মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২৭”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইরফান মেহরীনের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না। যা হবার নয় তা-ই বোধহয় হয়ে গেছে। মেহরীন তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার বউয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে ইরফানকে সত্যি সত্যিই তার স্বামী ভাবতে শুরু করেছে। তাকে হয়তো ভালোও বেসে ফেলেছে। এটা ঠিক না। ইরফান কখনও হামনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। মেহরীনের প্রতি যে তার মনেও কিছু একটা জন্ম নেয়নি তেমনটা না। তবুও সে এই অনুভূতিটাকে তার মনে জায়গা দিতে পারবে না। মেহরীনকে সে কখনও ভালোবাসতে পারবে না৷ মেহরীন ভুল করছে। প্রথমে অনন্তর ব্যাপারে, এখন তার ব্যাপারে। সে হামনার স্মৃতি নিয়েই সুখে আছে। মেহরীনকে নতুন করে তার জীবনে জায়গা দিয়ে হামনার স্মৃতিকে সে ভুলিয়ে দিতে পারবে না।
মেহরীন এখনও ইরফানের চোখের দিকে ঠিক একই ভাবে তাকিয়ে আছে। ইরফান তার ভুল বুঝতে পেরে মেহরীনের হাত ছেড়ে দিল। তাকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। ইরফানের এই কাজ মেহরীনকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, ইরফান তার জন্য কিছুই ফিল করে না। মেহরীনের চোখের জল বাঁধ মানছে না৷ অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। সে কেন আজ এতটা বেহায়া হতে গেল? কেন লোকটার সামনে নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করে দিল! সে তো জানে লোকটা শুধু একজনকেই ভালোবাসে। তবুও কেন তার ভালোবাসার কথা লোকটার সামনে রাখল! কেন, কেন আজ সে এতটা বেহায়া হলো!
ইরফান ওকে কাঁদতে দেখতে পারছে না। ভালো না বাসলেও মেয়েটার চোখে পানি দেখতে পারে না সে। ইরফান চায় মেহরীন সারাজীবন সুখে থাকুক। কখনও তার চোখে এক ফোঁটা পানি না আসুক। তাই সে মেহরীনকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চায় না। ইরফান কিছু বলবে এমন সময় দরজার সামনে থেকে আয়ামের গলা এলো।

“মাম্মী, ও মাম্মী! তুমি এখানে কী করো? পাপা তোমরা কী করো এখানে?”

মেহরীন আয়ামের আড়ালে চোখের পানি মুছে নিল। আয়াম ওকে কাঁদতে দেখলে একশো প্রশ্ন করবে। আয়ামের চলে আসাতে ইরফান যেন বেঁচে গেল। মনে মনে ছেলেকে ধন্যবাদ দিল সে। মেহরীনের সামনে থাকা তার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। ইরফান মেহরীনের সামনে থেকে চলে এলো।

“কিছু না বাবা। আমরা এখানে কিছুই করছি না। তোমার ঘুম আজ এত জলদি ভেঙে গেছে! ”

“পাপা আজ আমাদের ছুটি। মাম্মী বলেছে আজ আমরা ঘুরতে যাব। আমি কিন্তু ঘুরতে গিয়ে অনেকগুলো আইসক্রিম আর চকলেট খাব।”

ইরফান আয়ামকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

“আচ্ছা খাবে। এখন চলো দাঁত ব্রাশ করোনি এখনও। এহহ দাঁতে এই বড় বড় পোকা হবে।”

ইরফান আড়চোখে একবার মেহরীনকে দেখে বেরিয়ে গেল। মেহরীন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ইরফান তার মুখের উপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মুখে তাকে না, না বললেও আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছে। সে কীভাবে এই লোকটাকে ভালোবেসে ফেলল! সে তো অনন্তকে ভালোবাসতো। তাহলে হঠাৎ এসব কীভাবে হয়ে গেল। সে কাকে ভালোবাসে? অনন্তকে নাকি ইরফানকে?
.
ওরা তিনজন ঘুরতে বের হলো। বাবা মা’র সাথে ঘুরতে এসে আয়াম মহা খুশি। সকালের ওই ঘটনার পর মেহরীন একেবারে চুপ মেরে গেছে। সে আগে ইরফানের সাথে যা একটু কথা বলতো, তখন সেটাও বলছে না। ইরফানও নিজে থেকে মেহরীনের সাথে কথা বলতে পারছে না। সে কী বলবে? আয়াম আগে আগে দৌঁড়ে যাচ্ছে। ওরা দু’জন পেছনে। মেহরীনকে এতটা চুপচাপ দেখতে ইরফানের ভালো লাগছে না। মেয়েটা হাসি খুশি থাকলেই ভালো লাগে। ইরফান ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। ইতস্তত করছে সে।

“শুনুন, আসলে…

” পাপা আইসক্রিম খাব। আইসক্রিম কিনে দাও।”

“দিচ্ছি। তুমি দৌড়িও না। পড়ে যাবে।”

আয়াম নিজের জন্য দু’টা আইসক্রিম নিল। মেহরীনের জন্য একটা নিল। আইসক্রিম খেতে খেতে সে মেহরীনের কোলে ওঠার বায়না করল।

“পাপা পিকচার নিবে না? আমার আর মাম্মীর ছবি তুলে দাও। সুন্দর সুন্দর ছবি তুলবে।”

ইরফান নিজের ফোনে অনেক গুলো ছবি তুলল। ওদের দু’জনকে মা ছেলে লাগছে। কেউ দেখে বলতে পারবে না, আয়ামের সাথে যে মেহরীনের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। শুধু রক্তের কেন, কোন ধরণের সম্পর্কই তো নেই। তবুও মেহরীন আয়ামের কতটা আপন হয়ে ওঠেছে। আয়াম মেহরীনকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে, মেহরীন আয়ামকে খাইয়ে দিচ্ছে, আয়াম দুষ্টুমি করে মেহরীনের নাকে আইসক্রিম লাগিয়ে দিয়েছে, এরকম আরও অনেক পোজে ছবি তুলে রাখল ইরফান। মেহরীন এখন একটু হাসছে। ওর মন খারাপ কিছুটা কমেছে।
সারাদিন নানান জায়গায় ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে এলো ওরা। মেহরীন আজ আয়ামের সব বায়না পূরণ করেছে। ছেলে মায়ের প্রশংসা করার জন্য ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বারবার মেহরীন গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে একগাল হেসে বলছে,

“তুমি অনেক ভালো মাম্মী। পাপা একটুও ভালো না। তুমি যখন চলে গিয়েছিলে তখন পাপা আমাকে একটুও ঘুরতে নিয়ে যায়নি। আইসক্রিমও খেতে দেয়নি। তুমি আমাকে আইসক্রিম, চকলেট সব কিনে দিয়েছ। অনেক ঘুরিয়েছ। তুমি অনেক ভালো। আই লাভ ইউ মাম্মী। আমি তোমার সাথেই ঘুরতে যাব। পাপার সাথে গেলে মজা হয়না।”

আয়ামের কথা শুনে মেহরীনের চোখ জ্বালা করছে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। ইরফান পাশ থেকে নিজেকে নিয়ে ছেলের সব অভিযোগ মন দিয়ে শুনছে। মুচকি হাসছে সে। আয়াম তার থেকেও বেশি মেহরীনকে চায় দেখে অন্যরকম ভালো লাগাও কাজ করছে। আয়ামের আড়ালে মেহরীন চোখ মুছলো। কিন্তু সে ইরফানের চোখ এড়াতে পারল না। ইরফান ঠিকই তাকে কাঁদতে দেখে নিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরফান। তার সত্যিই কিছু করার নেই।
.
ইরফান তার স্টাডি রুমে বসে ভাবছে, মেহরীন কি সত্যিই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে? কিন্তু এটা কীকরে হয়! সে তো অনন্তকে ভালোবাসে। একই সময়ে একসাথে দু’জন মানুষকে ভালোবাসা যায়!
ভাবতে পারছে না ইরফান। মেয়েটা কেন বারবার ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে! সঠিক একটা মানুষকে খুঁজে নিয়ে তার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটিয়ে দিক না। কপালে হাত রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে মেহরীনের কথা ভাবতে থাকল সে।
এদিকে মেহরীন আয়ামকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সেই কখন থেকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আকাশ দেখছে সে। কতক্ষণ পরপর একরাশ মেঘ এসে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। তার জীবনেও এত মেঘ কেন? এক মেঘ কাটতে না কাটতে অন্য মেঘ এসে হাজির। যাকে বলে মেঘের আড়ালে মেঘ। বাইরে কারো পায়ের শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে মেহরীন বেডে এসে আয়ামের পাশে শুয়ে পড়ে। ইরফান ঘরে এলে ঘুমের ভান করে থাকে সে। একলা সময় ইরফানের মুখোমুখি হতে চায়না সে।
ইরফান ভেবেছিল মেহরীন হয়তো এখনও জেগে আছে। তার ধারণা ছিল, আজ মেহরীন ঘুমোতে পারবে না। মেহরীনের সাথে কথা বলা দরকার ছিল। কিন্তু সে তো এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ মেহরীন আর আয়ামকে দেখে ইরফান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইরফান চলে যাওয়ার সাথে সাথে মেহরীন উঠে বসে।

“আপনার সাথে আর কোনোদিন চোখ মেলাতে পারব না আমি। আমি জানি, আমি অপরাধী। একজনকে ভালোবাসা স্বত্বেও আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি। শুধু দুর্বল না, আমার মনে হয় আমি আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। আচ্ছা অনন্তকে কি আমি কখনও ভালোবাসতাম! অনন্তকে ভালোবাসলে কি দ্বিতীয় কারো প্রতি আমার মনে অনুভূতি তৈরি হতো? একসাথে দু’জনকে কখনও ভালোবাসা যায়!”

মেহরীন দু’হাতে চুল টেনে ধরল।

“উফ! আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেছি। এখনও পুরোপুরি না হলেও, বদ্ধ উন্মাদ হতে আমার বেশি দেরি নেই। একসাথে দু’জনের জন্য কীভাবে কারো মনে অনুভূতি কাজ করে! আচ্ছা আমি কি লিসার (ওর রুমমেট) মত ক্যারেক্টারলেস মেয়ে হয়ে গেছি? লিসাও তো একসঙ্গে কয়েকটা ছেলেকে পেছনে ঘুরায়। ওদের সবাইকে নাকি ও ভালোবাসে। এই কথা শুনে আমিই তো ওকে কতদিন খোটা দিয়েছি। আজ শেষে কিনা আমিও লিসার মত হয়ে গেলাম! একসঙ্গে দু’জনকে ভালোবাসি আমি! না,না৷ একজনকে তো ছাড়তেই হবে। অনন্তর সাথে কথা বলা দরকার। অনন্ত জানতে পারলে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে আল্লাহ জানে। নিশ্চয়ই আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে চাইবে। খাক। মারুক কাটুক, খেয়ে ফেলুক। তবুও ওকে সত্য বলতে হবে আমার। আমি ইরফান নামের একটা পাথর লোকের প্রেমে পড়েছি। বাকি জীবনটাও উনার সাথেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। হ্যাঁ, উনি আমাকে গ্রহণ করবে না মানছি। তবুও আমার কিছু করার নেই।”

মেহরীন কতক্ষণ একা একাই বিড়বিড় করে আবার আয়ামের পাশে শুয়ে পড়ল। সে ইরফানের সাথে ওর দেখা হওয়ার সেই প্রথম দিনের কথা মনে করছে। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা লোক। হঠাৎ করে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। সে কী ভীষণ বিরক্তটাই না হয়েছিল। সেদিন রাগও হয়েছিল ভীষণ। ইরফানকে তো মেরে ফেলতেই ইচ্ছে করছিল। মেহরীন কি কখনও ভেবেছিল সেই ভীষণ বিরক্তিকর লোকটাকেই সে একসময় ভালোবেসে ফেলবে। তার সাথে জীবন কাটাতে চাইবে।
মেহরীন কাঁদছে। ভাবছে সেদিন যদি এই লোকটার সাথে দেখা না হতো তাহলেই বুঝি সবার জন্য ভালো হতো। সে লোকটার প্রতি দুর্বল হতো না। অনন্তকেও ঠকাত না। অনন্ত তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। সে কীভাবে অনন্তকে বলবে, শোন আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এতদিন আমাদের মধ্যে যা ছিল তার নাম কী দেওয়া যায় আমি বলতে পারব না। একটা বছর ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসার ভাব করে গেছি। সত্যিকারের ভালোবাসা আমাদের মাঝে কখনও জন্মায়নি।
মেহরীন নিজের বোকামির কথা ভেবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আবার ভাবছে সেদিন যদি ইরফানের সাথে দেখা না হতো তাহলে আয়ামকে কীভাবে পেত সে? সে তো আজ এই ভীষণ দুষ্টু, মিষ্টি ছেলেটার মা।
মেহরীন কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। তার ভুল কীভাবে শুধরে নিবে সে? ইরফান তো তাকে ভালোবাসে না। সে কি ইরফানকে ছেড়ে দিয়ে আবার অনন্তর কাছে ফিরে যাবে? অনন্তকে কিচ্ছু জানানোর দরকার নেই। যা যেমন চলছে তেমনই চলতে দেওয়া উচিত। কিন্তু মন কি এত সহজে মানবে? মনটা যে বেহায়া ভীষণ। মনে মনে ইরফানকে চেয়ে কীভাবে অনন্তর সাথে থাকবে? এতে তো অনন্তকেও ঠকানো হবে। অনন্তর সামনা করার সাহস যে তার নেই।
মেহরীন কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমি মরে গেলেই সবার ভালো হবে। কেউ আমাকে চায় না। কারো জীবনে আমার গুরুত্ব নেই। আমি না থাকলেই বরং সব ঝামেলা চুকে যায়।”

চলবে___
গ্রুপ লিংক
👇
https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here