যখন এসেছিলে অন্ধকারে
১৯।।

অনি এসেছে রাজন মানিকের স্টুডিও কাম বাসায়। এখানে অনির আসা নিষেধ। রাজন নিষেধ করে দিয়েছেন। অনি যেদিন তাকে ঘিরে অনির অনুভূতি জানিয়েছে সেদিন থেকেই নিষেধ।

সন্ধ্যের মুখে অনিকে দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। স্টুডিওতে শ্যুট চলছে। একজন বেশ নামি নায়িকার এক্সক্লুসিভ ফটোশ্যুট হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে বেশ কয়েকজন বিনোদন সাংবাদিকেরও উপস্থিতি আছে। এসময় অনি আসবে, ব্যক্তিগত আলোচনার জন্য স্টুডিওর সীমা পেরিয়ে ওকে নিয়ে পার্সোনাল এরেনায় চলে যাবেন তিনি, তারপর এসব নিয়ে মিডিয়াপাড়ায় রসালো আলোচনা হবে, এসব ভেবেই বিরক্ত হচ্ছেন রাজন।

অনি চুপ করে বসে কাজ দেখতে থাকল। ওর শান্ত হয়ে বসাটা রাজনকে ভাবালো। স্বাভাবিক অবস্থায় অনির হাত পা চলতে থাকে। এটা ধরে, সেটা নাড়ে। একেবারে কিছু না হলেও হাতের আঙুল মটকাবে নইলে পা নাচাবে। চুপচাপ থাকলেও অনির চোখেমুখে অস্থিরতা। চলমান কাজ এসিস্ট্যান্টকে ট্রান্সফার করে অনিকে ভেতরে ডাকলেন রাজন। ধীর পায়ে হেঁটে এসে অনি স্টুডিও পার হয়ে বাসার স্পেসে ঢুকে গেল। রাজন কফিমেকারে নিজের জন্য কফি করতে করতে অনিকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কী অবস্থা, অনি? কফি চলবে?’

অনি নাবোধক মাথা নাড়ল।

গরম কফির কাপ হাতে রাজন অনির পাশে বসতে বসতে বললেন ‘কী সমস্যা? এখানে আসতে আমি মানা করেছি না?’

‘প্লিজ! আজ না।’ অনি কেঁদে ফেলল।

রাজন বুঝলেন কোনো গুরুতর সমস্যা হয়েছে। অনি অকারণে কান্নাকাটি করাটাইপ মেয়ে না। ফ্রিজ থেকে দুটো বরফের টুকরো নিয়ে একগ্লাস পানিতে ছেড়ে দিয়ে অনির হাতে দিলেন। অনি এক নিঃশ্বাসে পানিটা শেষ করে বলল ‘আপনি কাজ শেষ করে আসুন। আমাকে তাড়া দেবেন না। তাড়াতাড়ি বলা সম্ভব না। আমি অপেক্ষা করছি।’

‘বাকিটা ওরা করে নিতে পারবে। তুমি বলো।’

‘ইমরান এসেছে।’

‘ইমরান মানে তোমার এক্সহাজবেন্ড, তাই তো? সে দেশে ফিরেছে সেটা তো আগেই শুনেছি। নতুন করে কী হলো?’

”উনি এক্স থেকে প্রেজেন্ট হয়ে গেছেন এখন।’

‘মানে? বুঝিনি, বুঝিয়ে বলো।’

‘উনি বলছেন, আমাদের তালাক টালাক কিছু হয়নি। যে কাগজে তালাকের জন্য সইটই নিয়েছিলেন সেটা নাকি ফেরত নিয়ে নিয়েছিলেন। তালাক হয়নি।’

‘বাহ! ঝামেলার ব্যাপার তো! তোমরা ডিভোর্স সার্টিফিকেট তোলোনি?’

‘না, কখনো প্রয়োজন হয়নি তো!’

‘কী বলো! আচ্ছা, বেশ। তো এখন কী বলতে চান ভদ্রলোক?’

‘আমি জানি না।’ অনি আবার কেঁদে ফেলল।

‘অনি শান্ত হও। না কেঁদে বলো সবটা। আর আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি সেটাও বলবে। তুমি জানো, পেশাগত কোনো দূর্নীতির আশ্রয় না নিতে হলে, আমার সবরকম শক্তি দিয়েই আমি তোমার পাশে আছি সবসময়।’ অনির হাত চেপে ধরে আশ্বাস দিলেন রাজন মানিক।

অনি ফ্লোরের উপর বসে পড়ে, বিছানার উপরে মুখ ঠেকালো। উদাস হয়ে বলল ‘ওরা এখন আমার মায়ের বাসায়।’

‘ওরা কারা?’

‘ইমরান, তার বাবা, মা, আরও কারা কারা আমি জানি না।’

‘আচ্ছা, বুঝলাম সেটাও। কিন্তু কেন? কী চান তারা?’

‘যে বিয়েটা ভাঙেনি, সেটা আবার জোড়া দিতে চান।’

‘হুম’ চিন্তায় পড়ে গেলেন রাজন মানিক। দুমিনিট চুপ থেকে অনিকে বললেন ‘তুমি কী চাও?’

অনি দুইচোখ মেলে তাকালো রাজনের চোখের দিকে। সরাসরি। তারপর বলল ‘এই কথাটা আপনি জানতে চাইছেন? আপনি জানেন না, আমি কী চাই? কাকে চাই? আমি তো স্পষ্ট করেই বলেছি। বারবার বলেছি।’

‘সেটা নিয়ে আমিও তো কোনো অস্পষ্টতা রাখিনি অনি।’

‘কী বলতে চান? আমাকে কোনোভাবেই ভালোবাসবেন না আপনি? কোনোদিন ভালোবাসবেন না?’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছ, সেভাবে হয়তো নয়। আমার ভালোবাসা প্রেম না, এটার নাম স্নেহ। সুন্দরতম ভালোবাসা। স্নেহ নিম্নগামী হয় সর্বদা। বয়সে অনেক ছোটো তুমি। আমি একা মানুষ, নিঃসঙ্গ। তোমার সঙ্গ আমাকে আনন্দিত করেছে, পূর্ণতা দিয়েছে। এই ভালোবাসাটা শুধু স্নেহ, শুভেচ্ছা৷ তোমার ভালো চাই আমি সর্বান্তকরণে, এই অনুভূতিটুকুই আছে শুধু তোমার জন্য। আর কিছু নেই। এখন তোমার জীবনের এই জটিল হিসাব মেলাতে গেলে আমার অংশটুকু তোমাকে বাদ দিয়েই এগোতে হবে। আমাকে ভেবে ইমরান সাহেবকে ফিরিয়ে দিলে, এমনটা না হয় যে পরে তুমি অনুতাপ করছ!’

‘অনুতাপ কেন করব?’

‘অনুতাপ কেন করবে? ভালো প্রশ্ন। আমি সবসময়ই ফিল করেছি, যখন তুমি ইমরান সাহেবের কথা বলতে, তোমার পাস্ট নিয়ে বলতে, আমার মনে হতো তুমি তাকে ভালোবেসেছ। আর সেই ভালোবাসাটা তোমাকে ছেড়ে যায়নি কখনো। আসলে কী হয় ব্যাপারটা, জানো অনি? ভালোবাসার মানুষগুলো আমাদের পরিত্যাগ করে, মানুষগুলোই শুধু আমাদের ছেড়ে যায়। মাঝখানে যে ভালোবাসাটুকুন থাকে সেই ভালোবাসা কিন্তু ঠিকই অবিকৃত হয়ে রয়ে যায়। আমরা ভালোবাসাগুলোকে ছাড়তে পারি না। কখনোই পারি না।’ হেঁটে গিয়ে করিডোরের ফ্রেমগুলোতে আঁটা ছবিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজন মানিক।

অনি এসে তার পেছনে দাঁড়ালো ‘এটা মিথ্যে। আপনি জানেন আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি।’

‘সেটারও ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে।’

‘ব্যাখ্যা আছে?’

‘হ্যাঁ। বলি শোনো। ইমরান সাহেব তোমাকে ছেড়ে গেলে তোমার মনে একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়। তুমি তো সাকসেস পাওয়ার জন্য, ফেম পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলে। পেয়েছও কিছুটা। নিজের নাম হলো, পরিচয় হলো। ইনকাম করতে পারছ। কারো উপর ডিপেন্ডেড নও এখন। মনের খালি জায়গাটা কিন্তু অপূর্ণই থেকে গেল। তখন তুমি আমাকে পেলে। এমন একজন যে তোমাকে চাইছে না। ইমরান সাহেবের মতো। ইমরান তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু রাজন মানিক নাগালে। তো তুমি আমাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে। আমি ইমরান সাহেবের সাবস্টিটিউটের রোল প্লে করলাম তোমার জীবনে।’

‘ব্যস?’

‘না। শুধু এটাই আমার প্রতি তোমাকে দুর্বল করেনি। তোমার জীবনে আমি এসেছিলাম খুব অন্ধকার একটা সময়ে। তোমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টাতে। ইমরান সাহেব ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, চারিদিকে নিন্দামন্দ শুনছ, মডেলিংয়ে আসলে কিন্তু কাজ পাচ্ছিলে না, সেজানের অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ ব্যবহার আর তোমার পরিবার তোমাকে মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সেই অন্ধকার রাতে আমি তোমার আশ্রয় হয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে দেবতাজ্ঞানে তুমি অর্চনা শুরু করলে। এটা প্রেম না অনি, শ্রদ্ধা।’

‘এটা ভুল। মিথ্যে কথা।’

‘হতেও পারে ভুল। আমি হিউমেন সাইকোলজি পড়িনি কোনোদিন। আমার কাজ মানুষের সুন্দর চোখমুখের অভিব্যক্তি নিয়ে। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে চোখটা পড়ে ফেলি। ভুল পড়ি কী না জানি না।’

‘আমি কী করব এখন?’

‘এই যে দেখো, তুমি দ্বিধায় ভুগছ। আমার কাছে জানতে চাইছ কী করবে। এটাই বলে দেয় তুমি দোলাচলে আছ। চেতনার চাইতেও অবচেতন কখনো কখনো বেশি শক্তিধর হয়ে যায়। তুমি কী করবে সেই সিদ্ধান্ত হয়তো তোমার অবচেতন অনেক আগেই নিয়ে রেখেছে। তুমি সেটা স্বীকার করতে চাইছ না।’

‘আমার চেতনা বা অবচেতন যেটাই বলেন না কেন সবজায়গা জুড়ে আপনার বসবাস।’

‘হবে হয়তো। হয়তো না। নিজেকে স্থির করো। পুরোনো সব ভুলে আজকের অনি হয়ে সিদ্ধান্ত নাও। দ্বিধা দূর করো। দ্বিধার জায়গাটাই কিন্তু নেই। দুটো অপশন নেই কিন্তু তোমার কাছে। রাজন না কী ইমরান এমন না কিন্তু ব্যাপারটা। মোটেও তা না। ইমরান অথবা ইমরান না!’

‘এটা তো অনেক আগে থেকেই আমি জানি।’

‘হ্যাঁ। তবে তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিলো। এখন অন্যরকম এসে দাঁড়িয়েছে। ঘৃণা, রাগ, অপমান, কষ্টগুলোকে একপাশে রেখে ভাবো। ভেবে সিদ্ধান্ত নাও।’

‘রাগ বা কষ্টগুলো কি মূল্যহীন অনুভূতি?’

‘না, তা নয়। কিন্তু এরা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। একশোটা কারণ আছে, ইমরান সাহেবকে জীবন থেকে বাদ দিতে, কিন্তু এমন একটা কারণও তো থাকতে পারে, যেটার জন্য ভবিষ্যতে কোনোএকদিন মনে হতে পারে যে তাকে একটা সুযোগ দিলে সে একজন চমৎকার জীবনসঙ্গী হতে পারত!’

‘একটা কারণ কি একশোটা কারণের চাইতে পাল্লায় ওজনদার হতে পারে?’

‘হ্যাঁ, পারে। মনে করো, বছর দশেক পরে এই একটা কারণের জন্য তোমার অনুতাপ হলো, তুমি ভাবলে ইমরানকে বেছে না নেওয়াটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই একটা কারণই তখন অনেক বেশি ওজনদার মনে হতে পারে। তাই এখন তুমি খুঁজে বের করবে এমন একটা কোনো ভালো ব্যাপার তার ভেতর আছে কীনা, যার জন্য তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায়। যদি পাও, তবে তুমি তোমার মতো করে সিদ্ধান্ত নিও।’

অনিকে কনভিন্সড দেখালো। রাজন মানিক আবার বললেন ‘তবে ভাবতে হবে সবদিক বন্ধ করে। সব অপশন বাদ দিয়ে। একটাই ভাবনা, ইমরান অথবা ইমরান নয়। ওকে?’

অনি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।

*****

‘তো, ইমরান সাহেব, মনে করুন এইসব কিছু হয়নি। অনি পাগলের মতো নিজেকে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেনি। গেঁয়ো, অযোগ্য তকমা মুছে ফেলার জন্য রাতারাতি নামি কেউ হয়ে, ও যে এলেবেলে কোনো মেয়ে না এটা কোনো একজনকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ন্যায়, অন্যায় দেখেনি। কীভাবে, শুধু কীভাবে সাফল্য পাবে সেটাই করেনি রাতদিন ধরে। ভেবে নিন এসব কিছু হয়নি। পনেরো বছর বয়সের একটা মেয়ে, বিয়ের পরদিন যে জানল মাত্র বিয়ে হয়েছে যার সাথে সে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। কী কারণ? সেই মেয়েটা, স্বামী ব্যক্তিটির বিরাট যোগ্যতার সাথে ম্যাচ হয় না বলে। এখন মেয়েটার কী করা উচিত? বলেন?’

‘কিন্তু ডিভোর্সটাতো হয়নি।’

‘আহ, বয়সে কত বড় আপনি অথচ নিতান্তই বালকসুলভ কথা বললেন। সেটা তো আপনার ভার্সন এবং নতুন। আচ্ছা বাদ দেন, মেয়েটির দিক থেকেই আবার ভাবি। তালাক পাওয়া মেয়েটি এবার অপমানে, কষ্টে এতটুকু হয়ে গেছে। সারাদিন, সারারাত সে কাঁদে। তো টিপিক্যাল অভিভাবক হয়ে আমরা কী করতে পারি? না, এমন হয়নি, তবে আমরা ধরে নিই এমন হয়েছে। আমরা আবার অনিকে বিয়ে দিয়েছি। ডিভোর্সি মেয়ের খুব ভালো বিয়ে এই সমাজে হয় না। দায়সারা, খুব সাধারণ একটা ছেলের সাথেই বিয়ে দিলাম। ধরি সেই ছেলেটার আগে বিয়ে আছে। বউ ছেড়ে গেছে বা মরে গেছে। একটা দুটো ছেলেমেয়েও আছে। যাই হোক, ধরে নিই, এমন একজনের সাথে অনির আবার বিয়ে দিয়েছি আমরা। শুরুতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। একসময় দুজনের ভেতর ভালোবাসা হয়ে গেছে। কতদিন? ধরেন, বছরখানেক সময় দিলাম ওদের প্রেম হতে। লম্বা সময় মনে হচ্ছে? অসুবিধা নেই, আমাদের হাতে পাঁচবছর আছে। একবছর দিলাম ওদের দাম্পত্য তৈরি হতে, রইল বাকি চার। এই চারবছরে অনির একটা বা দুটো বাচ্চা থাকার কথা। অসম্ভব তো না, কী বলেন ভাই? তো এখন আপনি এসেছেন, এটা বলতে যে অনি আপনার বউ! এখন আমাকে বলেন দুইবাচ্চার মা যে, সে কীভাবে আপনার বউ হয়? অনেক গালাগাল, অভিশাপ খেয়ে আমার বোনটা নিজের মতো একটা রাস্তায় হেঁটেছে বলে আজ ওকে আপনি বউ বলতে এসেছেন৷ সত্যি যদি ও, খুব সাধারণ মেয়ে হয়ে থাকত, দুটো বাচ্চার মাকে এখন আপনি নিতে আসতেন? বউ বলে দাবি করতে আসতেন? আপনার নিজের কানেই কি হাস্যকর, অবান্তর শোনাচ্ছে না?’

‘আমার দিকটাও একটু শুনতে হবে, প্লিজ!’ ইমরান চোখ বন্ধ করে বলল।

পরশ হাসল। হাসিমুখেই বলল ‘আচ্ছা বেশ, শুনি আপনার কথা।’

‘আমি জানি আমার ভুল হয়েছে। আমার জায়গায় এসে একবার ভাবুন। বিয়েটা একরকম জোর করেই হয় আমার। আমার অন্যায় হয়েছে, আমি স্বীকার করছি অনেক বড় অন্যায় হয়েছে আমার। কিন্তু নিজেকে আমার জায়গাটাতে দাড় করান একবার। আপনার মতো করেই বলি, ধরেন আপনি বিয়েই করতে চাইছেন না। আপনি জানেন, বিয়ে করলেই আপনার ক্যারিয়ার শেষ, স্বপ্ন শেষ, জীবন শেষ। আপনাকে জোর করে বিয়ে করানো হলো। আপনি হলে কী করতেন? আমি জানি না, অন্য কেউ হলে কী করত, কিন্তু আমার সব রাগ অনির উপর গিয়ে পড়েছিল। ওকে অসহ্য লাগছিল, শুধু ওর খুঁত ধরা পড়ছিল চোখে। ওইসময়ে ডিভোর্সটা ছাড়া আর কোনো পথ পাচ্ছিলাম না।’

আগেরদিন মার খেয়ে ফুলে থাকা ঠোঁটদুটো টিপে ধরে জোরে মাথা নাড়ল ইমরান। ‘সবাইকে আমার শত্রু মনে হচ্ছিল তখন। আমার বাবা, মা, অনি সবাইকে শত্রু ভাবছিলাম। কীভাবে পালানো যায় এদের থেকে সেটাই ছিলো শুধু মাথায়। আর পালানোর আগে অনিকে মুক্তি দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, যেন আমার প্রতীক্ষায় না থাকে।’

‘এটা আপনার আর আপনার পরিবারের ভেতরকার সমস্যা।’

‘আমাকে শেষ করতে দিন, প্লিজ।’

‘আচ্ছা, শেষই করেন আপনি।’

পরশের কথার খোঁচাটা আমলে নিলো না ইমরান। বলতে থাকল ‘আমি রাগে, ক্ষোভে অনিকে ডিভোর্সপেপারে সই তো করালাম কিন্তু তারপরেই আমার মনে হতে থাকল অনি একটা চমৎকার মেয়ে। ওর সাথে জীবনের পথচলা সুন্দর হবে। আমি পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ডিভোর্সনোটিশটা ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। আর তারপর আবার আমার মনে হতে থাকল অনি আমার সাফল্যের পথের অন্তরায়। ও আমাকে একটু একটু করে আটকে ফেলছে। আমার লাইফগোল থেকে আমাকে সরিয়ে ওর দিকে টেনে নিচ্ছে।’

‘বাহ, আপনার তো খুব দ্রুতবেগে মুডচেঞ্জ হয়!’

পরশের কটাক্ষ গায়ে মাখল না ইমরান। মাথাটা নিজের কাঁধে হেলান দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল ‘আমি অনিকে বললাম না আমাদের তালাক হয়নি। তাহলে স্ত্রী হিসেবে ও নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইত। আমিও স্বামিত্বের বৈধ দাবি নিয়ে ওকে নিজের সাথে আটকে ফেলতাম। আমরা হয়তো খুব কাছাকাছি এসে যেতাম। আমাকে বেঁধে ফেলছিল ও। আর একবার ও জেনে ফেললে, আমাকে আরও বেশি জাপটে ধরত। আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারতাম না। এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। তাই ভেবেছিলাম, জাপান গিয়েই বলব। সবাই যখন আমার কাছে জবাব চাইবে, তখন সত্যিটা বলে দেবো।’

‘বললেন না কেন?’ নড়েচড়ে বসল পরশ। একেবারে আসল জায়গায় এসে গেছে আলোচনা। ঘরে সবার মুখ সিরিয়াস। ইমরানের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।

‘জাপান যাওয়ার পর কেউ আমাকে কিছু বলল না। না আমার মা, না আপনাদের বাড়ি থেকে কেউ। আমি ভাবলাম, অনি কাউকে কিছু বলেনি। ডিভোর্সের কথাটা কেউ জানে না। অনি যেখানেই আছে, আমার স্ত্রী পরিচয়টা সাথে আছে।’

সবাই চুড়ান্ত হতাশ হলো ইমরানের উত্তরে। যুক্তিসঙ্গত উত্তর আশা করেছিল সবাই।

‘তুই এটা কীভাবে ভাবলি? তোর কেন মনে হলো, অনি আমাদের কাউকে কিছু বলেনি?’ সাইদা এবার রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলেন। ছেলের বোকামি আর হজম হচ্ছে না তার।

ইমরান মুখ নামিয়ে আস্তে উত্তর করল ‘আমি ভেবেছিলাম, অনি বাচ্চামেয়ে। ও তালাকের কিছু বোঝেনি। বোঝেনি তাই কাউকে কিছু বলেনি।’

পরশ শব্দ করে হেসে ফেলল। ‘পাঁচ বছর ইমরান সাহেব। পাঁচ বছরে ওই বাচ্চা মেয়েটার বাচ্চার মা হয়ে যাওয়ার কথা। আপনার এটা একবারও মনে হয়নি?’

‘সত্যি বলতে কী, এসব সম্ভাবনা আমার মনেই আসেনি। অনি আছে, আমার আছে, এটা ভেবেই নিশ্চিন্ত হয়ে আমি পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম।’

‘মাশাআল্লাহ আপনার ভালোবাসা! এত ভালোবাসা নিয়ে একবারও অনির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। ওকে দেখতে ইচ্ছে করেনি?’

‘করেছে। কিন্তু পড়ায় ক্ষতি হবে ভেবে আমি জোর করে সেসব মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।’

পরশ নিজের উরুতে দুটো চাপর মারল। তারপর হাত দিয়ে কপালটা চেপে ধরে বলল ‘ মার্কেটিং এ যারা জব করে ধরে নেওয়া হয় তারা খুবই স্মার্ট। খুব চতুর না হলে এই প্রফেশনে শাইন করা যায় না। আমার এক পরিচিত লোক আছেন। একটা ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং এ। উনি বলেন, মানুষ চরায়ে ভাত খাই আমরা। মানে মার্কেটিং পেশার লোকেরা। আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সেই মাছিমারা কেরানির মতো মাছিমারা ছাত্র আপনি। শুধু বই মুখস্থ করেছেন, পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে ভালো রেজাল্ট এসেছে, কিন্তু আসলে শেখেননি কিছুই।
মার্কেটিংএর ছেলেদের চিন্তাভাবনা এতটা গর্দভটাইপ হতে পারে এই কথাটা খুব মার্কেটিং করেও আপনি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না।’

সাইদা চোখ কটমট করে ইমরানের দিকে তাকালেন।
আব্দুল মজিদ সাহেব তাড়াতাড়ি করে পরশকে বললেন ‘বাবা তুমি বয়সে অনেক ছোটো। ভুলগুলো আমাদের দিক থেকেই হয়েছে, আমরা নাক-কান মলে স্বীকার করছি। এখন এই পাগলদুটোকে মিলিয়ে দাও। আর যাই হোক, আল্লাহর কালাম স্বাক্ষী করে করা বিয়েটা তো বলবৎ আছে।’ করজোড় করলেন ভদ্রলোক।

পরশ খুব শ্রদ্ধা করে এই লোকটাকে। তাড়াতাড়ি করে বলল ‘প্লিজ সোনমিয়া এভাবে বলবেন না। আমিই বরং মাফ চাইব। ইমরান সাহেবের সাথে গতকালের আচরণটা ঠিক ছিলো না আমার। কিন্তু আমার জায়গায় অন্য যেকেউ থাকলে একই কাজ করত সম্ভবত।’

পরিস্থিতি তরল হয়ে এলো। ইমা আরেকটু সহজ করতে, পরশকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘তো, বেয়াইমশাই, আমরা বিয়ে খাচ্ছি কবে? তোমার দুইবোনের ননাস আমি। আমাকে কিন্তু ডিজাইনার লেহেঙ্গা দিতে হবে।’

পরশ সোজা হয়ে বসল। খুব সহজে অনির এতদিনের কষ্ট ভুলে যাওয়ার বান্দা সে নয়। সহজ করেই বলল ‘একটা বড় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কথা তো আমি বলিই নি।’

‘কী?’ ইমরান ভয়েভয়ে জানতে চাইল।

‘আমার বোনটা, মডেলিংয়ে কেন নেমেছে, কেন নাটক, সিনেমা করতে চায়, এসব নিয়ে প্রচুর কটুকথা শুনেছে। আমার মা ওকে দুপুররাতে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। ও খারাপ হয়ে গেছে, ও নষ্ট হয়ে গেছে, বহুগামী হয়েছে এইটাইপ খুব নোংরা নোংরা কথা শুনতে হয়েছে ওকে। সবাই পরিত্যাগ করেছে অনিকে। গালাগাল দিয়েছে। বাজে মেয়ের তকমা দিয়ে দিয়েছে। কেননা মেয়েটা প্রচলিত পথে হাঁটেনি। আর দশটা মেয়ের মতো ঘরের কোণায় লুকিয়ে কাঁদেনি। তালাকের অপমানে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়নি। কিন্তু ও যদি খুব সাধারণ মেয়ের মতো হতো, ওর জন্য যা স্বাভাবিক সেটাই করত তবে সিনারিওটা কেমন হতো জানতে চান?’

সবার দিকে একবার তাকায় পরশ। তারপর বলে ‘হয়তো গলায় দড়ি দিতো মেয়েটা নইলে আগুনে ঝাঁপ দিতো!’

সবার আতঙ্কিত চোখের দিকে তাকিয়ে পরশ বলল ‘ইমরান সাহেব, আপনার একেকটা ডিগ্রি অর্জনের পথ থেকে তো মেয়েটা সরে গেল, মরে গেল। এখন বলেন মরে যাওয়াটা যদি সত্যি হতো, তবে আপনার এই পাঁচ বছর পরের বিশেষ অনুধাবনের কারণে আমি মরা অনিকে কোথা থেকে এনে আপনার সাথে বিয়ের জাঁকজমক করতাম?’ ইমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘আর তোমাকে লেহেঙ্গা কিনে দেওয়ার উপলক্ষ কীভাবে আসত ইমা আপু?’

নিরুত্তর ইমরানের দিকে তাকিয়ে পরশ আবার বলল ‘আমার বোনটা নিজের একটা জগৎ তৈরি করেছে ইমরান ভাই। তাকে তার মতো থাকতে দেন প্লিজ। আপনার নতুন উপলব্ধির ভালোবাসায় তাকে অতিষ্ঠ করে দিয়েন না। মনে করেন, অনি মরে গেছে। আসলেই তো সেই অনি, অনন্যা যে, সে মরে গেছে। নিজের চেষ্টায়, ও অনামিকার জন্ম দিয়েছে। সেদিনের অনন্যার হাজবেন্ড হওয়ার দাবি নিয়ে আজকের অনামিকার সামনে যাওয়ার দরকার কী। তাকে কেন বিরক্ত করবেন?’

কিছুক্ষণ সবাই চুপ হয়ে থাকল। সবাই বুঝে গেছে, এখানে আর কিছু বলার নেই, কিছু করারও নেই। উঠে যাবে যাবে করছে এমনসময় ইমরান বলল ‘আমি এই কথাটা অনির মুখ থেকেই শুনতে চাই।’

‘আপনি তো ভাই ভালো ঘাউড়া আছেন। গতরাতে অনিকে ফোন করেছিলেন তো, ও বলেছে আমাকে। আমার তো মনে হচ্ছে উত্তরটা আপনি পেয়েই গেছেন।’

ইমরান তবুও মরিয়া হয় ‘ভাই প্লিজ। একবার ওর সামনাসামনি হয়ে আমাকে আমার কথাগুলো ওকে বলতে দিন। একটা সুযোগ করে দিন। ওর উত্তর পেয়ে গেলে, ও নিজে আমাকে ফিরিয়ে দিলে, আমি কথা দিচ্ছি, আমি কখনো ওকে বিরক্ত করব না। প্লিজ!’

নিজের মা সহ বাসায় উপস্থিত সবার চোখেই একই আকুতি পড়তে পারল পরশ। অনির চোখেও একদিন ইমরানের জন্য ভালোবাসা দেখেছিল ও। সবদিক ভেবে বলল ‘বেশ, অনিকে বলব আমি। অনির সময় আর জায়গা জানিয়ে দেবো আপনাকে….’

চলবে…

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here