মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৩+৩৪
মোনার জীবনে প্রথম প্রেম। কি এক ধারালো অনুভুতিময় মুহুর্তে। মোনার অন্তরতম প্রদেশে যেন বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। মোনা বিভোল চিত্তের কল্পনা দিগ্বিগিক মাতিয়ে তুলেছে । অদ্ভুত এক প্রেমাবেগ বসন্তের হিমেল মারুতের মত মোনার মনে মৃদু দোলা দিচ্ছে। মোনা মাঝে মাঝে স্থান,কাল ভুলে প্রিয়ম’কে নিয়ে ভাবনায় বিবশ হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণ প্রদেশে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ক্ষুদ্র তরঙ্গের ন্যায় দোলা দেয়।
কয়েকদিন কেটে গেলেও মোনা প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। প্রিয়মের উপস্থিতিতে মোনার হাঁসফাঁস অবস্থা হয়। ধরণীর সব আড়ষ্ট’টা মোনার মনে ভর করে। প্রিয়মের চোখে দিকে তাকানো যেন দুরূহ কাজ। অথচ আগে এই চোখের দিকে শ্যেন দৃষ্টি’তে কয়েক’শ বার বিরক্ত হয়েছে মোনা। সম্পর্ক’টা প্রেমে পরিণত হওয়ার পরপর’ই সব কিছু বদলে গেছে।
মোনা ভার্সিটি’তে যায়। মোনার খিটখিটে মেজাজ ইদানিং শীতল হয়ে গেছে। মোনার মর্মদেশে যে দুশ্চিন্তা গুলো বার বার উঁকি দিতো সে গুলো আজকাল স্থান পায় না। মোনার প্রতি প্রতিমুহূর্তের সহচর ছিলো যে বিষণ্নতা, সে ও যেন আজকাল মোনার দেখা পায়না।শ্রুতি গুরুত্বর চিন্তিত মুখে মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার এতসব পরিবর্তনের কারণ কি? মোনা আমি না তোমার এই বৈচিত্র্যময় আচরণ নিয়ে চিন্তিত।”
মোনা হৃষ্টচিত্তে হাসে। উচ্ছ্বাসিত সে হাসি। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক মোড়। কিছু কিছু মোড়ে মানুষ কাঁদে,কিছু কিছু মোড়ে হাসে।”
শ্রুতির মুখ দেখে মনে হলো মোনার বলা কথা গুলো দুর্বোধ্য লাগলো ওঁর কাছে। শ্রুতির সব কথার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিল করে উত্তর দিবে মোনা। সেসব কথার মানে খুঁজতে খুঁজতে শ্রুতি ধৈর্যচ্যুত হয়ে যায়।
মোনার ভার্সিটি ছুটি হয়। ভার্সিটি থেকে বের হতেই প্রিয়মের ম্যাসেজ। মোনা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়।
-“ভার্সিটির কাছে অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
মোনা ম্যাসেজ’টার দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়ম অফিস বাদে আসবে?মোনার এসব ভাবনা চিন্তা শেষ হতে না হতেই প্রিয়ম চলে আসে। মোনা’কে দেখেই খানিক’টা দূর থেকেই ঠোঁট প্রসস্থ করে হাসে। প্রিয়ম মোনার কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়ম কাছে আসতেই মোনা স্বভাব অনুযায়ী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ফেলে। ওপাশে ফিরানো মুখ’টা দেখার জন্য প্রিয়ম কৌতূহলী হয়ে ওঠে। গলায় কিছু’টা রোষাবেশ নিয়ে বলে,
-“ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমি চলে যাবো কিন্তু।”
মোনার কোন পরিবর্তন নেই। কিছুক্ষণ পেরিয়ে যায় যায়। প্রিয়ম ব্যগ্র হয়ে বলে,
-“আমি অফিস রেখে এসেছি। আর তুমি আমার কি তাকাতেই লজ্জা পাচ্ছো। এত লজ্জা আগে কোথায় ছিলো?ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছো কত।”
প্রিয়ম যেন হতাশ হলো।মোনা প্রিয়মের দিকে তাকালো। মোনার মুখে বিরক্তি আর লাজুকতা। নিঃশব্দ’তা ভেঙে মোনা বলে,
-“অফিস রেখে কেন এসেছেন?”
প্রিয়ম বিদ্রুপ করে বলল,
-“কেন এসেছি তুমি বুঝো না?”
মোনা প্রত্যুত্তর করল না। কিছুক্ষণ আবার আগের মত চুপ থাকলো। প্রিয়ম অধৈর্য হয়ে বলল,
-“এভাবে চুপ হয়ে আছো কেন?মোনা হয়েছে’টা কি তোমার?এত লজ্জা আসে কোত্থেকে?”
প্রিয়ম একটু থেমে আবার বলল,
-“গাড়ি’তে উঠো।”
মোনা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।প্রিয়ম বলে,
-“এক জায়গায় যাবো।”
মোনা আর কোন প্রশ্ন না করে গাড়ি’তে উঠলো। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা আগের মত অরব থাকলো। মোনার এই শব্দহীন’তায় প্রিয়ম বিরক্ত হয় মাঝে মাঝে।
-“মোনা রবীন্দ্র সংগীত শুনবো?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে। প্রিয়ম রবীন্দ্র সংগীত ছাড়ে।মোনার খেয়াল মোটেও গানের দিকে নেই। মোনার মস্তিষ্ক অদ্ভুত এক অনুভূতি’তে অবশ করে রেখেছে। মোনা নিসাড় পরিবেশ’টা কে অবকাশ দিয়ে বলল,
-“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
-“আমার একটা পছন্দের জায়গা আগে সেখানে নিয়ে যাবো তোমায়। আচ্ছা মোনা এর আগে কোন সম্পর্ক ছিলো তোমার?”
প্রিয়মের প্রশ্নে মোনা বিরক্ত হলো মনে মনে। আগে সম্পর্ক থাকা’টাও অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু মোনার ছিলো না, তাই মোনার কাছে অবান্তর লাগলো। মোনা ভারি গলায় বলল,
-“না। আপনার কয়’টা ছিলো?”
মোনার প্রশ্নে প্রিয়ম উচ্চস্বরে হাসলো। হাসি থামতে সময় লাগলো বেশ। গলায় হাসির রেশ বিদ্যমান রেখেই প্রিয়ম বলল,
-“আগে রিলেশন ছিলো কিনা তা জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করলে কয়’টা ছিলো?অবশ্য যৌক্তিক প্রশ্ন করেছো।হ্যাঁ অনেক গুলো ছিলো।”
মোনা অন্তরতম অঁচলে সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব করলো।প্রিয়মের ক্ষেত্রে এসব অস্বাভাবিক না মোনা জানে,তবুও কেন জানি এরূপ যন্ত্রনা। মোনা বিমর্ষতাপূর্ণ গলায় বলল,
-“এখনো আছে?”
প্রিয়ম সহজ গলায় বলল,
-“হ্যাঁ আছে তো।”
মোনা বজ্রাহত হলো যেন। মুখের অবস্থা সঙ্কটজনক। মোনা তীব্র যন্ত্রনায় দগ্ধ হচ্ছে যেন। নির্বাক, রক্তশূন্য দৃষ্টি’তে তাকায়। প্রিয়ম মোনা অবস্থা বুঝতে পেরে মোনার একটা হাত শক্ত করে ধরে গাঢ় গলায় বলল,
-“হ্যাঁ আছে আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। আর কারো সাথে নেই।”
মোনার একটু আগের সব শঙ্কা মিছে হয়ে গেলো। বুকের ভেতর যে সূক্ষ্ম যন্ত্রনা অনুভূত হয়েছিল তা উবে যায়। এক রাশ অভিমান নিয়ে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম হেসে আবার বলল,
-“কি ভেবেছিলে?”
মোনা প্রিয়মের হাত থেকে নিজের হাত’টা ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
-“ধ্যাত!কিছু ভাবিনি।”
-“ভেবেছো অনেক কিছু।”
মোনা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু’টা লাজুক ভাব মোনার মুখে। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“আমায় কি তুমি বলা যাবে?নাকি প্রিয়ম ভাই ই ডাকবে সারাজীবন? ছেলে-মেয়ে মামা ডাকবে আমায়। কি লজ্জার ব্যাপার!”
মোনা অস্বাচ্ছনদ্য বোধ করে এসব কথায়। মুখ ভারি করে বলল,
-“আচ্ছা ভাই ডাকবো না। শুধু আপনি বলব। কিন্তু পরবর্তীতে এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা বললে খারাপ হবে।”
মোনার মুখের ভাব দেখে প্রিয়ম মজা পায় যেন। বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
-“অসংলগ্ন কথাবার্তা কি বললাম?
মোনা কপাল কুঁচকে ফেলে।মোনা চোখ লাল করে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম হাসি থামিয়ে বলল,
-“আচ্ছা.. আচ্ছা বলবো না। কিন্তু ভাই ডাকলে আবার বলল।”
কথা শেষ না হতেই প্রিয়ম গাড়ি থামায়।প্রিয়ম গাড়ি থেকে নেমে মোনায় নামতে বলে। মোনা নামে গাড়ি থেকে। ঝকঝকে নদীর তীর,একটু তফাতেই বেঞ্চ।জায়গা’টা মনমুগ্ধকর! মোনা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে চারপাশ’টা। কিছু মুহূর্ত পর প্রিয়ম বলল,
-“বসো।”
মোনা বসলো,প্রিয়ম মোনার পাশে’ই। মাঝখানে একটু দূরত্ব রয়েছে। মোনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আচ্ছা আপনা আগে যে সব প্রেম ছিলো সব ব্রেকাপ হয়ে গেছে? তাঁদের ছাড়তে আপনার কষ্ট হয়নি?”
প্রিয়ম স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“এখানে ব্রেকাপে মানুষ কষ্ট পায় না তেমন। আর তাঁদের প্রতি তেমন কোন অনুভূতি ছিলো না আমার। যেটা তোমার প্রতি আছে।”
মোনা কিছুক্ষণ উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়ম মোনার একটু কাছে এগিয়ে বসে বলল,
-“অতীতের কথা বাদ দিই।বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা ভাবি।”
-“অতীত যদি কখনো সামনে আসে?”
প্রিয়ম জোর গলায় বলল,
-“আসবে না।”
মোনা স্বভাব অনুযায়ী আবার চুপ হয়ে থাকলো।প্রিয়ম মোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবেগপূর্ণ গলায় বলল,
-“মোনা তোমার কপালে একটা চুমু খাই?”
নিঃসংকোচ আবেদন। মোনা শিউরে উঠে। শীতল রক্ত স্রোত প্রবাহিত হয় হৃৎপিণ্ড ছেয়ে। শ্বাস দ্রুততর হয়। লাজুক লতার মত নুয়ে পড়ে। মোনার নীরবতা দেখে প্রিয়ম মোনার দুই গালে হাত দিয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মোনা ঈষৎ কেঁপে উঠে। নেত্র দুটো বুঁজে আছে মোনার, ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে। চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। মোনার একদম সম্মুখে প্রিয়ম। চোখ খুললেই প্রিয়মের চোখাচোখি হবে। মোনার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়ছে। প্রিয়ম তাকিয়ে আছে মোনার দিকে। বাড়াবাড়ি রকমের এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে মোনার চেহেরায়।প্রিয়ম কিছুক্ষণ পর দূরত্ব রেখে বসলেও মোনা সহজ ভাবে তাকাতে পারছে না। ঘোরলাগা অবস্থা মোনার। মহীর সমস্ত লজ্জা মোনা’কে আড়ষ্ট করে রেখেছে।এক তীক্ষ্ণ অনুভূতি মোনার ভিতরে তোলপাড় শুরু করছে। সারা রাস্তা প্রিয়মের দিকে তাকালো না মোনা। প্রিয়ম পুনরায় হতাশ গলায় বলল,
-“এত লজ্জা কোত্থেকে আসে? মোনা তাকাও বলছি আমার দিকে।”
মোনা তাকায়। আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। মোনার লজ্জা পাওয়ায় প্রিয়ম অন্যরকম এক সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছে। অনিমেষ দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমিকা’দের এমন লাজুক রূপ প্রিয়ম প্রথম দেখলো, এর আগে কখনো দেখেনি। মোনা অফিসেও যায় নি আজ। প্রিয়ম বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
(চলবে)
মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৪
নিশানের স্কুল বাসার কাছে হওয়াতে নিশান একাই যায়। মোনার সময় হলে মাঝে মাঝে দিয়ে আসে।নিশান স্কুলেই উদ্দেশ্য বেরুবার পর মোনা থালা-বাসন পরিষ্কার করল, বিছানা গোছালো, আরো টুকটাক কাজ শেষ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হলো। মোনা বাসার সামনে যেতেই কিছু’টা দূরে নিশানের মত কাউকে দেখে। মোনা ভ্রু কুঞ্চিত করে তির্যক দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে। মোনার দৃষ্টিশক্তির কার্যবিপত্তি ঘটলো। মেঘবৎ ভাবে বুঝা গেলো কারো হাত ধরে এগিয়ে আসছে নিশানের মত কেউ।মোনা খানিক’টা ভাবুক মনে কৌতূহলী হয়ে সেদিকে পা বাড়ায়। কিছুক্ষণ পর মোনা স্পষ্টভাবে দেখে নিশান পা টেনে টেনে হাঁটছে,এক শেতাঙ্গ মহিলা নিশানের হাত ধরে হাঁটতে সাহায্য করছে। মোনা তড়িৎ গতিতে ছুটে যায়। মোনার চোখে মুখে চাপা আতঙ্ক ঝিলিক। আতঙ্কপ্রবন গলায় অস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করল,
-“কি হয়েছে তোর?পায়ে ব্যথা পেলি কিভাবে?”
নিশানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শেতাঙ্গ মহিলা’টি মিহি গলায় বলল,
-“তেমন কিছু না, পায়ে ব্যথা পেয়েছে। হাঁটতে কষ্ট হবে কিছুদিন। শীঘ্র’ই সেরে উঠবে।”
নিশানের এমন অবস্থা শঙ্কিত হয়ে মোনা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ’টার প্রতি ঔদাস্য হয়ে পড়েছে। মোনা শেতাঙ্গ মহিলা’টির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করে নরম গলায় ধন্যবাদ জানালো। মোনা ভার্সিটি’তে যাওয়ার পথে প্রায়’ই দেখতো এই মহিলা’কে। বয়স পঞ্চাশোর্ধ হবে।
মোনা নিশান’কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিশান ব্যথায় চোখ মুখ কুঞ্চিত করে রেখেছে। এমন সময় মোনার কর্ণ গহ্বরে একটা শব্দ তরঙ্গ প্রবেশ করল।
-” আমি মেরিনা।”
ভদ্রমহিলা আগ বাড়িয়ে নিজের নাম বলল। মোনা মেরিনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
-“আমি মোনালিসা।”
মোনার আজ আর ভার্সিটি’তে যাওয়া হলো না। মোনা নিশান’কে কোলে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নিশানের পায়ের গোড়ালি’তে জখম হয়েছে, মাংস থেঁতলে গেছে।রক্ত ঝরা শেষে এখন জমাট বেঁধে আছে। মেরিনা ওঁদের সাথেই হাঁটছে। মোনা মেরিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আপনার বাসা এদিকে?”
-“হ্যাঁ এখানেই। তোমাদের আমি প্রায়’ই দেখি। তোমাদের বাসা থেকে দুই মিনিটের রাস্তা।”
খুব মার্জিত ভাবে কথা বলছে মেরিনা,অমায়িক ব্যবহার। মোনা মুগ্ধ হলো। পঞ্চাশোর্ধ মেরিনা’কে মোনার কেন জানি পঁচিশ বছরের মহিলা মনে হলো। মোনা নিশান’কে কোলে নিয়ে ক্লান্তি’তে হাঁপিয়ে গেলো। মোনা ওর বাসার সামনে এসে মেরিনার দিকে তাকিয়ে সুললিত কন্ঠে বলল,
-“বাসায় চলুন। কফি খেয়ে যান।”
মেরিনা হেসে প্রত্যুত্তর করল,
-“আজ না,অন্যদিন। পিচ্চির খেয়াল রেখো।”
মোনা নিশান’কে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। নিশান’কে খাটের উপর বসিয়ে মোনা লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতে লাগলো। মোনা স্যাভলন লিকুইড অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে দিলো। নিশান ব্যথিত মুখে চোখ বুঁজে আছে। ব্যথা কিছু’টা কমে আসলে, মোনা রোষপূর্ণ চোখে নিশানের দিকে তাকালো।রূষ্ট গলায় বলল,
-“নিশান তোমায় বলেছি আমি কাজ শেষ করে ভার্সিটি’তে যাওয়ার সময় তোমায় স্কুলে দিয়ে আসবো। তোমার তর সইলো না। আগে আগে চলে গেলা।এত বেশি বুঝো তুমি—।”
মোনা শেষ অংশটুকু অস্ফুট ভাবে বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বলল। খানিক বাদে কড়া গলায় আবার বলল,
-“আর কখনো একা একা যাবে না।”
নিশান মাথা নিচু করে আছে অপরাধীর ন্যায়। মোনা শঙ্কিত গলায় পুনর্বার বলল,
-“আজ যদি খারাপ কিছু হয়ে যেতো?”
বিভিন্ন শঙ্কা, আতঙ্ক আর ভীতি’তে উদ্বিগ্ন হয়ে নিশান’কে ধমক দিচ্ছে মোনা। স্কুলে ভর্তি করানোর পর দুষ্টুমি বেড়েছে নিশানের। নিশানের সাথে কথা বলার মাঝে’ই পিছন থেকে কেউ একজন নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হালকা কেশে ওঠে। মোনা চমকে গিয়ে পিছনে তাকায়। জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। মোনা খাট থেকে উঠে দাঁড়ায়। জ্যাক’কে দেখে অবাক হলো ভীষণ। ব্যস্ত হয়ে বলল,
-“জ্যাক আপনি? এভাবে হুট করে আসলেন? কতদিন বাদে আসলেন বসুন।”
জ্যাক মোনার দিকে তাকিয়ে হেসে চেয়ারে বসলো। নিশানের দিকে তাকিয়ে মোনা’কে উদ্দেশ্যে করে বলল,
-“কি নিয়ে এত রেগে ছিলেন?”
মোনা একটু হাসলো।জ্যাক আসাতে নিশানের উপর রাগের বিষয়’টা বাষ্পাকারে নির্গমন হয়ে গেলো। ঠান্ডা গলায় কিছু’টা বিরক্ত নিয়ে বলল,
-“ও কিছু না। স্কুলে যাওয়ার পথে পায়ে ব্যথা পেয়ে বাসায় ফিরেছে। আজকাল খুব বেপরোয়া হয়ে গেছে।”
-“এ বয়সে একটু দুষ্টুমি করবেই।আজ তাহলে ঠিক সময়ে আসলাম।”
মোনা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। জ্যাকের কথা’টা বুঝতে পারলো না। জ্যাক সহজ করে বলল,
-“দুর্ঘটনার সাথে সাথে ডাক্তার এসে গেছে।”
মোনা এবার হাসলো। হঠাৎ চিন্তাগ্রস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আচ্ছা জ্যাক ডাক্তারি ছেড়ে কেউ বিজনেস করে?কি চমৎকার একটা পেশা! আমার প্রবল ইচ্ছে ছিলো, বিভিন্ন সমস্যার কারণে আর হয়ে ওঠেনি।”
কথার শেষ অংশটুকু’তে প্রচণ্ড আক্ষেপ ছিলো। ইচ্ছে পূরণ না হওয়ার ক্লেশও ছিলো। জ্যাক বলল,
-“ছেড়ে দিয়েছে। জীবনে একটা পর্যায়ে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”
জ্যাকের গলায় বিষণ্ণ’তা। মোনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।জ্যাক নিজেকে সংযত করে বলল,
-“এসব অন্য এক সময় বলবো।এখন থাক।”
কথা বলার মাঝে প্রিয়ম ম্যাসেজ করলো। মোনা অকারণেই কয়েকবার পড়লো ম্যাসেজ’টা।
-“ভার্সিটি শেষে অপেক্ষা করো।”
-“আমি তো ভার্সিটি’তে যায়নি।”
ওপাশ থেকে সাথে সাথে উত্তর এলো,
-“কেন যাও নি?ভালো’ই হলো।আমি তাহলে দুই মিনিটের ভিতর আসছি।আমি তোমার বাসার কাছে’ই।”
প্রিয়ম আর ম্যাসেজের উত্তর দিলো না। হয়ত বাসার উদ্দেশ্যে আসছে তাই। মোনা ফোন হাত থেকে রেখে মনযোগী হয় জ্যাকের প্রতি।
-“প্রিন্সেস’কে দেখতে গিয়েছিলাম। আপনি বাসায় ছিলেন না। প্রিন্সেস এখন—”
প্রিয়ম বাসায় ঢুকাতে মোনার কথা’টা শেষ হলো না। প্রিয়ম প্রথমে জ্যাক’কে খেয়াল করেনি। কয়েক মুহূর্ত পর প্রিয়মের মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়।প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায় তীব্র বিস্ময়ে।প্রিয়মের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
প্রিয়মের মুখাবয়ব দেখে মোনা কিছু’টা বিচলিত হলো।প্রিয়মের অন্তর্দেশে কি চলছে বুঝার চেষ্টা করলো। বাসার ভিতর কিছুক্ষণের জন্য গাঢ় নিরাবতা বিরাজ করল। মোনা নিরাবতা ভেঙে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ইনি জ্যাক। আমার বন্ধু।”
প্রিয়মের চেহেরা আগের ন্যায়’ই রইলো। এতক্ষণ একটা বিস্ময় ভাব মুখে বিরাজ করলেও ক্রমে ক্রমে সেটা উগ্র রোষে পরিণত হলো। প্রিয়মের চেহেরায় চাপা ক্রোধ মৃদু দীপ্তি ছড়াচ্ছে।মোনার দিকে প্রদাহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। জ্যাকও এক অদ্ভুত কারণে অরব হয়ে রইল।জ্যাক প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,
-“আমি জ্যাক।”
-“প্রিয়ম।”
প্রিয়মের কথায় ক্ষোভ স্পষ্ট ভাবে প্রকটিত। সেটা জ্যাক না বুঝলেও মোনা বুঝেছে। প্রিয়মের এমন আচরণে মোনা ভীতি কিংবা আতংকিত হচ্ছে না। প্রিয়মের এরূপ আচরণে মোনা ভিতরে ভিতরে দারুন ক্রোধে ফেটে পড়ছে কিন্তু জ্যাকের সামনে নিজেকে সংযত করলো। প্রিয়মের আচরণে জ্যাকের সামনে অস্বস্তি’তে পড়লো মোনা। প্রিয়মের এমন প্রতিক্রিয়ায় মোনা আশ্চর্য না হয়ে পারলো না। তীব্র এক রোষ মোনার মগজে পীড়া দিচ্ছে।
প্রিয়ম তেমন কথা বলছে না। মোনা যত’টা সম্ভব সহজ আচরণ করছে জ্যাকের সাথে। একটু পর জ্যাক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
-“মোনালিসা উঠতে হবে আমায়। সময় পেলে বাসায় যাবেন কিন্তু একবার।”
প্রিয়মের সমস্ত প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে মোনা জ্যাক’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“যাবেন কেন?বসুন না,কফি নিয়ে আসি।”
জ্যাক প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে বলল,
-“না, না মোনালিসা অন্যদিন। গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে।”
জ্যাক বের হয়ে যায়। মোনা বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে দেয়। প্রিয়মের সামনে আজ লজ্জা,অস্বস্তি কিছুই লাগছে না। মোনা দরজার কাছ থেকে প্রিয়মের দিকে ছুটে গিয়ে ক্ষীপ্ত গলায় বলল,
-“এমন প্রতিক্রিয়ার মানে কি?আপনি জ্যাকের সামনে আমায় অপমান করেছেন।”
মোনার রাগ খুব ভয়ংকর জিনিস। প্রিয়ম যেন মোনার আচরণে অবাক হলো। প্রিয়ম ভেবেছিল মোনা ওঁর কাছে কুণ্ঠিত হবে। কিন্তু মোনার এমন নির্ভীক আচরণে প্রিয়মের ক্রোধ দ্বিগুণ হয়ে গেলো যেন। প্রিয়ম চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“তুমি একটা পুরুষের সাথে সময় কাটাবে ,সেখানে আমার কাছ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া আশা করো? কিসের এত ঘনিষ্ঠতা তোমার সাথে?”
প্রিয়মের কথা শুনে মোনা বুদ্ধিভ্রষ্ট, বিমূঢ় হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোনা হতবুদ্ধি হয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারলো না। মোনা অত্যাশ্চর্য গলায় বলল,
-“কি বললেন আপনি?আমি পুরুষের সাথে সময় কাটাই?”
মোনা ক্ষোভে চাপা গলায় আবার বলল,
-“জ্যাক আমার বন্ধু। এত নিকৃষ্টতর চিন্তা ভাবনা কেন আপনার? আপনি তো আমেরিকায় বড় হওয়া ছেলে, আপনার চিন্তা ভাবনা এত সংকীর্ণ কেন?”
-“আমি আমেরিকায় বড় হয়েছি। আমি নাইট ক্লাবে যেতে পারি, আমি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করতে পারি। কিন্তু তুমি তো কনজারভেটিভ একটা মেয়ে, তুমি কেন একটা পুরুষ নিয়ে বাসায় সময় কাটাবে?”
প্রিয়মের কথায় মোনা হতবাক হয়ে উত্তর খুঁজে পেলো না। মোনা রক্তশূন্য দৃষ্টি’তে তাকিয়ে আছে। মোনার মগজ রাগে দপদপ করছে। এত অসংলগ্ন কথা মোনা নিতে পারছে না। প্রচণ্ড ক্রোধান্মত্ত হয়ে মোনার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি বিসর্জিত হলো। মোনা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
-“জ্যাক আমার ভালো একজন বন্ধু। আপনার চিন্তা-ভাবনা কিংবা অবান্তর কথার জবাব আমার কাছে নেই। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি সত্যি অনুতপ্ত,আপনার মত কাউকে ভালোবেসে অনুতপ্ত।”
কথা গুলো বলতে বলতে মোনার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। বন্ধ চোখের কোঠর বেয়ে আরো কয়েক ফোঁটা পানি মোনার শুষ্ক কপোল ভিজিয়ে দিলো।
প্রিয়মের রাগ কিছু’টা কমে আসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“মোনা আমি অন্তত তোমার ক্ষেত্রে সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনার মানুষ। আমি ঈর্ষান্বিত মোনা,আগে কখনো এমন হয়নি আমার। তোমার পাশে যে কোন পুরুষ’কে আমার অসহ্য লাগবে,সে যে ই হোক।”
প্রিয়মের কথা শেষ হওয়ার পর মোনা চোখ খুলল। অক্লিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরস্থির গলায় বলল,
-“জ্যাক’কে নিয়ে আপনি ঈর্ষান্বিত হলে সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। জ্যাক আমার বন্ধু, আপনি আমার বিশেষ কেউ। আমার মনে দুই জনের জন্য দুই’টা ভিন্ন স্থান রয়েছে।”
প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে অবিক্ষুদ্ধ গলায় বলল,
-“আমার জন্য তুমি জ্যাক’কে ছাড়তে পারবে না?”
প্রিয়মের কথায় মোনা অধৈর্য হয়ে পড়ে। তীব্র বিরক্ত হয়।
-“আপনার জন্য জ্যাক’কে কেন ছাড়তে হবে?”
মোনা একটু থেমে বিস্ময়ের সুরে বলে,
-“এগুলো কোন ধরণের কথা?”
প্রিয়মের ক্ষুব্ধ চেহেরায় এখন চাপা অভিমানের ছাপ। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে ফেলে প্রিয়ম।
-“আমার আর জ্যাকের ভিতর কাকে প্রয়োজন তোমার?”
এমন একটা কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে মোনা দু দন্ডও ভাবলো না। যেন উত্তর আগে থেকে প্রস্তুত ছিলো। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-“জ্যাক আর আপনার সাথে তুলনা দেওয়া অর্থহীন,মূঢ়তা। আপনার যদি সেই অর্থহীন প্রশ্ন’টার উত্তর একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে আমি বলবো আমার জ্যাক’কে প্রয়োজন।”
(চলবে)