#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[১০]
বাড়িভর্তি মানুষ। সাগর সাহেব ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসার খাতিরে হলেও ব্যবসায়ী বন্ধুদের দাওয়াত করতে হলো বিয়ের পরের দিন। শফিক সাহেবের পক্ষ থেকে এল হসপিটালের বেশ কয়েকজন ডাক্তার, নার্স, স্টুডেন্ট। সীমান্তর কুকীর্তির কথা জেনে গিয়েছে সবাই। হসপিটালে কড়া পাহারা বসানো হয়েছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে শুরু গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্ট ও খোঁজ লাগিয়েছে সীমান্তর। বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবেনা। যে বাড়ি ঠিকানাতে সে থাকত সেখানে জায়িদ গিয়েছিল। কেউ নেই সেই বাড়িতে। মা বোন সবাইকে নিয়ে পালিয়েছে সীমান্ত। বাড়িটার আশেপাশে ও পুলিশ রেখেছে জায়িদ। যাতে সীমান্ত বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেই ধরতে পারে।
পুরো বাড়িতে কোথাও জায়িদকে দেখতে পেলনা জিনিয়া। মন খারাপ নিয়ে এদিকওদিক হাঁটল। জাহেদা ও কোথায় গেল। জিনিয়া নাহিলকে ডেকে বলল,
‘ ভাইয়া আম্মাকে একটু ডেকে দেবেন।
নাহিল বলল,ঠিকাছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে জাহেদা চলে এল। জিনিয়া জাহেদাকে অভিযোগ দিল।
‘ ভাইয়া আজকে আসল না কেন আম্মা? সবসময় এমন করে।
জাহেদা মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন।
‘ চলে আসবে মা। তোর ভাইয়ার একটু কাজের চাপ বেশি। বুঝিসই তো, দেশের মানুষের জন্য কত কাজ তাদের।
জিনিয়া মাথা নাড়ল। জাহেদা বলল,
‘ তুই এখানে বোস। আমি কয়েকটা মেয়েকে পাঠায়। আর মন খারাপ লাগবেনা।
জাহেদা চলে গেল। জিনিয়া মায়ের পিছু পিছু বের হলো। কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে চলে আসতেই সাহিলের সাথে দেখা। সাহিল হাসল জিনিয়ার সাথে । জিনিয়া ও হাসল। সাহিল ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ আমাকে খুঁজছ?
জিনিয়া কিছু একটা ভাবল। পরক্ষণে সাহিল কি বলে তা দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে আবার খুলে বলল,
‘ জ্বি।
সাহিল হেসে ফেলল। আনন্দে চোখ চকচক করল। খানিকটা এগিয়ে এসে জিনিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ আমাকে কেন খুঁজছ?
জিনিয়া এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
‘ কি করছেন? কেউ চলে আসবে। নামান। এমন করবেন না।
সাহিল বলল,
‘ আমি আমার বউকে কোলে নিয়েছি। কার বাপের কি?
কয়েকটা মেয়ে হেসে এগোতে এগোতে থেমে গেল। সাহিলের কোলে জিনিয়াকে দেখে তারা আর এগোলোনা। জিনিয়ার মামার মেয়ে। সাহিল ইশারায় মেয়েগুলোকে চলে যেতে বলল। লজ্জায় জিনিয়ার মাটি ফাঁক করে ডুকে যেতে ইচ্ছে হলো। মেয়েগুলো মুখে ওড়না গুজে হাসতে হাসতে চলে গেল। জিনিয়াকে ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিল সাহিল। জিনিয়া মাথা নামিয়ে বলল,
‘ এটা ভালো হয়নি একদম। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে আপনার ভালোলাগে?
সাহিল জিনিয়ার মুখের দিকে তাকাল৷ জিনিয়া তাকাল না। সাহিল চোখ নামিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা, আর কখনো ফেলব না। দুঃখিত আমি।
জিনিয়া সাহিলকে দেখার চেষ্টা করল। হেসে বলল,
‘ রাগ করেছেন?
সাহিল চোখ তুলে বলল,
‘ না। আমি রাগ করিনা সবসময়।
জিনিয়া ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ তো কখন করেন?
‘ আমি রাগ করিনা।
জিনিয়া সাহিলের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘ আপনার অনেক রাগ। আমি দেখেছি।
সাহিল বলল,
‘ আর দেখবেনা।
জিনিয়া হেসে ফেলল। বলল,
‘ আচ্ছা আর দেখব না।
________________
প্রায় দুইতিনদিন পার হলো বিয়ের। রাতের খাবার টেবিলে সাগর সাহেব ট্রেনের টিকেট কেটে সাহিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ যাহ গ্রামের বাড়ি ঘুরে আয়। বৌমাকে তোর গ্রাম দেখিয়ে নিয়ে আয়।
সাহিল যেতেই চাইল না। জিনিয়া জোরাজুরিতে রাজি হলো।
নাহিল বলল,
‘ হেব্বি মজা হবে ভাই। ইশ আমি কখন যাব এভাবে বউ নিয়ে? ভাই তোমাদের হানিমুনটা ও সেরে আসতে পারবে।
সাহিল রাগে নাহিলের দিকে একগ্লাস পানি ছুড়ে মারল। তরিনা খাতুন নাহিলকে ধমক দিলেন,
‘ মুন্টু তোর বড় ভাই না?
নাহিল মুখ কালো করে রাখল। জিনিয়া নাহিলকে খুশি করানোর জন্য বলল,
‘ ভাইয়া আপনি ও চলেন।
নাহিল চোখ বড় বড় করে তাকালো। সাহিল খাওয়া থামিয়ে জিনিয়ার দিকে তাকালো। জিনিয়া বলল,
‘ শুধু আপনি না। বাবা আর দাদু ও।
সাগর সাহেব জিনিয়ার কথায় হাসলেন। বললেন,
‘ কি ভালো বৌমা আমার! সবার কথা ভাবে। তোমার বাপ, ভাই আর মা ও বাকি যাবে কেন? তারা ও যাক।
খুশিতে, উত্তেজনায় জিনিয়ার দুচোখ চকচক করে উঠল। বলল,
‘ সত্যি?
সাগর সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ তিন সত্যি।
জিনিয়া সাগর সাহেবকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। বলে,
‘ আমি ভাইয়াকে আগেভাগে বলে রাখি। আর না করতে পারবেনা।
জিনিয়া চলে গেল। নাহিল ঢকঢক করে পানি খেয়ে সাহিলকে বলল,
‘ হানিমুন আর হইলোনা।
সাহিল খেতেই লাগল। আড়চোখে নাহিলকে সাবধান করল। বলল,
‘ রাগ উঠছে আমার নাহিল।
_________
জিনিয়া ফোন করে জায়িদকে জানাল। জায়িদ বোন কষ্ট পাবে বলে না বলল না। বলল
‘ ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করবে। জায়িদের বোন আর বোনজামাইর সাথে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু জিনিয়ার থেমেথেমে কথা বলার ধরণ দেখে জায়িদ হেসে ফেলল। বলল,
‘ জুননু আমি বড়স্যারকে বলে দেখব। চিন্তা করিস না।
জিনিয়া হেসে ফোন রাখল।
ঘরে সাহিল এল।
জিনিয়া দৌড়ে গেল। বলল,
‘ আপনি এত রাগেন কেন হুটহাট?
সাহিল মাথা নামিয়ে বলল,
‘ কোথায় রেগেছি?
জিনিয়া বলল,
‘ ওই যে নাহিল ভাইয়ার উপর রেগেছেন? ওনি আপনার ভাই না? কিভাবে পানি মারলেন?
সাহিল গায়ের শার্ট ছাড়িয়ে টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে বলল,
‘ তুমি সবকিছু দেখো কেন? অনেককিছু দেখে ও না দেখার ভান করতে হয়।
জিনিয়া খাটে বসে পায়ের আঙুল নিয়ে খোঁটাখুঁটি করতে লাগল। সাহিলের কথাটা খারাপ লেগেছে। সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাল।
পানির গ্লাস হাতে নিয়ে খাটের অন্যপাশে বসে বলল,
‘ রাগ করেছ?
জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ না।
সাহিল পানি খেয়ে জিনিয়ার কাছে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসল। বলল,
‘ দেখি মুখটা মুছে দাও তো।
জিনিয়া চট করে তাকাল সাহিলের দিকে। জানতে চাইল,
‘ আমি?
সাহিল মুখের ভঙ্গি পাল্টিয়ে বলল,
‘ জিনিয়া কি এখানে দুইটা আছে?
জিনিয়া গাল ফুলিয়ে তাকাল। বলল,
‘ কি দিয়ে মুছব?
সাহিল হেসে উঠে গেল। বলল,
‘ এমনি এমনি বলেছি। আমি মুছতে পারি।
জিনিয়া সাহিলের পিছু পিছু ছুটল। বলল,
‘ এদিকে আসুন। মুছে দেই। হুটহাট রাগ তার!
শেষের কথাটা মিনমিন করে বলায় সাহিল শুনতে পেলনা। সাহিল লম্বা পা ফেলে একদম জিনিয়ার কাছাকাছি চলে আসে। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
‘ এখন ঘাবড়ে গেলে কেন? ডেকেছ তাই এসেছি।
জিনিয়া পিছু হটে গেল। শাড়ির আঁচল দিয়ে সাহিলের মুখ মুছে দিতে দিতে বলল,
‘ আপনি সবসময় আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করেন।
সাহিল মৃদু মৃদু হেসে বলল,
‘ আচ্ছা, আর এমনটা করব না।
জিনিয়া বলল,
‘ আপনি করবেন না বলে, আবার ও করেন।
সাহিল জিনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে,
‘ করব না বলে ও আবার আর কি কি করি?
জিনিয়া সাহিলের গলার কাছে টিশার্টের কলার চেপে ধরল। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ পড়ে গেলে আপনার দোষ।
সাহিল হেসে ফেলল। জিনিয়ার নাক টেনে দাঁড় করাল। তারপর হেসে হেসে চলে যেতে লাগল। জিনিয়া নাক ধরে বলল,
‘ নাকটা লম্বা করে ফেললেন টেনে।
সাহিল আবার দৌড়ে এল। জিনিয়াকে টেনে কপালের একপাশে চুম্বন দিয়ে আবার চলে গেল। জিনিয়া কপালের পাশ ঢলতে ঢলতে হাসল। বলল, এটা তো আস্ত একটা পাগল।
_________________
ট্রেনে নানান ধরণের লোকমুখের সমাগম। স্যুটকেস আর মালপত্র নিয়ে টানাটানি। মানুষের ঠেলাঠেলিতে আর ও উপচে পড়া ভীড়ের সাথে গরম ৷ সাহিলের হাতের ভাঁজে থাকা হাতটা ও ঘেমে উঠেছে জিনিয়ার। হাতটার নড়াচড়া বুঝতেই সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাল। বলল,
‘ হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে?
জিনিয়া মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ আব্বা আম্মাদের সিট ওখানে। আমাদের এখানে কেন?
সাহিল সিট খুঁজতে খুঁজতে জবাব দিল।
তাদের টিকিট পরে কাটা হয়েছে তাই। আমাদেরটা আগে কাটা হয়েছে।
জিনিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সাহিলের ধরা হাতটার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিভাবে ধরেছে। এভাবে ধরতে হয়? হাতটার নাজেহাল অবস্থা। মানুষটা কি পাগল?
অনেক্ক্ষণ পর সিট খুঁজে পাওয়া গেল। সাহিল জিনিয়াকে বসতে বলল। নিজে বসে পর্দা টেনে দিয়ে বলল,
‘ নিকাব উপরে তুলে ফেল। আর সমস্যা নেই। চাইলে বোরকা ও খুলে ফেলতে পারো।
জিনিয়া নিকাব তুলে। বলে,
‘ না বোরকা খুলব না। থাকুক।
সাহিল দুষ্টু হাসি হেসে বলল,
‘ আমি বর।
জিনিয়া কপাল কুঁচকে বলল,
‘ তো? আমি কি জানিনা?
সাহিল হেসে ফেলল। বলল,
‘ মনে রাখবে।
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা।
_________________
সিটে বসে সাগর সাহেব আর শফিক সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। শফিক সাহেব ডাক্তার মানুষ, সিগারেট পছন্দ করেন না। সাগর সাহেব সিগারেট ফুঁকা শেষে সিটে এসে বসতেই অন্যপাশের সিট থেকে শফিক সাহেব গলা বের করে দিয়ে বললেন,
‘ সিগারেট খেয়েছে কে? এত গন্ধ? থাকা যায়?
নাহিল ইয়ারফোন কানে দেওয়ায় কিছু শুনতে পেলনা। তার পাশে বসা তরিনা খাতুন ঘুমে ঢলে পড়ল। সাজেদ সাহেব সাগর সাহেবের পাশে বসা। তিনি শান্তশিষ্ট মানুষ। ঝামেলা পছন্দ করেননা তিনি। শফিক সাহেবের কথা শুনে তিনি সাগর সাহেবের দিকে তাকান। সাগর সাহেব মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দুই তিনজন লোক শফিক সাহেবের কথা শুনে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখেন কে সিগারেট টানছে?
জাহেদা বোরকার আড়ালে থেকে শফিক সাহেবকে ধমকায়।
‘ আপনার কি আর কোনো কাজ নাই? এত মানুষের গন্ধ লাগছে না? শুধু আপনার লাগছে।
শফিক সাহেব বলেন,
‘ তুমি কি বুঝবে জাহেদা? ট্রেনে সিগারেট খাওয়া কতবড় অপরাধ তুমি জানো? আমার জুনু এখানে থাকলে জেনে নিতাম, কততম আইনে লিখা আছে সেটি। আমার জায়িদ থাকত তা ও হতো।
জাহেদা বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকেন। সবখানেই আইন এই লোকটার। ছেলেমেয়ের মাথা ও খেয়েছে।
সাগর সাহেব আড়চোখে শফিক সাহেবকে দেখে বিড়বিড় করেন,
‘ শালার বেয়াই তোরে আমি, সুযোগমত পাই? সিগারেট খাইয়ে ছাড়ুম। আমারে আইন শিখাস? আমার পোলার বউ উকিলাতি পড়ে। হুহ!
শফিক সাহেব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলে,
‘ ডাক্তার মানুষের নাকে এই সিগারেটের গন্ধ বিষের মতো লাগে। আর প্রত্যক্ষ ধূমপানের চাইতে পরোক্ষ ধূমপান বেশিই ক্ষতিকর। বুঝেন তো ভাই?
পাশের সিটের লোকটিকে বলল শফিক সাহেব। লোকটি মাথা দুলালেন। হেসে বললেন,
‘ আপনার মতো তা আর কয়জনে বুঝে ভাই? আমাদের সমাজ শিক্ষিত পোশাক দাড়ি সব অশিক্ষিত মানুষে ভরপুর। কথা বলি শিক্ষিতদের মতো, কাজ করি অশিক্ষিতদের মতো।
শফিক সাহেব হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে সমর্থন জানানোর মতো বলেন,
‘ ঠিক।
সাগর সাহেব জ্বলেপুড়ে শেষ হওয়ার অবস্থা। সবাই কেন তার পিছু লাগে, বুঝে কূল পায়না।
ব্যস্তপায়ে হেঁটে সাহিল এল। সবাইকে জায়গামতো দেখে বলল,
‘ সব ঠিকঠাক আছে তো? জায়িদ কখন ফিরছে নাহিল?
সবাই উৎসুক হয়ে নাহিলের দিকে তাকাল। নাহিলের কানে ইয়ারফোন গুজা। সাহিল জোরে মাথায় চাটি মারল নাহিলের। নাহিল ভ্যাবাছ্যাঁকা খেয়ে সাহিলের দিকে তাকাল। সাহিল বলল,
‘ জায়িদের সাথে কি তোর কথা হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। সারাক্ষণ ইয়ারফোন গুজে রাখে কানে।
নাহিল মাথায় হাত ঢলতে ঢলতে বলল,
‘ রাতের ট্রেনে ফিরবে বলেছে।
জাহেদা বলে উঠল,
‘ হ্যা আমাকে ও অমন বলেছে।
সাহিল নাহিলকে বলল,
‘ গ্র্যান্ডমাকে দেখে রাখিস। কখন কি প্রয়োজন হয়।
নাহিল কথা বলল না।
সাহিল বলল,
‘ আচ্ছা। জিনি পাঠাল সবাই ঠিকঠাক বসেছে কিনা দেখার জন্য। আর বাবা তোমাদের দুজনকে ঝগড়া করতে বারন করেছে।
সাগর সাহেব হেসে ফেলেন। শফিক সাহেব ও। সাজেদ সাহেব ছোট্ট করে বলেন,
‘ ঝগড়া অলরেডি হয়ে ও গিয়েছে।
সাহিল নাহিলের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার চলে যায়। নাহিল মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘ মেরে আবার হাত বুলায়।
সাগর সাহেব বলেন,
‘ একেই বড়ভাই বলে মুন্টু।
তরিনা খাতুন ঘুমের মাঝে ও সাগর সাহেবের দিকে হাত নাড়ে।
‘ তুই কেন মুন্টু ডাকিস সাগর? এটা আমি ডাকি। তোরা ডাকিস না।
সাগর সাহেব মাথা দুলিয়ে দিয়ে সায় জানিয়ে বলে,
‘ ঠিকাছে চাচি ডাকব না। তুমি তোমার কচুর ঘুম ঘুমাও। কানটা সজাগ থাকবে ঘুমের মাঝে। এগুলা নাকি কচুর ঘুম!
তরিনা খাতুন চোখ বন্ধ অবস্থায় বলেন,
‘ কি বললি সাগর?
সাগর সাহেব সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ না কিছুনা চাচি। তুমি ঘুমাও।
সাহিল সিটে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। বলে,
‘ জিনি পানির বোতলটা বের করো তো। গলা শুকিয়ে গেছে।
জিনির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সাহিল পাশে থাকায় ৷ জিনি নেই!
সাহিল উচ্চস্বরে ডাকে।
‘ জিনি? কোথায় তুমি? জিনি?
জিনিয়া কোথাও নেই।
সাহিল তরতর করে ঘামতে থাকে। কেন গেল সে? পাগলের মতো হন্য হয়ে খুঁজে সাহিল। জিনিয়াকে কোথাও খুঁজে পায়না। সাহিল কপালে হাত দিয়ে দৌড়াতে থাকে। মালামাল তোলা একটা কুলির হাতে থাকা কি একটার সাথে লেগে যায় সাহিলের হাতের বাহু। শার্ট ফেটে গড়গড় করে রক্ত বেরোয়। কেমন ধারালো জিনিস? ছুরি?
সাহিল দেখার ইচ্ছে পোষণ করল না। কুলিগুলো সাহিলের হাত কাটা না দেখে জিনিস পড়ে গেল তাই গালাগালি শুরু করে দিয়েছে। সাহিল সেসব না দেখে পাগলের মতো খুঁজতে লাগল জিনিয়াকে। একে ওকে জিজ্ঞেস করলে ও কেউ কিচ্ছু বলতে পারল না। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সাহিলের যন্ত্রণা অনুভব হলো হাতের বাহুতে। হালকা ছাইরঙা শার্টটি ভিজে জবজবে লালরক্তে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। সাহিল হাতের বাহু অন্যহাতে চেপে ধরে যন্ত্রণাদগ্ধ কন্ঠে ডাকল,
‘ জিনি?
স্টেশন কাঁপল সেই ডাকে। কয়েকটা লোক ট্রেনের জানালা দিয়ে সাহিলকে দেখতে লাগল। একজন তো বলে উঠল, বলল,
‘ ভাই রক্তপাত বন্ধ করেন আগে। পাগল নাকি?
সাহিল সেদিকে কর্নপাত করল না। পকেট হাতিয়ে ফোন খুঁজে পেলনা। সিটে ফেলে এসেছে বোধহয়। সাহিল আবার সিটের দিকে দৌড়ে গেল। সিটে গিয়ে একসাথে দুটো মোবাইল কুড়িয়ে পেল। ধপ করে বসে পড়ল সাহিল। জিনি ফোন ও নিলনা?
সাহিলের ক্লান্ত অবসন্ন শরীর আর এগোতে চাইল না।
ট্রেনের জানালা দিয়ে একটা মেয়ে পানির বোতল এগিয়ে দিল।
‘ বোতলটা নিন না৷ শুনছেন?
সাহিল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল৷ কপালের উপর নিকাব তোলা মেয়েটাকে দেখে সাহিল আর দাঁড়াল না। ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল।
আচমকা নিজের উপর সাহিলকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে জিনিস শ্বাস আটকে যাওয়ার অবস্থা। দুই পা পিছু হটে জিনিয়া তার দুহাত দিয়ে সাহিলের পিঠে হাত বুলালো। ঘেমে পিঠের সাথে শার্ট লেগে গিয়েছে। জিনিয়া সাহিলের ঘনঘন শ্বাস নেওয়া দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে আপনার? এভাবে ধরেছেন কেন? সবাই তাকিয়ে দেখছে। দেখুন। এই মশাই? কি হয়েছে?
সাহিল জিনিয়াকে ছেড়ে দাঁড়াল অনেকক্ষণ পর। গর্জে বলল,
‘ কোথায় গিয়েছ তুমি? তোমার সাহস কত বাইরে নেমে এসেছ তুমি? কত চিন্তায় ছিলাম আমি জানো? সীমান্ত আছে আশেপাশে।
জিনিয়া কিছু বলতে চাইল। চোখ পড়ল সাহিলের বাহুতে। জিনিয়ার দুচোখ জলে ভর্তি হলো সাথেসাথে । সে সাহিলের দিকে এগোতেই সাহিল গটগট করে চলে গেল। জানালার পাশের সিটে বসে মাথা এলিয়ে দিল। হাতের বাহুতে জ্বলছে, হাতের ব্যাথা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
জিনিয়া সাথে সাথে এসে ঝাপিয়ে পড়ল সাহিলের বুকে। সাহিলের মুখ ধরে ডেকে বলল,
‘ আপনি এভাবে আঘাত পেয়েছেন কোথায়? এইডবক্স? এইডবক্স কোথায় পাব? দাঁড়ান। আমি আব্বাকে ফোন করছি।
সাহিল সিটে মাথা এলিয়ে পড়ে থাকল৷ জিনিয়া শফিক সাহেবকে কল দিল।
তার কান্নামাখা ভার কন্ঠস্বর শুনে সবাই চলে এল। শফিক সাহেব সাহিলকে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিলেন। পানি খাইয়ে দিলেন। জিনিয়াকে বললেন,
‘ মা কি করে হলো এসব?
জাহেদা বললেন,
‘ আমরা এসব পরে জানতে পারব ৷ ও আগে একটু জিরিয়ে নিক। জিনু তুই দেখ সাহিলকে ৷
নাহিল, সাগর সাহেব, সাজেদ সাহেব এটা ওটা জিজ্ঞেস করল সাহিলকে। সাহিল কিচ্ছু বলল না। জিনিয়া ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল সাহিলের দিকে। তরিনা খাতুন হায়হায় করে মাথা চাপড়ালেন৷
‘ এসব কি করে হলো গুড্ডু? কিছুক্ষণ আগে ও তো তোকে ভালো দেখলাম।
সাহিল ঝিমানো কন্ঠে বলল,
‘ চিন্তার কিছু নেই। এসব কাঁটাছেড়া সামান্য।
জিনিয়া অবাকচোখে তাকাল সাহিলের দিকে। সামান্য? লোকটার কি মাথা গেছে?
সবাইকে চলে যেতে বলল সাহিল। আশেপাশে কয়েকটা প্যাসেন্জার চোখ পাকিয়ে দেখছে। সাহিল পর্দা নামিয়ে দিল। জানালার বাইরে চোখ দিয়ে রাখল। ট্রেন ছাড়ল মিনিটখানেকের মধ্যে। জিনিয়া সাহিলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের দিকে তাকাল। কিভাবে কেটে গেছে?
জিনিয়া সাহিলের বুকে আলতো করে মাথা রাখল। শার্টের বোতাম খুলে দিয়ে বলল,
‘ শার্টটা দিয়ে দিন। আরেকটা পড়ুন। এটাতে রক্ত লেগেছে।
সাহিলের কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। জিনিয়ার খারাপ লাগল। সে সাহিলের রক্তভেজা শার্ট ছাড়িয়ে ব্যাগ থেকে আরেকটা শার্ট বের করে সাহিলকে পড়িয়ে দিল। বোতল থেকে পানি রুমালে ঢেলে মুখ, কপাল মুছে দিল। তোয়ালে দিয়ে পানি মুছে দিতে দিতে কন্ঠে কপট অনুরাগ মিশিয়ে বলল,
‘ কথা আর বলিয়েন না।
সাহিল চোখ ঘুরিয়ে তাকাল জিনিয়ার দিকে। তীব্র রাগ নিয়ে বলল
‘ কেন কথা বলব? কোথায় গিয়েছিলে?
জিনিয়া ভড়কে গেল৷ কান্নারা গলায় এসে আটকে থাকল। জিনিয়া মাথা নামিয়ে ফেলে বলল,
‘ সীমান্তকে দেখেছিলাম। এখানে কেন, কি উদ্দেশ্যে এসেছে,কোথায় যাচ্ছে সেটা জানতে পারলে ভাইয়াকে,,
জিনিয়া বাকিটা বলতে পারল না। সাহিল উচ্চস্বরে গর্জন করে বলল,
‘ তো চলে যেতে পারোনি তার সাথে? আমার কাছে কেন এসেছ আবার?
জিনিয়ার ঠোঁট আপনাআপনি কেঁপে কেঁপে ভাঙতে লাগল। চোখের পাতা ভিজে উঠল। সাহিলকে না দেখানোর জন্য নিকাব নামিয়ে দিল জিনিয়া। অন্যদিকে মুখ করে রেখে বসে থাকল৷ নিকাব ও ভিজে উঠল।
সাহিল কপাল কুঁচকে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। জিনিয়া মুখ ফেরালো না। কিভাবে বলল? ভীষণ খারাপ লেগেছে। অন্যভাবে ও বলা যেত। সে কেন সীমান্তর কাছে যাবে? সীমান্তর কাছে কেন পাঠাতে পারেনি সেটা নিয়ে ওনার আফসোসের শেষ নেই।
সাহিল ভেবে পেলনা এই মেয়ের এত রাগ কোথা থেকে এল? এটুকুনি একটা মেয়ে?
বয়স কত?
সাহিল জিজ্ঞেস করল।
জিনিয়া সাহিলের দিকে ফিরল হঠাৎ এমনপ্রশ্নে। আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। সাহিল ডাকল,
‘ এই মেয়ে তোমাকে বলছি। বয়স কত?
‘ বিশ।
জিনিয়া বিড়বিড় করল। সাহিল হাসল। বলল,
‘ আমার কত জানো? তুমি আমার কত বছরের ছোট জানো?
জিনিয়া কিচ্ছু বলল না। সাহিল বলল,
” তুমি আমার দশ বছরের ছোট। এত রাগ দেখাও কেন? রাগ দেখাবেনা একদম।
জিনিয়া মুখ ফেরালো না। সাহিল জিনিয়ার নিকাব তুলে দিল। কি আশ্চর্য!
চেহারার এই হাল কেন?
সাহিল জিনিয়াকে টেনে আনল। বুকের উপর ফেলে বলল,
‘ কাঁদছ কেন মেয়ে? তুমি জানোনা উপন্যাসের মেয়েদের মতো কাঁদলে তোমাকে সুন্দর দেখায় না। জঘন্য লাগে।
জিনিয়া চোখ তুলে তাকাল সাহিলের দিকে। আবার নামিয়ে ফেলল। জিনিয়ার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। লোকটা তাকে জঘন্য বলেছে?
জিনিয়া উঠে যেতেই সাহিল আবার টান দিয়ে ফেলল তার বুকে। পরক্ষনে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল। জিনিয়া সাথে সাথে উঠে গেল৷
‘ দেখলেন শুধু শুধু এমন করেন। আর এখন ব্যাথা পেলেন।
সাহিল হেসে দিল। অনর্থক হাসল। জিনিয়া লোকটার হাসি দেখল ভ্রুকুঞ্চন করে। এমন অবস্থায় কেউ হাসে? সাহিলের অট্রহাসি ফেটে পড়ল কেবিনের বাইরে ও। কারো কারো ঘুম ছুটে গেল। কারো কারো ফোনে কথা বলায় সমস্যা হলো। কিন্তু সাহিলের হাসি থামল না।
জিনিয়ার মাথার পেছনে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনল সাহিল । একটু ভালোবাসল।
রাগ,অনুরাগ পানি হলো জিনিয়ার। তুষ্ট হলো মন, রুষ্ট হলো অভিমান।
সাহিলের বুকে পড়ে জিনিয়া বলল,
‘ সীমান্ত অনেক বড় ক্রিমিনাল। আমার মনে হচ্ছে ও অস্ত্র পাচার ও করে। কিডনি পাচার, অস্ত্র পাচার। আপনি কোথায় দেখেছেন ওকে? ভাইয়া যদি আজ থাকত, ইশশ। কত খুঁজছে এই আসামিকে। দেখুন আমি আপনি কিছু করতে পারলাম না। সীমান্তর হাতে আমি অস্ত্র দেখেছি। ফোনে কার সাথে কথা বলছে তা শোনার জন্য পিছু নিয়েছি, কিন্তু দেখুন শেষটা আর জানতে পারিনি।
জিনিয়া মাথা তুলল সাহিলের কোনো শব্দ না পেয়ে।
সাহিল ঘুমিয়ে পড়েছে। জিনিয়া তার মুখটা দেখে হাসল। সে ভেবে পেলনা কালো মানুষের আবার এত মায়া কেন? তারা কালা, কালাই থাকবে। আবার এই কালার মাঝে এত সৌন্দর্য কেন? সে হাসলে মাংস নাকি উদাও হয় গালের পাশ থেকে। আর এই লোকটা হাসলে মাংস উদাও হয় ঠোঁটের নিচে৷ কি সুন্দর করে হাসে? জিনিয়া পারেনা কেন? হিংসে হয় জিনিয়ার? বড্ড হিংসে হয়। পুরুষ মানুষের এত সুন্দর করে হাসতে নেই।
জিনিয়া সাহিলের নাক,ঠোঁট, চোখ, ধারালো দাড়ি ছুঁয়ে দিল। লজ্জায় মুখ লুকালো সাহিলের বুকে। লোকটা জানতে পারলে কি ভাববে? কি বলবে? বলবে,
‘ এই মেয়ে তুমি আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছ ? এত ভালো কেন তুমি? হ্যা?
জিনিয়া হাসতে হাসতে নাক ঘষল সাহিলের বুকে । সাহিল হেসে তার একহাত দিয়ে জিনিয়াকে আগলে নিল। অস্বস্তিতে না ফেলতে বলেছে, নইলে?
জিনিয়ার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ও আল্লাহ, আল্লাহ লোকটা ঘুমোয়নি? আল্লাহ শেষ। সব শেষ। জিনিয়া এই কি করলি তুই?
চলবে,