#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৬

আদ্র চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অর্থি। অর্থির ছোট্ট মুখখানায় চিন্তার চিহ্ন,ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বাহিরে বৃষ্টি নেই, তবে বাতাস বইছে মধ্যম গতিতে। নাছির উদ্দীন একবার এই মাথায় হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন, আরেকবার ওই মাথায়। মোতালেবকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে আনা হয়েছে।

রজনীর ঘর থেকে ডাক্তার মহিলা অনুপমা বের হতেই মোতালেব তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রশ্ন করল, ‘সিস্টার কী বাইঁচা যাবো ম্যাডাম?’
অনুপমা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সামান্য জ্বরে কেউ মারা যায়, শুনছেন?’
–‘ইয়ে, মানে…’ লজ্জিত ভঙ্গিতে তার সামনে থেকে সরে এলো মোতালেব। আদ্র ক্রুর দৃষ্টিতে একবার মোতালেবকে দেখে নিল। তারপর অনুপমার দিকে এগিয়ে গেল।

–‘কী অবস্থা?’

–‘আগের চেয়ে ভালো। হঠাৎ টেম্পারেচার অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সেন্সলেস হয়ে গেছিলো। চিন্তার কারণ নেই। আপাতত অনেকটা সুস্থ আর টেম্পারেচারও নেমেছে। ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করলে আর ওষুধ খেলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।’

–‘ওহ!’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আদ্র। সে ভেবেছিল হাসপাতাল অবধি যেতে হতে পারে। এই ভেবেই মোতালেবকে ডেকে এনেছিল। কিন্তু নাছির উদ্দীন বললেন, আগে একজন ডক্টর এনে দেখানো হোক। এরকম অচেনা একটি মেয়েকে হুট করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে একে ঘিরে নানান ধরনের কথা ছড়াবে মিডিয়ার লোক। এমনিতেই অন্তরাকে কাজ থেকে বের করে দেওয়ার জন্যেও মিডিয়ারা প্রশ্ন করে করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল আদ্রকে। একজন অভিনেতার জীবন নিয়ে মানুষের এত কেন আগ্রহ, উৎসাহ, আদ্র ভেবে পায় না। আর বাংলাদেশের নব্বই পারসেন্ট মানুষ মনে করে, নায়ক মানেই দিনের বেলা ঝলমলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো আর রাতের আঁধারে মেয়েলোক নিয়ে বিছানায় ফুর্তি করে বেরানো! কী অদ্ভুত চিন্তাধারা এদের!

আদ্র নাছির উদ্দীন এর কথা সমর্থন করেই অনুপমা কে ডেকে আনে। অনেক আগে থেকেই অনুপমার সাথে পরিচয় আদ্র’র। অর্থির সিজারের সময়েও অনুপমাই সর্বক্ষণ ছিলেন। ঘড়ির কাটা প্রায় তিনটার ঘরে। আদ্র, অনুপমাকে নিয়ে সোফাঘরে বসে আছে। অর্থি এতক্ষণ আদ্র’র কোলে থাকলেও, আদ্র এবার বলল, ‘তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো অর্থি।’

–‘আর কিছুক্ষণ থাকি পাপা?’ বায়না ধরে অর্থি।

–‘একদম না। শরীর খারাপ করবে। তোমার ননা মা আমার কথা না শুনে ভিজেছে। এখন তার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছো?’

অর্থি জবাব দিল না। আদ্র’র কোল থেকে নেমে ছোট ছোট পা ফেলে রুম ছাড়ল। আদ্র ঠোঁটের কোণা দিয়ে একটু হাসে। বলল, ‘মেয়েটার অভিমান খুব!’

–‘আসলেই.. আর প্রচুর গম্ভীর। এখনি এত গম্ভীর, না জানি বড় হলে কী হয়!’ বললেন অনুপমা।

–‘ওর মা চলে যাওয়ার পর থেকেই ও এরকম হয়ে গেছে। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, মায়ের মতোন ভালোবাসা তো দিতে পারব না।’ আদ্র’র কণ্ঠে হতাশার সুর।

–‘আপনি সেকেন্ড ম্যারি কেন করছেন না আদ্র সাহেব? আপনার উচিত এখন দ্বিতীয় বিয়ে করা। এতে অন্তত মেয়েটা একটা মা পাবে! আর শুনুন, সব সৎ মা-ই যে খারাপ হয়, এই কথা ভুল। কিছু মানুষ আছে, তারা সত্যিই ভালো। নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যায় সবাইকে। ওরকম কাউকে খুঁজুন। আমার বিশ্বাস পাবেন। কিন্তু ভুল করেও মিডিয়া জগতে কাজ করছে এমন কাউকে বিয়ে কইরেন না আবার।’ বলে মৃদু হাসে অনুপমা।

–‘পাগল? আমার একবারেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। আমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো মুক্তিকে বিয়ে করতে দিতো না।’ ঠোঁটের হাসি চওড়া করে আদ্র। তারপর একটুক্ষণ থেমে বলে, ‘কিন্তু সেরকম কাউকে পাব কোথায়? আমি নিজেও দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে চাই। জীবনটাকে আবার একটা সুযোগ দিতে চাই। আমিও চাই, আমার ঘরে একজন রমনী আসুক আর আমার সব দায়িত্ব সে যত্ন সহকারে কাঁধে তুলে নিক। এতদিন ভেবেছি অর্থির জন্য হলেও আর কখনো বিয়ে করব না বা অর্থি বড় হলে করব। কিন্তু এখন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সেরকম কাউকে খুঁজতে আসলেই হয়।’

–‘একটা কথা বলি?’ অনুমতি চায় অনুপমা।

–‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ সম্মতি জানায় আদ্র।

–‘রজনী মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো। আবার অর্থিও রজনীর সাথে খুব মিশেছে। একবার ভেবে দেখতে পারেন।’

অনুপমা কী ভেবে দেখতে বলেছে সেটা প্রথমে না বুঝলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারে আদ্র। আর বুঝতে পেরেই হতবাক হয়ে তাকায় সে। অনুপমা বললেন, ‘মেয়েটার কোয়ালিফিকেশন কী আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, স্ত্রী হতে কারো কোনো এডুকেশনাল যোগ্যতার দরকার হয় না। আর মেয়েটা দেখতে এতটাও খারাপ না। আপনি যদি তাকে ওরকম সাজিয়ে গুছিয়ে রাখেন, তাহলে আপনার সাথে বেশ মানাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, অর্থি ভীষণ খুশি হবে৷ অর্থি আবার আগের মতো হয়ে উঠবে। রজনীর জন্য ওর ভেতর যেই চিন্তাটুকু দেখেছি,সেটা নিতান্ত আপনজনদের পক্ষেই সম্ভব। আর আপনিই বলেছেন, রজনীর সাথে অর্থি এমনভাবে মিশে গেছে, যে দেখলে মনে হবে অর্থি রজনীরই সন্তান। কী বলেননি?’

–‘হ্যাঁ, বলেছিলাম..’ ইতস্তত করে আদ্র।

–‘ভাববেন না। এই মেয়েটি আর যেরকমই হোক, মুক্তির মতো হবে না অন্তত। আমি যখন তাকে চেক-আপ করছিলাম, তখনি হালকা হালকা ভাবে জ্ঞান ফিরে আসে তার। সে একটিবারের জন্যেও নিজের কী হয়েছে- তা জিজ্ঞেস করেনি। কী বলেছে জানেন?’

–‘কী?’

–‘অর্থি কোথায়? আর আপনি কোথায়? আপনাদের অনেক চিন্তায় ফেলে দিল এই ভেবে ভেবে দুঃখ পেয়েছে মনে মনে।’

–‘এই মেয়ে আসলেই পাগল!’ হেসে উঠল আদ্র। অনুপমাও মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আর এরকম পাগল মেয়েই আপনাদের সংসারে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে পারবে। এই গম্ভীর গম্ভীর ঘরটাকে হাসিতে মাতিয়ে তুলতে পারবে।’

–‘কিন্তু… একটা কথা শেয়ার করি। রজনীর আগের হাজবেন্ড, আই মিন ওর এক্স হাজবেন্ড ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিছে কারণ ও মা হতে পারবে না। রাস্তায় নাছির উদ্দীন এর কাছে সাহায্য চাইতে এসে এই মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আর আমরা একে নিয়ে আসি। এরপর থেকেই আমাদের সাথে আছে। আমাকে ও সবকিছুই খুলে বলেছে।’

–‘বাহ! তাহলে তো আরও চমৎকার! যে মেয়ে প্রথম সংসার থেকে সুখ পায়নি, সে যদি দ্বিতীয় সংসার থেকে একটুখানি সুখ খুঁজে পায়, তাহলে সেই দ্বিতীয় সংসার সে মাথায় তুলে রাখবে। আর মা হতে না পারাটা কোন ফ্যাক্ট না। অর্থিতো আছেই… অর্থির আদরে কমতি হবে না। আর একজন নিঃসন্তান মা-ই পারে তার ভেতরকার সবটুকু ভালোবাসা বের করে দিতে। আপনি আর ভাববেন না। যদি দ্বিতীয়বার বিয়ের পীড়িতে বসতে চান তাহলে একেই করুন। আর মুক্তিকে দেখিয়ে দিন, সে যতটা ভালো আছে তার চেয়েও বেশি ভালো আপনি আছেন।’

আদ্র মাথানিচু করে কতক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকে। তারপর হঠাৎই মাথা তুলে প্রশ্ন করল, ‘ওর খবর কী?’

–‘মুক্তির?’ পাল্টা জানতে চায় অনুপমা। আদ্র মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে।

–‘আগের মতো যোগাযোগ নেই। তবে যতটুকু জানি ভালো আছে। মোটামুটি… মানে ক্যারিয়ারের দিক থেকে। স্বামীর দিক থেকে না।’

–‘সেটা আমিও জানি। মিডিয়ায় ওদের নিয়ে ক’দিন পর পরই তো হৈ-হুল্লোড় হয়। তা ওর স্বামীর ব্যাপারে যে রিউমার ছড়িয়েছিল, সেটা কী ট্রু?’

–‘বোধহয়। মুক্তির সঙ্গে আমার লাস্ট যেদিন কথা হয়, সেদিন আমি আস্ক করেছিলাম, জয়ের কথা। মুক্তি জয়ের কথা এড়িয়ে গেছিল। আর এমনিতেও জয়ের টপিক আসলেই মুক্তি কেমন রেগে রেগে কথা বলতো। তা থেকে ধারণা করেছি, সত্যিই জয় পরনারীতে আসক্ত।’

আদ্র তৃপ্তির হাসি হাসে। এক পায়ের উপর অন্য পা তুলে আরাম করে বসে। অনেক বেশিই ভালো লাগছে তার। মুক্তি একজন সিঙ্গার। আদ্র’র সাথে তার পরিচয় টা মিডিয়ার একটা কাজের সময় হয়। এরপর মুক্তি নিজেই যেচে পড়ে আদ্র’র সঙ্গে সখ্যতা বাড়ায়। প্রতিদিন নিয়ম করে ফোন করত। মিডিয়াতে যতজন কাজ করে, তাদের সবার ব্যাপারে কম-বেশি খারাপ রিউমারস থাকলেও আদ্র’র বায়োডাটা একদম ফ্রেশ ছিল। আদ্র সবসময় অন টাইম কাজ করত। কখনো সেটে লেট করে যেত না। বা যেখানেই কাজ করত, কোনো প্রডিউসার বা স্পট গার্লরা বলতে পারবে না যে আদ্র কারো সঙ্গে সস্তা ফ্লার্ট করেছে! আর এই জন্যেই আদ্র’র কদর ছিল অনেক..
মুক্তির সাথে কথা বলতে বলতে একসময় সম্পর্কে জড়িয়ে যায় দু’জন। বাবা-মা হারা আদ্রকে সেই প্রথম কেউ এত ভালোবেসেছিল, এত কেয়ার করছিল। আদ্র’র নরম, বিগলিত মন সেটা নিতে পারেনি। মুক্তি আদ্র’র জন্য এতটা পাগল ছিল যে, আদ্র যদি রাত দুইটাই তাকে নিজের বিছানায় ডাকত, তাহলে দৌড়ে চলে আসতো মুক্তি। কিন্তু আদ্র কখনোই সেটা করেনি। খুব বেশিদিন রিলেশনও ছিল না। মাত্র দু’মাস। তারপরই মুক্তিকে বিয়ের জন্য প্রপোজাল দেয় আদ্র। মুক্তি এক্সেপ্ট করার আঠারো দিনের মাথায় ধুমধাম করে বিয়ে হয় তাদের। দু’জনে ভালোবাসার মুহূর্তগুলো উপভোগ করার পাশাপাশি ধুমিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। দেড় বছরের মাথায়, হঠাৎই মুক্তি টের পেল, তার মাসিক স্কিপ করে গেছে। সে তৎক্ষনাৎ অনুপমাকে দেখালো এবং টেস্ট করে জানা গেল,ওরা দু’জন থেকে তিনজন হবে। আদ্র’র খুশি দেখে কে! শুধু খুশি ছিল না মুক্তি। তার ক্যারিয়ার তখন মাত্র উঠতে শুরু করেছে জমজমাট ভাবে। সে এই বাচ্চা এবোরশন করাতে চাইলো আর এখানে ভাঙন ধরে আদ্র-মুক্তির সম্পর্ক। তারপরের পথটা আদ্র’র জন্য মোটেও সুন্দর ছিল না। মুক্তি কোনোরকমে বাচ্চা জন্ম দিয়েই আদ্র’র ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য ফ্ল্যাটে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিল, আদ্র’র সঙ্গে আর কোনো প্রকার বৈবাহিক সম্পর্ক রাখবে না। অবাক হয়েছিল আদ্র। সামান্য এই কারণে কেউ ডিভোর্স অবধি চলে যেতে পারে- সে ভাবতেও পারেনি। পরে অবশ্য জেনেছিল, জয়ের কারণেই মুক্তি এমনটা করেছিল। জয়ও একজন উঠতি বয়সের তরুণ সিঙ্গার। ভালো নাম কামিয়েছে ইতিমধ্যেই। একসময় আদ্র-মুক্তির ডিভোর্স হয়ে যায়। মাঝ দিয়ে ফেঁসে যায় ছোট্ট বাচ্চা অর্থি! অর্থির জন্য দুই-বছর গ্যাপ দেয় আদ্র। মিডিয়া জগত থেকে একদম সরে গিয়ে তার সবটুকু সময় অর্থিকে দিতে লাগল আদ্র। ওদিকে তখন আদ্র-মুক্তির ডিভোর্স নিয়ে তোলপাড় মিডিয়ায়। তার মধ্যে হুট করে আদ্র’র গায়েব হওয়া নিয়ে আরও কতশত সমালোচনা! সবাই বলতে লাগল, এভাবে গ্যাপ দিলে যেই নামটুকু সে কামিয়েছে তার কিছুই থাকবে না।আর ভালো কোনো ছবিও সে করতে পারবে না। তার ক্যারিয়ারে ধস নামবে। আদ্র শোনেনি। তার কাছে ক্যারিয়ারের আগে তার মেয়ে… তার অর্থি!

–‘কী ভাবছেন এত?’ অনুপমার প্রশ্নে ধ্যানের সুতো ছিঁড়ে যায়। আদ্র স্মর্তি হাতড়ে বাস্তবে এসে পৌছায়। জবাব দেয়, ‘না, তেমন কিছু না।’

–‘আমার কথাগুলো ভেবে দেখবেন মিস্টার আদ্র। আপনি আমাকে কী ভাবেন জানি না তবে আমি আপনাকে বন্ধুর চোখেই দেখি। আজ উঠি তবে। রাত তো শেষের পথে…’

–‘থেকেই যান না হয়।’

–‘না, না। আমি চলে যাব। বাসায় রূপায়ন টা একা।’

–‘আমি মোতালেবকে বলে দিচ্ছি। আপনাকে পৌঁছে দেবে।’

–‘ধন্যবাদ।’

আরও একবার রজনীকে চেক করে নিয়ে অনুপমা চলে গেল। অনুপমা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ নিজের ঘরে একা বসে রইল আদ্র। ভাবতে লাগল, অনুপমার প্রতিটি কথা। আদ্র নিজেকে আদর্শ স্বামী হিসেবেই মনে করে। রজনী তার জীবনে যে কষ্ট গুলো পেয়েছে- সেগুলো আদ্র ধুঁয়ে মুছে দিতে সক্ষম। তবে কী সত্যিই একবার চান্স নিয়ে দেখবে আদ্র? হতেও তো পারে, তাদের জীবনটা সুন্দর হয়ে উঠবে! অর্থিও একটা মা পাবে। রজনী অর্থির মা হিসেবে পারফেক্ট। কিন্তু বউ হিসেবে কতটুকু পারফেক্ট হবে, কে জানে! আর রজনী মানবে কী? রাজী হবে কী-না তাই বা কে জানে?
আদ্র’র মাথা ব্যথা শুরু হয়। এ কোন চিন্তা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল অনুপমা! ধুর.. আদ্র উঠে দাঁড়ায়। একবার রজনীকে দেখে আসা দরকার।

রজনীর ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ আগেই জ্বর ছেড়েছে। পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। জ্বর যখন উঠে, তখন যতটা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে, নেমে যাওয়ার পর তার চাইতেও বেশি গরম অনুভূত হয়। রজনীর ইচ্ছে করছে ফ্যানটা একটু চালিয়ে দেওয়ার জন্য৷ এই ঘরে এসি নেই। অবশ্য তা নিয়ে তার মাথা ব্যথাও নেই। সে ফ্যানের বাতাসেই অভ্যস্ত। এসির বাতাস ডিরেক্ট গিয়ে তার মাথার ভেতর ধরে।

রজনী শুয়ে থেকেই হাত-পা গুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল৷ একটু ব্যায়াম আর কী! হাতের আঙুল ফুটালো, পায়ের আঙুল ফুটালো। পায়ের তলা মালিশ করতে লাগল একা একাই। জ্বর হলে শরীর কেন ব্যথা করে- এটা রজনীর মাথায় ঢোকে না। এমন সময়ে দরজায় মৃদু শব্দ হলো। রজনী তাকাতেই দেখল, তার দিকে এক জোড়া চোখ গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। রজনীর মনে পড়ল, তার গায়ে তো ওড়না নেই। সে বিদ্যুৎ বেগে পাশ থেকে ওড়না নিয়ে বুকের উপর রাখতে রাখতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। বলল, ‘আ..আপনি?’

আদ্র’র অস্বস্তি হচ্ছে। রজনী জেগে আছে জানলে সে আসতো না। আর এখন যাওয়ারও উপায় নেই। অথচ এই মেয়েকে কীই-বা বলবে সে? ইশ…! আদ্র মনে মনে ভাবল, ‘এই জীবনে শুধু ভুল টাইমে ভুল কাজ গুলোই করে গেলি তুই!’

আদ্রকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে ভেতরে চমকালো রজনী। অজান্তেই তার কপালে সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ক’টি ভাঁজের সৃষ্টি হয়। ইতস্ততভাবে সে বলল, ‘আমাকে কিছু বলতে এসেছেন?’

–‘হ্যাঁ, না, মানে…’ আদ্র অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সামনে এগিয়ে আসতে আসতে আরও নার্ভাস হয়। অথচ সে ভেবেই পাচ্ছে না এখানে নার্ভাস হওয়ার কী আছে? অদ্ভুত! আদ্র মনে মনে নিজেকে গালি দেয় বেশ কয়েকটি। তারপর বেশ অনেকটা দূরত্ব রেখে রজনীর সামনে বসে। বলল, ‘ইয়ে মানে.. দেখতে এলাম আপনার শরীরের অবস্থা।’

–‘ওহ! তাই বলুন। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন ঠিক আছি। কিছুক্ষণ আগেই জ্বর ছেড়েছে।’

–‘যাক, ভালো তো। কিন্তু জ্বর ছেড়েছে বলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন না কিন্তু৷ ওখানে কিছু ভিটামিন ট্যাবলেটও দিয়েছে বোধহয়। সবগুলো নিয়ম মতো খাবেন।’

–‘ঠিক আছে। অর্থি কী ঘুমোচ্ছে?’

–‘হ্যাঁ। আপনার জ্বর শুনে একবার উঠেছিল। আপনাকে দেখেও গেছে। আপনি তখন ঘুমে। এরপর গিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়েছে।’

–‘ইশ! আমার জন্য কত হয়রানি হলো আপনাদের! নাছির উদ্দীনের গলাও শুনছিলাম বোধহয়। উনিও এসেছিলেন?’

–‘হুম।’

–‘উফ রে! নিজেকে জুতা মারতে মন চাচ্ছে। আমার জন্যে কতজনের যন্ত্রণা হলো!’ রজনীর কণ্ঠ দিয়ে নিজের প্রতি বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়ছে। আদ্র’র অপ্রস্তুত ভাব কমে এসেছে। যে এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। আর পরখ করছে রজনীকে। রজনী কথা বলছে হাত নাচিয়ে নাচিয়ে। এই মেয়ে কখনোই স্থির না! হাসে আদ্র, রজনীর অগোচরে। রজনীর চুলগুলো এলোমেলো খোঁপা করা। কিছু চুল খোঁপায় গুঁজে থাকলেও, বাকি চুল এদিক ওদিক দিয়ে বেরিয়ে আছে। সেগুলো অল্প সল্প উড়ছে। মনে হচ্ছে রজনীর সাথে সাথে এরাও আদ্র’র সঙ্গে গল্পে মেতেছে। হঠাৎ আদ্র’র চোখ পড়ল রজনীর চোখের দিকে। এত সুন্দর গভীর চোখ- আদ্র এর আগে কক্ষনো দেখেনি। কোনো কৃত্রিমতা নয়- একদম ন্যাচারাল ঘন আখি পল্লব। চোখের মনি গাঢ় কালো। একটু বড় বড়… এই জন্যেই চোখ দুটো অনেক গভীর… তার উপর ভাসা ভাসা! বাম চোখের কোণায় একটা তিলও বুঝি আছে। কালো কুচকুচে… সুন্দর।

আদ্র’র কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে। সারাক্ষণ যার বিচরণ কৃত্রিমতার মাঝে, তাকে হঠাৎ করে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি আনলে ঘোর তো লাগবেই! আদ্র বিড়বিড় করে উঠল আনমনে, ‘আসলেই সুন্দর।’

রজনীর কথা থেমে যায়। সে স্পষ্ট শুনতে পায়নি। কান পেতে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কিছু বললেন?’

–‘না, না, কিছু না।’ ঢোক চাপে আদ্র। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। ‘আমি আসি। আপনি ঘুমিয়ে যান।’ বলে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। রজনী হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল। আদ্র’র হঠাৎ আসা, হঠাৎ চলে যাওয়া- মাথায় ঢুকছে না তার! আদ্র নিজের রুমে এসে আলমারি খুলল। একদম নিচের দিকের একটি ড্রয়ার সবসময় তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এই ড্রয়ারের চাবি একমাত্র আদ্র’র কাছেই থাকে। অন্য কারো কাছে থাকার প্রশ্নও উঠে না অবশ্য! আদ্র তালা খুলে ড্রয়ার টানলো। ভেতর থেকে একটি এলবাম বের করে আনে। এটা মুক্তি আর তার এলবাম। তাদের বিয়ে থেকে শুরু করে, ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত যত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা হয়েছিল, সেসবে ভরে আছে এলবামটি। আদ্র এলবামটা নিয়ে বারান্দায় আসে। বেতের মোড়ায় বসে এলবাম খুলল। খুব গাঢ় দৃষ্টিতে মিলিয়ে মিলিয়ে কী যেন দেখল। তারপর এক গাল হাসি নিয়ে উচ্চারণ করল, ‘তুমি ফেল মুক্তি। তোমার চেয়েও সুন্দর কেউ আজ আমার আঙিনায়… বলেছিলে না? আমি সুন্দর চেহারার মানুষ পাব, তবে সুন্দর মনের মানুষ পাব না? এসো, দেখে যাও। ও শুধু বাহির দিক থেকেই সুন্দর না, ও ভেতর থেকেও সুন্দর, সচ্ছ, পবিত্র। তোমার মতোন স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন ভাঙতে জানে না। তোমার মতোন ভালোবেসে মন ভাঙতে জানে না। তোমার মতোন হাত ধরে মাঝপথে হাত ছাড়তে জানে না। ওকেই চাই আমার। ও আমার.. এখন থেকে রজনী আমার। তোমাকে আমি দেখিয়ে দিব মুক্তি। রজনী আর অর্থিকে নিয়েই সাজবে আমার সুখের সংসার। আফসোস করবে একদিন তুমি, আফসোস…’ আদ্র থামে। তার মনে হচ্ছে, মুক্তি সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আর সে এইসব কথা মুক্তির মুখের উপর বলতে পেরেছে। অদ্ভুত শান্তি হয় কলিজায় । এলবামটি রেখে ঘরে আসে আদ্র। ম্যাচ খুঁজতে কিচেনে যায়, কেননা সে স্মোক করে না। ম্যাচ এনে এলবামটি আগুন ধরিয়ে দেয়। তার চোখের সামনে পুড়তে পুড়তেন থাকে এতদিন ধরে যত্নে রাখা স্মৃতির টুকরো। আদ্র বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করল, ‘আমি আবার স্বপ্ন দেখব। আবার রং দিয়ে দুনিয়া সাজাব। তবে আমার সেই দুনিয়ার কোথাও তোমার ছিটেফোঁটাও থাকবে না মুক্তি। মনে রেখো, আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না, না, না.. মানুষের জীবনে দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রেমের মতো, দ্বিতীয়, তৃতীয় ভালোবাসাও আছে।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here