#মেঘফুল_১৩
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
_____________________________________

ফোনটা বের করে তার বান্ধবী স্নেহাকে কল দিলো। কল রিসিভ হলে,
‘ আসসালামু আলাইকুম,স্নেহা!’

‘ ওয়া আলাইকুমুসসালাম। কেমন আছিস পাখি?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু অনেক সমস্যায় আছিরে। দম বন্ধকর পরিস্থিতি। স্বামীগৃহ ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে এসেও শান্তি নেই। বোনদের স্বার্থান্বেষী আর রূঢ় আচরণ আমাকে প্রতিনিয়ত পীড়া দেয়। এতদিন মায়ের জন্য সব কষ্ট সহ্য করেছি। এখন আমি আর পারছি নারে।’

স্নেহা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,’তোর জীবনে তুই এত কষ্ট পাবি তা আমি কোনোদিনও ভাবিনি। আসলে জীবনটা নাটকের চেয়েও নাটকীয়! দুমুখী মানুষের থেকে দূরে থাকা শ্রেয়। তারা কাল সাপের ন্যায়। সুযোগ বুঝে ছোবল মারে। কপালের খন্ডন বিধাতা ছাড়া কেউ খন্ডিতে পারে না। কিন্তু তোর বোনগুলো এতটা রূঢ় যে হবে, তা আমি কল্পনাও করিনি। তুই অত ভাবিস না বোন। পারলে ঢাকায় চলে আয়। আমার বাসায় থাকবি। লেখাপড়া তো করেছিস। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবি। কারো উপর নির্ভর করা লাগবে না। মোদ্দা কথা অন্ততপক্ষে আত্মনির্ভরশীল তো হতে পারবিই।’

জান্নাত তটস্থ হয়ে বললো,’ হুম। কিন্তু আমি কিভাবে তোর কাছে আসবো বল? আমার কাছে যে এক পয়সাও নেই। তারউপর ভালো জামাকাপড় নেই। পরনে মলিন একটা জামা। এসব নিয়ে আমি কিভাবে পাড়ি দেই!’

স্নেহা আশ্বস্ত করে বললো,’অপস! তোকে এত ভাবতে হবে না পাখি। আমি বিকাশে কিছু টাকা পাঠাচ্ছি। তার থেকে কিছু টাকা দিয়ে তুই ভালো একটা জামা কিনবি। তারপর ঢাকায় আসলে আমি তোকে প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিবো।’

‘ কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু নয় পাখি। বিপদের দিনে যদি তোকে এতটুকু সহায়তা করতে না পারি,তোর পাশে না দাঁড়াতে পারি তাহলে কিসের বন্ধুত্ব?’

‘তোর মতো বান্ধবী পেয়ে আমি গর্বিত। এত কষ্টের মধ্যে থেকেও তোর এই আশ্বস্ত মূলক কথাবার্তা শুনে আমি পুলকিত। আল্লাহ তোকে দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম প্রতিদান করুক।’

‘ আমিন। শোন না, তুই তো প্রথম ঢাকায় আসবি। এর আগে কখনো আসিস নি। এখানে আসাটা তোর জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারউপর আমি মোহাম্মদপুরে থাকি। আমার বাসার ঠিকানা তোর ফোনে সেন্ড করে দিচ্ছি। আর কোনোমতে সিলেট আয় আমি তোকে নিতে আসবো।’

জান্নাত কৃতজ্ঞতার সহিত বললো,’আচ্ছা ঠিকাছে।’

জান্নাত বিকাশে টাকা তুললো। ভালো একটা জামা কিনে তা পরে নিলো। উদ্বেল চোখে আকাশপানে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর পরদিন সকাল বেলায় সিলেট যাবার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো। দুই বান্ধবী একসাথে মিলিত হলে স্নেহা উচ্ছ্বসিত হয়ে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,’সেই যে কবে দুইজন একসাথে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। দাদুর মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় এসেছি,আজ এতটা দিন পরে তোর সাথে দেখা হলো। দাদুর মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ি আব্বু আম্মু গেলেও আমি আর যাইনি। অসুস্থতার জন্য তোর বিয়েতেও যেতে পারিনি।’

পরক্ষণেই কুণ্ঠিত হয়ে বললো,’ কিন্তু জান্নাত! তোর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। আমার পাখিটা তোর জীবনটা এরকম কেন হলো? আল্লাহ তোকে সাহায্য করুক, ধৈর্য ধরার তাওফিক দান করুক।’

জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’ সবই কপাল।’

‘ হু,চল এবার বাসায় যাওয়া যাক।’

বাসায় এসে কলিং বেল বাজালে স্নেহার মা, সাদিয়া এসে দরজা খুললেন। জান্নাত তাকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো।

সাদিয়া মুচকি হেঁসে বললেন,’ অনেক দিন পর তোমার দেখা পেলাম মা। স্নেহার মুখ থেকে তোমার ব্যাপারে সবই শুনেছি।’ তারপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,’ ফুলের মতো মেয়ে তুমি। তুমি এত কষ্ট করবে তা কখনো ভাবিনি। কি আর করার আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে পরীক্ষা করেন। কুরআনে তিনি বলেছেন,’ মানুষ কি মনে করে যে,আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে,আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?'[১]

নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবনের তুলনা তো পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি, অতঃপর তার সাথে যমীনের উদ্ভিদের মিশ্রণ ঘটে, যা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু ভোগ করে। অবশেষে যখন যমীন শোভিত ও সজ্জিত হয় এবং তার অধিবাসীরা মনে করে যমীনে উৎপন্ন ফসল করায়ত্ব করতে তারা সক্ষম, তখন তাতে রাতে কিংবা দিনে আমার আদেশ চলে আসে। অতঃপর আমি সেগুলোকে বানিয়ে দেই কর্তিত ফসল, মনে হয় গতকালও এখানে কিছু ছিল না। এভাবে আমি চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি।[২]
অর্থাৎ এমন ফসল যা কেটে এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয় এবং ক্ষেত পরিষ্কার হয়ে যায়। পার্থিব্য জীবনকে এইরূপ ক্ষেতের সাথে তুলনা করে তা যে ক্ষণস্থায়ী; চিরস্থায়ী নয়, তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। ফসলও বৃষ্টির পানি দ্বারা বড় এবং সবুজ ও সতেজ হয়, কিন্তু পরে তা কেটে-শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।
এছাড়াও তিনি বলেন,’হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার।'[৩]
ঐ দিনকে ভয় করো,’যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হবে না।'[৪]
কাজেই চিন্তা করো না। তোমার সাথে যারা অবিচার করেছে, ধৈর্য ধরো তারা একদিন এর ফল ভোগ করবে। আর হ্যাঁ তোমার যতদিন মন চায় আমাদের বাসায় থেকো। এবার ফ্রেশ হয়ে এসো আমি খাবার সার্ব করে দিচ্ছি।’

জান্নাত আঁতকে উঠে বললো,’ না চাঁচিমা,আমি তা চাই না। আমি চাই আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুক। বিশেষ করে আমার স্বামী আর তার পরিবারের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। তাদের জন্য আমি কখনোই বদ দোয়া করতে পারি না। মন থেকে তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করি।’

‘তা তো অবশ্যই মা। বদ দোয়া দিতে কে বললো! কিন্তু যে যেমন কাজ করবে, সে তো তেমন ফলই ভোগ করবে। তাই না?’

জান্নাত মাথা নাড়িয়ে বললো,’ হ্যাঁ। জাজাকিল্লাহু খাইরান চাঁচিমা। আমার জন্য দোয়া করবেন।’

‘ হ্যাঁ মা অবশ্যই। ফি-আমানিল্লাহ।’

খাওয়া-দাওয়া করে জান্নাত স্নেহার রুমে আসলো। স্নেহার একটা হাত ধরে বললো,’ আমি কতদিন তোর বাসায় থাকবো বল? আমায় একটা চাকরি জোগাড় করে দে। সাথে একটা বাসা ঠিক করে দিবি?’

স্নেহা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,’ সবেমাত্র এলি এখনই আলাদা হওয়ার চিন্তাভাবনা করছিস কেন?’

‘ তা না। আমি আত্মনির্ভরশীল হতে চাই বোন।’

‘ তা তো অবশ্যই। শোন না আমার একটা স্বপ্ন আছে। তোকে নিয়ে আমি একটা উদ্যোগ নিবো।’

‘ সেটা কিরকম?’

‘আমি ‘তাকওয়া’ নামক একটা বোরখার শপ খুলবো। তুই তো সেলাইয়ের কাজ জানিসই। আমিও জানি। আর আমার আব্বু তো নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যাস্ত। আব্বুকে আমার এই স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। প্রথমে আব্বু না করলেও পরে তাতে একমত হয়েছেন। এতে আর কোনো টেনশন নাই। দুইজন মিলে দুমছে কাপড় সেলাই করবো। আমাদের এই উদ্যোগ অনলাইনেও অনেকটা জুড়ে থাকবে। আল্লাহ চাহেন তো দেখবি, আমরা এতে সফল হবো। সাথে তুইও আত্মনির্ভরশীল হইবি!’

জান্নাত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,’ মাশাআল্লাহ উত্তম পরিকল্পনা! ঠিক আছে তুই উদ্যোগটা নে।’

‘ ভাবছি সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু করবো। কি বলিস?’

‘ তাই ভালো।’

আচ্ছা তুই এখন একটু বিশ্রাম নে জান্নাত। ঘুমানোর চেষ্টা কর। তারপর গোসল করে তোকে নিয়ে শপিং করতে যাবো। জান্নাত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মেঘালয়ের কথা তার প্রচন্ড মনে পরছে। লোকটা তাকে অবহেলা,মারধর করলেও সে তাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। ভাবনার সাগরে ডুব দিতে গিয়ে জান্নাত কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার হদিস পায়নি। বিকেলে ঘুম ভাঙলো। স্নেহা মিষ্টি হেঁসে বললো,’ কি মেডাম ঘুম ভেঙে গেলো! ঘুম ভালো হয়েছে তো?’

জান্নাতও মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,’ অনেক!’

‘ ঠিকাছে এবার গোসল করে নে জলদি। আমরা একটু পরই বের হবো।’

‘ আচ্ছা।’

জান্নাত গোসল করে নিলো। তারপর দু’জন শপিং করতে বের হলো। জান্নাতের জন্য স্নেহা বেশকিছু জামা আর বোরখা, হিজাব,নিক্বাব,হাত মোজা, পা মোজা ইত্যাদি ক্রয় করলো। নিজের জন্যও অনেক কিছু কিনলো। আসার সময় জান্নাত মেঘালয়কে দেখলো তানভীর সাথে কথা বলতে বলতে শপিং মলে ঢুকছে। ক্ষনিকের জন্য জান্নাত থমকে দাঁড়ালো। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,’ এক মিনিট! ও কি মেঘালয় ছিলো? কিন্তু মেঘালয় তো ওরকম না। তাহলে সে কে? কিন্তু আমি তো তানভী ভাইয়াকেও পাশে দেখলাম!’

স্নেহা জান্নাতকে থেমে যেতে দেখে,হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বললো,’ কি হয়েছে জান্নাত? এভাবে হুট করেই দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’

জান্নাত চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে পদার্পণ করে বললো,’ ও কিছু না,চল।’

রিকশায় উঠে জান্নাত অস্বস্তিতে হাসফাস করছে। তার মনে হচ্ছে ওটা মেঘালয়ই ছিলো। মেঘালয়ের কথা মনে পড়লে আজও তার হৃৎপিণ্ড ক্রমশ উঠানামা করে। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মানুষটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। অথচ মেঘালয় একদিন তাকে মারধর করে বলেছিলো,’ আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যা। আর কখনো এদিকে আসবি না। আমাকে ভুলে যা!’

কথাটি মনে পড়তেই জান্নাতের চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

‘আমি কখনোই তোকে ভুলতে পারবো নারে বোকা।
কারণ,তুই যে আমার হৃদয়ে বন্দী এক জোনাকি পোকা!’

রেফারেন্সঃ-
[১]সূরা আল আনকাবুত,আয়াত নম্বর:০২
[২] সূরা ইউনুস,আয়াত নম্বর:২৪
[৩] সূরা আল হাজ্জ্ব,আয়াত নম্বর:০১
[৪] সূরা বাকারাহ্,আয়াত নম্বর:২৮১

চলবে…………

বিঃদ্রঃ দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখীত। আমি আশাবাদী যে,আপনারা এই পর্বে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আর হ্যাঁ গল্পটা শেষের দিকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here