#মেঘফুল_৬
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
_________________________________

তারপর সে ভারী কন্ঠে বললো,
” প্লিজ আপনি চুপ করুন। এখানে একটা কিছু ঘটতে চলেছিল আমার সাথে!”

” মানে কি? তুমি তো আমার রুমেই বসে আছো তাহলে তোমার সাথে আবার কি ঘটবে? নাকি আমিই কোনো অপরাধ করেছি!”

” আরে নাহ। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম!” বলে গম্ভীর হলো।

” সো,স্বপ্নে কি দেখছিলে?”

জান্নাত অসহায়দের মতো মুখ বানিয়ে একটা শুকনো ডুব গিলে মেঘালয়ের দিকে একবার তাকালো। তারপর ইতস্তত করে বলতে শুরু করলো,”আমি দেখছিলাম একটা বখাটে লোক আমার দিকে বাজেভাবে তাকাচ্ছে। আমি যখন তাকে আমার দিকে তাকাতে দেখি তখন আমি সেখান থেকে প্রস্থান নিলে,সেই লোকটিও আমার পেছন পেছন ধাওয়া করলো। তারপর আমি একটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম। আর ঘুম ভেঙে দেখলাম আপনি!
জান্নাতের বলা কথাগুলো শুনে মেঘালয় কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই জান্নাত নিষ্পাপ চাহনিতে মেঘালয়কে বললো,” ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে খারাপ মিন করিনি!”

মেঘালয় বোকা বনে গেলো। সে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। মুখটা ছোট করে জান্নাতকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে, নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর এদিকে জান্নাত পুরাই থ বনে রইলো। কথাটা বলা কি তাঁর উচিৎ হয়েছে? কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না ও। সে নিজেও ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে দরজা খুলে ধিরে ধিরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। রান্নাঘর খোঁজার চেষ্টা করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাটছিলো,তখন কাজের মেয়ে ময়নার সাথে একটা ধাক্কা খেলো। সে আঁতকে উঠলো। ময়না চোখ বড় বড় করে বললো,” আল্লাগো! ভাবীসাহেবা এত্ত সক্কাল সক্কাল আপনে এইহানে ক্যান আইছেন?”

জান্নাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,” আস্তে কথা বলো। আমাকে বলো রান্না ঘরটা কোথায়?”

ময়না দাঁত কেলিয়ে হেঁসে আংগুল তাক করে রান্নাঘর দেখালো। জন্নাত স্মিত হেঁসে বললো,” শুনো,আজকে আমি নাশতা তৈরি করবো। তুমিও এসো। আমাকে দেখিয়ে দিবে কোথায় কি রাখা আছে।”

ময়না চিন্তিত হয়ে বললো,” কিন্তু ভাবী খালাম্মা যদি রাগ করেন?”

” আরে অযথা ভয় পেয়ো না। আমি সামলে নিবো। মা কিচ্ছু বলবেন না, দেখে নিও। এবার চলো।”

ময়না চিন্তা মুক্ত হয়ে বললো,” ঠিক আছে ভাবী চলেন।

কিচেনে এসে জান্নাত ময়নাকে বললো,” আচ্ছা সকালে নাশতা হিসেবে উনারা কি খান?”

” রুটির সাথে ডিম ভাজি,ফলমূল এইগুলা খান। কিন্তু খালু সাহেব খিচুড়ি খান। যার মধ্যে চাউলের পরিমাণ কমিয়ে সবজির পরিমাণ বেশি করে দিতে হয়। তয় তার আগে উনারা চা পান করেন।”

” ঠিকাছে। তুমি আমাকে দুধ, চিনি, চা-পাতা বের করে দাও। আমি বরং চা বানাই। তারপর তার ফাকে খিচুড়ি, রুটি এবং ডিম ভাজি করবো!”

চা বানানো শেষ হলে জান্নাত ড্রয়িং রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আলম আহমেদ ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। জান্নাত ড্রয়িং রুমে ঢুকার আগে সালাম দিলো। আলম আহমেদ বিস্মিত কন্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,” আরে বউমা! তুমি এত সকাল সকাল উঠতে গেলে কেন? কে বলেছে তোমাকে এগুলো আনতে….জান্নাত থামিয়ে বললো,” কেউ বলেনি বাবা। আমি নিজে থেকেই বানিয়েছি। আপনি একদম আমাকে বকবেন না। আজ থেকে সংসারের কাজকর্ম আমিই করবো। এইবার চা-টা নিন বাবা।

আলম আহমেদ জান্নাতের ওমন মিষ্টি আচরণে ভীষণ খুশি হলেন। তিনি স্মিত হেঁসে বললেন,” ঠিক আছে মা দাও।”

জান্নাত সন্তর্পণে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো।

ভেবেছিলো এবার শাশুড়ীর জন্য চা নিয়ে যাবে। কিন্তু রান্নাঘরেই তাঁকে পেয়ে গেলো। সে আমতা আমতা করে বললো,” মা আপনি কেন….রুবি থামিয়ে বললেন,” হয়েছে এখনই এত কাজ দেখাতে হবে না। যাও চুপটি করে রুমে গিয়ে বসে থাকো। সময় হলে আমিই রান্নাঘরে ডেকে আনবো।”

জান্নাত দৃষ্টি নত করে বললো,”কাজ করতে আমার ভালো লাগে মা। দয়া করে আমাকে কাজ করতে দিন। আপনি শুধু কিচেনে বসে থাকুন। ভুল হলে একটা বেত নিয়ে দু’চার ঘা বসিয়ে দিবেন!”

রুবি আর রাগী-গম্ভীর ভাব ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি হেঁসে ফেললেন। তারপর বললেন,” বেত্রাঘাত করবো! পাগলী মেয়ে। ঠিক আছে তুমিই নাশতা তৈরি করো। দরকার হলে ময়না অথবা আমাকে ডেকো,কেমন?”

” আচ্ছা মা।”
—–
ওয়ালিমা ছোট করে আয়োজন করা হলো। নতুন বৌ দেখে অনেকেই জান্নাতের গায়ের রং নিয়ে অনেক কিছু বললো। জান্নাতের কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলেও আবার নিজেকে সামলে নিলো। পরদিন যাত্রায় যাওয়ার সময় হলে মেঘালয় বেঁকে বসলো। সে যাবে না। আলম আহমেদ ছেলেকে বকাঝকা করলেন। পরে সে রাজি হলো। বিয়ের আমেজে এমন ঝগরুটে পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় জান্নাত অস্বস্তিতে ভুগছিলো। শেষে মেঘালয় যাবে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এই মেঘালয় চরিত্রটাকে নিয়ে সে ভীষণ উদ্বীগ্ন। কারণ তার মতিগতি বোঝা বড় দায়। একসময় সুন্দর করে কথা বলবে তো আরেক সময় অবহেলা করবে। আবার লুকিয়ে লুকিয়ে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইবে। পরক্ষণে বলবে, সে প্রভাকে ভালোবাসে! মেঘালয়ের এমন অদ্ভূত আচরণে মাঝেমধ্যে তার ভীষণ কান্না পায়। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন মেঘালয় তাকওয়াবান হতে পারে। কিন্তু জান্নাত তার উল্টোটা দেখলো। মেনে নেওয়ার চাইতে,মানিয়ে নেওয়াটা তার জন্য অনেক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে ঠেকলো। মনে মনে সে আওড়ালো,” কি জানি কি আছে কপালে!”

এদিকে মেঘালয় জান্নাতদের বাড়িতে যাওয়ার আগে শপে গেলো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে। সেই সুবাদে প্রভাকে সে দেখতে পেলো একটা শপিং মলে ঢুকছে। তাঁর মনটা অস্থির হয়ে উঠলো প্রভার সাথে কথা বলার জন্য। দৌড়ে তার পিছু নিলো তার আগেই প্রভা ভিড়ের মধ্যে মিশে উধাও হয়ে গেলো। মেঘালয় অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও পেলো না। সে ঘেমে একাকার। শেষ পর্যন্ত না পেয়ে বাসায় চলে আসলো। অস্থির মন নিয়ে জান্নাতকে নিয়ে তার শ্বশুরালয়ে রওয়ানা হলো। জান্নাত বাড়িতে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর এদিকে মেঘালয় প্রভার সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
—-
জান্নাত জল চকিতে বসে আছে। পাশে তার মা তরকারি কুটছেন। তার ফাঁকে মেয়ের সঙ্গে গল্পও করছেন। তিনি বললেন,” আচ্ছা মা জামাই বাবাজি কেমন? তোর শ্বশুর শাশুড়ী ভালো তো?”

” তার কথা বলো না মা। বলেছিলে না তাকওয়াবান হতে পারে সে। সে মোটেও ওরকম না। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,” মা ও ড্রিংকস ও করে। এ কেমন ছেলের সাথে তোমরা আমার বিয়ে দিলে!”

রাবেয়া বিস্মিত কন্ঠে বললেন,” এসব কি বলছিস! আর তোর শ্বশুর শাশুড়ী কেমন?”

“উনারা ভালো।” তারপর খানিকটা থেমে বললো,” আরেকটা সত্যি কথা কি জানো মা,সে আমাকে বিয়ে করার আগে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছর হয়েছে তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। তাকে নাকি এখনও ভালোবাসে ও।” কথাগুলো বলার সময় তার চোখ দিয়ে অজস্র জল গড়িয়ে পরলো।”

রাবেয়া এবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালেন। তিনি কি বলে তার মেয়েকে স্বান্তনা দিবেন? এ মুখে কি আর স্বান্তনার বাণী ছুঁড়তে পারবেন!

“আমি যে কি বলে তোকে স্বান্তনা দেই রে মা! আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। এ কেমন ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিলাম! আমিই বা কি করবো বল? সব তো তোর বাবাই করলেন। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস কি আদৌও আছে আমার! ইচ্ছা হয় নিজেই নিজের গলা টিপে মরে যাই। তাতে পাপ হবে তাই পারি না। ধৈর্য ধরে বসে আছি। না হলে এ সংসার আর দুনিয়া থেকে সেই কবেই বিদায় নিতাম। কুরআনে পড়েছি,”হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”[১] তাই পৃথিবীর কোনো মানুষকে ভরসা না করে আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। কারণ আল্লাহ বলেছেন,”‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।”[২] কাজেই তুই ধৈর্য ধর মা। তোর সাথে তোর মায়ের দোয়া সবসময়ই আছে। চিন্তা করিস না,আল্লাহ তাকে হেদায়েত নসিব করুক।”

জান্নাত মায়ের কথায় সায় না দিয়ে অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয় নিয়ে ঘরের পেছনের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেলো। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সূর্য তখন অস্ত গিয়েছে। পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশপটে তার মনের কথাগুলো ক্ষণে ক্ষণে ছবির মতো আঁকা পড়ছে। স্থির রেখাহীন জলের উপর ভাষাতীত অসংখ্য বর্ণচ্ছটা দেখতে দেখতে ফিকে হতে গাঢ় লেখায়,সোনার রঙ হতে ইস্পাতের রঙে, এক আভা হতে আরেক আভায় মিলিয়ে আসছিলো। মরুভূমির ন্যায় তপ্ত হৃদয়খানি নিয়ে জরাগ্রস্ত বৃহৎ রেইনট্রিমূল-বিদারিত পুকুর পাড়ের উপরে ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাবেলায় একা একলা বসে তার শুষ্ক চক্ষুর কোণ আবারও জলে ভিজবে ভিজবে করছে, এমন সময় মসজিদের মাইক হতে সুমধুর কন্ঠে আজানের ধ্বনি তার কানে ভেসে আসলো। পাখপাখালির কিচিরমিচির বন্ধ হয়ে আসলো। সে পুকুরের স্বচ্ছ জলে হাতমুখ ধুয়ে অজু করে নিলো। তার রুমে এসে দেখলো, মেঘালয় কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল তাকে দেখেই ফোনের লাইনটা কেটে ফেললো! তার ভেজা কপালের নিচে একজোড়া বড়ো বড়ো চক্ষু আপন কোটরের ভেতর হতে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় জ্বলে উঠলো। আঁখিদ্বয়ে জল চিকচিক করলেও,সে তার চোখমুখ শক্ত করে মেঘালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। জান্নাতের ওমন অগ্নিশর্মা রূপ দেখে মেঘালয় একটা শুকনো ডুব গিললো। নোলা দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে বললো,” আশ্চর্য!এরকম করে তাকিয়ে আছো কেন?
_____
রেফারেন্সঃ-
[১]সূরা বাক্বারাহ,আয়াত নম্বর:১৫৩
[২]সূরা মায়িদা,আয়াত নম্বর:২৩
_____

চলবে…………

বিঃদ্রঃ-১ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here