#মেঘের_পালক
পর্ব-৬
কী দারুণ একটা দিন ছিল! ভজঘটটা কোথায় লাগল ঠিক বোঝা গেল না। অরিনের সাথে সকালেও কথা হয়েছে প্লাবনের। সব ঠিক ছিল, হুট করে এমন করছে কেন মেয়েটা? যা ভয় ছিল সেটাই হয়েছে? বাজির কথা কি বলে দিয়েছে অর্নব? আরও কয়েকবার অরিনের মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করল প্লাবন। ফোন ঢুকল না৷ খুবই বিরক্ত হয়ে লাথি দিয়ে একটা ইট সরালো সে। কী করা যায়?
অর্নবকেই ফোন করল এবার।
“ইয়েস ব্রো!”
ওর কথা বলার ভঙ্গিটাই পছন্দ না প্লাবনের। সবসময় যেন ফুর্তির মুডে থাকে।
বিরক্ত স্বরে সে বলল, “তুই কোথায়?”
“আপাতত ড্রাইভ করে ক্লাবে যাচ্ছি।”
“তুই ওকে কী বলেছিস?”
“কাকে?”
“অরিনকে!”
“ও বাবা! এত তাড়াতাড়ি ‘ও’ হয়ে গেল?” খিকখিক করে হেসে উঠল অর্নব।
“হাসবি না। ফোন রেখে হাসিস। এবার বল কী বলেছিস।”
“যা সত্যি তাই!”
“আমি কি তোকে নিষেধ করিনি?”
“করেছিলি। মনেও ছিল। কিন্তু তোর নখরা কুইন আমার সাথে চোটপাট করছিল বলে সব ফাঁস করে দিয়েছি।”
“তুই একটা ফালতু।”
“হয়তো কথা সত্যি, হয়তো সত্যি না..” গানের সুরে বলল অর্নব।
প্লাবনের মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গেল। সে চাইছিল নিজে পুরো ব্যাপারটা অরিনকে খুলে বলবে, কিন্তু কিসের কী?
প্লাবন চুপ করে আছে বলে অর্নব বলল, “ব্রো! এবার একটু বল তুই অরিনের মধ্যে এমন কী দেখলি? আমার কিউরিওসিটি মেটা! মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভেবে।”
“তুই ভাবা বন্ধ কর মাথামোটা!”
মাথামোটা বলার কারনে অর্নব কিছু মনে করল না। তার মাথাটা একটু মোটা এটা সে জানে, কিন্তু মনটা তো বড়। সেই মনে জায়গারও অভাব নেই। বিশেষ করে মেয়েরা অনায়েসে ঢুকে যেতে পারে। এমনকি অরিন আগ্রহ দেখালে সে মোটেও মানা করত না। মেয়েটার মধ্যে এক ধরণের চার্ম আছে। কিন্তু তাই বলে প্লাবনের মতো একটা ছেলের পাগল হওয়ার মতো কী আছে? তার এবার সত্যি ভাবনা বাদ দেয়া উচিত। সে আবার রিলাক্স মুডে ফিরে গিয়ে বলল, “ওকে ব্রো! চিল! আমি কাল সব ফিক্স করে দেব।”
শেষ কথাটা শুনতে পেল না প্লাবন। তার আগেই ফোন রেখে দিয়েছে সে।
প্লাবন বাইক নিয়ে এসেছিল আজ। চেয়েছিল বাইকে ঘোরাবে অরিনকে। বোধহয় সবকিছু একটু বেশিই তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছিল। বোধহয় না, সত্যি তাড়াহুড়ো করে ফেলছিল সে। একটা প্রেমের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। হুটহাট হয়ে যায় না। একদিনে বেশি মাখো মাখো প্রেম করতে গিয়ে দ্বিতীয় দিয়ে ধরা! গতকালকে রয়েসয়ে কথা বললে আর পার্টির ব্যাপারে খানিকটা আলোকপাত করলে হয়তো আজ অরিন ফোন ধরত।
যাহোক, এখন আর কিছু করার নেই। যা করার রাতে করতে হবে।
প্লাবন বাড়ি ফিরে গেল। মা ওকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “চলে এলি? বলেছিলি যে দেরি হবে?”
“দেরি হলে খুশি হতে নাকি?”
“এভাবে কথা বলছিস কেন? কী হয়েছে তোর?”
“কিছু না তো মা। হাতমুখ ধুয়ে আসছি। আজ তোমার সাথে বসে সিরিয়াল দেখব।”
প্লাবনের মা মনোয়ারা হাসলেন। ছেলের মতিগতি জানা আছে। মন খারাপ থাকলেই মায়ের আঁচলের তলায় লুকোতে আসবে। পাগল একটা! মনোয়ারা ভেবেছিলেন আজ নাস্তা বানাবেন না। কিন্তু প্লাবন ফিরে আসায় সিদ্ধান্ত বদলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। চটপট নুডলস করে ফেললেন। এটা দেখলে ছেলের মন হয়তো একটু ভালো হবে!
★
অরিন সেই যে ক্লাসে ফোন সাইলেন্ট করেছিল এখনো সাইলেন্ট আছে। ইচ্ছে করে ফোনের ধারেকাছেও যায়নি৷ গেলেই হয়তো দেখবে প্লাবন ফোন করেছে, তখন ধরতে ইচ্ছে করবে।
সে সময় কাটাবার জন্য টিভির সামনে বসে গেল। ভারতীয় সিরিয়াল চলছে। নায়কের হাতের পূজোর থালা থেকে সিঁদুর উড়ে গিয়ে নায়িকার মাথায় পড়েছে। তাদের নাকি তাতে বিয়ে হয়ে গেছে। রাজ্যের ক্যাচাল লেগেছে বিয়ে নিয়ে। অরিনের মজাই লাগল বিষয়টা৷ প্রত্যেকের ঝগড়া সে মন দিয়ে দেখল। কেউ কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে না। আর সবচেয়ে মজার কাহিনীটা করল নায়িকা। সে এক পর্যায়ে রণমুর্তি ধারণ করে নায়কের কাছে এসে তার হাত টেনে ধরে বলল, “ও আমার স্বামী। আজ থেকে আমি ওর সাথেই থাকব।”
দৃশ্যটা দেখে একটু লজ্জাও পেল অরিন। তারও তো অনেকটা এমন করেই প্রেম হয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেয়া! তারপর তার নিজেরও গলে যাওয়া, হাত ধরা…উফ! সে উঠে পড়ল। আর প্রেম টেম দেখবে না সে। একটা মারামারি কাটাকাটি থ্রিলার দেখা গেলে ভালো হতো। কী দেখবে? জোম্বির মুভি? খুব ভালো হয়! সে ল্যাপটপ খুলে খুঁজতে লাগল কোন মুভিটায় অনেক বেশি রক্তারক্তি আছে।
★
প্লাবন মায়ের কোলে মাথা রেখে সিরিয়াল দেখছে। ভারতীয় সিরিয়াল। সিঁদুর উড়ে গিয়ে হয়ে যাওয়া বিয়ে। নায়িকার সাহসী পদক্ষেপ দেখে প্লাবন একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা, সব মেয়ে কি এমন হয়?”
মা বিরস মুখে বললেন, “আরে না। এর জায়গায় বাস্তবের মেয়ে হলে কেঁদে মন্দির ভাসিয়ে দিত।”
“আর সাহসী মেয়ে হলে?”
“কে জানে! করতেও পারে এমন। কেন তুই কি এমন মেয়ে দেখেছিস?”
“না তা না।”
“তাহলে?”
“মেয়েরা আসলেই এমন হয় না। এরা কোনো কথা পুরোপুরি শুনতে চায় না। আধা জেনে রাগ করে বসে থাকে।”
মা প্লাবনের কান টেনে বললেন, “কোন মেয়ে রাগ করেছে শুনি?”
“এইযে তুমি করছো।”
“এহ..আমি রাগ করলাম কখন? সত্যি কথা বল?”
“মা এখন বিষয়টা অনেক ক্রিটিকাল পর্যায়ে আছে। নৌকা চলে গেছে বিশাল ঢেউয়ের নিচে। হয় ডুববে, নয়তো ভেসে উঠবে। কোনটা হবে এখনো আমি জানি না।”
মা প্লাবনের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “মেয়েটা কেমন দেখতে রে?”
প্লাবন একটু উদাস গলায় বলল, “নিচতলার কাজের বুয়ার মতো।”
মা খিলখিল করে হেসে ফেললেন। প্লাবন বলল, “সব ঠিক হয়ে যাক, তারপর তোমাকে সব বলব, ছবি দেখাব, তার সাথেও দেখা করাব।”
“আচ্ছা। কবে থেকে চলছে এসব?”
“অর্নবের পার্টি থেকে।”
“ওমা! সেটা তো পরশু গেল।”
“সেদিন থেকেই।”
“এত তাড়াতাড়ি?”
“বেশি তাড়াতাড়ি হয়েছে বলেই গুবলেট হয়ে গেছে। সব অর্নবের দোষ। বাদ দাও, চলো নাটক দেখি।”
টিভিতে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। যে নায়িকা স্বামী বলে হাত টেনে সবার সামনে থেকে নিয়ে এসেছিল, সেই মেয়ে বাসর ঘরে মুখ পাথরের মতো করে বলছে, “আমি আপনার সাথে শোবো না। আপনার ঘরে কোলবালিশ নেই কেন?”
প্লাবন উঠে বসে বিরক্তির স্বরে বলল, “সব মেয়ে একই। হোক বাস্তবে, হোক সিরিয়ালে!”
(চলবে)