মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২৩”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সমস্ত নীরবতা ভেঙে মেহরীনই আগে জিজ্ঞেস করল,

“অনন্তর সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?”

হুট করে মেহরীনের এই প্রশ্নে ইরফান ঘাবড়ে গেল। মেহরীন কিছু জানতে পেরেছে নাকি? হঠাৎ অনন্তর সাথে তার যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইছে কেন? ইরফান আমতা আমতা করে বলতে লাগল,

“যোগাযোগ! মানে ওই ব্যাপারে আপনাকে…

ইরফানের তোতলানো দেখে মেহরীনের রাগ উঠে গেল। পুরুষ মানুষ শক্ত গলায় কথা বলবে। মেয়ে মানুষের মত মিনমিন করে কথা বলে কেন?

” অনন্তর সাথে আমার কথা হয়েছে। ও বললো আমার পায়ে ব্যথার ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে শুনেছে। তাই জানতে চাইলাম। ওর সাথে তো আমি কখনও আপনার দেখা করাইনি। আপনারা দু’জন দু’জনকে কীভাবে চিনলেন? কবে থেকে কথা হয় আপনাদের?”

ইরফান ভাবছে এটাই মেহরীনকে অনন্তর সত্য বলে দেওয়ার সঠিক সময়। এই সময় আর আসবে না। সে বলে দিবে অনন্ত নিজে থেকে তার কাছে এসেছিল। মেহরীনকে নিয়ে ডিল করেছে। পরমুহূর্তে ইরফান ভাবল, মেহরীন বিশ্বাস করবে তো? তার কাছে সব ধরণের প্রমাণ আছে। তবুও সে কি ইরফানকে বিশ্বাস করবে? তাদের মাঝে এখনও কি বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে?
মেহরীন এখনও ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরফান কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অনন্তর সত্য আর কিছু দিন মেহরীনের আড়ালেই থাক। ওকে আর একটু সময় দেওয়া দরকার। আগে হুমায়রাকে জানাতে হবে। তারপর ভাবা যাবে মেহরীনকে কীভাবে অনন্তর সত্যের মুখোমুখি আনবে।

“না মানে, উনি একটা কাজে আমার কাছে এসেছিলেন। সেখান থেকেই চেনা।”

“ওহ। ভালোই হয়েছে, আপনার সাথে ওর দেখা হয়েছে।”

ইরফান কপাল কুঁচকে মেহরীনের দিকে তাকালে সে বলল,

“অনন্ত তো আপনাকে চিনতো না। তাই আপনার সম্পর্কে নিজে নিজেই একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছিল। আপনার সাথে সামনাসামনি দেখা করে এখন নিশ্চয়ই তার ধারণা পাল্টে গেছে।”

“আমাকে নিয়ে উনি কেমন ধারণা করেছিল?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপনি নিশ্চয়ই বিনা বাধায় আপনার গার্লফ্রেন্ডকে অন্য কারো বউ হয়ে অভিনয় করার জন্য পারমিশন দিতেন না।”

“জীবনেও না। অভিনয় কেন? আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে কারো বাসায় জবও করতে দিতাম না।”

“দেখেছেন আপনার মনে কত হিংসা। অনন্ত আপনার থেকে হাজার গুণে ভালো। আয়ামের কথা ভেবে ও রাজি হয়ে গেছে। যেখানে সে আয়ামকে চেনেও না। কখনও দেখেওনি।”

অনন্তর প্রতি মেহরীনের এই অন্ধ বিশ্বাস দেখে ইরফানের যেমন রাগ লাগছে তেমন হাসিও পাচ্ছে। মেয়েরা এতটা বোকা হয় কেন? ভালোবাসার আগে ওরা কিচ্ছু দেখতে পারে না। অনন্ত নাকি পরোপকারের মনোভাব নিয়ে মেহরীনকে ইরফানের বউ সেজে অভিনয় করতে দিতে রাজি হয়েছে। বাহ! কত মহান ব্যক্তিত্ব! অনন্তর মন কতই না বড়! আহা। ইরফানের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি মেহরীনকে সব বলে দেয়। কিন্তু না। সে এখন আর এমনটা করবে না। মেহরীনকে এভাবে বললে সে বিশ্বাস না-ও করতে পারে। তাকে হাতেনাতে প্রমাণ দিতে হবে। অনন্তর মুখোশ মেহরীনের সামনে টেনে খুলতে হবে। তবেই এই মেয়ের আক্কেল ঠিক হবে।
ইরফান টিটকারির সুরে বলল,

“হ্যাঁ আপনার বয়ফ্রেন্ডের মন অনেক বড়। আকাশের থেকেও বিশাল। কয়জন এমন বড় মনের অধিকার হয় বলুন তো! লাখে একটা… না, না কোটিতে একটা বয়ফ্রেন্ড পেয়েছেন। যে কিনা নিজের গার্লফ্রেন্ডকে অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারে। বাহ! আমার মনটা যদি আপনার বয়ফ্রেন্ডের মত হতো! তার থেকে একটু কম হলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আমি ভীষণ হিংসুটে। নিজের জিনিস অন্য কারো সাথে শেয়ার করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। আমার জিনিস শুধু আমারই। অন্য কেউ সে জিনিসের দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারবে না। আমি কেন আপনার বয়ফ্রেন্ডের মত অতটা জনদরদি হতে পারলাম না?”

মেহরীন ইরফানের খোঁচা বুঝতে পেরে মুখ মুচড় দিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ইরফান তিক্ত মুখে বিড়বিড় করে বলল,

“গাধা! আস্ত গাধা মেয়ে।”

মেহরীন ওপাশ ফিরেই বলল,

“কাল সকালে সবার আগে আপনার কাজ হবে, আয়ামকে ওর নানুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসা। আয়ামকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না। ওকে এক মুহুর্ত না দেখে থাকতে পারি না।”

“হুম।”

ইরফান অনেকক্ষণ বই হাতে সোফায় বসে রইল। মেহরীন ঘুমিয়ে গেছে নাকি জেগে আছে বুঝতে পারছে না। ইরফান বলল,

“আয়ামকে আপনি অনেক ভালোবেসে ফেলেছেন, তাই না? এক বছর পর তো ওকে ছেড়ে চলে যাবেন। তখন থাকতে পারবেন? ওকে ছাড়া আপনার কষ্ট হবে না? আয়ামের কথা, বাবার কথা মনে পড়বে আপনার? ”

ইরফান কোনোভাবেই নিজের কথাটাও বলতে পারল না। ওর ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কি মেহরীন ওদের কথা মনে করবে? ওর কথা মেহরীনের মনে থাকবে?
মেহরীন জেগে ছিল। ইরফানের সব কথা শুনেছে সে। তবুও উত্তর দিল না। এখন কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে সে। ইদানিং এতটা ছিঁচকাঁদুনে হয়েছে কেন? মুখ দিয়ে কথা বের হবার আগে চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। লোকটার সামনে কাঁদলে সে নিজেই লজ্জা পাবে। ইরফানের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চায়না সে। তাই ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইল।
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে বইটা রেখে সোফায় শুয়ে পড়ল।
আজকাল তার কিছু একটা হয়েছে। মেহরীন সামনে থাকলে হামনার কথা মনে পড়ে না তার। মনে হয় যেন হামনা সাথেই আছে। একা সময় হামনার কথা ভাবতে গেলে সাথে মেহরীনের চেহারাও চোখে ভাসে।
.
ইরফান সকাল সকাল হুমায়রাদের বাড়িতে চলে এসেছে। আজ সে হুমায়রাকে অনন্তর সত্য বলবে। হুমায়রা নিশ্চয়ই তার কথা বিশ্বাস করবে। আর হুমায়রা মেহরীনের মত আবেগপ্রবণ না। সে নিজেকে সামলে নিতে বেশি সময় নিবে না। হুমায়রার মত শক্ত প্রকৃতির মেয়েগুলো এসব বিষয় শক্ত হাতেই সামাল দিতে পারে।
হুমায়রা ইরফানকে সকাল সকাল নিজের বাড়িতে দেখে অবাক হলো। মজা করে বলল,

“কী দুলাভাই! শালির প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেছেন নাকি? আগে তো বছরে একদিনও খোঁজ খবর নিতেন না। বাড়িতে আসবেন তো অনেক দূরের কথা। আপনাকে চোখে দেখার জন্যও খুঁজে পেতাম না। কিন্তু ইদানিং রোজ রোজ দাওয়াত ছাড়াই চলে আসছেন। কাউকে বলেও আসছেন না। কি, আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন? মনের মধ্যে ওইরকম কোন অনুভূতি থাকলে বলে ফেলতে পারেন। এখনও আমার বিয়ে হয়নি। রিং পরেছি শুধু। আপনি বললে আপনার জন্য আমি রিং খুলে ওই লোকের মুখে ছুঁড়ে মারব। দশটা না পাঁচটা না, একটা মাত্র দুলাভাই বলে কথা। আপনার প্রপোজালে আমি নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যাব।”

“তাহলে রিং খুলে সত্যি সত্যিই ওই লোকের মুখে ছুঁড়ে মারো।”

হুমায়রা ভাবছে ইরফান মজা করছে। কিন্তু ইরফান মোটেও মজা করছে না। তার মুখ গম্ভীর।

“সত্যিই খুলে ফেলব? এই বিয়ে ভেঙে দিলে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন তো? দেখুন দুলাভাই, উপস এখন তো আর দুলাভাই বলা যাবে না। মিস্টার ইরফান ভেবেচিন্তে বলুন। একবার রিং খুলে আপনার ঘাড়ে ঝুলে পড়লে তখন কিন্তু ওঝা ডেকেও ঘাড় থেকে নামাতে পারবেন না। এই দুলাভাইয়ের ভালোবাসায় পাগল পেত্নীকে কিন্তু এত সহজে তাড়াতে পারবেন না।”

কথাগুলো বলে হুমায়রা খিলখিল করে হাসছে। ইরফান ওর হাসি মুছে দিতে চায় না। আজ অনন্তর কথা বলবে? হুমায়রা আজ একটু বেশিই খুশি আছে। তখন তাকে এই তিক্ত সত্য জানিয়ে মন খারাপ করে দেওয়া ঠিক হবে? কিন্তু যতই সময় যাবে ততই তো হুমায়রা ওই ভণ্ড, বাটপারকে নিয়ে আরও বেশি ভাবতে থাকবে। না, যা কিছুই হয়ে যাক ইরফান আজই হুমায়রাকে সব সত্য বলে দিবে। হুমায়রা কঠিন ধাঁচের মেয়ে। হামনা মারা যাওয়ার পর হুমায়রা নিজের দুঃখ সবার থেকে লুকিয়ে রেখে উল্টো হাসি মুখে সবাইকে সান্ত্বনা দিয়েছে। বাবাকে একা হাতে সামলিয়েছে। মেয়েটা তার আর আয়ামের পাশেও সমান ভাবে ছিল। হামনা চলে যাবার পর প্রথম একটা মাস তো হুমায়রাই আয়ামকে রেখেছে। এতটুকু সত্য জেনে হুমায়রার তেমন ধাক্কা লাগবে না। আর ইরফান তো হুমায়রার পাশে আছেই। সে সব সময় হুমায়রার সাথে থাকবে। তার নিজের কোন বোন নেই। হামনার ছোট বোন তো তারও বোন। মেয়েটা তাকে সব সময় একজন বড় ভাইয়ের চোখেই দেখেছে। ভাইয়ের সম্মান দিয়েছে। ভাই হিসেবে ইরফানের দায়িত্ব হুমায়রার ভালোর দিকটা ভাবা। প্রথম প্রথম কয়েকদিন কষ্ট পেলেও সারাজীবনের কষ্ট থেকে তো বেঁচে যাবে।

“হুমায়রা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমার হাতে সময় আছে? এখন বলা যাবে?”

ইরফানকে অতটা সিরিয়াস মুডে দেখে হুমায়রাও সিরিয়াস হলো।

“হ্যাঁ। আমার আর কী কাজ? ফাইনাল এক্সাম শেষ। ভার্সিটিতে আর যাওয়া হয়না। এখন হাতে সময়ই সময়। আপনি কী বলবেন ভেতরে এসে বসে বলুন না। দরজার সামনে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন।”

ইরফান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

“বাবা বাসায় নেই?”

“না। আয়ামকে নিয়ে স্কুলে গেছে। আপনার ছেলে একদিনও স্কুল মিস দিতে রাজি না। ওর মাম্মী নাকি ভীষণ বকবে। আয়াম কত কম সময়ে মেহরীনকে নিজের মা ভেবে নিয়েছে, তাই না দুলাভাই? ”

“হুম।”

“মেয়েটা ভারি মিষ্টি। একদম আপুর মত। আমি এখনো এটাই ভাবি, দু’টা মানুষের মধ্যে কীভাবে এতটা মিল থাকতে পারে। এর পেছনে কোন কারণ তো অবশ্যই আছে। নইলে আপু, মেহরীন দু’জন আলাদা মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছে। ওরা টুইন না হওয়া স্বত্বেও চেহারা হুবহু এক! এরকম কখনো হয়!”

হুমায়রা নিজের মত কথা বলে যাচ্ছে। ইরফান মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে কীভাবে ওকে কথাগুলো বলবে।

“দুলাভাই, আপনি এখানে বসুন। আমি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনি। সকালে ব্রেকফাস্ট করে এসেছেন? ”

“আমি খেয়ে এসেছি হুমায়রা। তুমি এখন একটু আমার পাশে বসো।”

ইরফান হুমায়রার হাত ধরে ওকে নিজের পাশে বসাল। হুমায়রা মনে মনে আন্দাজ করতে পারছে ইরফান আজ সিরিয়াস কোন কথা বলতে এসেছে। কিন্তু তার সাথে দুলাভাইয়ের কী এমন সিরিয়াস কথা থাকতে পারে?
.
ইরফান হাতে হাত রেখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে। হুমায়রা মাথা নিচু করে চুপচাপ তার কথা শুনছে। যতই সময় যাচ্ছে হুমায়রার মুখের হাসি হাসি ভাব চলে গিয়ে মুখ গম্ভীর হয়ে আসছে। ইরফান বলার ফাঁকে ফাঁকে মাথা তুলে হুমায়রাকে দেখছে। হুমায়রার মুখ দেখে তার আর বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও মনে সাহস জুগিয়ে ইরফান সবটুকু বলল। বলা শেষ হলে হুমায়রার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। হুমায়রার চোখ ছলছল করছে। হঠাৎ করে সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। ইরফান ওর পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল। ওকে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ সময় দিল। হুমায়রা কিছুটা সময় অঝোরে কাঁদল। কান্নাকাটি শেষ করে সোজা হয়ে বসে চোখ মুছল। ইরফান বলল,

“হুমায়রা তুমি ঠিক আছো?”

“হুম। চলুন দুলাভাই।”

ইরফান বিস্মিত গলায় জানতে চাইল,

“কোথায়? ”

হুমায়রা চোখ মুছতে মুছতে চুল ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ওই ঠকবাজ বাটপারটার সাথে বোঝাপড়া করতে। ওকে ওর কাজের জন্য উচিত শিক্ষা দিতে হবে। জোচ্চোরটাকে কিছু না বলে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে চলবে না। ও আরও মেয়েদের জীবন নষ্ট করবে। ওদের ইমোশন নিয়ে খেলবে। ফ্রডটা আমার সাথে যা করেছে তা যেন আর কারো সাথে না করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি চলুন আমার সাথে।”

হুমায়রার মনোবল দেখে ইরফান মুগ্ধ হলো। হুমায়রার মত মেয়ে সে আর একটাও দেখেনি। এত তাড়াতাড়ি নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারা সত্যিই মুগ্ধ করা বিষয়। ইরফান নিজেও হয়তো ভেতর থেকে হুমায়রার মত শক্ত না।

চলবে___

আমার গ্রুপ লিংক। গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন।

https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here