#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩৮]

ফোনের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠতেই ফোন কেঁপে উঠল। জিনিয়া কাঁপাকাঁপা হাতে ফোন তুলে নিল। কানে দিতেই লোকটির হাসির সাথে উগ্র রোষময় কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
‘ কাঁদছেন মিসেস আহম্মেদ?
জিনিয়া কথা বলতে পারেনা। অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখে শক্ত কন্ঠে বলে
‘ কেস আমি ছাড়বনা। ছাড়বনা। তোদের মতো জানোয়ারকে আমি খুন করব।
লোকটা হো হো করে হাসল। সাথে হাসল কোনো এক মহিলা। জিনিয়ার ভ্রু কুঞ্চন হলো। মহিলাটি কে? তারমানে মুননা ঠিকই বলছিল?
জিনিয়া কিছু বলে উঠার আগেই লোকটা বলল
‘ আপনি শেষপর্যন্ত তুই তুকারি শুরু করে দিলেন? দিস ইজ নট ডান ম্যাডাম। আমি কিন্তু আপনাকে রেসপেক্ট করি। তাই তো এখনো লাশ পৌঁছায়নি আপনার স্বামীর।
জিনিয়া মুখ চেপে কেঁদে দেয়। লোকটা বলল
‘ কেস থেকে সরে পড়ুন। আপনার স্বামী আপনার কাছে চলে যাবে। পুলিশকে জানালে ক্ষতি আপনারই হবে।
ফোনটা ছুঁড়ে মারে দূরে জিনিয়া। ছিটকে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় ফোনটা।
সারারাত পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে থাকে জিনিয়া। তাননা মুননা বেঘোর ঘুম। মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙে গেলে কি কি সব যেন অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে।

সকাল হতে না হতেই সালেহার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। জিনিয়া নিজেকে সামলে নেয় কোনোমতে। আর ও অনেকদূর যাওয়া বাকি। এর শেষটা দেখে ছাড়বে সে। কাউকে কিছু না বলে সে কোর্টের ড্রেস পড়ে বের হয়ে যায়। নাহলে কেউ বেরোতে দিবেনা। এক এক প্রশ্ন করতে থাকবে শুধু। জিনিয়া নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে ধারালো চকচকে ছুরিটা ও নিল। জায়িদের দেওয়া সেই পিস্তলটা ও নিল। পিস্তলটাতে চারটা গুলি আছে। দুটো জায়িদ শেষ করেছে। সাথে নিল ওই চাবির তোড়া। সকাল থেকে ঘুরল দোকানে দোকানে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেল। খিদের চোটে ক্লান্ত দুর্বল হয়ে পড়ল সে। তখন রাস্তায় একটি ছোট্ট বাচ্চা এসে জিনিয়াকে বলল
‘ উকিল ম্যাডাম আপনার চাবিটা আমাকে কি দেবেন?
জিনিয়া তার হাতের চাবিট নিজের দিকে টেনে নেয়। বলে
‘ নাহ।
ছেলেটির গায়ে ছেঁড়াজামা।
জিনিয়ার কথায় ছেলেটি বলল
‘ আমার দাদুকে দেখাবো। আব্বা দিতে বলছে। হয়ত চাবির তোড়াটা দাদু বানায়ছে।
জিনিয়া বলল
‘ তোমার দাদু?
ছেলেটা বলল
‘ হ্যা।
জিনিয়া ছেলেটির সাথে ছেলেটির বাড়ি গেল। সেখানে বৃদ্ধ মহিলা তাকে মোড়া বের করে দিল। হাসি-হাসি মুখে বলল
‘ ঠান্ডা পানি দেব?
জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে
‘ না না আমি আমার কাজে এসেছি।
ছেলেটা বলল
‘ ইনি আমার দাদু। ওনিই দোকানে বসতো আগে।
জিনিয়া বলল
‘ চাচী আমাকে এই চাবির তালার খোঁজ দিন দয়া করে।
বৃদ্ধা চাবির তোড়া ভালো করে দেখতে দেখতে বলে
‘ এক সাহেব বানিয়ে নিয়েছিল এই চাবি আর তালা। বেশ ভালো পয়সা ও পেয়েছিলাম সেবার।
জিনিয়া বলল
‘ লোকটার বাড়ি কোথায় জানেন?
বৃদ্ধা ভাবলেন। বাড়ির ভেতর ডুকে পড়ে পনের মিনিট পর বের হয়ে আসলেন। হাতে একটি কাগজ। জিনিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
‘ এখানে ঠিকানা দেওয়া আছে বোধহয়।
জিনিয়া দেখল, হসপিটালের পূর্ব পাশে, ১৭ নম্বর বাড়ি।
জিনিয়া আশপাশ না দেখে তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরল আবার ফিরতি পথে। তখন প্রায় আছরের আজান পড়ে গিয়েছে। হসপিটালের পূর্ব পাশে সতের নম্বর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাগরিবের আজানের সময় হলো । গেইটে তালা মারা। বাড়িটা ও তো কেমন যেন!
জিনিয়া ভাবলো
‘ কেউ নেই এই বাড়িতে। সে গিয়ে কি করবে?
কিন্তু ফিরে যেতে মন চাইল না জিনিয়ার। অনেক্ক্ষণ আশপাশ হাঁটল সে। পানি খেল দোকান থেকে কিনে। মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নামার সময়।

জিনিয়া হাতের বড় চাবিটা গেইটের তালায় দিতেই গেইট খুলে গেল মুহূর্তেই। হাসি ফুটল জিনিয়ার মুখে। অনেক কষ্টে গেইট খুলল সে। গেইট পেরোতেই সে দৌড়ে গেল বাড়িটার সদর দরজায়। চাবি এটা ওটা দিতেই ফটাফট দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে বড় ড্রয়িংরুমে ডুকল জিনিয়া। সারাবাড়িতে লাইট জ্বলছে কেন? মনেই হচ্ছেনা কেউ নেই এই বাড়িতে। এটি মাত্রই নতুন তোলা বাড়ি। তেমন আসবাবপত্র ও নেই। মুননার হাতের ঘড়িটা দেখতে পেল সে ছোট্ট খাটের উপর। তারমানে এখানেই মুননাকে কিডন্যাপ করে এনে রাখা হয়েছে। তারমানে এখানে সাহিল ও আছে। সতর্কতা সহিত পা ফেলে জিনিয়া। দ্বিতীয় রুমে পা রাখে জিনিয়া। একটি লম্বা গলি। চারপাশে কয়েকটা রুম। রুমগুলোর অনেকগুলোর দরজা বন্ধ। জিনিয়া দরজা ঠেলতে চাইল কিন্তু তখনি উচ্চস্বরে হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যায়। জিনিয়া সাবধানে পা ফেলল। গাউন খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। ব্যাগ থেকে পিস্তলটি বের করল সে । ফোন আনেনি । ফোনটা চলছেনা। তাই আনেনি। সোজা যেতেই একটি নীল রঙের দরজা দেওয়া রুম দেখা গেল। দরজা হালকা ভাজিয়ে দেওয়া। রুম নাম্বার চৌদ্দ। ধুপধাপ অস্ত্র রাখার শব্দ এল। সচল মস্তিষ্ক আর ও সাবধান হলো জিনিয়ার । দরজাটির সামনে দাঁড়িয়ে রইল জিনিয়া। কথা বলছে অনেকে ভেতরে। তারমধ্যে একজন বেশ তীক্ষ্ণ মেজাজে কথা বলছে। সব গুলিয়ে যেতে লাগলো জিনিয়ার। তার কানে বাজল একজনের ভয়ংকর আদেশ
‘ কালকের মধ্যেই সব কিডনি অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। এইবার কাজে কোনো গোলমাল হলে টুকরো টুকরো কেটে কুকুরকে খেতে দেব আমি। মনে থাকবে?
ছোট্ট করে সম্মতি জানালো সবাই। ক্ষেপে উঠে জিনিয়া। রক্ত টগবগ করে ফুটে। গরম হয় রক্ত।
সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কা দিল সে। ভরা জনসভায় যেন ভাটা পড়ল। স্তব্ধ, শক্ত, চমকিত হয়ে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো জিনিয়ার দিকে। গুলি বাড়িয়ে দিয়ে জিনিয়া শক্ত কন্ঠে আওড়ালো কেউ এগোলে গুলি চালিয়ে দেব। সাবধান।
একে একে নিরাপদে সরে গেল অনেকগুলো ভয়ংকর চেহারার লোক৷ জিনিয়ার সামনে আবিষ্কার হলো তার খুব প্রিয় একটি মুখ। তার প্রিয় একটি মানুষ। যার কন্ঠস্বর কানে আসলে তার বিশ্বাস হয়নি। লোকটার মাথায় ব্যান্ডেজ তবে চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মতো। হাতে ইয়া বড় এক পিস্তল। সুস্থ সবল চেহারা। তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। হাত কেঁপে উঠল জিনিয়ার। চোখে ভাঙল অবাঁধ ধারায় বৃষ্টি। বুকে হলো রক্তক্ষরণ। ভালোবাসা, বিশ্বাস শব্দগুলো ভেঙে হলো খানখান। গুলিটা বাড়ানোই থাকলো। ও-ই দূরে দাঁড়ানো লোকটা হঠাৎই গুলি তাক করল তার দিকে। চেনা মানুষটি অচেনা কন্ঠে বলে উঠল
‘ পিস্তল নিচে।
জিনিয়ার হাত থেকে পিস্তলটি পড়ে গেল নিচে। জিনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিল । উচ্চস্বরে কেঁদে ঘৃণাসহিত উচ্চারণ করল
‘ ঘৃণা করি আপনাকে। ঘৃণা। ঘৃণা।
দূরে দাঁড়ানো মানুষটা পিস্তলটি নিচে নামালো না। জিনিয়ার দিকে বাড়িয়ে রাখল।
জিনিয়া পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। সে টের পায় তার আশেপাশে এসে ঘিরে ফেলেছে ভয়ংকর জন্তুগুলো। ভয়ংকর মানুষরূপী অমানুষগুলো।

চলবে

সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here