‘যার হাত ধরে সব ছেড়ে চলে এলাম, সেই আজ আমার হাত ছেড়ে দিলো রে। দোষ আমার একটাই, কেন গত দুটি বছরেও একটিও বাচ্চা পেটে আনতে পারলাম না। আমি কী করব এবার, বল সুপ্তি।’
মাথার উপর উত্তপ্ত রোদ, মিহি কাঁচের গুড়োর মতো উড়ছে বালি। মানুষজন যেন ব্যস্ত ঘোড়া, ছুটছে এদিক সেদিক। কারো দিকে দুই দন্ড তাকানোর সময় নেই। শুধু রজনীর পা জোড়াই থমকে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে মেইন রাস্তার পাশে, ফুটপাতে। তার চোখ দুটি ভীষণ লাল। গতকাল দুপুরে শেষবার খেয়েছিল। এখন পর্যন্ত পেটে কিচ্ছু পড়েনি। শরীরের জায়গায় জায়গায় ব্যথা। মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ জোড়া ঘুমাতে চায়। রজনীর মনে হলো, সে যে কোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে।
ফোনের ওপাশ থেকে খানিকটা বিরক্তি মাখানো কণ্ঠে সুপ্তি বলল, ‘এখন আমি কী বলব, বল? আমার কাছে এনে রাখার মতো উপায় নেই। আরিফের মাত্র ব্যবসাটা দাঁড়িয়েছে, বুঝিসই তো..’
রজনী অবাক, স্তব্ধ। সে জানেও না, কখন তার চোখ ভেঙে অশ্রুরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। শেষ ভরসা ছিল সুপ্তিই… এই সুপ্তির জন্য কত্ত কিছু করেছে সে! দু’জনে ছোট বেলাকার বান্ধবী। এক সাথে স্কুল পাশ করেছে। ক্লাস এইট থেকে সুপ্তির সঙ্গে আরিফ ভাইয়ের সম্পর্ক, কেউ জানত না রজনী বাদে। সুপ্তি প্রথম থেকেই ভীষণ ভীতু ছিল। দেখা করতে যাওয়া তো দূরেই থাক, আরিফের কাছে চিঠিটা পর্যন্ত দেওয়ার সাহস হতো না। পাছে কেউ দেখে ফেলে! তাই সুপ্তির হয়ে রজনী আরিফ ভাইয়ের কাছে চিঠি চালাচালি করত, আবার আরিফ ভাইয়ের চিঠি নিয়ে সুপ্তিকে দিত। কতজন যে দেখে ফেলতো, তারা ভাবত আরিফের সাথে রজনীর সম্পর্ক। তারপর তার বাবার কাছে বিচার দিয়ে দিত। এই নিয়ে কম মাইর খায়নি সুপ্তি, অনেক কথাও শুনেছে। আর আজকে তার যখন এত বিপদ, তখন কী-না সুপ্তি এই বলছে?
রজনী কোনো জবাব দিতে পারল না। চুপ করে রইল।
ফোনের ওপাশ থেকে সুপ্তি খানিকক্ষণ পর বলল, ‘কথা বলিস না কেন?কাজ আছে তো আমার।’
অভিমানী গলায় রজনী উত্তর, ‘যা, কাজ কর। রাখি।’
–‘শোন, রাগ করিস না আমার উপর। আমাদের বিয়েটা কেউ মানে নাই এখনো, কত কষ্ট করেছি, জানিসই তো। এখন মাত্র ব্যবসাটা ধরল…’
–‘না, না, বুঝতে পারছি আমি। সমস্যা নাই।’
–‘তোর ভাইয়ের বাসায় যা। তাদের হাতে-পায়ে ধর।’
রজনী মলিন ঠোঁটে হেসে বলল, ‘বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইদের কাছে আমি কী পরিমাণে বোঝা হয়ে গেছিলাম, তা তোকে বোঝাতে পারব না। তার উপর, ভাবিরা তো আমাকে দুই চোখে সহ্যই করতে পারত না। এই জন্যেই অভির হাত ধরে চলে গেছিলাম। কে জানত, একসময় আমিও তার কাছে বিরক্তি এবং বোঝা হয়ে যাব!’
–‘বেচারাকে কেন দোষ দিচ্ছিস? সমস্যা তো তোর, বাচ্চা না হলে কোনো ছেলেই বউ রাখে না। বাচ্চা ছাড়া বউ দিয়ে পূজা করে নাকি?’
রজনী কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
তার ঠোঁটের মলিন হাসি চওড়া হয়ে গেল। চোখ দিয়ে জলপ্রপাতের মতো পানি ঝড়ছেই…
–‘গিয়ে ভাইদের পা ধর, যা… এছাড়া আর উপায় দেখি না।’
–‘আমারটা আমিই বুঝে নিব। রাখি, ভালো থাক।’
ফোন কেটে দেয় রজনী। তার চারপাশ ঘুরছে। পেট মোচড় দিয়ে বমি বমি ভাব হচ্ছে। গলার ভেতরটা তেতো লাগছে। সে সজোরে রাস্তার মাঝখানে ফোনটাকে ছুঁড়ে মারল। ফোনটা রাস্তায় পড়তেই তার উপর দিয়ে একটি বাস চলে গেল। ধপ করে বসে পড়ল রজনী, এতে আশেপাশের কয়েকজন হাঁটা বাদ দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাল। রজনীর চারিদিকের কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু শব্দে কাঁদছে…
দুই বছর আগে, এক বর্ষার দিনে অভির সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল রজনী। অভি প্রথম প্রথম খুব ভালোবাসত রজনীকে। রজনীকে ছাড়া এক দন্ড কোথাও কাটাতো না। অভির মা তো কিছুতেই রজনীকে ঘরে তুলবেন না। কারণ, মেয়ের বাবা-মা নেই,আছে শুধু ভাইয়েরা। ভাইদের অবস্থাও ভালো নয়। তার উপর পালিয়ে আসার কারণে ভাইরা সাফ সাফ বলে দিয়েছে, তারা রজনীর বিষয়ে কিচ্ছু জানে না এখন থেকে। অর্থাৎ, রজনীকে ঘরে তোলা মানে, একদম বিনা খরচে আরেকটি প্লেট বাড়ানো। শুধু শুধু কেন পরের মেয়েকে খাওয়াতে যাবে?
এই শুনে অভিও রজনীকে নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকতে লাগল। শেষমেশ ছেলের জন্য রাগ,জিদ, একপাশে রেখে রজনীকে ঘরে তুললেন অভির মা জহুরা। এই ঘরে উঠাটাই কাল হয়ে দাঁড়াল রজনীর জন্য। যত দিন যায়, অভি পালটায়। মা, ভাই, ভাবিদের কথা মতো রজনীর উপর মানসিক থেকে শারীরিক, সব ধরনের অত্যাচার করতে শুরু করে। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই দেখেই, ঠোঁট কামড়ে সবটা সহ্য করে নিয়েছিল রজনী। বিয়ের দেড় বছর অতিবাহিত হওয়ার পর, রজনীর হুট করে খেয়াল আসে, সে দুইবার বাচ্চা নিতে চেয়েও পারেনি। কনসিভ হচ্ছে না কোনো ভাবেই। বিষয়টি নিয়ে অভির সাথে আলোচনা করে। অভি বলে, আবার ট্রাই করতে। ট্রাই করা হয়, একবার নয়.. দুই-তিনবার।কিন্তু একবারও কনসিভ হয় না। কথাটা জহুরার কানে যাওয়া মাত্রই শুরু হয় তান্ডব। তিনি এবার আর কিছুতেই রজনীকে রাখবেন না। অভির নতুন বিয়ে দেবেন। অভিকেও বুঝাতে লাগলেন, একজন পাত্রী আছে। তাকে বিয়ে করতেই নগদ তিন লাখ! সাথে ঘরের আসবাবপত্র তো ফ্রী! আবার যখন যা চাবে, তাই পাওয়া যাবে শ্বশুর বাড়ি থেকে। বড়লোক বাবার ছোট মেয়ে! রাতারাতি মালামাল। অভির দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ব্যবসায়ী হবে। সেটাও পূর্ণ হবে।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন… একসময় অভিও মায়ের কথায় সায় দিল। রজনীর উপর বাড়িয়ে দিল অত্যাচার। তবুও রজনী ঘর ছেড়ে বের হয়নি। যাবে কোথায় সে? আজ সকালে রজনীকে মারতে মারতে আধমরা বানিয়ে ফেলে অভি। তারপর ঘরের বাইরে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘যদি আর কোনোদিন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় তোর ছায়াও পড়ে, আমি ভাববো তুই তোর মরা বাপ-মায়ের মাথা খাস।’
চলে আসে রজনী। একবারও ওই বাড়ির দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। তার না হয় সম্মান নেই, কিন্তু তার মৃত বাবা-মায়ের সম্মান অনেকখানি… যেখানে তার মৃত বাবা-মায়ের সম্মান নেই, সেখানে তারও থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে,এসে বড় ভুল হয়েছে। যাবে কই এখন? তার বিয়ের পর পর ভাইরাও বাসা পাল্টে কোথায় গিয়ে উঠেছে, রজনী জানে না। তাদের নাম্বার ও নেই। কী করবে, কাকে বলবে? কে করবে এই বিপদে সাহায্য? রজনীর মাথা ঘুরানি বাড়ছে ক্রমশ। এক্ষুনি মাথাটা ফেটে মগজ বের হয়ে গেলে মন্দ হয় না!
________
–‘তোমার ভালো লাগছে আম্মু?’
একমাত্র মেয়ে অর্থির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল আদ্র মেশতাক। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য এক্টর তিনি। অর্থির বয়স পাঁচে পড়েছে। সবসময় ঘরে একাই থাকে বলতে গেলে। মা নেই, আর বাবা তো সবসময় বিজি ম্যান! কাজের লোক আছে, দারোয়ান চাচা আছে, ন্যানি আছে, তবুও অর্থির সবসময় মন খারাপ থাকে। এইটুকুনি বাচ্চা, বাবা-মায়ের সঙ্গই তো খুব পছন্দ করে। তেমন অর্থিও সবসময় তার পাপার সঙ্গে থাকতে চায়, সময় কাটাতে চায়। হলিডে গুলো দারুণ কাটে অর্থির। হলিডের সময় পাপা বাসায়ই থাকে,অর্থির সব আবদার, ইচ্ছা পূরণ হয় তখন।
অর্থির গায়ে কফি কালারের হাতা-কাটা ফ্রক। চুলগুলো পোনিটেল করে বাঁধা। দুই কানে ছোট্ট সোনার রিং ঝুলছে। চোখেমুখে উজ্জ্বল হাসি। সে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে জবাব দিল, ‘খুব ভালো লাগছে পাপা…’
আদ্র’র বুক ঠান্ডা হয়। তার মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়, দুর্বল লাগে। এর একমাত্র কারণ, মেয়েটাকে সময় দিতে না পারা। এই মেয়ের কারণেই আদ্র তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় নামটি হারিয়েছে। অর্থির কারণেই আদ্র তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছে। আল্লাহর রহমতে সেগুলো ফেস করতে পেরেছে, সফল হয়েছে। কিন্তু প্রিয় নামটি আর ফিরে আসেনি… সে হারিয়ে গেছে বিভীষিকার মতো, মরীচিকার আড়ালে…
আদ্র গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হঠাৎ অর্থি চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘পাপা স্টপ দ্য কার.. প্লিজ, স্টপ।’
আদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব হয় গাড়ির সামনের সিটে বসে থাকা ম্যানেজার এবং ড্রাইভারও। আদ্র কিছু বলে উঠার আগেই সাইড করে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। ম্যানেজার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পেছনে তাকাল। অর্থি কেন গাড়ি থামাতে বলল, তাই যেন বোঝার চেষ্টা করছে।
আদ্র প্রশ্ন করার আগেই, অর্থি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিল। আঙুল তুলে বাইরে ইশারা করে কিছু একটা দেখাল,বলল, ‘খাবো পাপা। প্লিজ, না করবে না। প্লিজ..’
রীতিমতো অনুরোধ করতে লাগল অর্থি। আদ্র আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল, হাওয়াই মিঠাই-ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একজন মহিলা বাচ্চা সমেত দাঁড়িয়ে। মহিলাটিও বোধহয় নাছোরবান্দা বাচ্চার জেদের কাছে হেরে হাওয়াই মিঠাই কিনছেন। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অর্থি।’
–‘একবার খেলে কিচ্ছু হবে না। প্লিজ পাপা.. আমি কিন্তু কখনো কিচ্ছু চাই না তোমার কাছে …’
এই কথায় আদ্র’র কোঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। বলে কী এই মেয়ে! ও নাকি কখনো কিচ্ছু চায় না! আদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘গতকালকে বারবি সেট কিনে দেওয়ার জন্য কে জেদ ধরেছিল?’
অর্থি দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। করুণ চোখ করে তাকাল। ম্যানেজার বললেন, ‘স্যার, কিনে আনব? বাচ্চা মানুষ.. ‘
আদ্র ম্যানেজারের দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই ম্যানেজার চুপসে গেল। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। এই ম্যানেজারের বয়স পয়ত্রিশের এদিক সেদিক, কিন্তু আচার আচরণ নিতান্তই বাচ্চাদের মতো। এখন যদি আদ্র অর্থিকে কিনে না দেয়, তাহলে আগামী তিনদিন অর্থি গাল ফুলিয়ে থাকবে, সঙ্গে এই ম্যানেজারও গাল ফুলাবে। ম্যানেজারের নাম নাছির উদ্দীন। আদ্র মমতা দিয়ে ডাকে, নাছির মিয়া বলে।
আদ্র চেয়ে দেখল, অর্থি হাওয়াই মিঠাইওয়ালার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো চিকচিক করছে। যেকোনো মুহূর্তে বর্ষার মেঘ কেটে জল নামবে ঝর ঝর করে। আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাছির উদ্দীন কে ডেকে বলল, ‘একটা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসুন।
–‘থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ স্যার..’
বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটলেন নাছির উদ্দীন। ড্রাইভার মোতালেব হাসল। আদ্র বলল, ‘মোতালেব মিয়া, নাছির মিয়া রে কেমন লাগে তোমার কাছে?’
–‘ভালোই লাগে স্যার। পরিষ্কার দিলের মানুষ। বড় ভালো লোক।’
মোতালেব ঠিক বলেছে, ভাবে আদ্র। নাছির উদ্দীন বড় ভালো মনের অধিকারী। যখন একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঝড়ের মুখে পড়েছিল আদ্র, তখন কেউ তাকে সাহায্যে করার জন্য এগিয়ে না আসলেও এই নাছির উদ্দীন শুরু থেকে একদম শেষ অবধি ছিলেন। সবাই যখন বলেছিল, গ্যাপ নিলে নাম থাকবে না, পরিচিতি থাকবে না। তখন একমাত্র নাছির উদ্দীনই আদ্রকে উৎসাহ দিতেন বার বার। বলতেন, ‘আল্লাহ ভরসা স্যার। আপনি খালি একবার ছবিতে নামেন, সেই ছবি হিট খাইবো… একদম সুপার ডুপার হিট…’
দুই বছরের গ্যাপের পর যখন ছবি করে আদ্র, নায়িকা বিহীন সেই ছবি সত্যি সত্যি হিট করে যায়। নাছির উদ্দীন তখন খালি দাঁত কেলিয়ে হাসতেন আর বলতেন, ‘দেখছেন স্যার? মিললো তো আমার কথা?’
আদ্র ভাবনা থামিয়ে ফোন হাতে নেয়। স্ক্রল করতে লাগল। তখন অর্থি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘পাপা, লুক এট দ্যাট… নাছির আংকেলের কোলে একটা মেয়ে।’
আদ্র তাকাল, নাছির উদ্দীন ভীষণ বেকায়দা অবস্থায়। তার কোলের উপর একটি মেয়ে, দূর থেকে চেহারা বোঝার উপায় নেই। সে ছেড়েও দিতে পারছেন না, আবার ধরে রাখতেও অস্বস্তিবোধ করছেন। নাছির উদ্দীন বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন। তাদের ঘিরে মোটামুটি একটা জটলার সৃষ্টি হচ্ছে। আদ্র দ্রুততার সঙ্গে বলল, ‘মোতালেব, দ্রুত যাও। মেয়েটি কে, কী বৃত্তান্ত আমাকে জানাও।’
মোতালেব গাড়ি থেকে বের হয়েই দৌড়…
বাস, গাড়ি কোনো কিছু মানলো না। কোনোরকমে নাছির উদ্দীনের কাছে গিয়ে পৌঁছোলো। তখনি ফোন বেজে উঠে তার। মোতালেব ফোন হাতে নিয়ে দেখল, আদ্র ফোন করেছে। সে রিসিভ করে।
–‘স্যার, বলেন।’
–‘কী হয়েছে ওখানে?’
–‘একটা মহিলা নাছির ব্রাদারের কাছে আইসা সাহায্য চাইতে চাইতে আচমকা অজ্ঞান হইয়া পইড়া যাইতে নিছে। ব্রাদারে দ্রুত তারে ধরছে।’
–‘ওহ! আচ্ছা শোনো, আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি। এখানে আমাকে কেউ দেখলে আরও ভীড় লেগে যাবে। তুমি আর নাছির মিলে ওই মেয়েটিকে হাসপাতালে এডমিট করাও দ্রুত। অ্যাপোলো তে চলে আসো। আমি ওখানেই থাকব।’
–‘জি, আচ্ছা স্যার।’
–‘ভুলেও মেয়েটাকে ফেলে এসো না। এই দুনিয়ায় মানুষরূপী পশুর অভাব নেই কিন্তু।’
আদ্র ফোন কাটে। চোখে বড় কালো সানগ্লাস পড়ল। তারপর আশপাশটা ভালোমতো দেখে নিল। আশেপাশের সবার নজর মোটামুটি রাস্তার ওই পাশে, দৃশ্যের দিকে। একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কেউ তাকে সাহায্য না করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার মত কী আছে আজব! আদ্র’র ভেতরে ভেতরে একটু রাগ রাগ লাগে। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। তারপর গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
________
পিটপিট করে চোখ খুলতেই, বড়সড় একটা ধাক্কা খেল রজনী। এটা কোথায়! কার বাসা? সে কী কোনো খারাপ লোকের খপ্পরে পড়েছে? তার কাপড়চোপড়…
রজনী তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে গিয়ে টের পেল তার এক হাতে ক্যানোলার নল, টান লেগে রক্ত বেরিয়ে আসছে। রজনী তীব্র স্বরে গুঙিয়ে উঠল। ঠিক তখনি রোগা-পাতলা, লম্বা শরীরের একজন কেবিনে ঢুকে। রজনী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। লোকটি অপরিচিত। সে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘উঠবেন না সিস্টার, উঠবেন না। আল্লাহ, আপনার হাতে তো রক্ত চইলা আসছে। আমি এখনি যাইয়া নার্স ডাকি, দাঁড়ান।’
লোকটি যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিল, সেভাবেই ঝড়ের গতিতে চলে গেল। ব্যথা কমে আসছে হাতের। কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা…
রজনীর তন্দ্রাভাব কাটল। সে পরিপূর্ণ চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল, এটা একটা হাসপাতাল এবং খুব দামী হাসপাতাল। এখানে সে এলো কীভাবে? আর কেই বা আনলো?
ভাবনার মধ্যেই একজন কম বয়েসী নার্স ঢুকলো কেবিনে। রজনীকে শুইয়ে দিয়ে হাত দেখল। অল্প একটু রক্ত এসেছে, সেটা পরিষ্কার করে দিতে লাগল। রজনী দুর্বল কণ্ঠে জানতে চায়, ‘আমাকে এখানে কে এনেছে?’
–‘মোতালেব এবং নাছির উদ্দীন নামের দুই’জন ব্যক্তি। আপনি নাকি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলেন।’
–‘ওহ।’
–‘জি…’
নার্স বেরিয়ে গেল। মোতালেব এসে আবার ঢুকলো। রজনী উঠার চেষ্টা করল, শরীর দুর্বল লাগছে তাই উঠল না।শুয়ে থেকেই বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
–‘নো, নো, নো প্রবলেম সিস্টার।’ মাথা নাড়ে মোতালেব। ইংলিশে কথা বলতে তার ভীষণ ভালো লাগে যদিও এত বেশি ইংলিশ সে জানে না।
রজনী মৃদু হাসলো। কেন জানি তার, লোকটাকে ভীষণ বোকা কিসিমের মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই রজনীর মনে পড়ল, অভিকেও সে খুব ভালো ভেবেছিল। তার ভেতর যে এরকম কুৎসিত কীট আছে, তা কে জানত?
–‘শুনলাম আরও একজন আমাকে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। উনি কোথায়?’
–‘আছে সিস্টার, বাইরেই আছে। স্যারের সঙ্গে। দাঁড়ান, ডাইকা দেই।’
মোতালেব বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায়, একজন টল, হ্যান্ডসাম,ফর্সা মানুষ ভেতরে ঢোকে। তার গায়ে অফ-হোয়াইট শার্ট, কালো প্যান্ট। হাত ঘড়িটা এত উজ্জ্বল যে চিকচিক করছে লাইটের আলোতে। ভীষণ সুদর্শন পুরুষ….
রজনীর দম বন্ধ হয়ে গেল। বিস্ফোরিত নয়নে সে তাকিয়ে আছে। স্বপ্ন দেখছে নাকি? নাকি সবটাই সত্যি? উঁহু, স্বপ্নই নইলে বিভ্রম। পড়ে গিয়ে নির্ঘাত মাথায় চোট পাওয়ায় এইসব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছে।
আদ্র অত্যন্ত নমনীয় গলায় বলল, ‘এখন কেমন আছেন আপনি?’
রজনী তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে একসময় মৃদু স্বরে কোনোরকমে বলে উঠল, ‘কে আপনি?’
আদ্র হেসে ফেলে। মৃদু হাসি, ভীষণ সুন্দর। হাসির সময় এক গালে টোল জাগে, অল্প একটু। সেটাও সুন্দর। এই মানুষটাই আগাগোড়া সৌন্দর্যে মোড়ানো। রজনীর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এটা যে কল্পনা নয়, সে বুঝতে পারছে। আর বুঝতে পারছে দেখেই তার অস্বস্তি হচ্ছে। অস্থির লাগছে।
এতবড় একজন ফিল্মস্টার.. তার সামনে! রজনী ভাবতে পারল না। সে তৎক্ষনাৎ উঠে বসল। ক্যানোলায় আবার টান পড়ে। রক্ত আসে, ব্যথা হয়। রজনীর ধর্তব্যে নেই সেসব। সে নিষ্পলক তাকিয়ে….
আদ্র থতমত খায়। যদিও এটাই স্বাভাবিক। একজন সাধারণ মানুষের সামনে হুট করে নায়ক টাইপের কেউ চলে আসলে, সে সাডেন শক খাবেই! একবার তো এক ব্যক্তি তাকে হঠাৎ সামনে দেখে স্ট্রোক করে ফেলেছিল। ভাগ্যিস মারা যায়নি যথাসময়ে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। মাঝে মাঝে আদ্র’র মনে হয়,সে মানুষ না। কোনো ভূত-প্রেত টাইপের কিছু। নইলে এত কেন শকড হয় মানুষ? কে জানে?
আদ্র খুকখুক করে কাশে। গলা খ্যাঁক করে বলল, ‘হ্যালো মিস.. শুনছেন?’
রজনী উঠে দাঁড়ায়। অন্য হাত দিয়ে টান মেরে ক্যানোলা খুলে ফেলে। রক্ত ছিটকে আসে। আদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই রজনী আদ্র’র দুটো পা জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘আপনার ঘরের চাকর হতেও রাজী। তবুও একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।’
চলবে…
#রজনীগন্ধা
#পর্ব ১
#অলিন্দ্রিয়া রুহি
(প্রথম পর্ব কার কেমন লেগেছে, অবশ্যই জানাবেন)