#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[৯]

ছোট্ট থেকে বড় হয়ে উঠা বাড়িটার বাইরে পা ফেলতেই বুক যেন মুচড়ে উঠল জিনিয়ার। চেনাপরিচিত বাড়িটা, বারান্দা, দাওয়া আর ভালোবাসার মানুষগুলোকে পিছু ফিরে দেখতেই মনে হলো কি যেন ছেড়ে যাচ্ছে। যেন সে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। অথচ দুই মিনিটের পথ। জিনিয়া চক্ষুর কোটরে জমা জল গড়িয়ে পড়ল নীরবে। বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা অনুভব হয়। গলা রোধ হয়ে আসে। ঢোক গিলতে কষ্ট হয়। শফিক সাহেব মেয়েকে বুকে আগলে ধরেন। আজ কিচ্ছু বলার নেই তার। কিচ্ছু না। জাহেদা হাত বাড়িয়ে ডাকতেই জিনিয়া আবার ছুটে গেল মায়ের কাছে। ভাইয়ের কাছে। জায়িদ কতক্ষণ বোনকে বুকে ধরে রাখল হিসেব নেই। জিনিয়া আবদার করল,
‘ আমার সাথে আসো।
জায়িদ হেসে ফেলল। বলল,
‘ দুই মিনিট লাগবে যেতে। সারাক্ষণ আসব আর যাব। চিন্তা করিস না জুননু। তুই ভালো থাক শুধু।
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা।
সবাই সাহিলকে খুঁজতে লাগল। সাহিল ছাদ থেকে ডাক পাড়ল।
‘ আমি এখানে। বউ পাঠিয়ে দাও।
সাগর সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘ এটা কি হলো? বউ রেখে তুই চলে গেলি? এটা কেমন রিচুয়াল?
সাহিল বলল,
‘ এটা কোনো রিচুয়াল না বাবা। এটা নতুন ট্রেন্ড। ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে এসব দেখা কত মজার তুমি জানো?
নাহিল বলল,
‘ ভাই তুমি আমাকে ডাকোনি কেন? আমি ও দেখতাম।
সাগর সাহেব নাহিলের মাথায় চাটি মারল। বলল,
‘ রাখ ব্যাটা। তোর বড়ভাইকে কান ধরে টেনে নিয়ে আয়। যাহ।
নাহিল বলল,
‘ তুমি আসতে বলো। আমি বললে আসবেনা।
সাগর সাহেব বলল,
‘ আমি এই বউমানুষকে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখব?
নাহিল বলল,
‘ তো?
সাগর সাহেব গর্জে সাহিলকে ডাক দিলেন,
‘ এই অকাল কুম্মান্ড নিচে নেমে আয় বাপ। তোর বউরে কোলে করে নিয়ে ঘরে ডুকা।
সাহিল জিহ্বায় কামড় দিয়ে দিল।
‘ এত লোকের ভীড়ে সে বউকে কোলে নেবে? সাহিল চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ এটা কেমন রিচুয়াল বাবা? আমি তো শুনিনি?,
সাগর সাহেব দাঁতে দাঁত ঘষলেন।
‘ আসবি নাকি আসবিনা?
সাহিল বিরক্তি নিয়ে নামতে গেল। সাগর সাহেব বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করল,
‘ কেমন আক্কেল ছেলের? নতুন বউকে নাকি হাঁটাতাম?

সাহিল নিচে নামল। সাগর সাহেব ইশারায় জিনিয়াকে দেখিয়ে দিল। সাহিল মাথা চুলকালো। সাগর সাহেব চোখ লাল করে তাকাল। সাহিল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। সাগর সাহেব চেঁচাতে লাগলেন।
‘ এতগুলো লোকের সামনে মেয়েটা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? এতবড় ছেলে হয়েছিস, আক্কেল হয়নি তোদের।
নাহিল বলল,
‘ আমাকে ও বকছ কেন? আমি কি করেছি?
সাগর সাহেব নাহিলকে নিয়ে লাগলেন।

জিনিয়ার হঠাৎ মনে হলো সে হাওয়ায় ভাসছে। সাগর সাহেবের চেঁচানি বন্ধ হয়ে গেল। সাহিলের দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকল। সাহিল জিনিয়াকে নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করল,
‘ সুন্দরী বউয়ের প্যারা আজ থেকে শুরু হইছে।
জিনিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ কি বললেন?
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাল থেমে গিয়ে। আবার হাঁটা শুরু করে বলল,
‘ বলেছি শক্ত করে ধরো, নইলে ফেলে দেব।
জিনিয়া হেসে সাহিলের গলা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। টেনে ধরে বলল,
‘ এই যে ধরলাম। ফেলে দিলে কিন্তু খবর আছে।
সাহিল একগাল হেসে বলল,
‘ শুধু শুধু নিজেকে আঘাত দিতে যাব কেন?
জিনিয়ার দিকে আর তাকাল না সাহিল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ ওভাবে দেখতে নেই মেয়ে।
জিনিয়া মৃদু হেসে বলল,
‘ দেখছি কই?

তরিনা খাতুন দরজা খুলে দিয়ে বললেন,
‘ হয়ছে গুড্ডু তোর বউকে এবার দাঁড় করা।
সাহিল জিনিয়ার মুখের দিকে একবার তাকালো। তারপর বলল,
‘ না না এখানে নামতে হবেনা। একেবারে ঘরে গিয়ে নামিয়ে দেব।
পেছন পেছন যারা আসছিল সবাই একসাথে হা হু করে হেসে উঠল। জায়িদ আর নাহিল ও হাসল। নাহিল এসে বলল,
‘ ভাই তখন নিতে চাচ্ছিল না। আর এখন ছাড়তে চাইছেনা। আ___মোলোজা,,,,,,,,
সাহিল পিছু ফিরল। চেহারায় কাঠিন্যেতা ফুটিয়ে বলল,
‘ নাহিল কানের নিচে একটা দেব। তুই বড় ভাইয়ের সাথে মশকরা করিস?
নাহিল হেসে ফেলল। জিনিয়া চোখ নামিয়ে রাখল। তার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। আর লোকটা তাকে কোলে নিয়ে ঝগড়া করছে? আল্লাহ!

তরিনা খাতুন সাহিলকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
‘ আচ্ছা ঠিকাছে গুড্ডু। তুই যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাহ তোর বউকে নিয়ে। আমরা কিচ্ছু বলব না। তোর বউ! তোর সিদ্ধান্ত!
তরিনা খাতুন খোঁচা মেরে কথাটা বলল বুঝতে পারল সাহিল। সুযোগের অপেক্ষা করে জিনিয়াকে নিয়ে আবার হাঁটা ধরল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ সুযোগ আমার ও আসবে।
জিনিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ ছেড়ে দিলে কি হতো? তখন তো কোলে নিতেই চাচ্ছিলেন না।
সাহিল বলল,
‘ আরেহ তখন তো এমনি এমনি বলেছি। সিরিয়াস ভাবে বলিনি। যদি সাথে সাথে হ্যা বলে দিতাম তাহলে সবাই কি ভাবত? সবাই হাসত। বউপাগলা বলতো।
জিনিয়া হা হয়ে গেল। কি চালাক মানুষ! বাহবা!
সাহিল রুমের দরজা ঠেলে ডুকল। জিনিয়া পুরোঘরে চোখ বুলালো। সাহিল জিনিয়াকে রাখল না। তার আগেই জিজ্ঞেস করল,
‘ পছন্দ?
জিনিয়া বলল,
‘ অপছন্দ বললে কি করবেন?
সাহিল জিনিয়াকে নিয়ে আবার বের হয়ে যেতে লাগল। জিনিয়া ছটপট করতে করতে দুহাত দিয়ে আর ও শক্ত করে সাহিলের গলা জড়িয়ে ধরল। অনেকটা কাছে এসে গেল সে। সাহিল ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে আছে। জিনিয়া ঘনঘন মাথা নাড়ল।
‘ খুব পছন্দ। পছন্দ হয়েছে খুব। বাড়াবাড়ি করবেন না। এখানে রাখুন।
সাহিল মাথা দুলালো। বলল,
‘ আচ্ছা।
জিনিয়া হেসে ফেলল। বলল,
‘ আচ্ছা।
সাহিল তাকে বসিয়ে দিল খাটের উপর। বলল,
‘ এটা এমনিতে ও তোমার ঘর না। অন্যটা। এখানে ক্ষণিকের জন্য থাকবে। ধরো কিছু ঘন্টার জন্য।
জিনিয়া খাটে বসে এদিকওদিক তাকালো। বলল,
‘ বসুন।
সাহিল বসল ঠিক কিন্তু আবার উঠে গেল। বলল,
‘ সবাই চলে আসবে।
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা বসতে হবেনা।
সাহিল জিনিয়ার ঘোমটা টেনে দিল। কন্ঠ একটু খাদে নামিয়ে বলল,
‘ নতুন বউদের এভাবে থাকতে হয়।
সবাই হুড়মুড় করে রুমে ডুকে পড়ল। সাগর সাহেব বললেন,
‘ সাইড সাইড সাইড।
সবাই সাইড দিল। তরিনা খাতুন মিষ্টির প্লেট আনলেন। বললেন,
‘ নতুন বউকে মিষ্টি মুখ করাও সবাই। তারপর কথা বলবে।
নাহিল কাঁটাচামচে করে মিষ্টি তুলে নিল। বলল,
‘ ভাবিজান ঘোমটা তোলেন। মিষ্টি খান। আর আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলেন।
ঘোমটার আড়ালে জিনিয়া হেসে ফেলল। সবার পেছনে দাঁড়ানো শফিক সাহেব আর জায়িদ। দুজনই এদের পাগলামি দেখে হাসতে লাগল। সাহিল নাহিলকে বলল,
‘ এতবড় মিষ্টি কি করে খাবে? কেটে দে।
নাহিল চোখ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সাহিলের মুখের কাছে এসে বলল,
‘ ভাই বউ কি তোমাকে জাদু করছে?
সাহিল রেগে গেল।
‘ নাহিল?
নাহিল সরে গেল দ্রুত। মিষ্টি একটুখানি জিনিয়াকে ঘোমটার নিচে খাইয়ে বাকিগুলো সে নিজের গালে পুড়ল। খেতে খেতে বলল,
‘ ভাবিজান ভালা, কম খায় বেশি খাওয়ায়।
সবার মাঝে হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল মুহূর্তেই। শফিক সাহেব এসে ঘোমটা তুলে দিলেন মেয়ের। চামচে একটুখানি মিষ্টি নিয়ে মেয়ের মুখের কাছে রাখলেন। বললেন,
‘ আমি ও মিষ্টিমুখ করায়?
জিনিয়ার দুচোখ জলে ভর্তি হলো। বাবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিষ্টি গালে নিল জিনিয়া। শফিক সাহেব জায়িদকে ইশারায় ডাকলেন। জায়িদ বোনকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে জিনিয়ার হাতে চামচ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ জুননু আমাকে মিষ্টি বড়টা দে।
জিনিয়া আশপাশ না দেখে আওয়াজ করে হেসে ফেলল। জায়িদের চাওয়া পূর্ণ হলো। বোন তার হাসল। একদম কলিজায় গিয়ে লাগল সেই হাসি। বোনটা ভালু থাকুক। সাহিলের হাতের উপর জিনিয়ার হাত রাখল জায়িদ। বলল,
‘ এইটা আমার কি বলে বোঝাতে পারব না। ভালো রাখিস আমার জুননুকে। খুব ভালো রাখিস। জুননু? তুই ও ভালো রাখিস। ভালো থাকিস।
জিনিয়ার চোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে জল বেরোলো। সাহিল মাথা নামিয়ে বলল,
‘ বউটাকে শুধু শুধু কাঁদায় এরা। ভাল্লাগেনা।
সাগর সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ এখানে বোধহয় কিছু পুড়ছে। কার কি পুড়ছে? পোড়া গন্ধ পাচ্ছি বোধহয়??

সাহিল সাথে সাথেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ এটা কোনো কথা? ছেলের সাথে পাল্লা?
সবাই কিছু একটার আঁচ করতে হো হো করে হেসে ফেলল। জিনিয়া শফিক সাহেবের বুকে পড়ে রইল। খানিকক্ষণ পর মুখ তুলে বলল,
‘ আব্বা আম্মা কখন আসবে?
শফিক সাহেব মেয়ের মাথায় ঘনঘন হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ এইতো সবকিছু গুছিয়ে এক্ষুণি চলে আসবে।
জিনিয়া বলল,
‘ আম্মা একা সব পারবেনা তো।
শফিক সাহেব হেসে বললেন,
‘ তোমার মামি আর চাচীরা আছেন তো। সবাই আসবে একসাথে। চিন্তা করোনা।
জিনিয়া আবার বাবার বুকে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ আব্বা তোমরা চলে যাবে?
শফিক সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ থাকব থাকব এখানে। তুমি ভেবোনা তো অত। ঘুমানোর জন্য চলে যাব।
জিনিয়া বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মশারি? ঔষধ?
শফিক সাহেবের চোখের কোণায় জলের আভাস দেখা দিল। তিনি কাঁদার বদলে হেসে ফেললেন। বললেন,
‘ তোমার ঘরের জানালা খুলবে, বলে দেবে জানালা দিয়ে। ইশারায় দেখিয়ে দিলে হয়ে যাবে। খেয়ে নেব। আর মশারী তোমার আম্মা টাঙাবে।
জিনিয়া বলল,
‘ আব্বা আমি যখন তখন যেতে পারব না?
শফিক সাহেব বললেন,
‘ এটা কেমন কথা আম্মা? যেতে পারবেনা কেন? যখন ইচ্ছা তখন যেতে পারবে। তোমার সাথে সবসময় কথা হবে। জানালা খুললে ও দেখতে পারবে। বারান্দায় দাঁড়ালে ও দেখতে পারবে। ছাদে দাঁড়ালে ও দেখতে পারবে। সবখানে আছি তো। আমি তো এখন ভাবতেই পারছিনা দূরে কোথাও বিয়ে দিলে কি করতে তুমি?
জিনিয়া চুপটি মেরে পড়ে রইল বাবার বুকে। কি করত সে জানেনা? শুধু এটুকু জানে ওই পশুটার সাথে বিয়ে হলে সে জীবন্ত লাশ হয়ে বাঁচত। যাকে বলে জীবন্মৃত।

__________________

জাহেদা এল বেশকিছুক্ষণের মধ্যে। সাগর সাহেব বললেন,
‘ আপা মেয়েকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন। এখানে আমার চাচি ছাড়া আর কোনো মহিলা নেই। চাচি তখনকার মানুষ। অনেককিছু বললে ও জিনিমা নিতে পারবেনা। তাই আপনি শিখিয়ে দেবেন। এ বাড়িটা তারই। এই বাড়ি আর বাড়ির মানুষগুলোকে আপন করে নিলে আপনার মেয়েকে ও সবাই ভালোবাসবে। অন্য কিছুর অভাব হলেও আপনার মেয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসার অভাব হবেনা। ও আমার ছেলের বউ কম, মেয়ে বেশি। আমি ওকে আমার মেয়ের মতো করে রাখব। আমাকে যেন বাবা বলে ডাকে।
জিনিয়া মৃদুমধুর হাসল সাগর সাহেবের কথা শুনে। জাহেদা মেয়েকে বুকে নিয়ে বলল,
‘ দেখলি কি বলল? সামলাতে পারবি এত বড় সংসার? এত এত দায়িত্ব, কর্তব্য? ভালো মেয়ে হয়ে দেখাতে হবে। ভালো বউ।
জিনিয়া বলল,
‘ খুব পারব। তোমরা আমার মাথার উপর ঢাল হয়ে থেকো শুধু।
জাহেদা চুমু দেন মেয়ের কপালে।
জিনিয়ার মামি বলে উঠেন,
‘ জিনু এটার আরেক নাম নাকি নরপুরী? তোকে নারীপুরী বানাতে হবে। কয়েকটা গুলুমুলু নিয়ে আসলে হয়ে যাবে। কি বলিস?
জিনিয়া মাথা তুলতে পারল না।
জাহেদা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তোমরা বাজে কথা রাখো।

________________

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে শফিক সাহেব যাওয়ার জন্য তাড়া লাগালেন। জাহেদা আর জায়িদ জিনিয়ার মুখের দিকে তাকালো। থমথমে মুখটা। মাথা নিচু করে বসা। জায়িদ হেসে ফেলল। বোনকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ জুননু কাল সকালেই চলে আসব। তুই ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে আসব। কথা বলবি না?
জিনিয়া মাথা তুলল। কৃত্রিম হাসল। মাথা নাড়ল। জাহেদা মেয়ের মুখে হাত বুলালেন। বললেন,
‘ মুখটা এরকম করে রাখলে যেতে ইচ্ছে করে?
জিনিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। শফিক সাহেব হেসে ফেলেন। বলেন,
‘ এভাবে কি দেখছ?
জিনিয়া বলল,
‘ তোমাকে দেখি। কালকে সকাল সকাল চলে আসবে।
শফিক সাহেব মাথা দুলিয়ে বলেন,
‘ আচ্ছা আম্মা।
জিনিয়া হাসল।
সবাই চলে যাওয়ার পর জিনিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। তরিনা খাতুন তাড়া দিলেন,
‘ নতুন বউ ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকিওনা। আসো নাতবৌ।
জিনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তরিনা খাতুন হাতে থাকা কয়েকটা শাড়ি দেখিয়ে দেয় জিনিয়াকে। বলে, এখান থেকে কাল একটা পড়ো। কেমন?
জিনিয়া মাথা দুলায়।
শাড়িগুলো নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা ঠেললেও দরজা খুলেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে সাহিল গলা খাঁকাড়ি দেয়। জিনিয়া পেছনে সাহিলকে দেখে আবার দরজা ঠেলতে ঠেলতে বলে,
‘ দরজাটা খুলছেনা কেন?
সাহিল জিনিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। বলে,
‘ এটা লক করা। খুলতে চাবি লাগবে।
জিনিয়া ফিরল। সাহিলের দিকে তাকাতে চোখ উপরে তুলতে হলো। সাহিল চোখ নিচু করে জিনিয়াকে দেখে বলল,
‘ এটা নয়, ঘর ওটা।
জিনিয়া বামপাশের ঘরটা দেখে বলল,
‘ ওহ আচ্ছা।
সাহিল বলল,
‘ জ্বি।
জিনিয়া দাঁড়িয়ে থাকল। বলল,
‘ যাব কি করে?
সাহিল বলল,
‘ কেন?

‘ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন।
সাহিল তাড়াতাড়ি সরে গেল। বলল,
‘ আচ্ছা সরে গিয়েছি। ওই ঘরে যাও।
জিনিয়া দুপা বাড়িয়ে আবার থেমে গিয়ে বলল,
‘ আপনি ?
সাহিল কৌতূহল নিয়ে তাকাতেই জিনিয়া মাথা নামিয়ে ফেলল। জিভে কামড় দিয়ে ফেলল৷ কি বলে ফেলল সে?
সাহিল জিনিয়াকে আরেকটু লজ্জায় ফেলার জন্য বলল,
‘ আমি আসছি এক্ষুনি। টেনশন নিওনা।
জিনিয়া বলল,
‘ আপনি বেশি ভাবছেন।
সাহিল হেসে ফেলল। যেতে যেতে বলল,
‘ গ্রান্ডমা কোথায় তুমি? কি একটা শিখিয়ে দিয়েছ না? ভুলে গেছি। আবার শিখিয়ে দাও। গ্রান্ডমা কাহা হো তুম ?
জিনিয়া দরজা ঠেলে ঘরে ডুকল। তাজা বেলীফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। সবখানে বেলীফুল। শুভ্রতা, পবিত্রতার প্রতীক সাদা। জিনিয়া বিছানার চাদর থেকে কয়েকটা বেলীফুল হাতে তুলে গন্ধ শুঁকল। পুরো ঘর হেঁটে হেঁটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বধূবেশে নিজেকে দেখতে দেখতে একসময় চোখ গেল নিজের কপালের কাছে। ক্ষত এখনো শুকায়নি।। কালো চামড়া বিঁধে রয়েছে। জিনিয়া গলা উঁচু করে গলার ক্ষত দেখল। ছিঃ এখনো সেই নোংরা স্পর্শ লেগে আছে। কামড়ের দাগ দগদগ করছে। দাগে হাত বুলিয়ে কাঁপতে লাগল জিনিয়া৷ কাঁপতে কাঁপতে একসময় ফুঁপানি উঠল। তরতর করে কাঁপা অবস্থায় টলতে টলতে জিনিয়া খাটের এককোণায় গিয়ে বসে পড়ল। মাথা চেপে ধরল অসহ্য যন্ত্রণায়। আঁখিপটে ভাসতে লাগল সেই যন্ত্রণাদগ্ধ দৃশ্যবলি।
দরজা ঠেলে সাহিল ডুকল৷ জিনিয়া সাহিলের চক্ষুর অগোচরে ভিজে উঠা গাল মুছে নিল। খাট থেকে নেমে মামিদের কথামতো সাহিলের পা ছুঁয়ে সালাম করল। সালাম করে দাঁড়িয়ে সাহিলের দিকে তাকাল। সাহিল কি যেন বিড়বিড় করে জিনিয়ার কপাল ছুঁয়ে ফুঁ দিল। তারপর বড় করে শ্বাস ফেলে বলল,
‘ অনেক কষ্টে মুখস্থ করেছি এই দোয়াটা । গ্র্যান্ডমার চড় ও খেয়েছি। কি শক্ত মাইর!
একটু ভালো করে শিখিয়ে দিলে কি হয়? মারতে হয়?
বলেই সাহিল হো হো করে হাসল। জিনিয়া সাহিলের হাসি দেখে মাথা তুলে একটুখানি হাসল। আবার মাথা নামিয়ে ফেলল। সাহিল হাসি থামিয়ে জিনিয়ার মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘ মন খারাপ?
জিনিয়া চোখ তুলল সাথে সাথে। বলল,
‘ না।
সাহিল হেসে বলল,
‘ আচ্ছা ওখানে গিয়ে বসো তুমি।
জিনিয়া মাথা দুলালো। খাটের এককোণায় গুটিসুটি মেরে বসল। সাহিল জগ থেকে ঢেলে পানি খেল। জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ পানি খাবে?
জিনিয়া না বলল।
সাহিল বলল,
‘ চেন্জ করবে?
জিনিয়া বলল,
‘ জ্বি।
সাহিল জিনিয়ার কাছে গিয়ে বসল। বলল,
‘ এদিকে এসো, গয়না খুলতে সাহায্য করি। এগুলো নিয়ে নামাজ পড়বে কি করে?
জিনিয়া বলল,
‘ আমি পারব। আপনি ওযু করে আসুন। আমি যাচ্ছি। া
সাহিল চলে গেল। জিনিয়া গয়নাগুলো খুলে রেখে দিল। গলার ক্ষতস্থানে আচঁড় লাগায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো। ওযু করতে গিয়ে ঝরঝরে কেঁদে ফেলল সে। মুখে ঘন পানির ঝাপটা দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ওযু করে এসে দুজনেই নামাজ পড়ে নিল।
জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে জিনিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের খোঁপা খুলে নিল। কোনোমতে হাত খোঁপা করে জগ থেকে ঢেলে পানি খেল। পানি খেয়ে গ্লাস রাখতে রাখতে সাহিলকে বলল,
‘ আপনার মা কোথায় থাকে? আর আপনার কাকি? এখানে থাকেনা কেন?
সাহিল ফোন থেকে মাথা তুলে বলল,
‘ কিছু বললে?
জিনিয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না। মিনমিন করে বলল,
‘ আপনি হয়ত ব্যস্ত। থাক অন্যকোনোদিন।
জিনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে সাহিলের দিকে তাকাল। কিছু বলতে গিয়ে ও থেমে গেল।

সাহিলের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের গলায় হাত রাখল। সাহিলের অন্যরকম চাহনি দেখে ভড়কে গেল সে। পুনরায় ভয়ে বুক কাঁপল তার। এলোমেলো ভাবনায় বিভোর হতে হতে
দুইপা পিছু হেঁটে দৌড়ে খাটের পেছনে চলে গেল৷ গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরে ফোপাঁতে ফোঁপাতে অশ্রুবিসর্জন দিল। আচমকা মনে হলো কেউ কোমর জড়িয়ে, ধরে বেঁধে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। গলার কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস টের পেল জিনিয়া । বুক ভার হলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা হলো। জিনিয়ার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তীক্ষ্ণ ব্যাথা, যন্ত্রণাগুলো আরও যেন বেড়ে গেল।

গলায় লেপ্টে থাকা চুল সরিয়ে সাহিল সেই ক্ষতস্থানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমি কামড়াবো না। ভয় কেন পাচ্ছ?
জিনিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে সামনে ফিরে সাহিলের বুকে আটকে গেল। সাহিল জিনিয়ার মাথার পেছনে হাত রেখে বলল,
‘ আমি সীমান্ত নই জিনি। স্বাভাবিক হও।
জিনিয়া সাহিলের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে শক্ত করে ধরে কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ আপনি সীমান্তর মতো।
সীমান্তর মতো হবেন না।
সাহিল হেসে জিনিয়ার ঘেমে উঠা কপালে দীর্ঘ চুম্বন বসাল। ক্ষত হওয়া হাতের উল্টোপিঠ ভিজিয়ে দিয়ে বুকের সাথে আগলে নিল। ধীরে ধীরে কলঙ্কের দাগ মুছে দিয়ে নতুনভাবে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিল। আজ দুজনার ঘরে ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতিরা এল রাঙিয়ে দিতে। কালো দাগ মুছে দিয়ে পবিত্র ছোঁয়ায় ভালোবাসার পৃথিবী সাজিয়ে দিতে। স্মৃতির পাতায় ভালোবাসার একটি দিন একটি রাত বন্দী করতে। আজ ভালোবাসারা এল, ভালোবাসার সাগরে পানশী ভাসাতে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here