#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২৮”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
“মেহু তুই আমার সাথে দেখা কর প্লিজ। প্লিজ মেহু আজ একটু সময়ের জন্য আয়।”
অনন্তর কাকুতিমিনতি ভরা কন্ঠ শুনেই মেহরীনের বুকের ভেতর চিন করে উঠল। সে কীভাবে অনন্তর সামনে যাবে? অনন্তর অপরাধী সে। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে তার দ্বারা। বেচারা অনন্ত তাকে মনে প্রাণে ভালোবাসলেও সে এখন ইরফানকে চায়। নিজের মনটাকে কেটে কুচি কুচি করে লবণ মরিচের গুড়া লাগিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মন কেন তাকে এভাবে ধোঁকা দিল। সে তো এতদিন ভাবত অনন্তকেই সে ভালোবাসে। বিয়েও করতে চেয়েছিল। এখন হঠাৎ মন যে অন্য একজনকে চাইবে এটা সে জানত নাকি? সব দোষ মনের।
মেহরীন ইতস্তত করে বলছে,
“অনন্ত, আজ কীভাবে…না মানে বাড়িতে কী বলে বের হবো?”
অনন্ত করুণ গলায় বলল,
“আয় না মেহু। কতদিন ধরে তোর মুখটা দেখি না। বুকে বড্ড কষ্ট হয় রে। তুই জানিস না আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। আসলে নিজের ভালোবাসা তো কোনো দিনও প্রকাশ করতে পারিনি। তুই-ই সব সময় ভালোবাসার কথা বলে গেছিস। আমি নীরবে শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি আমি কত বড় ভুল করেছি। ভালোবাসার কথা মনের ভেতর চেপে রাখতে নেই। সেটা সঠিক সময়ে মানুষটার সামনে তুলে ধরতে হয়। নইলে পরে এর কোন মূল্য থাকে না।”
অনন্ত কথা বলতে থাকলেও মেহরীন তার কথা শুনছে কই? সে তো ইরফানের ভাবনায় মগ্ন। মেহরীনের নিজেই সত্যিই ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।
“মেহু, আসবি তো?”
“দেখি। আমি আসার চেষ্টা করব। আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে। আজ দেখা হলে সব বলব।”
“আচ্ছা। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই আসিস কিন্তু। আমাদের সেই প্রিয় জায়গায়।”
“হুম।”
মেহরীন কল কেটে দিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার দম নিল। দেখা হলে অনন্তকে কীভাবে কথাটা বলবে, এই ভেবে এখন থেকেই তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আজ অনন্তকে এটাও জানাবে সে যে, তার আর ইরফানের বিয়েটা নকল না। আসলেই তাদের বিয়ে হয়েছে। ভুল করে হলেও এটাই সত্যি। সে বাস্তব অর্থেই ইরফানের স্ত্রী।
“স্ত্রী! উনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেনই তো না। তাহলে কোন অধিকারে এই বাড়িতে থাকতে চাইছি আমি? আমার উচিত উনাকে ডিভোর্স দিয়ে অনন্তর কাছে ফিরে যাওয়া। ওকে ঠকাতে চাই না আমি।”
মেহরীন এক মিনিট ভাবল।
“কিন্তু ওকে কিছু না জানালেও তো এক দিক দিয়ে ওকে ঠকানোই হবে। আমি সে আগের মেহু নেই। তার প্রতি এখন আমার সেরকম অনুভূতি কাজ করে না। আমি ইরফান নামের মানুষটার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। এটা অনন্তকে না জানিয়ে ওর সাথে থাকলে ওকে আরও বেশি ঠকানো হবে। মনে মনে অন্য একজনকে চেয়ে বাহিরে আমি কোন ভাবেই ওর সাথে সুখী থাকতে পারব না।”
পায়চারি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মেহরীন। কয়েকটা দিন ধরে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। মাথা যথেষ্ট খারাপ হয়েছে তার। আর না। এবার অনন্তকে সব বলেই দিবে। তারপর যা হবার হবে। তবুও এই মানসিক চাপ সে আর নিতে পারবে না। এখন সবথেকে ভালো হবে তিনজন মুখোমুখি কথা বললে। অনন্তকে জানাবে, সে ইরফানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। ইরফান যদি তাকে গ্রহণ না করে। তাহলে যদি অনন্ত তাকে ফিরে পেতে চায় তবে সে অনন্তর কাছে ফিরে যাবে।
“কোনো কিছুই এখন আর আমার হাতে নেই। সব সম্পর্ক আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। নিজেকে অপরাধী ভেবে সব বোঝা নিজের উপর নিতে পারব না আমি। মনের উপর কারো জোর চলে না। এটা অনন্তকে বুঝতে হবে। উনাকে ভালো না বাসার আমি অনেক চেষ্টা করেছি। তবুও মনকে আটকে রাখতে পারিনি। মন নিষিদ্ধ জিনিসের দিকেই দৌড়ে গেছে। এর জন্য ইরফান, অনন্ত কেউই আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”
.
অনন্ত মেহরীনের জন্য প্রায় এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে। মেহরীন এখনও আসছে না দেখে বিরক্তই হচ্ছে সে। মেহরীন কি তাকে অবহেলা করছে আজকাল? দূর থেকে মেহরীনকে আসতে দেখে অনন্ত মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল। আজ তার অভিনয়ের উপর অনেককিছু নির্ভর করছে। মেহরীনকে ঠিকঠাক বুঝাতে পারলে ইরফান তার আর কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু তার জন্য সবার আগে ওকে মেহরীনের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। কাজটা অতটা সহজ না হলেও তাকে পারতেই হবে। তার আর মেহরীনের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। অনন্ত মুখের মধ্যে বেচারা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
দূর থেকে অনন্তকে দেখেই মেহরীনের হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেল। আজ সে যা বলতে এসেছে সেটা শুনে অনন্ত নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে তো? তার ভয় হচ্ছে অনন্ত যদি রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে! না,না৷ মনে কোন বাজে চিন্তা আসতে দিবে না সে। সব ভালোই হবে। ভালো ভালো চিন্তা করবে সে। বুক ভরে দম নিয়ে মেহরীন সামনে এগিয়ে আসছে।
মেহরীন অনন্তর সামনে এসে দাঁড়ালে সাথে সাথে টুপ করে অনন্তর গাল বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মেহরীন হঠাৎ অনন্তকে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। সে ব্যস্ত গলায় জানতে চায়,
‘কী হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছো কেন? অনন্ত কী হয়েছে আমাকে বলো।”
অনন্ত মেহরীনের হাত চেপে ধরে বলে,
“মেহু তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি। তোকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।”
মেহরীন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে অবাক গলায় বলল,
“এসব কী বলছো তুমি? কী হয়েছে তোমার বলবে তো।”
“আমি তোকে হারিয়ে ফেলছি। একজন আমার থেকে তোকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে। কেড়ে নিচ্ছে তোকে আমার থেকে।”
“কে কেড়ে নিচ্ছে! কোথায় দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? আমি তো তোমার কাছেই আছি। কেউ দূরে সরিয়ে দেয়নি। দেখো আমি তোমার পাশেই আছি।”
“সে আমাকে বলেছে। আমার থেকে তোকে ছিনিয়ে নেবে। তার ক্ষমতার কাছে আমি কিছুই না মেহু। ওর সাথে আমি পেরে উঠব না। ওর অনেক টাকা আছে। আমার কাছে তো কিছুই নেই। তোকে ধরে রাখার লড়াইয়ে আমি হেরে যাব।”
মেহরীনের এবার সত্যি সত্যিই রাগ লাগছে। অনন্ত এসব কেন বলছে? কারো টাকা থাকলেই কি সে তাকে ছেড়ে ওই লোকের সাথে চলে যাবে! টাকার কথা, ক্ষমতার কথা কেন আসছে। আর কে এই লোক? যে তাকে টাকার জোরে পেতে চাইছে! সে কি এতই সস্তা! বাজারের পন্য সে? তাকে নিয়ে দরদাম করার অধিকার সে কাউকে দেয়নি।
“কে সেই লোক বলো? কে তোমাকে এসব বলেছে?”
অনন্ত কান্নার তোড়ে কথা বলতে পারছে না যেন। সে মেহরীনের হাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মেহরীন ওর পাশে বসে, ওর পিঠে হাতে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“একটু শান্ত হও। তুমি অতটা ভেঙে পড়ছো কেন? কেউ বললেই তো আমাকে তার করে নিয়ে যাচ্ছে না। আমার মতামতের কি কোন দাম নেই? আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ আমাকে কীভাবে পাবে বলো?”
“তুই আমাকে ছেড়ে যাস না মেহু।”
“আহা! তুমি এসব কথা বারবার কেন বলছো? তুমি ওই মানুষটার নাম বলো না। আমিও দেখি কে সেই লোক।”
“বললে তুই বিশ্বাস করবি? আমার কথায় বিশ্বাস হবে তোর?”
“আশ্চর্য! কেন হবে না। আমি না কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে, কে কী বলেছে আমাকে বলো না প্লিজ। এই অনন্ত…
” ইরফান…
নামটা উচ্চারণ করে অনন্ত মেহরীনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ওর মুখের দিকে তাকাল।
অনন্তর মুখে ইরফানের নাম শুনে মেহরীনের সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না। যে মানুষকে সে নিজে ভালোবাসার কথা বলেছে। তার অনুভূতির কথা জানার পরও যে মানুষটা চুপ থেকেছে। তাকে কিছু না বলে সরাসরি ফিরিয়ে দিয়েছে, আজ সেই মানুষ তাকে টাকার জোরে পেতে চাইবে! এটাও কখনো হওয়ার! ইরফান চাইলে সেদিনই তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে পারত। ধর্মমতে, আইনগত ভাবে সে এখনো ইরফানের স্ত্রী। তবুও ইরফান তাকে গ্রহণ করেনি। সে হামনাকেই ভালোবাসে। মেহরীন চেষ্টা করেও হামনার জায়গা নিতে পারেনি।
“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। উনি তোমাকে এসব বলেছে! নিজের মুখে! ”
“দেখলি তুইও বিশ্বাস করছিস না। আমি জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না। লোকটাকে বাইরে থেকে যতটা ভালো মনে হয় আসলে সে ভেতর থেকে তেমন না। উনি সম্পূর্ণ আলাদা। আমিও প্রথমে উনাকে একজন ভদ্র, ভালো লোক ভেবেছিলাম। আমি কখনও ভাবিনি উনি আমাদের জীবনের সাথে এভাবে গেম খেলবে। তোর উপর উনার লোভ জন্মেছে।”
অনন্তকে আর বলতে দিল না। মেহরীন কান চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল।
“চুপ করো তুমি। প্লিজ চুপ করো। আমি আর এসব কথা শুনতে চাইছি না।”
“তুই শুনতে না চাইলেও এটাই সত্যি মেহু। আমরা মানুষকে যেমন ভাবি সব সময় তারা তেমন হয়না। আমাদের সামনে থাকলেও অনেক কিছুই চোখের আড়ালে থেকে যায়। তেমনি ইরফানের অনেক সত্যিই তোর অজানা। তুই কিছুই জানিস না ওই লোকের সম্পর্কে।”
“হ্যাঁ জানি না। আর জানতেও চাই না।”
“আমার থেকে তুই ওই লোকটাকে বেশি বিশ্বাস করছিস মেহু? কতদিন ধরে তুই ওই লোককে চিনিস? কী কী জানিস ওর সম্পর্কে? আমাকে সম্পর্ক কতদিনের? আমার উপর তোর ভরসা নেই? আমি তোকে মিথ্যা বলব।”
“জানি না। কিছুই জানি না আমি। তোমাকে অবিশ্বাসও করছি না। আবার তোমার কথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। উনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। তুমি যা বলছো উনি তেমন মানুষই না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“আমার ভুল হচ্ছে! আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তোর! আচ্ছা ঠিক আছে। প্রমাণ দেখাতে পারলে তখন বিশ্বাস করবি তো? আমার কাছে প্রমাণ আছে।”
তারপর অনন্ত মেহরীনকে যা শোনালো, তা শোনার পর মেহরীনের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। পুরো আকাশটাই যেন তার মাথায় ভেঙে পড়েছে। সে কোনোভাবেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইরফান এসব বলেছে! এগুলো ইরফানের কথা! সে যাকে ফেরেশতা ভাবতো সে তো শয়তানের থেকেও নিকৃষ্ট।
এই মানুষকে ভালোবেসে নিজেকে এর হাতে সপে দিতে চেয়েছিল সে! এই লোকের জন্য অনন্তকে ঠকাতে যাচ্ছিল সে! নিজের সবটা দিয়ে একে ভালোবেসেছে সে! বড্ড ভুল করে ফেলেছে।
.
মেহরীন চলে গেলে অনন্ত চোখ মুছলো। আহ! চোখে কী এক ছাতা দেওয়ার পর থেকে সমানে চোখ জ্বলছে। যাক ভালোই হয়েছে। নইলে মেহুর সামনে এভাবে কাঁদতে পারত না। আজ তার চোখের পানি অনেকটা কাজ করে দিয়েছে। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। সে তো আজ ভাসিয়ে কেঁদেছে।
অনন্ত হাসতে হাসতে বলল,
“ইরফান পেশায় তুমি উকিল হতে পারো। কিন্তু শয়তানি বুদ্ধিতে তুমি কখনও আমার আগে যেতে পারবে না। আগে কী? তুমি আমার সমান সমান হয়ে দেখাও তো। শয়তানের সাথে লড়তে গেলে নিজেকে আগে শয়তানের লেভেলে নামিয়ে আনতে হয়। তুমি কখনও নিজেকে আমার লেভেলে নামিয়ে আনতে পারবে না। তাই এই বুদ্ধির খেলায় আমারই জয় হবে। তুমি ভাবতেও পারবে না কোন দিক দিয়ে আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি।”
অনন্ত মন ভরে হাসছে। আজ হাসি থামাতে পারছে না সে। এই জেদাজেদির খেয়াল সে জিতে গেছে। ইরফানকে হারিয়ে দিয়েছে সে।
“বাংলাদেশে এখনো অনেক ট্যালেন্টেড মানুষ আছে। ধন্যবাদ দোস্ত। তোর গলার জোরে আজ আমার এতবড় জিত হলো। ইরফানের গলা তুই এতটা পাকা ভাবে নকল করতে পারবি তা আমারও কল্পনার বাইরে ছিল। এসব শোনার পর মেহু আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য। আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। এখন শুরু আগুনে ঘি ঢালার কাজটা চালিয়ে যেতে হবে।”
চলবে___
ফোন চুরি হয়ে গেছে। তাই এতদিন গল্প দিতে পারিনি। অনেকে হয়তো জানেন, অনেকে জানেন না। পেইজে, আইডিতে মেসেজ দিয়েছেন। গ্রুপে জয়েন থাকলে অবশ্যই জেনে যেতেন। যারা আমার গল্প পড়েন, সবাইকে বলছি আমার গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন। গল্প সম্পর্কিত সময় আপডেট গ্রুপে পেয়ে যাবেন।
আপনাদের এতো এতো ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই মুগ্ধ।
এখন থেকে রোজ গল্প পাবেন।
গ্রুপ লিংক
https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share