#রজনীগন্ধা_১৬
[অলিন্দ্রিয়া রুহি]

চুলায় ভাত বসানো ছিল, বলক এসে ভাতের ফেনা চারপাশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অভি দায়সারাভাবে উঠে গিয়ে চুলো বন্ধ করে দিল। তবুও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দোলার। সে এক মনে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আজকেই চলে যাবে বাপের বাড়ি।

বিছানায় এসে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো বিছানায়, চোখজোড়া বন্ধ করে অভি বলল,
—“যাচ্ছো, যাও। আমি আর আনতে যাবো না মনে রাইখো।”

সঙ্গে সঙ্গে কথার প্রত্যুত্তর করলো দোলা,
—“তোর সঙ্গে সংসার করার জন্য বসে নাই আমি। তুই থাক তোর রজনীকে নিয়া।”

—“থাপড়াইয়া গালের হাড্ডি, মাংস সব আলাদা করে ফেলুম। কথাবার্তা ঠিক মতো বল।” ফুঁসে উঠে তৎক্ষনাৎ বিছানায় বসলো অভি।

তার দিকে রক্তচক্ষু করে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো দোলা। চুপচাপ ব্যাগ গোছাতে লাগলো। মিনিট দুই পর ব্যাগ গোছানো শেষ হলে আলনা থেকে বোরকাটা তুলে নিলো। বাতাসে একটা ভারী নিঃশ্বাস মিলিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো অভি। দোলাকে মোটেও সহ্য হচ্ছে না। চলে যাচ্ছে, যাক…

—“আমি গেলাম। আমার বাপের বাড়িতে তোর ছায়াও যেন না দেখি। আর আমার বাপের থেইকা যেসব টাকা নিছোস, সেগুলা সব ফেরত দিবি। নাইলে পুলিশের কাছে যামু আমি। নারী নির্যাতনের মামলা দিমু। তুই আমারে চিনোস নাই।” কাটাকাটা গলায় কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাগ সমেত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল দোলা। দরজাটা এত জোরে লাগালো যে দড়াম করে শব্দ হলো। তবুও তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না অভি। ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।

বেলা এগারোটা চৌত্রিশ, মঙ্গলবার। বড় লিভিং রুমে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে অভি। আর বিস্মিত নয়ন জোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। এত সুন্দর বাড়ি দেখার তৌফিক এর আগে হয়নি কোনোদিন। তার পাশেই বসে আছে উকিল। কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছে। টাকার জোর থাকলে কী না করা যায়! মাত্র ছয় দিনে ডিভোর্সের সবকিছু তৈরি করে ফেলেছেন আদ্র সাহেব। আজকে অভিকে ডাকিয়েছেন পেপারে সাইন নেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আদ্র’র পেছন পেছন রজনীকেও আসতে দেখা গেল। কত্তদিন পর দেখলো রজনীকে! এটা কী সেই রজনী? ভালো পরিবেশ, সুন্দর পরিবার পেয়ে রজনীর শারিরীক দিক আগের চেয়ে অনেক উন্নত। অভি একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। রজনী একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। যেদিন প্রথম অভিকে ভালোবেসে, ভরসা করে, তিন কবুলের মাধ্যমে জীবনের অন্য একটি ধাপে প্রবেশ করেছিল সে, সেদিন কী ভেবেছিল তাদের ভবিতব্যে এই লেখা রয়েছে? কোনোদিন কল্পনাও করেনি এইরকম পরিস্থিতি নিয়ে অভির মুখোমুখি হতে হবে! আদ্র যদিও বলেছিল,বেশি অস্বস্তি হলে সামনে আসার দরকার নেই। নিজের ঘরে বসেই সাইন করে দিও। কিন্তু রজনী তবুও এসেছে। এটাই তো শেষ দেখা… আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে। তাই শেষবারের মতো একটু দেখে নিক অভিকে। আদ্রকে বিয়ে করলেও অভির প্রতি কোনো রাগ নেই রজনীর, অভিযোগ নেই, শুধু আফসোস হয়। একটা ভালো জীবন তাদেরও হতে পারতো। কিন্তু ভাগ্য যখন তাদের একসাথে রাখতে চাইছে না, তখন এসব ভেবে লাভ কী? তার চেয়ে বরং যে সুখটুকু সে পেতে যাচ্ছে, সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক। একটু স্বার্থপর মাঝে মাঝে হতে হয়, অন্তত নিজের জন্য।

—“রজনী, নিন..” একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো আদ্র। অভি ততক্ষণে সাইন করে দিয়েছে। এবার রজনীর পালা। না চাইতেও হাতটা একটু একটু কাঁপলো। অদ্ভুত এক মুহূর্ত! ভীষণ দোটানা.. একবার ইচ্ছে করে, সব ছেড়ে দিয়ে অভির সঙ্গেই চলে যেতে। ছোট্ট খড়কুটোর ঘরে শুয়ে অভির বুকে মাথা রেখে চাঁদের আলো গায়ে মাখাতে। আবার ইচ্ছে করে, কী দরকার? একবার তো গিয়েছিলোই… লাভ হয়েছে? পেয়েছে কোনো সুখ?নাকি দিনের পর দিন প্রাপ্তির খাতা জিরো দিয়ে পূর্ণ হয়েছে? আজ যখন সব জিরো উঠিয়ে নিতে আদ্র এসেছে, তখন কেন এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব? অভিও তো নিজের জীবনে ভালো আছে। আরেকটি বিয়েও নাকি করেছে। আদ্র নিজেই খবরটা বলেছে তাকে।

মৃদু নিঃশ্বাস ফেলে কাগজের উপর সাইন করে দিলো রজনী। সাইন করার পরও তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এখানে অভি-রজনীর সমস্ত সম্পর্ক শেষ। এখানেই সমাপ্তি… আর কোনোদিন কোনো অধিকার নিয়ে অভির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। বুকটা মুচড়ে উঠলো। এই অদ্ভুত দোটানার কথা কাকে বলবে রজনী? কে বুঝবে?

—“শুনুন।” ধরে আসা গলায় আদ্রকে ডেকে উঠল।

আদ্র কাগজগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিল, রজনীর ডাক পেয়ে রজনীর দিকে তাকালো। সেই সঙ্গে তাকালো আরও এক জোড়া চোখ।

—“বলছিলাম কী, আমি কী উনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে পারি? এটাই শেষ।” জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সাহস করে বলল রজনী। অভি অবাক হলেও আদ্র স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর করলো,
—“নিশ্চয়ই। অভি সাহেব, আপনি রজনীর সঙ্গে ভেতরে যান। আমার উকিলের সঙ্গে কথা আছে।”

অভি একমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেও পরমুহূর্তে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। রজনীর পিছু পিছু কাচুমাচু ভঙ্গিতে এগিয়ে চললো।
নিজের বেড রুমে অভিকে নিয়ে আসলো রজনী। বিছানায় বসার ইশারা করে নিজেও মুখোমুখি বসলো। একটা সময় কতটা আপন ছিল রজনী, চেনাজানা.. আর আজকে তার সামনেই ইতস্ততবোধ হচ্ছে। যেই মানুষটা তার আন্ডারওয়ারটা অবধি একসময় ধুঁয়ে পরিষ্কার করে রাখতো, সেই মানুষটার চোখে চোখ রাখতেও অস্বস্তি হচ্ছে। নিঃশ্বাস অস্থির লাগছে। সময় যে প্রবহমান, এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো আরও একবার।

—“হঠাৎ এভাবে ডেকে আনাটা ঠিক হয়নি তোমার। মিঃআদ্র কী না কী মনে করলেন!” আড়ষ্টতার সঙ্গে মুখ খুললো অভি।

রজনী বলল,
—“উনি কিছুই মনে করবেন না। উনার চিন্তাভাবনা ছোট না।”

—“কেন ডেকে আনলা?”

—“আগে তো তুই করে বলতা, এখন হঠাৎ তুমি??”

—“আগে তুমি আমার বউ ছিলা.. আর এখন..” চুপ করে রইলো অভি। কথা আগালো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রজনী বলল,
—“তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে, জানার জন্য ডেকে আনলাম। আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না, কথা তো দূরেই থাক।”

সেকেন্ড তিনেক সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় অভি উত্তর দিলো,
—“ভালো আছি।”

—“তোমার বউ?”

—“জানি না।” অভির দায়সারা ভাব।

—“কেন? সে কই?”

—“বাপের বাড়ি।”

—“ঝগড়া করে চলে গেছে?”

অভি মিথ্যে করে বলল,
—“ঘুরতে গেছে।”

—“ওহ!” ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো অভি।
তারপর নিজে থেকে প্রশ্ন করে উঠল,
—“তোমার ভাইদের খোঁজ খবর জানো কিছু?”

—“উঁহু.. তারা আমার খোঁজ পেলে নিজেরাই দেখা করার চেষ্টা করবে আমি জানি। আদ্র মেশতাকের মতো এতবড় কারও সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে, আর তারা দেখা করতে আসবে না, এটা অসম্ভব।”

—“তুমি তখন কী করবা?”

—“কী করব? কিছু করার আছে? আসুক, দেখুক। আমি কতটা সুখে আছি। শুধু হ্যাঁ, দূরত্ব বজায় রেখে চলব। দুঃখে পড়ে মানুষ চিনতে শিখে গেছি।”

অভি একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর হঠাৎ অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠল,
—“আমার জন্যেই তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছিল।”

রজনী প্রত্যুত্তর করার আগে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করলো।
—“ভাগ্যিস… নইলে কোনোদিন আদ্র সাহেবের দেখাই পেতাম না। আমি ভাবতেও পারছি না, উনার বউ হবো আমি! মানে.. একবার ভাবো!কীভাবে সম্ভব?”

—“জীবন নাটকের চাইতেও নাটকীয়, বলে না?”

—“হুঁ।”

দু’জনেই চুপ। কেউ কোনো কথা খুঁজে পেল না আর। অভি ফ্লোরে তাকিয়ে আছে, রজনী হাতের নখ খুঁটছে। এমন সময়ে দরজায় নক পড়ল। আদ্র দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই তার দিকে তাকালো। আদ্র সৌজন্যমূলক হাসি ঠোঁটের মাঝে ফুঁটিয়ে রজনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“কথা কী শেষ? আসতে পারি?”

—“আসুন।” ঠান্ডা গলায় অনুমতি দিলো সে।

আদ্র ভেতরে ঢুকতেই অভি দাঁড়িয়ে পড়ল।

—“আমি তাহলে যাই..” আমতা আমতা করে বলল অভি। আদ্র বলল,
—“আরে বসুন, সমস্যা নাই।”

—“না, না, যাই আমি। ওদিকে কাজ পড়ে আছে।”

রজনী কোনো কথা বললো না। অভি পালাতে চাইছে, পালাক… এখন এখানে সবাই তার অপরিচিত, আর অপরিচিতদের মাঝে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আদ্র জোরজবরদস্তি করলেও অভিকে রাখতে পারলো না বেশিক্ষণ। রজনীকে শুকনো মুখে একবার “আসি” বলেই অভি বেরিয়ে গেল। আদ্র বলেছিল, তার গাড়িতে করে যেতে। মোতালেব তাকে নামিয়ে দেবে, কিন্তু অভি রাজী হলো না। অভি যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি নামলো। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি যাকে বলে…

জুবুথুবু রজনীর পাশে গিয়ে বসলো আদ্র। সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
—“আমি আপনাদেরকে জোর করে আলাদা করে দিলাম না তো?”

রজনী ছলছল চোখে তাকালো। তার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। সে জানে না কেন, কিন্তু ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার, ভীষণ…
আদ্র রজনীর হাতজোড়া শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
—“প্লিজ কাঁদবেন না। আমার কষ্ট হয়।”

জ্বলতে থাকা সিগারেটটা বৃষ্টির ফোঁটায় নিভে গেল। সেটাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে হাঁটতে লাগলো অভি। আশেপাশে কেউ নেই। সবাই কোথাও না কোথাও ঠাঁই নিয়েছে। সবার একটা নিজের বাড়ি আছে। আফসোস, অভির কোনো নিজের বাড়ি হলো না!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here