রজনীগন্ধা – ১২
অলিন্দ্রিয়া রুহি
ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে। বৃষ্টির কলতান শোনা যেতে পারে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। নিজের ঘরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রজনী। তার মনটা বিষন্ন। চোখের দৃষ্টি অসচ্ছ। শীতল হাওয়াও তার মনের কুঠুরিতে জমে থাকা দুঃখ বাষ্পগুলোকে শীতল করে তুলতে পারছে না। একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে সেই সঙ্গে জেঁকে ধরেছে একরাশ ভয়। মুক্তির মুখের উপর চটাং চটাং বুলি ছুঁড়ে দিলেও ভয় যে একদম হচ্ছে না, তা কিন্তু না। আদ্র সাহেব বাসায় আসার পর সে নিজে থেকে সমস্ত মান-অভিমান, লজ্জা ভুলে ছুটে গিয়ে সবটা জানানোর পরেও আদ্র চুপ করে ছিল। সেই নিশ্চুপতা রজনীকে ভেতরে ভেতরে ভাবিয়ে তুলছে আরও। রাত ঠিক ক’টা বাজছে রজনী জানে না। নিশাচর প্রাণী বাদে সকলেই ঘুম… এমনকি ঝিঝি পোকারাও। শুধু ঘুম নেই তার চোখ দুটিতে। নেত্র দুটি মস্তিষ্কের সঙ্গে যুদ্ধ করে শান্তিতে ঘুমুতে চাইলেও মস্তিষ্ক তা হতে দিচ্ছে না।
বুক চিঁড়ে একটি ভারী দীর্ঘশ্বাস সশব্দে নির্গমন করে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল রজনী। বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে, বুকের উপর দু-হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র। গায়ের নীল টি-শার্টের বুকের উপর একছড়া রজনীগন্ধা ফুলের চিত্র আঁকা। সেদিকে চোখ যেতেই রজনীর ভ্রু কুঁচকে গেল।
আদ্র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
-আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন?
রজনী মৃদু শ্বাস ফেলে ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-না।
-যাক, আপনার তো আবার অজ্ঞান হওয়ার রোগ আছে!
রজনী কিছু বললো না। চুপ করে রইলো।
-আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি।
-ওহ! ভেতরে চলুন।
-দরকার কী। এখানেই বসি?
-আপনার ইচ্ছা।
বারান্দার কিনারায় তিনটে বেতের চেয়ার অবহেলায় পড়ে রয়েছে। একটি চেয়ার টেনে রজনী বসলো, তার পাশের আরেকটি চেয়ার টেনে একটু দূরত্ব সৃষ্টি করে বসলো আদ্র। বাতাসে বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ। নাক টেনে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম শব্দ তুলে বৃষ্টির বড় গোল ফোঁটা আছড়ে পড়তে লাগলো মাটিতে। নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখার উপায় নেই, তবে অনুভব করা যাচ্ছে যে বৃষ্টির বেগ বেশি। রজনী বলে উঠল,
-বৃষ্টি পড়ছে তো। এখন ভেতরে গিয়ে বসি?
-এখানে বসতে কী আপনার প্রবলেম হচ্ছে কোনো? বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, আমাদের তো ভিজিয়ে দিচ্ছে না।
-হুম।
গাঁট হয়ে বসলো রজনী। কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা লজ্জা মিলে মিশে তাকে পুরোপুরি অপ্রস্তুত করে তুলছে। অজান্তেই বার বার চোখ দুটো চলে যাচ্ছে আদ্র’র দিকে। আদ্রও এক ধ্যানে রজনীর দিকে তাকিয়ে কীসব যেন ভাবছে। এই ব্যাপারটা রজনীকে আরও বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। কী দেখছে ওমন করে লোকটা? যেন এর আগে কোনোদিন দেখেনি!
আসলে অনেকদিন পর চোখের সামনে রজনীকে দেখে দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছে আদ্র। তার তৃষ্ণার্ত নয়ন দুটি রজনীকে মন-প্রাণ ভরে দেখে নিয়ে তাদের পিপাসা মেটাচ্ছে। এতে আদ্র’র দোষ কোথায়? অল্প কয়েকদিনের পরিচিত মেয়েটি, এমনভাবে তার মনের কুঠুরিতে জায়গা দখল করে বসেছে যে, একে ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসে না আদ্র’র। চব্বিশটা ঘন্টা মন,মস্তিষ্কে দাপিয়ে বেরায় শুধুই রজনী…
বৃষ্টির কলতান এক অদ্ভুত শিহরণ জাগাচ্ছে শরীরের ভেতর। ইচ্ছে করছে, দেহের উষ্ণ তাপমাত্রা রজনীর দেহেও ছড়িয়ে দিতে.. একটুখানি! তবে তা অসম্ভব। একদম অসম্ভব!!
রজনী- একটু ছুঁই তোমাকে? তোমাকে না ছুঁতে পেরে আমার হাত দুটো হরতাল বাধিয়ে দিতে চাচ্ছে। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে সেগুলো তোমার দিকে.. তোমার ওই গালে,গালের উপর উড়ে এসে পড়া এক বিন্দু জল ফোঁটাকে.. তুমি বিরক্তি নিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছো। আমার দিকে একবার তাকালে দেখতে পেতে, তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আগুনে কী নিদারুণ করুণ রূপে দগ্ধ হচ্ছি আমি। ইশ! তুমি এতোটা মায়াবতী কেন বলো তো রজনী? তোমার আশেপাশে যারাই থাকে সবাইকেই এভাবে মায়ার বাধনে বেধে ফেলো নাকি?
চোখ জোড়া না চাইতেও সরিয়ে নিলো আদ্র। শরীরকে প্রশ্রয় দিয়ে কোনো ভুল করে ফেলতে চায় না সে। এমনিতেই নায়কদের ক্যারেক্টার নিয়ে হাজারটা সন্দেহ থাকে সবার মধ্যে। রজনীকে পেতে চায় আদ্র, এ কথা চরম সত্য। তবে পবিত্র বাধনে বেধে… জোরপূর্বক আর সব হলেও ভালোবাসা হয় কী? কেউ একজন উত্তর দিয়ে যায়,’না’। ঘন ঘন কিছু তপ্ত শ্বাস ভেতর থেকে বাহির করে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে আদ্র। কণ্ঠটা স্বাভাবিক করে রজনীকে ডেকে উঠল সে,
-রজনী।
-হুঁ।
-যে কথা বলতে এসেছি, বলি?
-অনুমতি চাইছেন কেন!
-না, এমনিই…
সংকুচিত বোধ করলো আদ্র। সে কী কথা বলতে এসেছিল? কিছুই না.. এসেছিল রজনীকে এক পলক দেখতে। রজনী যে সময়ে মুক্তির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল, তখন আদ্র’র মাথা একটু গরম থাকায় সে চুপ করে ছিল। তারপর রজনী যাওয়ার পর ইম্পর্ট্যান্ট কয়েক জায়গায় কল দিয়ে কিছু কথাবার্তা বলার পর নিজেকে শান্ত মনে হলো নিজের কাছেই। ঠিক তখনি রজনীকে এক পলক দেখার ভীষণ তাগিদ অনুভব করলো সে। ততক্ষণে রাত গড়িয়েছে অনেকটা। আসবে কী আসবে না- দ্বন্দ্বে বার বার মন জিতে যাচ্ছিল। তবুও অদ্ভুত এক জড়তার কারণে পা-জোড়া চাইলেও আগাচ্ছিল না। লোহার সমান ভারী পা জোড়া টেনে টেনে রজনীর ঘর অবধি এসেও একটা ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। যদি রজনী অন্য কিছু মনে করে? এত রাতে তার ঘরে যাওয়াটা কী ঠিক? কী করবে বুঝতে না পেরে যথেষ্ট উশখুশ করেছে আদ্র। ভাবতে ভাবতে একসময় তার মাথায় এসে ধরা দিলো, বাহানা করেও তো যাওয়া যায়! বলবে মুক্তির ব্যাপারে কথা আছে। আইডিয়াটা মনে ধরে আদ্র’র। কিন্তু রজনী যদি ঘুমিয়ে থাকে? তবে এক পলক দেখেই চলে আসবে.. কেউ জানবে না। সাক্ষী থাকবে দরজার চারিপাশ ঘিরে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালগুলো, যারা আদ্র’র পাগলামি দেখে ঠোঁট টিপে হেসেছে এতক্ষণ। দরজায় দু-বার টোকা দিলেও কোনোপ্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আদ্র। খালি বিছানা দেখে প্রথমে বাথরুম চেক করলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারে বারান্দায় আছে হয়তো। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বারান্দার দরজায় এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রজনীর পেছন দিকটা মন-প্রাণ ভরে দেখে নেয় আদ্র। এই তো রজনী… তার রজনী… তার রজনীগন্ধা ফুল! আর ক’টা দিন… রজনী ঠিক মানবে। একবার আল্লাহর কালাম অনুযায়ী তিন কবুলের ব্যবস্থাটা সাড়া হলেই এই রজনী আর কোত্থাও যাবে না… কোত্থাও না!!
-কী হলো? বলছেন না কেন কিছু? কী বলতে এসেছেন?
তাড়া কণ্ঠে বলে উঠল রজনী। তার প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে। কোনোরকমে আদ্র সাহেব কে বিদায় করতে পারলেই এলোমেলো শরীরটা এলিয়ে দিবে বিছানায়.. হারিয়ে যাবে ঘুম রাজ্যে.. যতক্ষণ পর্যন্ত না সকালের নরম রোদ তাকে ছুঁয়ে যাবে।
-বলছিলাম কী.. মুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। ওর সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন। ওর কথাবার্তার মাধ্যমে কী বুঝেছেন? অর্থিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও সত্যি কোনো স্টেপ নিবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রজনী। মুক্তির ব্যাপারটা মস্তিষ্কে আঘাত হানতেই ঘুমে নিভে আসা চোখ দুটো সজাগ হয়ে উঠল তড়িৎ বেগে। মনের ভেতর থেকে কে যেন গলা ফাটিয়ে বলছে, যা কিছু হয়ে যাক, অর্থি কোত্থাও যাবে না.. কোত্থাও না। ও আমার মেয়ে.. আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। দুনিয়া উল্টে গেলেও আমি অর্থিকে ছাড়ব না।
এই কথাগুলো চিৎকার করে বলে যাচ্ছে যে, তবে সেই কী ‘মাতৃত্ব?’
-হুম। উনার কথা শুনে যতটুকু মনে হলো, উনি সিরিয়াস। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় আসছে না। উনি কী কারণে এত বছর পর অর্থিকে নিয়ে যেতে চাইছে? অর্থিকে ফেলে তো উনিই চলে গিয়েছিল আরেকজনের কাছে।
-সেলফিস! আপনি কিছু বলেননি?
-তো কী মিষ্টিমুখ করিয়েছি নাকি? যা বলার বলেছি।
-কী বলেছেন? একটু শুনি…
-অত কিছু আপনাকে শুনতে হবে না। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, অর্থির দিকে যদি আর একবার হাত বাড়াতে আসে, তবে রজনী নামক ঘূর্ণিঝড়কে ক্রস করে তবেই অর্থি পর্যন্ত পৌঁছোতে হবে। আর আমি এমন ঘূর্ণিঝড় হবো, যে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতেও দুই সেকেন্ড ভাববো না। অর্থি আমার মেয়ে। আমার মেয়েকে অন্য একজন মহিলা কেন নিয়ে যেতে আসবে? কেন???
-তাই? অর্থি আপনার মেয়ে?
এক সেকেন্ড থামলো রজনী। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
-হুম, আমার মেয়ে। রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বেও অনেক সম্পর্ক হয়।
-সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু, অর্থি আর আপনি- একটু অসম্পূর্ণ লাগছে।
-কীসের অসম্পূর্ণতা?
-একজন বাবার অসম্পূর্ণতা। আমি অর্থির বাবা কিন্তু.. আপনার স্বামী তো হতে পারলাম না। তবে কী মিললো বলেন?
নাকের উপর লালচে আভার জন্ম বুঝি লজ্জা থেকেই হয়? উঁহু.. রাগলেও হয়। তবে এখন রজনীর নাক লাল হয়েছে লজ্জার কারণে। লোকটা লজ্জাজনক কথা বললো কেন? এখন যদি আবার উল্টোপাল্টা ভাবতে গিয়ে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে, তবে এর দায়ভার কার? তার? রজনীর কান ঘেঁষে বাতাস ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
-হ্যাঁ, আমার।
রজনী চমকে তাকাল, লোকটা মুখে হাসি নিয়ে ঘন আঁধারের জমিন দেখছে। সে তো বলেনি এই কথা। তাহলে রজনী যে স্পষ্ট শুনলো। তবে কে বললো? রজনীর ভেতরে বাস করা অন্য এক সত্তা? ইশশিরে! এই ব্যাটা কখন, কীভাবে রজনীর মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল- এটা হাজার ভেবেও বুঝে উঠতে পারলো না সে।
-কেউ একজন জবাবের অপেক্ষা করছে।
ভণিতা করে বললো আদ্র। রজনী ফোঁস করে চেপে রাখা কিছু রুদ্ধশ্বাস বের করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটু এগিয়ে গ্রিলের ভেতর থেকে হাত বের করে বৃষ্টির পানি ধরার বৃথা চেষ্টা করল। সানসেটের কারণে পানিগুলো আসছে না এদিকে। আবার জলধারার বেগও কমে এসেছে। হতাশ মনে হাত সরিয়ে গ্রিল খামচে ধরল সে। পেছন ফিরে তাকাল না। তাকালে লজ্জারা চৌদ্দ গুষ্টি সমেত এসে হাজির হবে আবার!
এত যন্ত্রণা সহ্য করা যায় না…
-কিছু বলার নেই।
রজনীর উত্তর শুনে ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকালো আদ্র। তার মন বলছে, একটু অধিকার চর্চা করতে। একটু পাগল পাগল হয়ে অপরাধ করলে ক্ষতি নেই খুব বেশি.. এই রাতটা আজ এত আঁধারে ঢাকা বোধহয় ওদের জন্যেই… যাতে কেউ কারও মুখ দেখে লজ্জায় গুটিয়ে না নেয় নিজেকে!
বারান্দায় ড্রিম লাইট জ্বলছিল এতক্ষণ। হালকা নীলচে আলো… তবে নীলের চেয়ে অস্পষ্ট কালোই লাগছিল বেশি। ভূতুড়ে পরিবেশ লাগছিল চারিপাশটা.. আর এখন মনে হচ্ছে, এই পরিবেশই মনের কথাগুলো বলার জন্য সবচেয়ে উত্তম। উঠে দাঁড়াল আদ্রও। প্রথমে ড্রিম লাইটের অস্পষ্ট আলোগুলো তাড়ানোর জন্য লাইট বন্ধ করতেই আকাশ তার ঝাপি থেকে কিছু অন্ধকার বারান্দার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিলো। কেঁপে উঠে পেছন ফিরতেই আদ্র’র বুকে নিজের মাথার সংঘর্ষে আঁতকে উঠল রজনী। এক কদম পিছিয়ে নিজেকে গ্রিলের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। পারছে না গ্রিল ভেঙে নিচে পড়ে যেতে.. বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এখন যদি উল্টোপাল্টা কিছু ঘটে যায়? লোকটা ড্রিংক করেনি তো?
কাঁপা কণ্ঠটা আরেকটু কাঁপিয়ে রজনী বলে উঠল,
-আ..আপনি ড্রিংক করেছেন নাকি?
-করলেও তার নেশা আপনার চেয়ে অনেক কম রজনী।
ঘোরলাগা কণ্ঠটা রজনীর কর্ণকুহরে ঢুকতেই বরফের মতো জমে গেল সে। এই লোক এক্ষুনি উল্টোপাল্টা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে একটা। রজনী শিউর..
-চলুন, ভেতরে গিয়ে বসি। আসুন…
রজনী সামনে পা বাড়াতেই তার এক হাত চেপে ধরল আদ্র। রজনী বড়সড় চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল। ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে এবার। কী থেকে কী হয়ে যায়- কে জানে!
-আপনি এমন করছেন কেন?
-কেমন করছি?
-পাগলের মতোন..
-আমি তো পাগলই।
-আপনি প্লিজ ঘরে যান।
-যাব রজনী।
-এক্ষুনি যান.. প্লিজ। আমি.. আমি চেঁচিয়ে উঠবো কিন্তু। আমার সঙ্গে এসব চলবে না…
কেঁদে ফেললো রজনী। ভয় পেয়ে গেছে সে। অস্বাভাবিক ভাবে হাত-পায়ে কাঁপন উঠেছে। শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন,গাঢ়.. বুকটা হাপড়ের মতো উঠছে,নামছে। রজনীকে শান্ত করতেই তাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে নিলো আদ্র। দু’হাতে জাপটে ধরলো শক্ত করে.. দু’জনার মধ্য দিয়ে একচিলতে বাতাস যাওয়ার ক্ষমতাও নেই বুঝি…
খোঁপা খুলে চুলগুলো আছড়ে পড়ছে পিঠ জুড়ে। একটা হাত পিঠে রেখে আরেকটা হাত চুলের ফাঁকে গলিয়ে দিলো আদ্র। মন মাতানো ঘ্রাণে নিজেকে নেশাখোরের মতো লাগছে তার কাছে.. এত ঘ্রাণ কীসের? কী মাখে মেয়েটা? এর সেন্ট!
-আপনি.. আপনি একটা কী যেন রজনী! আপনাকে দেখলে আমি ঠিক থাকতে পারি না। পাগল হয়ে যাই বিশ্বাস করুন। মাত্র কয়টা দিন আগেও আপনাকে আমি আর দশটা সাধারণ মেয়ে ভাবতাম। আর এখন মনে হয়, আপনি অসাধারণ.. আপনার তুলনা আপনিই। আপনার চোখ, আপনার নাক, আপনার ঠোঁট.. সবকিছুর একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আর সেই ভাষা আমি পড়েছি। ওরা বলে… ওরা বলে, ওরা আমাকে চায়। খুব করে চায়… শুধু আপনিই স্বীকার করেন না। কেন করেন না? বুকে মাথা রেখে কান পেতে শুনুন, কতটা চাই আমি আপনাকে… আপনি ছাড়া আমি… এই অন্ধকার রাতের খাপছাড়া অন্ধকার গুলোর মতোন। আপনি আমার জীবনের আলো রজনীগন্ধা… শুনছেন আপনি? আমি ভালোবাসি আপনাকে। ভালোবাসি খুউউউউব। রজনীগন্ধা… কী হলো? রজনী!
রজনীর শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে হুট করেই। নেই কোনো সাড়াশব্দ। ঘোর কেটে গেছে আদ্র’র। দ্রুত নিজের বুক থেকে রজনীকে সরিয়ে নিলো সে। এক হাত বাড়িয়ে সাদা লাইট জ্বেলে দিতেই বুঝতে পারল, আবার অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে রজনী। হেসে উঠল আদ্র… এই মেয়েটার অজ্ঞান হবার বাতিক আছে বুঝি! মুখটা দু’হাতের আঁজলায় ভরে কপালে চুমু এঁকে দিলো আদ্র। খুব আলতো করে… পাছে অবচেতন রজনী টের পেয়ে যায়! তারপর পাজাকোলে করে নিলো আদ্র। এইরকম ঠান্ডা পরিবেশে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত জ্বর বাধাবে।
(চলবে)