করলে জায়িদ বুঝতে পারত আনহা তার দুই সিট পেছনে পড়েছে।
এত এত লড়াই শেষ হলো আনহার। নিজ পরিবারকে ফিরে পেল। সাগর সাহেব মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ক্ষমা চাইলেন। শুধু মাত্র তারজন্য কত কষ্ট করতে হলো মেয়েটাকে। কত আঘাত পেতে হলো সালেহাকে। যে তার সন্তানকে তার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এতকষ্ট করেছে তাকে প্রতিনহয়ত সে পাষাণ উপাধি দিয়েছে। আসলেই তো সালেহা ঠিকই ধরেছে। কেন যেন মেয়েমানুষ সহ্য হতোনা সাগর সাহেবের। হয়ত সালেহা না পালালে মেয়ে সন্তান হলে গলা টিপে মারত সাগর সাহেব। সালেহা চলে যাওয়ায় প্রতিটা পদে পদে সাগর সাহেবের ভুল ভেঙেছে। শফিক সাহেবকে দেখে রোজ রোজ হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরত সাগর সাহেব। কত সুন্দর সংসার ওই পাশের বাড়ির লোকটার। স্ত্রী একটা ছেলে, একটা মেয়ে। কত সুন্দর পরিবার। তার কেন নেই। কেন?
সালেহা বেগম সুস্থ হন প্রায় মাস তিনেক পরে। অনুতপ্ত সাগর সাহেব লুকিয়ে থাকেন একপ্রকার। সালেহাকে মুখ দেখাতে কষ্ট হয়। কত কষ্ট দিয়েছে সে এ মহিলাকে। বিশটা বছর। কম নয়। সালেহা ক্ষমা করে সাগর সাহেবকে। এতকিছুর পরেও সে নিজের স্বামী সন্তানকে ফিরে পেল। একটা ছেলের বউ পেল। আর কি চাই?
সালেহা যখন পুরোপুরি সুস্থ হলো সাহিলকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ মুন্টু কই? মুন্টুকে দেখিনা কেন?
সাহিল মাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
‘ মুন্টু নেই মা। মুন্টু স্বার্থপর। আমরা মুন্টুর কেউ নই। কেউ না।
সালেহা বেগমের মনে পড়ে নাহিলের কথা। ছবিতে দেখে ঝরঝরে কেঁদে দেয় সালেহা। কত বড় হয়ে গিয়েছে মুন্টু। তার মা কোথায়? নাতাশা? এখনো কি বজ্জাত আছে? ঝগরুটে আছে? এই এত ঝগরুটে মেয়েটা সালেহার সামনে এলেই কেমন যেন চুপসে যেত। ছোট বোনের মতো ভালেবাসত সালেহা নাতাশাকে। ঘাড়ত্যাড়া ছিল নাতাশা। কয়েকবার চড় ও খেয়েছিল সালেহার হাত থেকে। অনেকবার মনোমালিন্য ও হয়েছে। বেশিরভাগ বাপের বাড়ি থাকত নাতাশা। যেদিন সালেহা বেগম চলে যায় সেদিন নাতাশা নাহিলকে নিয়ে বাপের বাড়ি। তাই আর দেখা হয়নি।
সালেহা ফিরেছে শুনেছে নাতাশা। আসবে আসবে করে আর আসা হয়নি। একমাত্র ছেলের দেওয়া এত বড় আঘাত সইতে না পেরে শয্যাশায়ী ছিল নাতাশা। যখনি সুস্থ হয় নোরাকে নিয়ে চলে আসে। সালেহা কতক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখল। হেসে এ ও বলল, তুই তো দিন দিন সুন্দর হচ্ছে নাশু।। নাতাশা হেসে বলে, আমি ছোট দাদু হচ্ছি, সুন্দর তো হতেই হবে আপা।

চারদিকে কত আনন্দ। কত উল্লাস। সবকিছুর মাঝে বসে ও দুশ্চিন্তা কমেনা আনহার। বারান্দায় দাঁড়ালে ওই বাড়ির বারান্দা ও দেখা যায়। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখা যায়না। আনহার নিজেকে আতংক মনে হয়। সে এত বড় আতংক যে তার কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সন্ত্রাসের আতংক ইশতিয়াক তালু্কদার।

নাতাশা বেগমের সাথে নোরা এল। নাতাশা বেগম নিজের ছেলের রুমে গিয়ে কেঁদে ফেললেন আওয়াজ করে। সাহিল তার নাহিলের ছবি দিয়ে ভর্তি পুরো রুম। ছবি তুলতে ভীষণ পছন্দ করত নাহিল। ছবি দিয়ে নিজের পুরো ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে পাড়ি দিল বিদেশে। মায়ের সাথে রাগ আর অভিমানে। তারমতে সোরাকে না পাওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী তার মা। নোরা দেখে হাসিমুখের ছেলেটির ছবি দেয়ালে টাঙানো। সারাক্ষণ নোরাকে রাগিয়ে দেওয়ার তালে থাকত। আর ঝগড়া। টেবিলে বসে ও কয়েকবার দুমদাম খেয়েছে নোরা। একবার তো চেয়ার নিয়ে পড়ে গিয়েছিল নোরা। সেইবার কি যে ব্যাথা পেল পিঠে!
এই ছেলেটাকে এখন আর কোথাও দেখা যায়না। কোথাও না। নোরার সাথে বিয়ের কথা তোলায় একেবারে বিদেশ পাড়ি জমালো নাহিল। নোরাকে সে বোনের চোখেই দেখে এসেছে, অন্যকিছু সে ভাবতে পারবেনা। তাছাড়া সোরাকে দিয়ে ফেলা জায়গা সে অন্য কাউকে দিতে পারবেনা। থাকুক না একা। একা থাকা যায়।

সালেহার সাথে ফোনে কথা বলল নাহিল। সাহিল শুনল ভাইয়ের গলা। রাগে, অভিমানে সে কথা বলল না। নাহিল সালেহাকে কত জোর করল! কিন্তু সাহিলকে কথা বলাতে পারল না। কথা বলল না সাহিল। সে না ছিল ভাইপাগলা। কোথায় গেল এখন সেই পাগলামি? কোথায়? অস্ট্রেলিয়া থাকা অবস্থায় দিনে কতবার ফোন দিত নাহিল। সেই ছোট্ট থেকেই। সারাদিন ভাইয়ের সাথে কথা বলে ও যেন পোষাতো না নাহিলের। নোরা দাঁড়িয়ে শুনে নাহিলের কথা। অনেক অপেক্ষা করেছে সে এই ছেলের জন্য। এই ছেলের মন পাওয়ার জন্য। সেই তখন থেকে, যখন থেকে সে বুঝতে শিখেছিল ভালোবাসা কি?
কিন্তু এখন? বাবার শেষ ইচ্ছে তার পূরণ করতে হবে। নাহিল ভাই সোরার হয়ে গেছে। অন্যের হয়ে ও সোরা নাহিল ভাইয়ের । নাহিল ভাই চাইবে না আর কাউকে। সহজ সরল হলেও প্রচন্ড ত্যাড়া এই নাহিল ভাই। যা বলবে তাই করবে। করে ও। করছে ও।

নোরা এসেছে খবর শুনে জাহেদা খবর পাঠাল সাগর সাহেবকে। সবাইকে নিয়ে যাতে তাদের বাড়িতে যায়। সালেহা বেগমকে দাওয়াত খাওয়াবে। ছেলের শ্বশুরবাড়ি দেখবেন।

নোরার বাবাকে ও আসতে বলল নাতাশা। নিজের ছেলেকে নিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখিয়েই গেছে সে নোরাকে। এবার নিজে দাঁড়িয়ে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেবে।

জিনিয়া ভীষণ খুশি হলো। জায়িদকে ফোন করে বলে রাখল, তাড়াতাড়ি ফিরো ভাইয়া। সারপ্রাইজ আছে।
জায়িদ প্রত্যুত্তরে হাসল শুধু। আগে আগে চলে আসল জিনিয়া। মাকে সাহায্য করবে কাজে। কিন্তু জাহেদা মেয়েকে পানি ও ছুঁতে দেয়না। তোর বর আবার আমার উপর ফুলে থাকবে জুনু। বলবে, আমার বউকে কাজ করানোর জন্য নিয়ে গেছে।
জিনিয়া হাসে মায়ের কথায় । সাহিলের কথা ভাবতেই হাসি পায়। লোকটা চূড়ান্ত পাগলামি করে। আর সবাই মজা নেয় তা বলে বলে।

নোরাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিল আনহা। বলল,
‘ কম করে সাজালাম নোরা। পুলিশ অফিসাররা নকল রূপ দেখতে পছন্দ করেন না।
আনহা এদিকে সাজালো, ওদিকে নোরা কাঁদল। নাহিল ভাইয়ের জন্য সাজতে চেয়েছিল সে। ফুপী যে বলল, সঠিক মানুষ পেলে অতীতের মানুষটাকে কেন পুরো অতীত ভুলে থাকা যায়। তারমানে নোরা নাহিল ভাইকে ভুলে যাবে? আর নাহিল ভাই তা জীবনে তো কেউ এলনা তাহলে? সোরা থেকে নাহিল ভাইয়ের মনে।
আনহা জানে নোরা নাহিলকে পছন্দ করে। নোরার চোখের পানি দেখে আবার ও তার প্রমাণ পেল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘ পুলিশ অফিসার ভালো। তোমাকে ভালো রাখবে। তোমার দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখবে।
নোরা তো বলেই ফেলল।
‘ তুমি এতকিছু কি করে জানো আনহা আপু?
আনহা থতমত খেল।
‘পাশের বাড়ি তাই জানি। তাছাড়া ওনাদের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলাম আমি। তাই জানি।
নোরা আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
তালুকদার বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসলেন সবাই। সালেহা বেগম ভেতরে রান্নাঘরে চলে এলেন। জিনিয়াকে ডেকে বললেন,
‘ তোমার বর কোথায় বৌমা? আজ সারাদিন বাসায় আসেনি। কল ও ধরছেনা।
জিনিয়া বলল,
‘ ওনার কাজের চাপ বেশি। বাবার কেনা রিসোর্ট গুলো নিয়ে একটু ঝামেলা চলছে, একা হাতে সামলাতে হচ্ছে তাই। আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল কিছু আগে। আপনাকে বলতে বলেছিল, আমি বলতেই যাচ্ছিলাম।
সালেহা হাসল । আচ্ছা। সাবধানে থেকো। জিনিয়া মাথা নাড়ল।

নোরা যাওয়ার আগে আনহাকে খুঁজে পেলনা। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে গেল। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আনহার হাত ধরে ডাকল নোরা।
‘ আনহা আপু চলো। নিচে যাই। চলো।
আনহা গেলনা।
‘ আমি যাবনা, আগেই বলে রেখেছি নোরা। তুমি যাও। তোমার বাবা আবার চেঁচামেচি করবে।
নোরা যেতে চাইল না।
আনহা জোর করে পাঠিয়ে দিল নোরাকে। মুখ কালো করে চলে গেল নোরা।

আনহা দাঁড়িয়ে থাকল ছাদে। মা কত জোর করল। বাবা জোর করল। শফিক আন্কেল জোর করল। গেল না সে। তার যেতে ইচ্ছে করল না। দূর থেকে দেখবে। মাকে বলেছে ভাইয়া আসলে যাবে। কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে নেই আনহার।
জায়িদের গাড়ি থামল গেইটের কাছে এসে। আনহা দেখল পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল জায়িদ ফোনে কথা বলতে বলতে। ব্যস্তভঙ্গিতে ডুকে পড়ল বাড়িতে। এদিক-ওদিক তাকাল না। পায়ের ভর দিয়ে তাকিয়ে দেখল আনহা। জায়িদ বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।
জিনিয়া দৌড়ে এল। না না করে বলল,
‘ এখন ডুকবেনা ভাইয়া। সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ।
জায়িদ বলল,
‘ তোর বর কই জুননু?
জিনিয়া বলল,
‘ উনি আসছেন। তোমাকে কি সারপ্রাইজ দিতে পারি বলোতো। জায়িদ ডুকে যেতে চাইল।
জিনিয়া আটকালো।
জায়িদের কপালে ভাঁজ পড়ল। বাড়িতে কারা এসেছে। জুননু ডুকতে দে।
জিনিয়া বলল,
‘ নোরা এসেছে। ওর ফ্যামিলি ও। এবার বলো সারপ্রাইজটা কেমন হয়েছে?
জায়িদের কপালে আর ও গাঢ় ভাঁজ পড়ল।
‘ নোরা কে?
জিনিয়া কোমড়ে হাত দিল। নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ ওইদিন আম্মা বলেছে না?
জায়িদ বলল,
‘ হ্যা বুঝতে পেরেছি৷ নাহিলের কাজিন। কেন এসেছে?
জিনিয়া আর ভালোভাবে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
‘ ও আমার ভাবি হবে। বুঝেছ?
জায়িদ গম্ভীরস্বরে বলল
‘ মজা না জুননু। আমি বিগ ব্রাদার।
জিনিয়া হেসে বলল,
‘ জানি জানি ।
ফোন এল জায়িদের। ফোন তুলে কানে দিল জায়িদ।
বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে।
ওপাশ থেকে কনস্টেবল বলল,
‘ স্যার লোকগুলো আসলেই কোনো কিছু জানেনা। ওদের টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। সিফাত নামের লোকটাকে ওরা চেনেনা।
জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা। আমাকে সবকিছুর আপডেট জানিও।
কল কাটল। ঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগেই জায়িদের চোখ গেল ওই বাড়ির ছাদে। ছাদের আবছা আলোয় দাঁড়ানো আনহা তাকে তাকাতে দেখে পিঠ করে দাঁড়াল। জায়িদ ডুকে পড়ল ঘরে। বেশিক্ষণ দাঁড়াল না।
বাড়িভর্তি লোক দেখে ও কৌতূহল দেখালো না। ব্যস্তপায়ে হেঁটে নিজের রুমে গেল। জাহেদা সবার সাথে মেকি হাসল।
‘ আসবে এখন ও। বুঝতেই তো পারছেন পুলিশের কাজ।
নোরা ছাদে। কথা বলছে আনহার সাথে।
জাহেদার চিল্লাচিল্লিতে পাঞ্জাবি গায়ে দিল জায়িদ।
‘ এসব কি হচ্ছে আম্মা? তোমাদের এত তাড়া কিসের আমি বুঝিনা। আমি এসব করতে পারব না এখন।
‘ তুই করবিনা তোর বাপে করবে।
‘আমার বাপকে করতে বলো। আমি পারব না আম্মা।
জাহেদা ধমকালেন।
‘ সোজা নিচে আয়। সবাইকে সালাম দিবি। কথা বলবি। এখন তো মনে হচ্ছে তোকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। আশ্চর্য!
নোরা ওখানে নেই। ও জুনুর সাথে। ওর সাথে আলাদা করে কথা বলিস।
‘ কোনো আলাদা টালাদা করে কথা বলতে পারবনা আম্মা। আমি এসব পারব না। জোর করোনা আম্মা।
জাহেদা চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেলেন। জায়িদ বিরক্ত হয়ে ঢলে পড়ল বিছানায়।
কি হচ্ছে এসব? এমনটা না হলেও পারত।

_______

দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। জায়িদ কথা বলছিল সবার সাথে। হেঁটে গিয়ে সে দরজা খুলেই সাহিলকে দেখল। হাসল।
‘ এতক্ষণ কেন তোর? আর ও আগে আসতে পারলি না?
সাহিল বলল,
‘ অনেক আগেই এসেছি। আনহা নাকি আসেনি তাই ওকে আনতে গিয়েছি আবার। দেখলাম ও চলে এসেছে। তাই।
সালেহা বেগম দৌড়ে এল।
‘ আনহাকে আনলিনা আব্বা। তোর সাথে আসবে বলেছিল।
সাহিল পাত্তা হীন সুরে যেতে যেতে বলল, আনহা এসেছে মা । জিনিকে ডাকো। জিজ্ঞেস করো।
সালেহা বেগম দৌড়ালেন ছেলের পিছু পিছু।
‘ আনহা আসেনি আব্বা।
থেমে গেল সাহিল।
‘ আসেনি? তাহলে কোথায় আনহা? আমি তো ওকে দেখিনি ঘরে। সবখানে খুঁজেছি। ছাদে ও গিয়েছি।
জায়িদ বলল,
‘ ছাদে দেখেছিলাম আমি।
সাহিল বলল,
‘ বাড়িতে মেইন দরজা খোলা ছিল। আনহা কি কোথাও গেল?
সাহিল আর সালেহা বেগম চলে গেল। সাগর সাহেব, শফিক সাহেব ও গেল। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে ও খুঁজে পেলনা আনহাকে। ওড়না পড়ে থাকতে দেখা গেল বাড়ির উঠোনে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাহিল। মনে পড়ল আনহার বলা কথাটা।
‘ সিফাত আমাকে হুমকি দিল ভাইয়া।
সালেহা পাগলের মতো একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে সাহিলকে। জায়িদ গেইট ঠেলে সাহিলের কাছে গেল।
‘ কি হয়েছে সাহিল? কোথায় আনহা?
সাহিল ওড়নাটা দেখিয়ে দিল জায়িদকে। ওড়নাটা কুড়িয়ে নিল জায়িদ।
‘ সিফাত? এখানে?
সালেহা পাগলের মতো কেঁদে উঠল। সুখ পেলনা আমার মেয়ে। পেলনা।
সাগর সাহেব আটকাতে পারলনা সালেহাকে।
জায়িদ দৌড়ে গেল ঘরে। জাহেদা পেছন পেছন দৌড়াল জায়িদের৷

এদিকে নোরাকে বেহুশ অবস্থায় পাওয়া গেল। মুখে পানি ছিটাতেই নোরা উঠে কেঁদে দিল পাগলের মতো। কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ আনহা আপুর সাথে ছাদে কথা বলছিলাম আমি। হঠাৎ কতগুলো কালো বোরকা পড়া ডাকাত নাকে কাপড় বেঁধে বেহুশ করে ঘাড়ে তুলে নিয়ে চলে গেল আনহা আপুকে ।আমার দিকে গুলি তাক করায় আমি চিৎকার করতে পারিনি। আনহা আপু অনেক ছটপট করছিল।
কাঁদতে কাঁদতে আবার ও বেহুশ হয়ে পড়ে নোরা।
জিনিয়া ধরল তাকে শক্ত করে।

জাহেদা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে জায়িদকে। জায়িদ কোনেকিছুই বলল না। জাহেদা উত্তর না পেয়ে চলে গেল। ইউনিফর্ম খুঁজে গায়ে দেওয়ার আগে পড়ে গেল মেঝেতে একটি শুকনো গোলাপ। জায়িদ চোখ সেখানে আটকে গেল৷ মেঝে থেকে গোলাপ কুড়িয়ে নিল জায়িদ। কানে বাজল
‘ আমার জন্য কি আনবেন অফিসার?
‘ কি আনব?
‘ আনবেন। চুড়ি, গোলাপ, নূপুর।
জায়িদ ইউনিফর্ম গায়ে জড়াল। নিচে নেমে এল। জাহেদা দৌড়ে এল। কোথায় যাচ্ছিস আব্বা?
জায়িদ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

অন্ধকার কুঠরিতে ফেলা হলো আনহাকে। বন্দি করল তাকে সীমান্ত। আনহার জ্ঞান ফিরল। সীমান্তকে দেখে চেঁচাল আনহা। হাত বেঁধে ফেলল সীমান্ত তার। লাল শাড়ি পড়াল নিজ হাতে। ঘৃণায়, রাগে,ক্রোধে কাঁদল আনহা। থুতু মারল সীমান্তর মুখে।
কাজীর মতো কেউ একজনকে এনে বিয়ে পড়াল। আনহা চেঁচালো, এই বিয়ে মানিনা আমি। সীমান্ত হাসল হো হো করে। বিয়ে না করে কি করে তোকে ছুঁই বলতো? আমাকে তো বিয়ে করবি বলেছিলি? এখন মত পাল্টালি কেন? এখন আমার সাথে বিয়ে হলে তোকে আর কেউ বিয়ে করবেনা। তোর তেজ কি করে কমাতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম। বিয়ে করছি তোকে, তাও আমার স্বার্থে।

আনহা কাঁদল চেঁচিয়ে। গরম লোহার সিক নিয়ে ধরল তার মুখের সামনে। কবুল বলতে হলো আনহাকে প্রাণের ভয়ে। সাইন বসাতে হলো রেজিস্ট্রি পেপারে।
অন্ধকার রাত কাটল এক। জোর করে নিজের চাহিদা মেটালো সীমান্ত। সিফাত নামটা ব্লেড দিয়ে আঁকল আনহার পিঠে।
তারপর শাড়ি পেঁচিয়ে বস্তাবন্দি করল আনহাকে। ফেলে রাখল কুঠুরির এককোণে।
মৃদুমৃদু শ্বাস আসা যাওয়া করা আনহা নিজের বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছা ত্যাগ করল ।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here