রজনীগন্ধা – ১৪
অলিন্দ্রিয়া রুহি
আকাশ ঘন নীল। তার মধ্যে ছোপ ছোপ করে ভেসে আছে স্তুপাকারের মেঘরাজ। মাথার উপর বড় ছাতা ধরে রেখেছে পিন্টু- এখানকার স্পট বয়। আদ্র এসেছে শ্যুটিং এর জন্য। দুইবার শ্যুট করা হয়ে গেছে। আর একটুখানি বাকি… নায়িকা টাচ আপ নিচ্ছে। আদ্রও এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। গরম যা পড়েছে না! শরীরের ভেতরটা চিটচিট করছে আদ্র’র। একটা শাওয়ার নিতে পারলে ভীষণ ভালো হতো।
-আদ্র ভাই…
প্রডিউসার আখতারুজ্জামান মুহিত ডেকে উঠলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে আদ্র’র পাশে এসে দাঁড়ালেন। আদ্র’র কানের কাছে নিজের মুখ দিয়ে অত্যন্ত নিচু গলায় বলে উঠলেন,
-মুক্তি ম্যাডাম আসছে। আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। আপনার অনুমতি ব্যতীত উনাকে আমি এখানে আনতে পারি না। তাই আগে আপনার কাছে আসলাম।
আদ্র’র চোখজোড়া ক্ষুধার্ত বাঘের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল। মুক্তির এখানে আসার পেছনের কারণটা সে ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। নাছির উদ্দীনকে দেখা গেলেও তিনি ঘোড়ার ন্যায় ছুটে আসছেন।
-স্যার.. মু..
হাত ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলো আদ্র। ঠান্ডা গলায় বলল,
-আমি শুনেছি। ওকে আসতে দাও। আর আশেপাশে কোনো মিডিয়ার লোক যেন না থাকে। আমি চাই না উল্টাপাল্টা কোনো কিছু নিউজ হোক!
-আপনার সাথে মুক্তি ম্যাডামরে এখন দেখলেই নিউজ ছড়াবে- নায়কের জীবনে আবারও ফিরে আসতে চাচ্ছেন গায়িকা।নায়কও কী মেনে নিলো তবে? প্রিয় কন্যার জন্য সব ভুলে মিটমাট হলো পারিবারিক সমস্যা?
কথা শেষ করে দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠলেন মুহিত। আদ্রও ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করলো। মিডিয়া ওয়ালাদের কাজই তো এমন! মুহিত চলে গেল। নাছির উদ্দীন পিন্টুর হাত থেকে ছাতা নিয়ে পিন্টুকে চলে যেতে বললো। ভেতরকার আলাপের মধ্যে বাহিরের কাউকে থাকতে দেওয়া ঠিক না। এই স্পট বয়দের একদম ভরসা নেই। টাকার অফার পেলেই শ্যুটিং স্পটে চলা বিভিন্ন নিউজ লিক করে দেয়।
জিন্সের সঙ্গে সাদা-নীলের কাতুয়া পরনে ঠক ঠক শব্দ তুলে মুক্তি এগিয়ে আসছে আদ্র’র দিকে। তার চোখের উপর নীল রঙের সানগ্লাস। চোখ দেখা না গেলেও আদ্র স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মুক্তি। আদ্রও ধারালো চাহনি নিয়ে মুক্তির দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ সরালো না।
কাছে এসে আদ্র’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মুখে বলল,
-হ্যালো!
আদ্র হাত বাড়ালো না। ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠল,
-নট ইন্টারেস্টেড!
অপমানে থমথমে হয়ে গেল মুক্তির চেহারা। আশেপাশে তাকিয়ে কেউ দেখেছে কী-না দেখে নিলো। নাহ, কেউ তাদের দিকে চোখ দিয়ে রাখেনি। বিষন্ন মন নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
-তুমি কিন্তু আমার অনেক গানে শ্যুট করেছো! সেই হিসেবে আমি হাত বাড়িয়েছিলাম! তোমার হাত ধরার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না আদ্র।
আদ্র এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে আরাম করে বসলো। ফিচেল হাসিতে ওষ্ঠদ্বয় মেতে উঠল।
-আমার হাত ধরার জন্য পাগল হলে কী আর অন্য পুরুষের কাছে চলে যেতে পারতে?
-কাম অন আদ্র! তুমি অন্তত থার্ডক্লাস মেন্টালিটি নিয়ে কথা বলো না! মানুষের মন পরিবর্তনশীল। কখন কাকে কীভাবে ভালো লেগে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। তুমি যদি ওই সময়ে আমার কথা শুনতে আর এবোরশন করতে দিতে আমাকে- তাহলে হয়তো আমাদের ভেতর আজও সম্পর্ক থাকতো। আজকাল কে বিয়ের পর পরই বেবি নেয় বলো তো! আমার তো শারিরীক, মানসিক একটা প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে নাকি? তুমি আমাকে সময়ই দিলে না। আমি কনসিভ করার পর পাগল হয়ে গেলে বাচ্চা বাচ্চা করে!
-তো তুমি কী আশা করো? আমি নিষ্ঠুরদের মতোন আমার বাচ্চার অস্তিত্ব বিনাশ করে ফেলব? তাও অর্থি তো অবৈধ সম্পর্কের বাচ্চা ছিল না!
-তাই বলে আমাকে একটু সময় দেওয়া যেত না?
-আমি কিন্তু ইচ্ছে করে তোমাকে কনসিভ করায়নি মুক্তি। হয়ে গেছিল। বিধাতার হুকুম বোধহয় এভাবেই বাবা হওয়া লিখা ছিল আমার কপালে। তাই হয়েছে। তুমি যথেষ্ট সময় পেতে মুক্তি। পুরো টেন মান্থস! এই দশ মাসে একজন মেয়ের মা হওয়ার মতো মন-মানসিকতা চলে আসে। তার উপর তোমার পেটে একটু একটু করে অর্থির গ্রোথ হচ্ছিল। তুমি সেসব অনুভব করছিলে না? তারপরও তোমার পাষাণ মনে দয়ামায়া জেগেছে? বাচ্চা জন্ম দিয়েই খালাস! কীভাবে ওইটুকুন বাচ্চাকে মায়ের শরীর ওম দিতাম আমি? চিন্তাও করোনি।
-দেখো আদ্র..
-এসব পুরোনো কথা বাদ দাও। তুমি আমার কাছে কীজন্যে এসেছো সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমি। রজনীকে তুমি যা বলেছো, সেই কথা যদি আমার সামনে উচ্চারণও করো, আমি সমাজ, আইন, সম্মান সব ভুলে যাবো বলে দিলাম। তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো, আমি কতটা ভালো আর ঠিক কতটা খারাপ!
মুক্তি নিভে গেল পুরোপুরি। আদ্র’র এরকম তেজী মনোভাব সে আগে কখনো দেখেনি এমনকি জয়ের সাথে বিয়ে করার সময়ও না। আদ্র মুক্তিকে মুক্তির মতোই ছেড়ে দিয়েছিল। তার জীবনে এসে কোনো ধরনের বাগড়া দেয়নি। মুক্তি দম ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
-আসি তাহলে।
ক্ষীণ গলায় বলল সে।
আদ্র এক ভ্রু নাচিয়ে হাসিমুখে বলে উঠল,
-সব হাওয়া ফুরুস?
সেকথার জবাব না দিয়ে রোদের ভেতরে নেমে পড়ল মুক্তি। সানগ্লাসটা চোখে লাগিয়ে হিল জুতোর গটগট শব্দ তুলে এগিয়ে চললো সামনের পথে।
★
ইয়োলো কালারের পোলো টি-শার্ট গায়ে চড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল আদ্র। আকাশের বুকে চাঁদের আলো নেই। এই ফাঁলি সূক্ষ্ণ চাঁদ মেঘের আড়ালে অর্ধেক মুখ লুকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলতেই কানে এলো ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। পেছন ফিরে তাকালো আদ্র। একটা বাটি হাতে নিয়ে রজনী দাঁড়িয়ে আছে।
-আপনার জন্য।
বাটিটা বাড়িয়ে ধরলো রজনী। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বাটির ভেতর তাকাতে তাকাতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
-কী এতে?
-পায়েশ।
-আমার জন্য?
-হুম। আপনি নাকি মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন।
মাথায় ক্যালকুলেশন চললো। নিশ্চয়ই অর্থির থেকে জেনেছে। আর পায়েশ বানিয়ে তার অভিমান ভাঙাতে এসেছে। তার অভিমান ভাঙানো এতই সহজ? মোটেও না… নায়ক সাহেবের নাকে দড়ি দিয়ে গরুর মতো ঘোরানোর ফল তো রজনী ম্যাডামকে একটু হলেও পেতে হবে!
চোখ সরিয়ে নিলো আদ্র। বারান্দায় গোল বলের মতো নরম গদি। একটার উপর বসে অভিমানী কণ্ঠটা নাড়ায় আদ্র,
-আমি পায়েশ খাবো না। নিয়ে যান।
মুখ দিয়ে যন্ত্রণাসূচক একটি শব্দ বেরিয়ে এলো রজনীর। ভ্রু যুগল কুঁচকে ছপছপ শব্দ তুলে আদ্র’র সামনে এসে দাঁড়ালো।
-এমন করছেন কেন? কী করছি আমি?
-কেমন করছি?
-এই যে.. কথা বলতে চাইছেন না। ইগনোর করছেন। রুড বিহেভ! আপনি তো এমন ছিলেন না। আপনি না নরম মনের মানুষ ছিলেন?
-নরম ছিলাম দেখেই তো আমার দাম না রজনী। তাই একটু শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। এবার দাম পেলেও পেতে পারি।
ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে বলল আদ্র। রজনীর কী যে হলো! প্রচন্ড খারাপ লাগলো। একবার ভালোবেসে বড়সড় ধোঁকা পেল বিনিময়ে… তারপর আর ভালোবাসার কাছেই ঘেঁষেনি। নায়ক হয়েও চরিত্র ঠিকঠাক ধরে রেখেছে। তাকে আশ্রয় দেওয়ার পরেও কোনো অন্যায় আবদার করেনি। যদি প্রেমটা শরীরি হতো, তাহলে তো রজনীকে জোরও করতে পারতো। একবার জোর করে কাছে পেতে চাইলে বাধ্য হয়ে কাছে যেতে হতো রজনীকে। কিন্তু তা সে করেনি… একটা নিরাপত্তা যুক্ত আশ্রয় দিয়েছে। পরিবারের একজন ভেবেছে। তারপর কখন, কীভাবে রজনীকে ভালোবেসে ফেলেছে! এবার পবিত্র ভাবে রজনীকে নিজের করতে চায়। তাহলে কীসের বাধা রজনীর? সে নিজেও তো ভালোবাসার বিনিময়ে কঠিন অপমান, লাঞ্চনা, গঞ্জনাই পেয়েছে। শারীরিক, মানসিক অত্যাচার পেয়েছে। এবার যদি জীবন তাকে আরও একবার সুযোগ দিতে চায়, তাহলে কেন হাতের মুঠ ভরে কুড়িয়ে নিতে চাইছে না রজনী? কীসের পিছুটান?
বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আদ্র’র ফ্যাকাশে মুখখানা মনবাড়ি কামড়ে ধরলো। একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুকের মাঝটায়। দম আঁটকে আঁটকে আসছে। বাটিটা নিচে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলো রজনী, আদ্র’র মুখোমুখি হয়ে। আদ্র অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, রজনী বলল,
-এদিকে তাকান।
আদ্র তাকালো না।
-কী হলো! তাকান বলছি…
সুঃসাহসের কাজ করে ফেললো রজনী। নিজেই আদ্র’র মুখ আঁজলায় ভরে নিজের দিকে ফেরালো। ছলছল চোখজোড়া পরিপূর্ণ ভাবে মেলে ধরে বলল,
-আমার বাচ্চা হবে না, জানেন তো?
-আমাদের অর্থি আছে!
-আমার তালাকও হয়নি এখনো।
কথাটা বলেই মাথানিচু করে ফেলল রজনী। বাম চোখের কোল ঘেঁষে একফোঁটা শীতল পানি গড়িয়ে পড়ল। হতবিহ্বল হয়ে সেকেন্ড দুই বসে রইল আদ্র। রজনীর সমস্যা কোথায় এবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। রজনীর হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-আমি যদি সব ব্যবস্থা করে দেই, পারবে তো তাকে ডিভোর্স দিতে??
সেকেন্ড তিনেক স্তব্ধ নয়নে আদ্র’র চোখের গভীরতা, মুখের আদল, ভ্রু’য়ের ঘনত্ব, ঠোঁটের ভাঁজ, মুখস্থ করে নিলো রজনী। তারপর খুব শীতল… কণ্ঠে বলে উঠল,
-পারব।
বুকটা ঠান্ডা হলো আদ্র’র। সব অভিমানে গলে পানি… নিজের হাতের মুঠোয় আগলে ধরা রজনীর হাতজোড়ায় চুমু এঁকে দিলো খুব সন্তপর্ণে। কেঁপে উঠে লজ্জায় মাথা নোয়ালো রজনী। ভাগ্য তাকে সুখের ঠিকানায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত!
(চলবে)