#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”৩২”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মেহরীন স্থীর দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আজ যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে সে। তাকে কখনো এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তা হয়তো মেহরীন কল্পনাও করেনি।
ইরফান চায়নি এভাবে অনন্তর সত্য মেহরীনের সামনে আসুক। আজকের এই ঘটনার পর যে মেহরীন তাকেও ভুল বুঝবে এটার কোন সন্দেহ নেই। মেহরীনকে আপন করে নেওয়ার আগে সে অনন্ত আর তার ডিলের কথাটা জানাত। কিন্তু কিছু জানানোর আগেই মেহরীন অপ্রত্যাশিত ভাবে সব জেনে ফেলল। এক দিক দিয়ে ভালোই হলো। মেহরীন হয়তো অনন্তর এই নিকৃষ্ট চেহারার কথা তার মুখে শুনে বিশ্বাস না-ও করতে পারত।
আজ নিজের চোখে দেখে, নিজের কানে শুনে অবিশ্বাস করার কোন অবকাশ রইল না।
অনন্তর মাথা ফাঁকা লাগছে। রাগের মাথায় সে যা যা বলেছে মেহু সব শুনে নিয়েছে!
অনন্ত তাড়াহুড়ো করে মেহরীনের কাছে আসতে নিলে চেয়ারে ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে গেল। হাতে পায়ে ব্যথা পেলেও সে ব্যথা তোয়াক্কা না করে আবার উঠে দাঁড়াল।

“মেহু তুই যা যা শুনেছিস কিছুই সত্যি না। আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি মেহু। আমি তোকে সব বুঝিয়ে বলছি।”

মেহরীন সব কিছু জেনে গেছে এটা জানার পরও অনন্ত যেভাবে সাফাই দিতে চাইছে এটা দেখে ইরফান সত্যিই বিস্মিত হলো। একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া হলে এমন করতে পারে। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ কাজ করছে না! আশ্চর্য!

” সব, সব এই ইরফানের কারসাজি। ও আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। তোর চোখে আমাকে ভিলেন সাজাতে চাইছি।”

একটু আগে মেহরীন অনন্তর মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে যা যা শুনেছে, ওসব শোনার পর আর কিছু শুনেই সে অবাক হবে না। অনন্ত তার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে। তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনি। বরং সরাসরি তাকে দুশ্চরিত্রা বলে আখ্যায়িত করেছে।
ইরফান অনন্তর আস্পর্ধা দেখে নিজেকে রুখে রাখতে পারল না। হুংকার দিয়ে সে বলে উঠল,

“স্কাউন্ডেল! তুই এখনও মিথ্যা বলে যাচ্ছিস।”

“মেহু দেখ। দেখ মেহু। কেমন আমাকে তেড়ে মারতে আসছে। ও আমাকে ভয় দে…

মেহরীন আর সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে কান চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,

” চুপ। চুপ করো তুমি। আমি অন্ধ বা কানে কালা নই। আমি কানে শুনতে পাই, চোখে দেখতে পাই। তোমাদের সব কথাই আমি এখান থেকে শুনতে পেয়েছি। দয়া করে আমাকে আর কিছু বোঝাতে এসো না। তুমি আমাকে ভালোবাসো! তুমি? হাহ্, তুমি কখনও আমাকে ভালোবাসতে? ভালোবাসা কী জানো তুমি? যাকে ভালোবাসো বলে দাবি করো তার চরিত্র সম্পর্কে এত জঘন্য কথা বলতে তোমার মুখে বাঁধলো না! আমি শারীরিক চাহিদার জন্য তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতাম! এই কথা বলার আগে একটা বারও ভাবলে না তুমি! তোমার মত মানুষকে একসময় আমি ভালোবাসতাম এটা ভেবে এখন নিজের উপরই ঘৃণা লাগছে। মানুষ চিনতে এতটা ভুল করলাম আমি! আমাদের এক বছরের সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল না এটা তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তুমি তো আমাকে একটা মেয়ের সম্মানও দাও নি। আরে তুমি তো আমাকে মানুষই মনে করোনি। বাজারে বেচা পণ্যদ্রব্যের মত তুমি আমার দরদাম করেছ। আমার আড়ালে তুমি আমাকেই অন্য একটা লোকের কাছে বেচে দিলে! যাকে নিয়ে, যার জীবন নিয়ে এত বড় খেলা খেলছো তাকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না। আমি কী চাই তা একবারও ভাবলে না।”

এতক্ষণ মেহরীন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে কথাগুলো বলেছে। এবার তার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগল। ইরফানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলব,

“আমার জীবন নিয়ে দরদাম করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? আমাকে নিয়ে বেচাকেনা করার আপনারা কে? আমি কাউকে এতটা অধিকার দেইনি যে, কেউ আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেবে। সেখানে আপনারা তো আমাকে নিয়ে বাজার বসিয়ে দিয়েছেন। আমার জীবনটাকে নাটকের থেকেও নাটকীয় বানিয়ে তুলেছেন। এভাবে নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা না করে আমাকে নিলামে তুলে দেখতেন। হতে পারত এর থেকেও বেশি দাম পেতেন। আচ্ছা আমি তার থেকেও ভালো একটা আইডিয়া দিই? আপনাদের দু’জনেরই লাভ হবে। আমাকে নিয়ে দালালী শুরু করেন না কেন আপনারা? আপনারা দু’জন নতুন নতুন কাস্টমার খুঁজে আনবেন, আমি ভালো সার্ভিস দেব। এতে আমার চাহিদাও মিটবে। কী বলেন?”

মেহরীনের এসব কথা শুনে ইরফানের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সে এগিয়ে এসে মেহরীনের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল,

“অনেক হয়েছে। আর একটা কথা বলবে না তুমি। নিজেকে নিয়ে এরকম নোংরা কথা বলার সাহস হলো কী করে?”

মেহরীন ধাক্কা দিয়ে ইরফানকে পেছনে সরিয়ে দিল।

“কেন? আপনারা করতে পারলে আমি কেন বলতে পারব না। আপনি তো আমাকে কিনেই নিয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে কাউকে কিনে নিলে তাকে কী বলবে? বউ নিশ্চয়ই বলে না। আমি আপনার রক্ষিত…

” বিয়ে করেছি আমি তোমাকে। তুমি আমার বউ, বুঝেছ তুমি? তোমার পরিচয় তুমি আমার বউ।”

“বিয়ে বিয়ে নাটক করতে গিয়ে সত্যিকারে বিয়ে করে ফেঁসে গেলেন। এই বিয়ের কোন দাম আছে নাকি?”

অনন্তর জন্য এটা আকাশ থেকে পড়া খবর ছিল। মেহু আর ইরফানের বিয়ের ব্যাপারে এতদিন সে কিছুই জানত না। সত্যিকারে বিয়ে হয়েছে মানে? মেহু তো ওকে কিছুই বলেনি। ওরা কি তাহলে এতদিন স্বামী স্ত্রী হয়ে থেকেছে!
অনন্তকে এখন উন্মাদের থেকে কম লাগছে না। সে ইরফানকে ঠেলে সরিয়ে মেহুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“সত্যিকারে বিয়ে মানে? কী বলছিস তুই? তোরা স্বামী স্ত্রী! আমাকে এতদিন কিছু জানাসনি কেন? মেহু তুই আমার থেকে এই কথাটা লুকাতে পারলি।”

মেহরীন অনন্তর কথা কানেই নিল না। এই নোংরা লোকের মুখ দেখলেও তার বমি পাচ্ছে। এতকিছু করার পর এখনও তার উপর কেমন অধিকার দেখাচ্ছে।
এই পৃথিবীতে মেহরীনের আজ সত্যিই আপন বলতে কেউ রইল না। ও যাকেই ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, সে-ই তাকে ঠকায়৷ ধোঁকা দেয়। দু’জন মানুষ তার বিশ্বাস যেভাবে ভেঙেছে এর পর হয়তো মেহরীন আর কাউকে বিশ্বাসই করতে পারবে না। বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভরসা শব্দ গুলোর উপর তার ভয় কাজ করবে। জীবনে যেন আর ঠকতে না হয় সে ভয়ে একাই থেকে যাবে।
কাঁদতে কাঁদতে মেহরীন নিচে বসে পড়ল। তার মনটা আজ এতটা খন্ডে ভেঙেছে যে, সে চাইলেও আর টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জোড়া লাগাতে পারবে না। গতরাতেই সে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিল, তার এই সুখ যে দীর্ঘস্থায়ী হয়। উপরওয়ালার কাছে চাওয়ার সময় সে ভাবতেও পারেনি, আসলে সে সেটাকে সুখ ভাবছে সেটা শুধুই মরীচিকা। সুখ তার কপালে আল্লাহ কখনো লিখেইনি। যা কপালে লিখা নেই সেটাই সে আল্লাহর কাছে চাইছে।
মেহরীন একেবারে ভেঙে পড়েছে।

” তোমাকে ঠকিয়েছি ভেবে আমি রোজ রোজ একটু একটু করে মরছিলাম। কোন অনুতাপের আগুন আমাকে জ্বালাচ্ছিল তা তুমি জানো না। আজ তোমার সত্য আমার সামনে না এলে আমি হয়তো সারা জীবনই নিজেকে অপরাধী ভেবে যেতাম। ভালোই হয়েছে তুমি তোমার আসল রূপ দেখিয়ে দিলে। এই কয়টা দিন আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। দম বন্ধ হয়ে ছিল আমার। আজ অন্তত এটা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারব যে, আমি কাউকে ঠকাইনি। আমার জন্য কারো জীবন নষ্ট হয়নি। কারো কষ্ট বা চোখের জলের কারণ আমি নই।”

কথাগুলো বলার সময় মেহরীনের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। কত কষ্ট তার আগে কখনও হয়নি। সব সময়ই সর্বহারা ছিল সে৷ যে কয়বারই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ততবারই তার স্বপ্ন ভেঙেছে। হতদরিদ্র বাবা মা’র ঘরে জন্ম নিয়েছে। বাবা তাকে দূরে ঠেলে দিলে নতুন বাবা মা পায় সে। যারা ওর হাত ধরে তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে। মাঝপথে উনারা তার হাত ছেড়ে দিলে অনন্ত আসে তার জীবনে৷ যে আবার তার হাতটা ধরেছিল। ইরফানের সাথে দেখা হওয়ার পর মেহরীন ভেবেছিল সে হয়তো হাঁটতে হাঁটতে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু না। আজ সামনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে এখনও পুরো পথই বাকি আছে। অথচ তার হাতটা ধরে চলার মত আর কেউ নেই।

“আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। চোখ কান বুজে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম। আপনি কখনও আমার সাথে এমনটা করবেন এটা ভাবিনি বলেই হয়তো আজ এত বেশি কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আপনি তো আইনের লোক ছিলেন। একবার এটাও ভাবলেন না, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে দু’জনই সমান অপরাধী। আপনি নিজের পরিবারের কথা ভেবে একটা মেয়ের সাথে অন্যায় করছেন, এটা কেন ভাবলেন না? আপনাদের দু’জন থেকে আমি কাকে বেশি অপরাধী সাব্যস্ত করব? যে আমার বিশ্বাস ভেঙে আমাকে বাজারে নামিয়েছে? নাকি যে আমার বিশ্বাস ভেঙে আমাকে কিনে নিয়েছে।”

তিনজন মানুষের মুখেই কোন কথা নেই। তিনজনে মনেই কি সমান তালে ঝড় বয়ে যাচ্ছে?
মেহরীন পড়ে পড়ে অনেক কাঁদল। চোখের পানি ফেলে কষ্ট কম করতে চাইছে হয়তো। ইরফান মেহরীনকে সামলাতে পারছে না। তার সেই অধিকার থেকেও নেই। অনন্তর মত ইরফানও সমান অপরাধী।
চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল মেহরীন।
অনন্তর উদেশ্যে বলল,

“আমার দেখা পৃথিবীর সবচে নিকৃষ্ট মানুষটি হচ্ছ তুমি। তোমাকে আমি কখনও ক্ষমা করতে পারব না। তোমার সাথে কখনও আমার কিছু ছিল এটা মনে পড়লেও হয়তো আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাইব। মনুষ্যত্ব তোমার মাঝে নেই। তবুও একটা অনুরোধ করছি। পারলে এই শেষ অনুরোধটা রেখো। এই জীবনে কখনো আমার সামনে এসো না। তোমাকে আমি এতটাই ঘৃণা করব যে, আজকের পর থেকে তোমার নামটা শুনলেও আমি এক দলা থুতু ফেলব।”

মেহরীনের ঘৃণা ভরা কথাগুলো শুনে অনন্ত বাকরূদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেহুর ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচতে পারবে না।

“আপনাকে আমি শুধু একটা কথাই বলব। আপনি ভীষণ স্বার্থপর একটা মানুষ। নিজের পরিবারের সামনে অন্য কারো অনুভূতি আপনার চোখে পড়ে না। মৃত স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে আপনাকে আমি মনে মনে কতটা সম্মান দিয়েছিলাম তা শুধু আমিই জানি। আজ বুঝতে পারছি সেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য না আপনি। হামনাকে যদি প্রকৃত ভালোবাসতেন তাহলে অন্ততপক্ষে হামনার চেহারার অন্য একটা মেয়ের সাথে এরকম করার আগে একবার ভাবতেন।”

এটুকু বলে মেহরীন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।

“আয়ামকে আমি সেই প্রথম থেকেই নিজের সন্তান ভেবে এসেছি। ওর সাথে কোন সম্পর্ক না থাকলেও অদৃশ্য একটা মায়া ওর প্রতি কাজ করত। ওকে ছাড়া থাকতে সত্যিই আমার অনেক কষ্ট হবে। ওর মুখ থেকে মা ডাক…

মেহরীন কান্নার কারণে আর কথাই বলতে পারছে না। ইরফান পাথর হয়ে চেয়ে আছে। এসব কথার মানে কি মেহরীন তার বাড়িতে আর ফিরবে না? তাদের ছেড়ে মেহরীন চলে যাবে? মেহরীনকে ছাড়া আয়াম কীভাবে থাকবে? মেহরীন চলে যাবে এটা ভেবে বুকের ভেতর এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here