#মেঘে_ঢাকা_জ্যোৎস্না
পর্ব -৫
সোনা বাচ্চাটা আমার জীবনটাকে আবার পরিপূর্ন করে দিয়েছিল। আমি যেন শুধু মা হয়েই বেঁচেছিলাম। পৃথিবীর সব কিছু ভূলে আমি আমার পরিটাকে নিয়ে আবার বাঁচতে শুরু করেছিলাম। আমি ওর নাম রেখেছিলাম ‘রুপকথা’।
যাকে কাছে পেতে এতো কথা, তার নাম হয়ত রুপকথা হবারই কথা। অপু আমি আর রুপকথা, আমাদের পরিবার যেন পূর্ন হয়ে গেছিল। ও হাসলে আমরা হাসি! ও কাঁদলে আমরা……..
হঠাৎ একদিন সোনাটা টেনে খেতে পারছে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে। সাথে সাথে রুপকথাকে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। অনেক গুলো টেষ্ট করলো আমার সোনাটার। রিপোর্ট আসলো, আমার রুপকথার হার্টে একটা ছিদ্র আছে।
আমি আর অপু, মুহূর্ত দেরি না করে রুপকথাকে ঢাকায় শিশু ডাক্তার দেখালাম। আমি জানিনা আমার জন্যে আরও কতো পরীক্ষা বাকি আছে! ডাক্তার বললো, রুপকথার ব্রেনের পরিপূর্ন বিকাশ হয়নি। হার্টে ফুটা আছে। সোনাটার শ্বাস নালী পরিপক্ক নয়।
পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেলো যেন। কতটা কষ্টে নীলাভ আমার মন, তা হয়ত কাউকে দেখাতে পারবো না। আমার স্বর্বোস্ব দিয়ে আমি আমার মেয়েকে বাঁচাবো। আমি হাটতে পারছিলাম না, অপুর কাঁধে ভর করে আমি হেটে এসেছি গাড়ি পর্যন্ত। এরপরে শুরু হলো আমার যুদ্ধ। রুপকথাকে আমি সুস্থ করে তুলবোই।
আমার দিন রাত কাটতো রুপকথার সেবা করে। আমাকে সাহায্য করতো অপু আর রাবেয়া নামের মেয়েটা। আমার শাশুড়ীর বয়স হয়েছে। সে বড় জোর বাবুকে খেলা দিতে পারে। কিন্তু খাওয়ানো, বা অন্য কাজ গুলো করতে পারে না।
বাবুর জন্যে আমার দোতলায় দুটো ফ্রিজ রাখলাম। একটাতে রুপকথার জন্যে সব রকমের ফল থাকতো। অন্যটাতে চকলেট আর বিভিন্ন রকমের বাদাম। সোনাটার ব্রেনের বিকাশ যেহেতু হয়নি তাই সবসময় আমার চেষ্টা থাকতো এসব খাইয়েও যেনো ওর ব্রেনের বৃদ্ধি হয়। আমি দিন রাত কতটুকু ঘুমাতাম, বলতে পারিনা। নিজের জন্যে কতোদিন কিচ্ছু কিনিনি। বাবুর চিন্তায় নিজের দিকে দেখিনি কতোদিন। আয়নায় নিজের চেহারা দেখার সময় কোথায়। কোন আত্নীয়র বাসায় যাইনা, রুপকথার যদি সমস্যা হয়। মায়ের বাড়ি যাইনি বহু দিন। মা বাবা দেখে যান আমাকে। আমি পারিনি তাদের পাশে দাডিয়ে তাদের সহায় হতে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আমার রুপকথা যে আমার জীবন। আমি ছাড়া যে ওর কেউ নেই।
মেয়েটা আসতে আসতে বড় হচ্ছে। সে আমার কথা গুলো বুঝতে শিখেছে। বলার চেষ্টাও করে। একদিন সে ঠিকই কথা বলতে পারবে, আমি জানি। এ আমার বিশ্বাস।
সোনাটার আমার প্রাই ঠান্ডা লেগে যায়। জ্বর চলে আসে। কদিন আগে জ্বর আসলো, ডাক্তার বললো রুপকথার নিউমোনিয়া হয়েছে। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে। আমি সোনাটার সেবায় আরও জোরে সোরে লেগে গেলাম।
এমন করতে করতে রুপকথা বড় হচ্ছে। ডাক্তার রুপকথাকে স্কুলে ভর্তি করাতে বললো। আমি সোনাটাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। সোনাটা আমার স্কুলে যেয়ে কদিন বেশ আনন্দ পেলেও কদিন পর থেকে আর যেতে চাইত না। আবার নিজেই কখনও কখনও স্কুল ড্রেস দেখিয়ে দিতো। সেদিন আমি ওকে স্কুলে নিতাম। আসতে আসতে রুপকথার স্কুল ভালো লাগতে শুরু করলো। ডাক্তার আমাকে এই স্কুলে নয়, অটিস্টিক বেবিদের স্কুলে স্কুলে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তা কি করে করবো, আমার সোনাতো সুস্থ বাচ্চা। সে আমার সব কথা বোঝে, আমিও ওর সব কথা বুঝতে পারিতো।
আমার সোনাটার হার্টের ছোট্ট একটা অপারেশন করাতে হবে ওর ৯/১০ বছর বয়সে। আমার সোনাটার দেখতে দেখতে অপারেশনের বয়স হয়ে এসেছে। রুপকথাকে অপারেশন এর জন্যে নিয়ে যেতে হবে ঢাকায়। অপু সিদ্ধান্ত নিলো রুপকথাকে দিল্লি নিয়ে যাবে। আমরা রওনা দিলাম, রুপকথাকে নিয়ে দিল্লিতে। মেয়েটা আমার কিছুতেই যেন থাকতে চাইছিল না, ওখানে। বার বার বাসায় আসার জন্যে জিদ করতে লাগলো। অপুও যেন আর পারছে না, কিন্তু আমি তখনও একটুও ক্লান্ত হইনি। আমি সারারাত জেগে থাকলেও যেন ক্লান্ত হতে ভূলে গেছি। অসুখ হলে তা অনুভব করতেও ভূলে গেছি।
কিন্তু রুপকথাকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। তার একই কথা দাদী, দাদী…….দাদী। কেন যেন মেয়েটা আমার শুধু বাড়ি আর দাদীকেই ডাকছিল। বাধ্য হয়ে আমরা রওনা দিলাম। বিমানে রুপকথার খুব ঠান্ডা লাগছিল। বাংলাদেশে বিমান থেকে নামার কিছুক্ষন পরেই রুপকথার খুব জ্বর চলে আসলো। রাতের ফ্লাইটে আমরা বাসায় অর্থাৎ খুলনায় চলে আসলাম। রাত যতই বাড়ছে রুপকথার জ্বর ততই বাড়ছে। ভোরের দিকে জ্বর অনেক বেশি। সোনাটাকে আমরা হসপিটালে নিলাম। ডাক্তার রুপকথাকে আইসিইউতে দিয়ে দিলো। সোনাটার নাকি শ্বাস কষ্ট আর খিচুনী হচ্ছে। সারাদিন আমি আর অপু আইসিইউ এর সামনে। দুপুরের পরে শাশুড়ী শশুর আমার বাবা মা আরও সব আত্নীয় হসপিটালে চলে আসলো। সন্ধ্যার পর সোনাটার নাকি খুব ঘুম আসলো। ডাক্তার আমাকে ডেকে বললো, বাবু নেই। আমি বললাম, রুপকথা জার্নি করে খুব ক্লান্ত। তাই ঘুমিয়ে গেছে।
রাতে বাবুকে বাসায় আনা হলো। আজও জ্যোৎস্না ভরা চাদনী রাত। সোনা-টাকে আমি গোসল করিয়ে দিয়েছি। চোখে সুরমা দিয়ে দিয়েছি। আমার মাটাকে ওরা নিয়ে গেলো। মা আমার আর আসেনি। এরপর থেকে এমন চাদনী রাতে আমি করপুর গন্ধ পাই। জ্যোৎস্নার আলোয় যেনো রুপকথার গায়ের গন্ধ মেশানো।