#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৮
আদ্র ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে আছে হাত-পা মেলে। সে তৈরি, অপেক্ষা করছে রজনী-অর্থির তৈরি হওয়ার জন্য। নাছির উদ্দীন ঘরের এক পাশে বিচলিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আদ্র তার উপস্থিতি অনেকক্ষণ যাবত টের পেলেও কিছুই বলেনি। কিন্তু এবার বলল, ‘আপনি কী কিছু বলার জন্য এসেছেন?’
–‘জি স্যার। আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, আজকে না গেলে হতো না?’ আমতা আমতা করে নাছির উদ্দীন। আদ্র উঠে বসতে বসতে বলল, ‘কেন?’
–‘আপনার শরীরটা খারাপ তো।’
–‘আমি ঠিক আছি। একটু ক্লান্ত লাগছে সত্যি, তবে বাইরের বাতাস লাগলে চাঙা হয়ে উঠব।’
নাছির উদ্দীন আর কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকলেন। অর্থি তার ছোট ছোট পা ফেলে ঠিক তখনি রুমের ভেতর ঢুকলো। কোমরে হাত গুঁজে বিরক্তি ধরা গলায় বলে উঠল, ‘তুমি এখনো রেডি হওনি পাপা?’
–‘আমি রেডি মামনী।’ উঠে দাঁড়াল আদ্র। ‘তোমার ননা মাকে নিয়ে নিচে নেমে দাঁড়াও। আমি আসছি। জাস্ট দুই মিনিট।’
–‘ঠিক আছে।’ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে অর্থি চলে যায়। আদ্র আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত দিয়ে চুলগুলোকে উপরের দিকে ব্রাশ করতে করতে ভাবতে লাগল রজনীর কথা। কীভাবে রজনীকে বিয়ের জন্য অফার দিবে, সেটা ভেবে পাচ্ছে না আদ্র। আর বিয়ের অফার পেয়ে রজনীই বা কীরকম রিয়েক্ট করে উঠবে কে জানে!
নিচে নামতেই রজনীর দিকে চোখ পড়ে আদ্র’র। বুকের ভেতর ছলাৎ করে ঢেউ উঠে গরম রক্তের। অনুভূতি হয় শিরশির ধরনের। কেমন যেন লাগে.. ঘোর ঘোর.. বা অন্যকিছু, তবে সেই অনুভূতির মাত্রা তীক্ষ্ণ। আদ্র’র কথা মতোই শাড়ি পড়েছে রজনী। মেরুন রঙের জামদানিতে তাকে ফুলের মতো দেখাচ্ছে। আদ্র’র মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে আসে, ‘বিউটিফুল..’
রজনী তার থেকে অনেকটা তফাৎে দাঁড়িয়ে থাকায়, সেই কথাটা শুনতে পেল না। শুনলে নিশ্চয়ই লজ্জায় মরে যেত। তবে এখনো যে কম লজ্জা পাচ্ছে না, তা কিন্তু না। অনেক লজ্জা পাচ্ছে সে। অত্যধিক! শুধুমাত্র আদ্র’র অনুরোধ রক্ষার্থে শাড়িটা পরেছে আর যেতে রাজী হয়েছে।
অর্থি তাড়া দিল, ‘তাড়াতাড়ি চলো না পাপা..’
আদ্র প্রতুত্তরে হাসি দিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মোতালেব গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াতেই আদ্র বলল, ‘চাবি দাও। আজকে আমি ড্রাইভ করব।’
মোতালেব অবাক হলো বেশ। তবে বিনাবাক্য ব্যয়ে আদ্রকে চাবিটা দিয়ে দিল। আদ্র ড্রাইভিং সিটে বসল। অর্থি পেছনের সিটে বসল। তার পাশে রজনীও উঠে বসল। ঠিক তখনি আদ্র চাপা চিৎকারে বলে উঠল, ‘আরে আরে,দু’জনেই পেছনে বসলে যে! আমি কী ড্রাইভার নাকি? রজনী, আপনি সামনে আসুন।’
রজনী থতমত খেল। জড়ানো কণ্ঠে টেনে টেনে বলল, ‘আ..আ…মি?’
–‘এখানে রজনী নামের আর কেউ আছে?’
–‘অর্থি বসুক..’
–‘উঁহু.. আমার পেছনেই ভালো লাগে।’ বলে উঠল অর্থি। ‘তুমিই যাও ননা মা। নইলে পাপা আমাকে জোর করে হলেও সামনে বসিয়ে দিবে। প্লিজ ননা মা, যাও না…প্লিইইজ।’ অর্থির অনুনয় মানা করতে পারল না রজনী। একরাশ জড়তা সমেত সে গিয়ে সামনে বসতেই আদ্র মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি চলে যেতেই মুখ খুললো মোতালেব। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘এসব কী হইতাছে? বুঝলাম না ভাই!’
পাশে দাঁড়ানো নাছির উদ্দীন বাতাসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে মোতালেবের কথার জবাব দিল, ‘এগুলো তো কিছুই না। সামনে যে আরও কত কী হবে, কে জানে!’
★
মৃদু শব্দে গান চলছে গাড়িতে। ইংলিশ গান। যার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না রজনী। তবে সুর টা বেশ ভালো লাগছে। রাতের ঢাকা শহর। জ্যাম তেমন একটা নেই বললেই চলে। গাড়ি চলছে আদ্র’র দেওয়া গতিতে, শাঁ শাঁ করে… বাতাস ঠেলে এগিয়ে চলছে সামনে। আকাশ চন্দ্র তারকাহীন। শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার। রাস্তার পাশে সারি করে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্ট গুলো থেকে হলদে আলো বের হচ্ছে। তারা হয়ত এই আলো দিয়ে রাতের আঁধার মুছে ফেলতে চাইছে শহরের বুক থেকে কিন্তু পরিপূর্ণ ভাবে তা পারছে না। তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাড়ির কাঁচ বন্ধ করে রাখা। রজনী একবার বলেছিল খোলার জন্য, কিন্তু আদ্র খুলতে নিষেধ করেছে। পরবর্তীতে রজনী আর এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। হয়ত কেউ দেখে ফেলতে পারে। তখন আবার মাঝ রাস্তায় ভীড় জমে যাবে। নায়ক-নায়িকাদের এই এক সমস্যা, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করা যায় না। সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। রজনী ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই চোখের পর্দায় অভির লম্বাটে মুখ খানা ধরা দিল। সিগারেটে পোড়া মোটা ঠোঁট দুটি একসময় আদরে আদরে স্বর্গে নিয়ে যেতো রজনীকে। সেই আদর থেকে আজ কতদিন হলো, বঞ্চিত সে! কেমন আছে অভি? দ্বিতীয় বিয়ে করেছে নিশ্চয়ই? করবে নাই বা কেন, রজনীকে বের করেছেই তো আরেকটি বিয়ে করার জন্য। কিন্তু! রজনী চাইলে পারতো থানাপুলিশ করতে। তাতে লাভ হতো কোনো? পুলিশের চাপে পড়ে রজনীকে নিয়ে সংসার করলেও সেই সংসারে অভির তরফ থেকে ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও থাকত না। শুধুই দায়িত্ববোধ থাকতো। আর এই দায়িত্ববোধ একসময় বোঝায় পরিণত হতো। এর চেয়ে আলাদা হয়ে গেছে, এই-ই ভালো। যে যার জায়গায় ভালো আছে।
–‘কী ভাবছেন রজনী?’ আদ্র’র করা প্রশ্নে একটু চমকে উঠে রজনী। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে মৃদু হেসে বলল, ‘কিছু না। কতক্ষণ লাগবে আর?’
–‘চলে এসেছি প্রায়।’
–‘ওহ।’ চুপ হয়ে গেল রজনী। কথা বাড়াতে ভালো লাগছে না। শুধুই প্রসঙ্গ পাল্টাতে প্রশ্নটি করেছিল সে। পেছনে ঘুরে তাকাল রজনী। অর্থি জানালায় হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রজনী মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন করল, ‘একা একা বিরক্ত লাগছে তোমার, তাই না?’
অর্থি নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘উঁহু.. আই লাভ মাই এলোন টাইম ননা মা।’ তারপর আবার জানালায় হেলান দিলো। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আঁটকাতে পারল না রজনী। তার খারাপ লাগছে ভীষণ। এইটুকুন একটা মেয়ে, অথচ এত কীসের গম্ভীরতা এর ভেতর? তবে কী রজনীও পারছে না মায়ের মতো অর্থিকে স্নেহ করতে? রজনীর বুকটা হু হু করে উঠে। সে চায়, খুব করে চায় অর্থির জীবনটা গুছিয়ে দিতে। অর্থিকে মায়ের মতো পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসতে। অর্থির সব দুঃখ-কষ্ট গুলো ভাগ করে নিতে। কিন্তু সেটা কী আদৌও পারবে রজনী?
হঠাৎ গাড়ি থামতেই সামনের দিকে ছিঁটকে পড়ে রজনী। আদ্র কোনো কিছু না ভেবেই রজনীর এক বাহু ধরে টেনে ধরল। আদ্র’র হ্যাঁচকা টানে তার খুব কাছাকাছি আসলো রজনী। আর এখানেই দুই জোড়া চোখ এক হয়ে গেল। দু’জন দু’জনের দিকে স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে রইল, তাকিয়েই রইল। পেছন থেকে অর্থি দেখছে আর মুখ টিপে নিঃশব্দে হাসছে। সেদিন তার বাবা আর অনুপমা আন্টির সব কথাই শুনে ফেলেছিল অর্থি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, আড়ি পেতে। সেদিন থেকেই সেও স্বপ্ন দেখছে, তার ননা মা-ই তার মা হবে। তার আপন মা… আর তার পাপার জীবনটাও ঠিক হয়ে যাবে। অর্থিও মনেপ্রাণে চায়, রজনী আর তার পাপা একে অপরের কাছাকাছি আসুক। এই জন্যেই মিথ্যে অযুহাত দিয়ে রজনীকে সামনে বসিয়েছে সে। রজনীকে জোরাজুরি করে শাড়িও পড়িয়েছে। তবে এর কিছুই না রজনী জানে, আর না তার পাপা। সে তার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে। বাকিটা উপর ওয়ালার ইচ্ছা…
ছোট্ট অর্থি বড়দের মতো ‘উহুম…উহুম’ করতেই আদ্র রজনীর বাহু ছেড়ে দিল। রজনী চাপা গলায় ‘উহ’ করে সরে বসল। তবে তার গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না। আদ্র যেখানে চেপে ধরেছিল, সেখানটায় হাত বোলালো রজনী। মাংসটা থেতলে দিয়েছে পুরো। এত শক্ত কেন হাত? আদ্র ইতস্তত করে কাকে যেন ফোন করল। তার কোনোকিছু না বলেই ফোন কেটে দিল। অর্থি বুঝতে পারল, এই দু’জনের মধ্যে একধরনের গাম্ভীর্যতা এসে ভর করেছে,যেটা সরিয়ে দিতে হবে। নইলে দু’জনের কেউই কথা বলবে না। অর্থি বলল, ‘কী ব্যাপার? বাইরে নামবে না পাপা?’
কথা খুঁজে পেল আদ্র। তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নামছি নামছি।’
আদ্র গাড়ির দরজা খুলতেই এক ঝাঁক সাংবাদিক তার দিকে দৌড়ে আসলো। কিন্তু গার্ডদের জন্য আদ্র’র কাছাকাছি যেতে পারল না। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখেই একের পর এক ক্লিক করতে থাকলো ক্যামেরায়। রজনী তখনো গাড়ির ভেতর। ইতস্তত করছে। অর্থি পেছন থেকে রজনীর একটা হাত টেনে ধরে বলল, ‘ননা মা, চলো।’
–‘আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে অর্থি।’ বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল রজনী।
–‘কিচ্ছু হবে না। আসো তো।’ অর্থির আশ্বাসে একটু হলেও ভরসা পেল রজনী। বড় করে দম নিয়ে ধীরস্থির ভাবে গাড়ির দরজা খুলতেই তীব্র আলোতে তার চোখ ধাধিয়ে উঠল। প্রায় টলতে টলতে পা রাখলো জমিনে। উঠে দাঁড়াতে পারল না, শাড়ির পায়ায় হিল বেজে উষ্ঠা খেতে নিল রজনী। সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে পড়ে গেলে- ভেবে চোখমুখ খিঁচে ফেলল সে। যখন বুঝল সে পড়েনি, তখন ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই আরেকটি ঝটকা খেল। কেননা ততক্ষণে সে জায়গা করে নিয়েছে আদ্র’র বুকের মধ্যে। আদ্র’র মুখ তার মুখের থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে… আদ্র গাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে রজনীর চোখ বরাবর। কী যেন একটা ছুটে গেল রজনীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে…
(চল