যখন এসেছিলে অন্ধকারে
৯ ও ১০
‘এই যে আপু এদিকে তাকাবেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম। চোখ মেলে দিন। ভুরু কুঁচকে থাকবেন না। কোথাও আনকম্ফোর্টেবল হলেই বলবেন।’
‘আলো লাগছে চোখে? বলবেন আপু।’
‘চুলে হালকা করে হাত দিন আপু। আনমনে কিছু ভাবছেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, আরেক পা সামনে আসুন, হাতটা ফুলটার উপর ছুঁয়ে দিন। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। না না আরেকটু হাসুন। ক্লোজআপ যাবে।’
স্টুডিওতে একের পর এক ফ্ল্যাশ পড়ছে। কথোপকথন কানে আসছে। ফটোজোনে পরশকে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে স্টুডিও দেখা যাচ্ছে। কাজ অনেক গোছানো এদের। আজকে টেস্ট ফটোশুট হচ্ছে।
রাজন মানিক আজ কাজ করছেন না, আসেনওনি এদিকে। কিন্তু তার টিম অনেক করিৎকর্মা। স্টাইলিং টিম আজকে অনির পোজ, লুক, ব্যাকগ্রাউন্ড আর লোকেশন নিয়ে আউটলাইন রেডি করবে। বেস্ট ছবিগুলো ডেমো হিসেবে রেখে ফাইনাল ফটোশুটের কস্টিউম, লোকেশন, লাইটিং ফিক্সড করবে।
একটা টিমে কতধরণের মানুষ পরশ অবাক হয়ে দেখে – হেয়ার স্টাইলিস্ট, ওয়ারড্রব স্টাইলিস্ট, নেইল স্টাইলিস্ট, ব্যাকড্রপ স্পেশালিস্ট, প্রপস ম্যানেজার, লাইট টেকনিশিয়ান, আরও আরও কত!
কাজের ব্যাপ্তি দেখে টাকাটা খুব বেশি মনে হচ্ছে না পরশের কাছে। চারটে সেশনে অনিকে একদম নতুন করে গড়েপিটে নিয়েছে ওরা। হেয়ারস্টাইলিং, কমপ্লিট মেকওভার তো হয়েছেই, দুইকেজি ওজন ঝড়িয়ে বডিশেপে চেঞ্জও আনতে হয়েছে অনিকে। ওজন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত রাজন মানিক ডেট দেয়নি।
বিভিন্ন রকম জামায় ট্রায়াল চলেছে সমানে। হাইহিলে অভ্যস্ত করানো হয়েছে। জামা, গয়না, জুতো, একসেসরিজ সবই ফটোগ্রাফার এর টিম স্পন্সর করছে।
অরিজিনাল সেশনের জন্য পাঁচটা ড্রেস পছন্দ করা হবে। আউটডোর আর ইনডোর মিলিয়ে সারাদিনের সেশন। অনি ফট করে বলল ‘পাঁচটা না, প্লিজ চারটা। চারটাতেই কাজ হবে।’
টিম এসিস্ট্যান্ট জাহিন অনির চার দুর্বলতা ধরে ফেলেছে। ও হেসে ফেলে ‘আচ্ছা যান, চারটা। নইলে বাড়ির থেকে এক্সট্রা নিয়ে আইসেন। আলাদা কয়টা ছবি তুলে আটটা বানায় দেবো।’
অনির মুখ দেখে আশ্বস্ত মনে হলো।
অনির উপরেও ধকল কম যাচ্ছে না। খাবার, ঘুম, এক্সারসাইজ – পুরো লাইফস্টাইলে রুটিনবাঁধা তো আছেই – হাঁটা, কথা বলা, হাসি এমনকি তাকানোটাও শিখতে হচ্ছে। পিন্টারেস্ট থেকে ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ছবি নামিয়ে ট্রায়াল দেওয়ানো হচ্ছে অনিকে দিয়ে, বেস্ট লুকটা টিম মার্ক করে নিচ্ছে।
অনিকে একেকটা ছবি বারবার দেখিয়ে এক্সপ্লেইন করছে ওরা, চোখ থেকে ঠোঁটের কাজ। দাঁড়ানোর ভঙিমা বা বসার কায়দা। হাসির মাপটুকুও বুঝিয়ে দিচ্ছে ওরা অনিকে।
লাল রঙের একটা অফ শোল্ডার গাউন পরে অনি দৌঁড়ে এলো ‘ভাইয়া দেখ, দেখ, কেমন লাগছে? ভালো না?’
আসলেই সুন্দর দেখাচ্ছে অনিকে। পরশ হেসে ফেলে বলে ‘তুই তো সুন্দরই!’
‘সেই সুন্দর না ভাইয়া! হিরোইনদের মতো লাগছে কীনা সেটা বলো?’
‘ভালোই তো মনে হচ্ছে!’
‘আমি মডেল হতে পারব তো? এই ফটোশুটটা হলে সব ডিরেক্টর, প্রডিউসারদের কাছে ছবি পাঠালে, ওরা আমাকে ডাকবে না?’
‘ডাকবে না কেন?’
‘ধরো, আমি নিজেই গেলাম আমার ছবি আর ওই যে বলল, পোর্টফোলিও, ওইটা নিয়ে যদি যাই, একেবারে তারা যদি কিছু একটিং করে দেখাতে বলে দেখিয়ে দিলাম। বলো?’
‘হুম।’
‘তুমিও যাবে আমার সাথে। সময় হবে না? আচ্ছা সময় না হলে আমি একাই যাবো!’
‘অতদূর এখনি কেন ভাবছিস? সে যখনকারটা তখন দেখা যাবে।’
‘আপু চলে আসেন? ফ্রন্টলাইট দিয়ে কাজ হবে এখন। আমরা রেডি।’ কল এলো অনির।
কতধরণের লাইটের ব্যবহার, অবাক হয় পরশ। ফ্রন্ট লাইট, ব্রড লাইট, ব্যাক লাইট, রিম লাইট, বাটারফ্লাই লাইট! কোনোটা নাইনটি ডিগ্রি এঙ্গেলে শ্যাডো তৈরি করছে তো কোনোটা ফরটি ফাইভ ডিগ্রিতে। লম্বা স্ট্যান্ড দিয়ে মডেলের একেবারে মাথার উপর আলো ফেলে নাকের নিচে আলোছায়ার খেলা তৈরি হয় বাটারফ্লাই লাইট দিয়ে। ছবি তোলার এত কায়দা, এত এত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, অজানাই থাকত পরশের কাছে। ফ্রন্ট লাইট একেবারে রোদের মতো, মুখের উপর পড়ে। বিদ্যুৎ শক্তিকে আলোক শক্তিতে রূপান্তর করলে কিছুটা তাপশক্তিও নির্গত হয়। এই তাপে মুখ ঝলসে যায়।
‘এই লাইটটা অনেক গরম, জানো ভাইয়া?’ কাজে ফিরতে ফিরতে বলল অনি। তবুও আনন্দিত ও। ওর চোখেমুখে সেই আনন্দ দেখে পরশ স্বস্তি পাচ্ছে। শুধু একটা চিন্তা কাঁটার মতো গলায় আটকে রয়েছে। বারবার সরিয়ে দিতে চাইলেও ফিরে ফিরে এসে মাথা খেয়ে নিচ্ছে।
সাদামাটা অনি, যে কখনো ভবিষ্যৎ ভাবেনি, কিছু হতে হবে, কেউ একজন হতে হবে, জীবনে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিলো না কোনোদিন, কোনো কাজ করার স্পৃহা দেখায়নি কখনো, হেসেখেলে দুরন্তপনায় ব্যস্ত ছিলো সে কেন এতটা ডেসপারেট হলো?
এই এত আয়োজন, এত পরিশ্রম কেন? এত তাড়াহুড়োই বা কেন?
মডেলিংয়ে আগ্রহ কেন তৈরি হলো অনির?
সত্যিই কি এটা ওর আগ্রহের জায়গা নাকি কাউকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য?
ইমরানকে কি ভালোবেসে ফেলেছিল ও? এখনো কি ভালোবাসে অনি ইমরানকে? অনির প্রথম ভালোবাসা কি ইমরান?
প্রথম ভালোবাসা ভুলে ও কি এগিয়ে যেতে পারবে নাকি আঁকড়ে ধরে তিলে তিলে শেষ করে দেবে নিজেকে? এই ডানাভাঙা পাখিটার কতখানি প্রাণশক্তি আছে কে জানে? ঠিক কতটা আকাশ উড়তে পারবে ও? ধেয়ে আসা উড়ো ঝড়ের মোকাবেলা করতে পারবে কী, নাকি পথভুলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে?
এসব ভাবলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে ওর। ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করে। লোকে বলে ‘কার্মা’। কৃতকর্মের ফলই নাকি ভোগ করতে হয় মানুষকে।
তবে অনির এই শাস্তি কেন? জীবন বোঝার আগেই জীবনের সব আনন্দ কেন ঝরে গেল মেয়েটার। এইটুকু জীবনে এই মেয়েটার অন্যায় কোথায়? কোন কর্মের জন্য শাস্তি হচ্ছে ওর?
জীবনে আরেকবার কোনোদিন ইমরানকে সামনে পেলে একটা খুন অবশ্যই করবে পরশ। সেটাই হবে ‘কার্মা!’
*****
‘মা একটু দোয়া করে মাথায় ফুঁ দিয়ে দাও না?’
‘যাহ যাহ সর? যাইতেছিস হারাম কাজে। বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা করতে, আবার দোয়া চাস?’
কালো হয়ে যায় অনির মুখটা। ‘আর ওইসব বেলেল্লা, বেহায়ারা যখন নাটক করে, সিনেমা করে তখন যে হুঁশ থাকে না, টিভির সামনে বসে বসে হাঁ করে গেলো, সেইটা দোষের না?’
‘যা, সামনে থেকে?’ অনিকে বকেই সুমনা কাঁদতে শুরু করেন, ‘চার আঙুল কপাল। সেই কপালে যা লেখা আছে তাই তো হবে। আমার কপাল আমি নিজে পোড়াইছি নাকি তোর কপাল সাধ করে পোড়াইছি যে এইভাবে তুই শাস্তি দিবি? কারো কোনো কথাই কানে নিবি না? আর তোরও বা দোষ কী দেবো, আগের হাল যেদিকে যাবে পরের হালও তো সেদিকেই যাবে!’
‘আগের হাল কি আমি?’ পরশ এগিয়ে এসে বলল ‘আজকের দিনেও মেয়েটাকে না বকলে পারতে, মা!’
‘সাধ করে আর বকিনি। ওকে বুঝানোর বদলে বগলদাবা করে ঘুরছ তুমি। ও ভুল করছে বলে সবাই ভুল করব?’
‘কোনটা ভুল মা? এই যে ও কোনো একটা কাজ করতে চাইছে। এটা? নাকি যেটা আমরা করেছিলাম সেটা? পনেরো বছর বয়সের একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলাম লোভে পড়ে, সেই ছেলের বিয়েতে মত আছে কীনা একবারও জিজ্ঞেস না করেই। আমাদের লোভটা ভুল ছিলো না?’
‘অনি কি আমার শত্রু, যে আমি ওর সর্বনাশ হবে জেনে ওকে বিয়ে দিয়েছিলাম? বারবার ওই এক কথা কেন বলো তোমরা?’
‘সেটাই তো বলছি মা। জেনেশুনে কেউ ভুল করে না, ভুল করছি জেনে কেউ ভুল করে না। ভুল হয়ে যায়। যেমন আমরা ভুল ছিলাম। হয়তো অনি ভুল না। ও যা করছে, সেটা যে ভুল না তা হয়তো একদিন বুঝতে পারব।’
‘আর যদি ভুল হয়, ভুল করে?’
‘ফিরে আসবে। কিন্তু আফসোস থাকবে না তো।’
‘এত জ্ঞানের কথা তোমারে বলতে বলিনাই। এখনো বাপের সম্পত্তির আয়ই খাও। এতটা লায়েক হওনাই যে কথায় কথায় মা, চাচা – সবাইকে জ্ঞান দিবা। মেয়েটার সর্বনাশ করতেছ তুমি। ও মরবে। এই নায়িকারা কী করে বেড়ায় তা তো দুনিয়া জানে। অনিকে আর সমাজে নেওয়া যাবে?’
‘ও তো এমনিতেই সমাজছাড়া। গ্রামে গিয়েছিলে তো, রটনা শোনোনি? ভালো ভালো ভাবো মা। দেখবে সব ভালো হবে।’
‘ভালো কিছু হবে না বাপ। আমি মা হয়ে বলতেছি, ভালো হবে না। মায়ের মন সব টের পায়। ভালো হবে না।’
চোখের পানি মুছে সুমনা সোজা হয়ে বসেন ‘আচ্ছা, বাপ। ছবি তোলার শখ করেছে ওর। তুলুক। আমার টাকা যা গেছে, যাক। তারপরে আর না। আর না বাপ। ওরে তুমি বুঝাও। সাইদা আপা ঠিক ঘরে তুলবে আবার ওকে। কিন্তু পচা পাঁকে পড়লে আর কেউ ওকে টেনে তুলবে না। ওরে বুঝাও।’
‘তুমি বোঝো মা। তুমি আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখছো।’
‘আমার আরেকটা মেয়ে আছে পরশ। অলিরে বিয়ে দিতে হবে না? সীমা, রিমার বিয়ে কীভাবে দেবে, অনি এমন বদনামির লাইনে গেলে? সব ভেসে যাবে বাপ!’
‘কার কী হবে সেটা তুমিও দেখোনি, আমিও দেখিনি। যেটা দেখিনি সেটা নিয়ে কথা বলাটা বাতুলতা। দোয়া করতে না পারো অভিশাপ দিও না। আর অন্য কারো জন্য অনিকে কোনো স্যাক্রিফাইস করতে দেবো না আমি। অনি, অনির মতো করে বাঁচবে, তাতে কেউ ডুবুক বা ভাসুক!’
‘অনি মরবে।’
‘মরুক। মা হয়ে বারবার মরতে বলছ, ওর মরাই উচিত। যে মরার কথা বলছ তুমি হয়তো সেটাই হবে ওর জীবনের পূর্ণতা! ভবিষ্যৎ কে দেখেছে মা?’
রাগ করে বললেও, মুখে সন্তানের মরণকামনার অপরাধবোধে বারবার জিভ কেটে তওবা পড়েন সুমনা! ‘আল্লাহ হেদায়েত করো’ নামাজের পাটিতে বসে দোয়ায় হাত ওঠে তার…
যখন এসেছিলে অন্ধকারে
১০
মায়ের দোয়ার জোর না থাকলেও বদদোয়ার জোর অবশ্যই উসাইন বোল্টের গতিতে দৌঁড়োয় আর হক আইয়ের মতো তড়িৎ গতিতে নির্ভুল লক্ষ্যভেদী হওয়ার ক্ষমতা রাখে, রাজন মানিকের অফিস কাম ফ্ল্যাটে বসে বসে অনির তাই মনে হচ্ছে এখন। দশটায় সময় দেওয়া ছিলো, অনি আর পরশ এসে গেছে ঠিকঠাক, কিন্তু না রাজন নিজে না তার টিমের কাউকে দেখা যাচ্ছে। যে কয়েকবার এসেছে অনি এখানে, তিনটে ছেলেকে দেখেছে বিভিন্ন ছবি আর ভিডিও ক্লিপ এডিটিংএ ব্যস্ত। তাদের কাউকেও দেখছে না।
কার্ডে দেওয়া মোবাইল নাম্বারে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছে পরশ, রিং পড়ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। কেটেও দিচ্ছে না। ওদেরকে দরজা খুলে দিয়েছে যে, ঘরের কাজ করে। সে সকালে আসে, সারাদিন কাজ করে বিকেলে চলে যায়। তার কাছে দরজার চাবি থাকে। সে ও কিছু জানে না।
‘ফুন দিতে থাকেন। আইবো না যাইবো কই?’
‘আপনি বলতে পারেন কোথায় গেছে?’
‘ফটুক তুলতে গেছে কই? কতরাইতেই তো আসে না। আমি যেমন রাইন্ধা রাইখা যাই, যেমন বিছানা পাইতা রাইখা যাই ঠিক তেমনি আইসা দেখি সকালে। গেছে, আইয়া পড়বো!’
‘কিন্তু ডেট তো আমাদেরকে দেওয়া আজকে। উনি অন্য কোথাও কীভাবে যাবেন?’ ফিসফিস করে অনিকে বলল পরশ।
‘মিডিয়াতে কাজ করা লোকেরা এমনই হয়, ভাইয়া। কাজে ডুবে গেলে খেয়াল থাকে না। হয়তো ওনার মনেই নেই আমরা অপেক্ষা করছি।’
‘এটা কেমন কথা? বুঝলাম না কিছুই! ওইটা কাজ, এটা কাজ না? নগদ টাকাগুলো গুণে দিলাম। এক টাকাও বাকিতে কাজ করবে না। আর ফোনটা তো ধর বাবা? এত ডিমান্ড কেন দেখায় এই লোক?’
‘লোকটার আসলেই অনেক ডিমান্ড, ভাইয়া। আমি এখানে এসেছি পোর্টফোলিও করাতে এটা শুনে আমার বান্ধবিরা তো হিংসায় মরে যাচ্ছে। আর রবিউল স্যারও বললেন, আমার এবার রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।’
‘রবিউল স্যার কে?’
‘ওই যে বিজ্ঞাপন করলাম না? এন্টিওয়েভের? ওটার ডিরেক্টর।’
‘তোর সাথে কন্টাক্ট আছে?’
‘থাকবে না? মিডিয়ায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। উপরে উঠতে গেলে এগুলোই তো ছোটো ছোটো সিঁড়ি!’ অনেক বড় বড় ভাব নিয়ে কথাগুলো বলছে অনি, যেন কত অভিজ্ঞতা! নিশ্চয় কারো বলা কথাগুলো শুনেছে, এখন চালিয়ে দিচ্ছে, মনে মনে হাসল পরশ।
অনি বলে চলেছে ‘রবিউল স্যার তো আমাকে এখনো ডাকে।’
‘কেন?’
‘ওনারা বিজ্ঞাপন বানাবেন, নাটক বানাবেন। আমাকে অভিনয় করতে ডাকে। কিন্তু আমি সেইসব করব না। লক্ষ্য বড় করতে হবে, রবিউল স্যারের কাজ তো টিভিতে আসবে না, লোকাল চ্যানেলেই থাকবে। ওখানে ক্যারিয়ার হবে না। কিন্তু তিনিই আমাকে প্রথম ব্রেক দিয়েছেন, আমার ক্যালিবার চিনিয়েছেন, তাই অকৃতজ্ঞ হওয়া চলবে না। ওনার সাথে তাই কন্টাক্ট রেখে যাচ্ছি!’ আবারও বিজ্ঞের মতো বলে অনি।
কত খোঁজখবর আর হিসেবনিকেশ করতে শিখে গেছে অনি। পরশের মজাই লাগে ছোটোবোনের মুখে পাকা পাকা কথা শুনতে।
বসে থাকতে থাকতে অনির কোমর ধরে গেছে। ও উঠে একটু পায়চারি করতে লাগল স্টুডিওর ভেতর। লম্বা রুমটা। বাইরে থেকে ঢুকে ছোটো অফিস। তারপরই আরেকটা স্লাইডডোর পার হয়ে স্টুডিও। রাজন মানিকের সলো ফটোগ্রাফ একটা। একপাশে আলো ফেলা হয়েছে। মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে, অন্যপাশে আঁধার। রহস্যময় দেখাচ্ছে। চোখে দ্যুতি, ওয়াটারি আইজ। তারপর একে একে দেশের বেস্ট মডেল আর শোবিজ তারকাদের বেস্ট স্ন্যাপ একেকটা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। পারফেক্ট সব শট। এই তারকাদের হয়তো সামনাসামনি দেখতে এত ভালো না, যতটা এই ফ্রেমগুলোতে দেখা যাচ্ছে। একটা দেয়াল ভরা রাজন মানিকের সেরা সব ফটোগ্রাফি ফ্রেম!
এককোণে ফটোশেডিং আমব্রেলা, ক্যামেরা স্ট্যান্ড, লাইট গাদা করে রাখা। আটটা কম্পিউটারটেবিলে পিসি, মনিটর, প্রিন্টার, একগাদা তারের জঞ্জাল। একপাশে একটা পাটি আর তোশক গুটিয়ে রাখা। কেউ মনে হয় ঘুমিয়েছিল রাতে এখানে। আগে কখনো এটা দেখেনি অনি। সবসময় ফিটফাট অফিসলুকে দেখেছে। ট্রায়াল ফটোশুটের দিন কিছু প্রপস আর ব্যাকড্রপ দেখেছিল।
এপাশে একটা বড় কাঠের দরজা। ডাবল ডোর। ওপাশটা সম্ভবত বাসার কাজে ব্যবহার হয়। বুয়া ওদিকেই কাজ করছে। একবার শুধু এসে চা দিয়ে গেছে। অনি দরজার কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিলো।
‘এই অনি? কী করছিস? আয় এদিকে?’ পরশ জানে অনি চঞ্চল খুব। ওর পায়ের নিচে সর্ষেদানা ছড়ানো থাকে সবসময়। এক মিনিট স্থীর হয়ে বসে থাকা ওর ওর জন্য দুঃসাধ্য। এটা ধরছে, তো ওটা নাড়ছে, এই এখানে তো এক মূহুর্তে হাওয়া। এখানে এভাবে বসে থাকাটা ওর জন্য কষ্টকর। কিন্তু অচেনা, অনাত্মীয় মানুষের ঘরে উঁকি দেওয়াটাও তো ঠিক না।
‘ভাইয়া, দেখে আসি না, ভেতরে কেউ আছে কীনা!’
‘না। তুই এদিকে আস। এখানে বস চুপ করে। আর আধাঘন্টা দেখি। তারপর না আসলে আমরা চলে যাব।’
‘চলে যাব কেন?’ অনি আঁতকে ওঠে।
‘যাব না? এখানে থেকে যাব?’
‘না। তা না। আমরা টাকা দিয়েছি তো!’
‘কী জানি। টাকাটা মার গেল কীনা বুঝতে পারছি না। আজ যাই। কাল এসে আবার খবর নিয়ে যাব।’
‘না। আমি দেখে আসি কেউ আছে কীনা ভেতরে।’
‘কাজের মহিলাটা আছে সে তো দেখলিই!’
‘না, আর কেউ যদি থাকে, কিছু যদি জানা যায়!’
‘এত অধৈর্য কেন হচ্ছিস? আয়, বস এখানে।’
একটু ইতস্তত করল অনি তারপর সোজা চলে গেল ভেতরে। ‘এই মেয়েটা কোনোদিন কারো কোনো কথা শোনেনি। নিজের মনে যা আছে সেটা ও করবেই ‘ ভুরু কুঁচকে বসে থাকল পরশ।
লম্বা একটা করিডোর। বাইরের আলো পুরোপুরি উজ্জ্বল করতে পারেনি। এই দেয়ালটা ভর্তি একটা মেয়ের ফ্রেম। কোনো নান্দনিকতা নেই, নেই কোনো আর্টিফিশিয়াল লাইট, ডেকোরেশন নেই, পুরোনোদিনের ক্যামেরায় তোলা সাধারণ সব ফ্রেম। সব ফ্রেমেই মেয়েটা হাসছে, একগালে টোল ফেলে মেয়েটা হাসছে, তার সাথে তার চোখও হাসছে!
অনি আরেকটু ভেতরে উঁকি দিলো। কাজের মহিলাটি এগিয়ে এলো ‘কিছু লাগব আপা? কিছু কইবেন?’
‘না। আর কেউ নাই বাসায়? ছবির এই মেয়েটা কে?’
‘হইবো কোনো মঠেল।’
‘মডেল? এই বাসার কেউ না?’
‘না তারে দেখিনাই কোনোদিন। এইবাসায় মেয়েলোক কেউ থাকে না। মেয়েরা যারা আসে, ওইপাশ দিয়ে ফটু তুলে যায়গা। সব বেটাছেলে থাকে। আসে, যাই, রাইতে থাকে। আউল বাউল খায়, এত্তগুলা বাসন বানায় রাখে। দুনিয়ার আউলা ঝাউলা করে রাখে ঘরবিছানা। যেইখানে খায় সেইখানেই কাচরা ফালায় থোয়।’
‘ও। আচ্ছা। আমি বাইরে গিয়েই বসি।’
অনি ফিরে আসতে আসতেই একজন এলো। ট্রায়ালের সময় যাদের সাথে কাজ হয়েছে তারা কেউ না। পোস্টপ্রডাকশন বলে যে কাজগুলো হয়, সেই কাজগুলো করে এই ছেলেটি। ফটো এডিটিং, পডকাস্ট তৈরি এইসব। কম্পিউটারের সামনেই দেখেছে ছেলেটিকে আগে। পরিচয় হয়নি। ছেলেটি পরশকে বলল ‘আপনারা?’
‘আজকে আমাদের ডেট ছিলো।’
‘রাজন স্যারের?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ! স্যারের তো একটা একসিডেন্ট হয়েছে।’
‘কী বলছেন? কীভাবে? কখন?’
‘গতকাল রাতে, বাসায় ফেরার পথে হাইওয়েতে গাড়িটা ব্রেকফেল করে। সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’
‘এখন কী অবস্থা!’
‘অবস্থা বেশি একটা খারাপ না। পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে, শরীরে কয়েক জায়গায় জখম আছে।’
‘আর কেউ ছিলো সাথে? মানে অন্যদের কী অবস্থা?’
‘ড্রাইভার ছিলো। টিমের আরও চারজন ছিলো। সবাই টুকটাক আহত হয়েছে।’
‘ওহ। রিলিজ দেবে কবে?’
‘আজই দেবে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। কিন্তু আপনাদের কেউ জানায়নি? আজকের স্কেজিউল পোস্টপন্ড হয়েছে এটা কেউ বলেনি আপনাদের। কল করে ইনফর্ম করার কথা তো!’
‘না, জানায়নি তো! আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি।’
‘এমনটা তো হওয়ার কথা না। একটা মেসেজ হলেও তো রাখার কথা। দেখুন তো?’
পরশ নিজের মোবাইল বের করে চেক করতে থাকলে অনির মনে পড়ে গেল, ফরমে ও নিজের ফোন নম্বর দিয়েছিল। মোবাইল তো বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রাখা। ও তাড়াতাড়ি মোবাইল চালু করে দেখল, মেসেজ এসেছে। পরশকেও দেখালো।
‘তাহলে আমরা আর বসে থাকি কেন? রাজন সাহেব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। আমাদের জানিয়ে দিলে, আমরা আসব আবার।’
অনি উঠল না দেখে পরশ আবার তাড়া দিলো, ‘চল? অনি? এখানে তো আর কাজ নেই।’
অনি মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল ‘না ভাইয়া, আমি থাকি?’
‘থাকবি মানে? কী করবি? অসুস্থ মানুষ এসে কি শ্যুট করতে পারবে আজকে?’
‘না, তা না।’
‘তবে কী?’
অনি খানিকক্ষণ নাক ঘষে। তারপর ইতস্তত করে বলে ‘বাসায় কোনো মহিলা মানুষ নেই। দেখাশুনা করার কেউ নেই।’
পরশের হঠাৎ কথা আসে না মুখে। ও হতবাক গলায় বলে ‘তুই নিশ্চয় এটা বলছিস না যে, এখন তুই ওনার শুশ্রূষা করবি?’
অনি কথা বলে না। মাথা নিচু করে রাখে।
‘কোনো দরকার নেই। না উনি আমাদের আত্মীয়, না পরিচিত কেউ। আর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে মানে তেমন গুরুতর কিছুও না। আর সেরকম হলে চব্বিশঘণ্টা নার্সের ব্যবস্থাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা যাদের ব্যাপার, তারা বুঝবে। উপযাচক হয়ে কিছু করার দরকার নেই।’
‘না ভাইয়া। আমরা উপস্থিত আছি। এখন এভাবে চলে যাওয়া যাবে না।’
পরশ বুঝে উঠতে পারে না অনিকে। ওর চেনা অনি আমূল পালটে গেছে আর প্রতিদিন একটু একটু করে ও সেটা জানতে পারছে।
অনিকে আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে ও বলল ‘আমাদের কাছ থেকে উনি টাকা নিয়েছেন অনি। এটা ওনার কাজ। সুস্থ হলে ঠিক করে দেবে। ভালো করেই করবে। একদম ভাবিস না।’
‘না, মানে, ম্যাগাজিন কাভারে ফটো আসার একটা ব্যাপার আছে। কোনোভাবে ওনাকে খুশি করা গেলে…’ থেমে থেমে বলে অনি।
পরশ রেগে যায় ‘আমি বুঝতে পারছি না অনি, তুই এমন তোষামোদি হয়ে উঠলি কবে থেকে? খুশি করে কাজ উদ্ধার করাটা তোকে কে শেখালো?’
‘অত কথা জানি না ভাইয়া, আমার উপরে ওঠা লাগবে, সেটা যেভাবেই হোক না কেন….’
চলবে…
Afsana Asha