মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৯+৩০
মোনা ওভাবে কতক্ষণ প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো হিসেব নেই। প্রিয়ম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আছে। মোনা ও’কে জড়িয়ে ধরেছে?এটা ভেবে যত না রোমাঞ্চিত হয়, তার থেকে হাজার গুন বিস্মিত হয়। প্রিয়মের মনে হচ্ছে এটা নিছকই স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে এসব মিছে হয়ে যাবে। এটা যদি স্বপ্ন হয় তাহলে সারাজীবনেও যেন ঘুম না ভাঙে,এটা যদি বাস্তব হয় তাহলে যেন এই বাস্তবতা অন্তত কাল অক্ষত থাকে।
প্রিয়মের চোখের পানি দেখে মোনার মনে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে,সে তোলপাড় থেমে যাওয়ার পর মোনা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে প্রিয়মের আলিঙ্গনে।
মোনা তাৎক্ষণিক নিজেকে প্রিয়মের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে। মোনার দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ। মোনা আর কোথায়ও তাকাতে পারছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ’টার জন্য একটু আগেও বুকের ভিতর প্রেম অনুভূত হয়েছে। কিন্তু একটু সময়ের ব্যবধানে সেই প্রেম, বুকের ভিতর তোলপাড় সব শেষ হয়ে গেছে যেন। মোনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-“প্রিয়ম ভাই,আর কখনো আসবেন না আমার সামনে।আমায় দুর্বল করার চেষ্টা করবে না।”
মোনা অনুনয় করছে বলছে কথা গুলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে এই অনুনয়। আজকাল প্রিয়মের সামনে আসলেই মোনার ভিতর কি যেন কি হয়ে যায়। মুহূর্তেই মোনার এই বিচিত্র আচরণে প্রিয়ম আবার চমকায়। মোনার আচরণে ক্ষণে ক্ষণে চমকায় ইদানিং।প্রিয়ম বুঝতে পারেনা মোনা কি চায়? কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ মোনা’কে বুঝা। প্রিয়ম মোনার নিচু হয়ে থাকা মুখের চিবুক আলতো করে ধরে মুখ’টা উঁচু করে। অদ্ভুত এক মোহময় গলায় বলে,
-“কিসের এত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছো মোনা?কিসের এত দোটানা? বিশ্বাসী হও মোনা, বিশ্বাস করতে শিখো। জীবনে কোন এক মোড়ে হেরেছো বলে, প্রতি পদক্ষেপে হারবে এমন কিন্তু না।”
মোনা চোখ তুলে তাকায়। প্রিয়মের চোখে চোখ রাখে। মোনার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মাথার ভিতর থাকা সমস্ত চিন্তাভাবনা উপেক্ষা করে, শীতল গলায় বলে,
-“হার -জিতের ভয় আমি করিনা।‌‌‌ ছোট এই জীবনে পাওয়া না পাওয়া, হার কিংবা জিত, পূর্ণতা-অপূর্নতা এত হিসেব কষতে নেই। এত সব হিসেবে মগ্ন থাকলে জীবনের বেলা কখন ফুরিয়ে যায় টের পাওয়া যায় না।
আমি কারো প্রেয়সী হতে পারবো।নিজের অস্তিত্বে কাউকে জড়িয়ে নিজেকে বিলীন করতে পারব না।”
প্রিয়ম কি ভেবে যেন একটু হাসলো। রহস্যময় একটা ভাব ছিলো হাসিতে। অসংশয়ে, অভ্রান্তচিত্তে বলল,
-“তুমি ইতোমধ্যে আমাতে বিলীন হয়ে গেছো মোনা।তোমার অস্তিত্বে আমি জড়িয়ে গেছি।”
প্রিয়মের দৃষ্টিতে মিশে থাকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয় মোনা। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মোনার অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকা মুখটা দেখার জন্য প্রিয়মের মুহূর্তেই কৌতূহল জাগে। প্রিয়ম কয়েক পা মোনার ঘুরিয়ে রাখা মুখের সম্মুখে দাঁড়ায়।প্রিয়ম প্রেমময় ধরা গলায় বলল,
-“মনের ভিতরের সন্দিহান ভাব’টা ঘুচিয়ে ফেলো মোনা।”
মোনা প্রত্যুত্তর করলো না। চিন্তান্বিত চিত্তে বিষাদময় এক যন্ত্রনা অনুভব করে। দোটানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ভালোবাসতে পারছে না,আবার রহস্যময় এক মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আছে। মোনা দিশেহারা হয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই আপনি এখন এখান থেকে যান, এক্ষুনি যান। আমার সময় দরকার।”
প্রিয়ম কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল। অকারণে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। দুই জনই নির্বাক , নিঃশব্দ হয়ে রইলো। একটু আগে প্রিয়মের মনে হয়েছে পৃথিবীর সব সুখ ওঁর মনে জড়ো হয়েছে। মোনার মনে হয়েছিল প্রিয়ম’কে ভালোবাস’তে কোন বাঁধা নেই, কিন্তু এখন কিছু মুহূর্ত বাদে আবার হাজার দ্বিধার মুখোমুখি হলো।
প্রিয়ম হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যর্থ গলায় বলল,
-“আমি আসি মোনা। তুমি সময় নেও।” প্রিময় এইটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“প্লীজ আমায় অন্তন একবার সুযোগ দিও।”
প্রিয়ম চলে যায়। মোনা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো, ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মোনা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা’টা লক করে দেয়। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। প্রিয়ম’কে কেন জড়িয়ে ধরলো?আত্মক্ষোভে মোনা ফেটে পড়ছে। নিজেকে সংযত করতে পারে না, কি ব্যর্থতা!
মোনা একটু আগ বাড়িয়ে ভাবলো। প্রিয়মের সাথে প্রেম তারপর বিয়ে।প্রিয়মের সাথে বিয়ে হলে প্রিয়মের বাসায় থাকবে?কখনো না! মোনা সেটা পারবে না। প্রিয়মের প্রতি ভালোবাসার পথে সে রাত’টাই এখন তীব্র ভাবে বাঁধ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মোনা দোটানা, দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু লিলি বেগমের বাসায় কখনো যেতে পারবে না। অমন পিতার সন্তান’কে ভালোবাসতে পারবে না। ঘৃনায় মোনার চোখ দুটো ভিজে যায়।
——
মোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হয়। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। আজ ট্যাক্সিও নেয় নি। হেঁটে হেঁটে যাবে। অকারণেই এই সিদ্ধান্ত। মোনার মাথায় নানান ভাবনা উঁকি দেয় আর অস্থির ভাবে পা বাড়ায়। হঠাৎ কি হলো মোনা বুঝতে পারলো না। কার থেকে এক ভদ্রলোক মোনার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
-“রাস্তায় দেখেশুনে হাঁটেন। নেশাগ্রস্ত মানুষের মত পথ চলছেন।”
মোনা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মোনার কাছ থেকে প্রত্যুত্তের অপেক্ষা না করেই চলে গেলো গাড়ি নিয়ে শোঁশোঁ করে। মোনা পুনরায় নিজের ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে পথ চলে।
ভার্সিটির কাছাকাছি গিয়ে দেখা ওয়াটসের সাথে। ওয়াটস পিছন‌ থেকে ডাকছে মোনালিসা,মোনালিসা বলে। মোনার সমস্ত খেয়াল মাথার ভিতর থেকে দুশ্চিন্তায় নিবদ্ধ। চারদিকে ভূমিকম্প হয়ে গেলেও বোধ হয় টের পাবে না। ওয়াটস মোনার একটু দূরে ছিলো। দৌড়ে এসে মোনার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-“মোনালিসা তুমি আমায় উপেক্ষা করছো কেন?”
আচমকা কারো এমন গলা শুনে মোনার অবচেতন মনে চমকায়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,
-“আমি উপেক্ষা করবো কেন তোমায়? কিভাবে উপেক্ষা করলাম?”
-“কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায়। কোন সাড়া দিলে না।”
-“স্যরি ওয়াটস‌ শুনিনি আমি।”
ওয়াটস মোনার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল,
-“তোমার অস্বাভাবিক, চিন্তাগ্রস্থ লাগছে। কোন প্রবলেম মোনালিসা?”
মোনা একটু হাসার চেষ্টা করলো। চেহেরা স্বাভাবিক করতে চাইলো। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,
-“না,না। আই এ্যাম ওকে।” মোনা একটু থেমে আবার বলল,
-“আচ্ছা শ্রুতি এসেছে?”
-“অদ্ভুত তো মোনালিসা! তুমিও মাত্র আসলে, আমিও আসলাম। আমি বলবো কিভাবে?”
মোনা বুঝতে পারলো ও একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে ফেলেছে। ওয়াটস এর সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাস রুমে গেলো।ওয়াটস অনার্গল কথা বলে যাচ্ছে। মোনা শুধু উদাস মনে হ্যাঁ,হু বলে যাচ্ছে।
মোনা আজ আর ক্লাসে মন বসাতে পারলো না। কি এক যন্ত্রনা, চিন্তা মোনা’কে দগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। মোনা বের হতে পারছে না এসব। এসবে মোনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বিশ্রাম দরকার।
মোনা অফিসে যাওয়ার পর পরই লরি এগিয়ে এসে বলল,
-“তোমার কয়েক দিন যাবৎ কি হয়েছে বলো তো মনা? মনমরা, বিষন্ন হয়ে থাকো।”
-“কিছুই হয় নি। শরীর’টা একটু খারাপ লাগছে।”
লরি বুঝতে পারলো মোনা মিথ্যা বলেছে, লরি আরো কয়েক বার জিজ্ঞেস করলো। মোনা একই উত্তর করলো। লরি দমে গেলো, নিজের কাজে মন বসালো। কাজের মাঝে মাঝে হঠাৎ মোনা নির্লিপ্ত হয়ে যায়।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ কয়েক মিনিট পর আবার সম্বিত ফিরে।
মোনা বাসায় ফিরে।‌ প্রিয়ম কয়েকবার ফোন দিয়েছে, জ্যাকও ফোন দিয়েছে। মোনার ফোন সাইলেন্ট ছিলো। মোনা জ্যাকের কল ব্যাক করল।জ্যাক বলল,
-“আজকাল কি হয়েছে আপনার মোনালিসা? আপনার হদিস পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বাসায়ও গিয়ে আসছি আপনার।”
জ্যাকের বলা কথা গুলোর প্রত্যুত্তর খুঁজে পেলো না মোনা। মোনা কথা গুলো উপেক্ষা করে বলল,
-“প্রিন্সেস কেমন আছে?”
-“প্রিন্সেস এখন স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারে। একদিন আসুন একবার।”
-“সময় হয়ে উঠে না।‌‌‌‌ সময় পেলে আসবো একদিন আসবো।” মোনা একটু থেমে আবার বলল,
-“জ্যাক রাখছি আমি, একটু কাজ করছি।”
মিথ্যা বলেই ফোন রাখলো মোনা। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। জ্যাক ফোন রাখার পর পরই প্রিয়ম আবার ফোন দিলো। মোনার আবার অস্থিরতা শুরু হলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরলো ফোন। মোনা ক্লান্ত স্বরে হ্যালো বলল। ওপাশ থেকে বলল,
-“কালকে একটু রেস্টুরেন্টে আসবে?কথা ছিলো।”
কথা বলতে রেস্টুরেন্ট কেন? ফোনে বলা যায়, ম্যাসেজে বলা যায়। বাসায় এসে বলা যায়। মোনা কিছুক্ষণ পর বলল,
-“কথা শুনতে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে?”
-“তো কি তোমার বাসায় আসবো?”
মোনা জোর গলায় বলল,
-“না,না। বাসায় আসবেন না খবরদার।”
প্রিয়ম হাসলো।
-“না,না তোমার বাসায় যাবো না। তোমার বাসায় গেলে তো তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাবে। এত তাড়াহুড়া করে প্রেমে পড়ার দরকার নেই। আস্তে আস্তে পড়ো।”
মোনা ফোন রাখার পর ভাবছে চোখ বুঁজে ভাবছে, প্রিয়মের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির কথা। প্রিয়ম নিজেকে বদলে ফেলল,মোনার জন্য চোখ ভিজে ওঠে, দিশেহারা হয়ে ওঠে। মোনার প্রিয়মের ভালোবাসা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দোটানা শুধু হাবিব সাহেবের জন্য।কাল কেন ডেকেছে প্রিয়ম রেস্টুরেন্ট? মোনা কৌতূহল বোধ করে। কাল একবার প্রিন্সেস কে দেখতে যাবে,অনেকদিন দেখে না।
(চলবে)

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩০
মোনা বিছানা গোছাচ্ছে। দিনে কয়েকবার গোছাতে হয় বিছানা।‌ রুম’টা সাজানো থাকলে নিশানের বোধ হয় অশান্তি লাগে। সব কিছু এলোমেলো করে রাখবে। মোনা বিরক্তিতে মনে মনে বিড়বিড় করছে আর বিছানা গোছাচ্ছে। উঁচু গলায় নিশানের নাম ধরে ডাকে। নিশান পাশের রুম থেকে ছুটে আসে গলা ফাটানো চিৎকার শুনে।‌ মোনা কর্কশ গলায় বলে,
-“নিশান তোমায় কতদিন না বলছি বিছানা এলোমেলো করবে না? প্রতিদিন এক কথা কতবার বলল?সব কিছু এলোমেলো করে রেখেছো।‌ আমার কথার অবাধ্য হলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো।”
নিশান ভীতি হয়ে তাকায় মোনার দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। মোনা নিশানের চেহেরার অভিব্যক্তি দেখে রাগ ধরে রাখতে পারলো না, হেসে ফেলল।
-“থাক মন খারাপ করো না। পাঠাবো না বাংলাদেশে।”
নিশানের সাথে কথা বলার মাঝে মোনার ফোনের ম্যাসেজের টিউন বেজে ওঠে। প্রিয়ম ম্যাসেজ করছে,
“রেস্টুরেন্টের লোকেশন বলবো নাকি আমি নিতে আসবো?আর শুনো খবরদার আমায় দেখে প্রেমে পড়ে যেয়ো না। পাব্লিক প্লেসে জড়িয়ে ধরো না। আমি লজ্জা পাবো।”
সুযোগ পেয়ে খোঁটা দিচ্ছে। মোনা বিরক্ত হলো, কিছুক্ষণ পর কি মনে করে যেন হাসলো। রিপ্লাই করলো,
“আপনি পাব্লিক প্লেসে কাঁদবেন‌ না প্লীজ। কেউ কাঁদলে আমার জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে।”
এমন একটা উপযুক্ত উত্তর দিতে পেরে মোনা নিজের মনে হাসলো।প্রিয়ম রিপ্লাই দিলো,
“আজকাল কথায় প্রচুর মিষ্টি, মিষ্টি ভাব।প্রেমে পড়ে গেলে নাকি আমার?”
মোনা উত্তর দিলো না। বিরক্তি’তে কপাল ভাঁজ করলো। প্রিয়ম সুযোগ বুঝে লজ্জা দিচ্ছে। মোনার যত’টা বিরক্ত হওয়ার কথা তত’টা বিরক্ত হতে পারছে না। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।
মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আজ স্কুলে যেতে হবে না। এক জায়গায় যাবো আমরা।”
নিশান কোথায়ও যাওয়ার কথা শুনলে আনন্দে মাখামাখি হয়ে যায়। মোনা একটা হোয়াইট কুর্তি পড়েছে। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দিয়েছে। মোনা সাজতে পছন্দ করে না। ছোট বেলা থেকেই কোন এক অজানা কারণে সাজতে পছন্দ করত না।
প্রিয়ম মোনার বাসার সামনে গাড়ি পার্কিং করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। মোনা বাসা থেকে বের হয়ে দরজা লক করে সামনে তাকাতেই দেখে প্রিয়ম আসছে। প্রিয়ম’কে দেখে চমকালো।প্রিয়মের উপস্থিতি মোনা’কে যথাযথ নিয়মানুসারে অস্বস্তি দিতে লাগলো। মোনা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“আপনি! আমি তো বলেছি বাসায় আসার দরকার নেই। আমি নিশান’কে নিয়ে যাবো রেস্টুরেন্ট।”
প্রিয়ম হাসলো।মোনার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি থেমে গেলো। মোনা অস্বস্তি’তে পড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
-“এগিয়ে নিতে আসলাম। বাংলাদেশী সুন্দরী, ন্যাকা নন্দিনী।”
মোনার চোখে মুখে নিদারুণ বিরক্ত উপচে পড়ছে যেন। বাহির থেকে দেখে যত’টা বিরক্ত মনে হচ্ছে ,মোনা ভিতরে তত’টা বিরক্ত না।
-” আচ্ছা কি বলতে রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন?এখন তো বাসায়ই এসে গেছেন। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
প্রিয়ম খুব সিরিয়াস গলায় বলল,
-“রেস্টুরেন্টের কথা বাসায় বসে বলা যায় না। আমেরিকান রুলস এটা।”
-“এমন অদ্ভুত রুলস যদি থেকেও থাকে সেটা আপনার জন্য আমার জন্য না।”
প্রিয়ম এদিক ওদিক তাকালো। আচমকা মোনা’কে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মোনা হতভম্ব হয়ে গেলো।‌ হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। কি বলে প্রতিবাদ করবে মোনা বুঝে উঠে পারলো না। ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই, খারাপ হচ্ছে খুব। অতিরিক্ত করছেন কিন্তু।”
মোনার কোন কথা যেন প্রিয়মের কান অবধি পৌঁছায় না যেন। প্রিয়ম ভাবলেশহীন ভাবে পিছনে নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিশান আসো তুমি। মোনা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে ও’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”
মোনা অধৈর্য গলায় প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলল,
-“আমি কোথায়ও ব্যথা পাইনি। আমি কিন্তু খারাপ আচরণ করবো প্রিয়ম ভাই।”
প্রিয়ম মোনার সব কথা উপেক্ষা করে গাড়িতে নিয়ে তুলে। মোনা চোখ বুঁজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েক মুহূর্ত পর গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো। প্রিয়ম বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। মোনা নাক মুখ ঘুচিয়ে রেখেছে।
-“ভৃত্য হিসেবে রানির সেবা করলাম।”
মোনা কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা নিদারুণ বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“আমায় প্রিয়ম ভাই ডাকো কেন? ছেলে-মেয়ে আমাকে বাবা না ডেকে, মামা ডাকবে।”
কথা’টা মোনার কানে তীক্ষ্ণ ভাবে বিদ্ধ হলো যেন। কি নির্লজ্জের মত কথা! মোনা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলেও প্রকাশ করলো না। গলায় ভারি রাগ নিয়ে বলল,
-“আমার ছেলে-মেয়ে আপনায় মামা’ই ডাকবে। মামা’কে কেউ বাবা ডাকে? ছিঃ!”
প্রিয়ম হেসে উঠলো মোনার মুখের অভিব্যক্তি দেখে। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ম আবার বলল,
-“আমাদের ছেলে-মেয়ের চোখও আমার মত নীল হবে। তুমি যেমন আমার নীল চোখ দেখে দেওয়ানা হয়েছো, আমার ছেলে-মেয়ে’দের জন্যও মানুষ অমন পাগল হবে।”
মোনা বিধ্বস্ত মুখে তাকালো প্রিয়মের অসংলগ্ন কথা শুনে। চোখে মুখে রাগ উপচে পড়ছে। মোনা জবাব দেওয়ার উপযুক্ত ভাষা খুঁজে না পেয়ে, কোন প্রত্যুত্তর করলো না। প্রিয়ম ও’কে রাগানোর চেষ্টা করছে মোনা সেটা স্পষ্টভাবেই বুঝলো।
কিছু সময় পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামলো। প্রিয়ম গাড়ি থেকে নেমে নিশান’কে নামতে বলল। তারপর গাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে মোনার উদ্দেশ্য বলল,
-“মহারানী মাটি’তে পা রাখবে নাকি কোলে করে রেস্টুরেন্টে নিতে হবে?”
মোনা গাড়ি থেকে নামলো। প্রিয়মের দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“এত প্রেম আসে কোত্থেকে?”
রেস্টুরেন্টে বসার পর প্রিয়ম খাবার অর্ডার করলো। মোনা আগের ন্যায় গম্ভীর’ই থাকলো। প্রিয়মের বলা কথা গুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। মোনা এখন প্রিয়ম’কে মন থেকে জোর গলায় বাঁধা দিতে পারেনা। মোনা প্রিয়মের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। খাবার আসার পর প্রিয়ম বলল,
-“যে কথা বলতে রেস্টুরেন্টে ডেকেছি শুনবে না?”
মোনা কথা শোনার জন্য আগ্রহী হলেও প্রকাশ করলো না। একটু আগের বলা কথা গুলোর জন্য অনাগ্রহ মিশ্রিত আচরণ করল। প্রিয়ম নিজ থেকেই বলল,
-“আমার জব’টা হয়ে গেছে।” একটু থেমে বিষাদময় সুরে বলল,
-“কাল থেকে অফিস। তোমায় সারাদিন বিরক্ত করা হবে না।”
মোনার মুখাবয়ব দেখার জন্য তাকালো প্রিয়ম। মোনা খুশি হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে পারলো না। প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল,
-“খুশি হও নি?”
-“অভিনন্দন! খালাত ভাইয়ের চাকরি হয়েছে খুশি হবো না?”
মোনা যেন ব্যঙ্গ করে বলল কথা’টা। প্রিয়ম খাবার নাড়াচাড়া করছে চিন্তিত মুখে। মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি তো তোমার জন্য—”
প্রিয়ম কথা’টা শেষ করতে পারলো না। কোত্থেকে এক মেয়ে এসে উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরলো। প্রিয়ম অপ্রস্তুত এক অবস্থার মুখোমুখি হলো। মোনার সামনেই হতে হলো এটা!
-“জব হয়েছে নাকি? পার্টি কবে দিচ্ছো?”
মেয়ে’টা প্রিয়ম’কে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে প্রিয়মের গালে চুমু খেয়ে বলল,
-“কনগ্রাচুলাশন।”
প্রিয়ম মেয়ে’টার সাথে ইতস্তত বোধ করে কথা বলল। সরু চোখে তাকালো মোনার দিকে। মেয়ে’টার সাথে প্রিয়মের বলা কথায় মোনা বুঝতে পারলো মেয়ে’টা প্রিয়মের ক্লাসমেট।
মেয়ে’টা তড়িঘড়ি করে বলল,
-“আসছি। টাইম শর্ট।”
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর প্রিয়ম মোনার দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। মোনা কেমন প্রতিক্রিয়া করবে? প্রিয়ম ভীতি হচ্ছে। মোনার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বলল,
-“আমার ক্লাসমেট।” প্রিয়ম একটু থেমে মোনা’কে যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
-” প্লীজ মোনা তুমি আমায় ভুল বুঝো না। তুমি তো অনেকদিন ধরে থাকছো এখানে। তুমি তো এখন এখানকার মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানো। এঁরা এমনই মোনা।”
মোনার সাথে সম্পর্কের যেন অবনতি না ঘটে সেজন্য প্রিয়ম প্রাণপণে বুঝানোর চেষ্টা করছে। প্রিয়ম অস্থির হয়ে ওঠে। মোনা প্রিয়ম’কে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“আমি কিছু মনে করেনি। বুঝেছি মেয়ে’টা আপনার ক্লাসমেট। আপনার স্পেশাল কেউ হলেও আমার কিছু এসে যায় না।”
খুব সাবলীল গলায় বলল মোনা। কোন রাগ, অভিমান কিছুই নেই। প্রিয়ম মোনা’কে বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক।প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“সময় চেয়েছিলে না তুমি? সিদ্ধান্ত নিয়েছো? আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসলেও হ্যাঁ বলবে না।”
মোনা কোন উত্তর করলো না।মোনা’কে নিরুত্তর দেখে প্রিয়ম আবার বলল,
-“তুমি যদি আমায় বিশ্বাস না করতে না পারো তাহলে বিয়ে করি চলো।”
মোনা চমকালো। ভারি গলায় বলল,
-“আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিই নি। আমার একটু তাড়া আছে উঠতে হবে এখুনি।”
মোনা নিশান’কে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়।প্রিয়ম ওঁদের পিছু পিছু আসছে। মোনার কাছে এসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,
-“কোথায় যাবে?আমি পৌঁছে দিই?”
-“না,না দরকার নেই।”
প্রিয়ম জোর করতে লাগলো। মোনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো। সেখানে আপনি কি করতে যাবেন বলুন?”
প্রিয়ম আর কথা বাড়ালো না। মোনা নিশান’কে নিয়ে চলে গেলো। কতদিন পর জ্যাকের বাসায় আসছে। মোনা গিয়ে দেখে জ্যাক বাসায় না। জ্যাক’কে ফোন করে বলল মোনা তাঁর বাসায় এসেছে। জ্যাক অপেক্ষা করতে বলল, একটু বাদে আসছে সে। প্রিন্সেস’কে কোলে নিলো। গালে গভীর আবেগে চুমো খেলো। মোনা প্রিন্সেস’কে বলল,
-“Say Father.”
প্রিন্সেস স্পষ্ট ভাবে বলল। প্রিন্সেসের মুখে কথা শুনে মোনা আনন্দিত হয়ে গেলো। মোনা দ্বিগুণ উৎসাহি হয়ে বলল,
-“say Mother.”
প্রিন্সেস আগের ন্যায় বলল। মোনা হাসলো। এর ভিতর জ্যাক আসলো। কফি খেতে খেতে গল্প করলো অনেকক্ষণ। তারপর বাসায় ফিরলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here