#মেঘফুল_১২
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
_____________________________________
পরক্ষণেই সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,” আরে আমি তো পালিয়ে এসেছি! তাহলে তারা কেনই বা আমাকে খুঁজবে? বোকা মন আবোলতাবোল বকে যায়। হাহাহ..!”
দীলুর বিয়ে হয়েছে আজ এক মাস হলো। তার স্বামী কানাডা থাকে। পরের বছর নীলুর সাথে দীলুর দেবরের বিয়ে হবে। কানাডা না যাওয়া অব্দি দীলু বাপের বাড়িতেই থাকবে। দীলু আর নীলু যখন থেকে শুনেছে জান্নাত আর স্বামীর বাড়ি যাবে না তখন থেকেই দু’বোন জান্নাতকে অন্য চোখে দেখা শুরু করলো। তাকে অবহেলা করে। সারাদিন এটা ওটা দিয়ে তাকে কাজে নিয়োজিত রাখে। জান্নাত দিনের বেশিরভাগ সময়ই রান্নাঘরে খেটে মরে। তার এক বোনও তাকে কাজে সহায়তা করে না। রান্না-বান্না, গোয়াল ঘরের গোবর ফেলা, মায়ের সেবা-যত্ন করা সবই জান্নাত একা হাতে সামলায়। তবুও মুখ ফুটে তার বোনদের বলে না যে,আমায় একটু কাজে সহায়তা করো। দীলু,নীলু রাজ রাণীর মতো চলাফেরা করে। কেউ তাদের কিচ্ছুটি বলেও না। তাদের ভাই জিসানকে জমির মিয়া একটা হাফিজি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটাকে নিয়ে আপাতত তার কোনো চিন্তা নেই। সব চিন্তা জান্নাতকে নিয়েই। মেয়েটাকে তিনি কিছুতেই বুঝাতে পারেন না।
—
এদিকে জান্নাত আসার সময় কোনো কাপড় সাথে করে আনে নি। পরনে একটা সেলোয়ার-কামিজই ছিলো। দীলু তাকে একটা জামা দিয়েছে। এই দু’টো দিয়ে কয়দিনই বা চলে? একটা জামা ছিঁড়ে গেছে। পরনের কাপড়টাও ময়লা হয়ে আছে। বাবাকে যে বলবে তাও সাহসে কুলোয় না। বোনরা এসব দেখেও না দেখার মতো ভাব নিয়ে থাকে। তাও নিজেদের একটা জামা পরতে দেয় না। সারাদিন বুয়ার ন্যায় খাটাবে। মাঝেমধ্যে জান্নাতের প্রচন্ড বিরক্তি লাগে। তার কোথাও শান্তি নেই। আর তার মায়ের অবস্থাও তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। সে নিজেও শুকিয়ে গেছে। মুখে স্পষ্ট দারিদ্র্যের চাপ। বোনগুলো যেন স্বার্থান্বেষী হয়ে উঠেছে। নিজেদের স্বার্থ নিয়েই সবসময় ভাবে। বোনদের আচরণ,সারাদিন এমন খাটা জান্নাতের মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। সে এক গাদা থালা-বাসন নিয়ে পুকুরে গেলো ধোয়ার জন্য। ধোয়া শেষ হলে একটা চিৎকার তার কানে এলো। তার বুকটা ধক করে উঠলো। থালা-বাসন নিয়ে দ্রুত ঘরে আসতেই দীলু বললো,” আপা মা আর নেই!”
জান্নাত যেন চোখে অন্ধকার দেখছে। মাথাটা ভনভন কর উঠলো। হাতের থালা-বাসন মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে উঠলো। জান্নাত সেন্সলেন্স হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। দীলু মুখে পানির ঝাঁপটা দিলে তার জ্ঞান ফিরলো। তারপর সে চুপচাপ মেঝে থেকে উঠে মায়ের লাশের পাশে গিয়ে বসলো। মুখটা কেমন হাসো হাসো করছে। হলদেটে একটা ভাব রয়েছে। যেন কেউ কাঁচা হলুদ বেটে রাবেয়ার মুখে মাখিয়ে দিয়েছে। জান্নাত দু’হাত দিয়ে মাকে ঝাঁপটে ধরে কপালে একটা চুমু খেলো। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দীলু,নীলু বিলাপ করে কাঁদতে গেলে জান্নাত তাদের থামিয়ে দিলো। কঠোরভাবে নিষেধ করলো কেউ যেন বিলাপ করে না কাঁদে।
—
আমরা কেউ সহজে আপনজনের মৃত্যু মেনে নিতে পারি না। আর জম্মালে একদিন মৃত্যুবরণ করতেই হবে এটা চিরন্তন সত্য কথা। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাওত।’ অর্থাৎ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে।’
তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আমাদের সমাজে বিশেষ করে,আমাদের সংস্কৃতিতে যখন আপনজনদের মৃত্যু হয়, তখন আমরা শোকাহত হয়ে কান্নাকাটি করি। আমরা জানি না যে, উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করে মৃত্যুর শোক প্রকাশ করা কত জঘন্য মাত্রার একটি গুনাহের কাজ। যদি মৃত ব্যক্তির জন্য আপনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেন তাহলে আপনার কঠিন শাস্তি হবে। যা বিভিন্ন হাদিসে উঠে এসেছে।
—
আমাদের সমাজে কেউ মারা গেলে তখন মৃত ব্যক্তির পরিবার যদি তার জন্য কান্নাকাটি না করে তখন পাড়ার লোকজন বলে, মৃত ব্যক্তির জন্য কারো টান নেই। আহারে লোকটা সারা জীবন সবার জন্য কত কিছু করলো কিন্তু তার জন্য কেউ একটুও কান্না করে না, কারো ভালোবাসা নেই। পরিবারের লোকেরা সব আজরাইলের মতো। কারো মনে দয়া মায়া নেই,এ ধরনের কথা বলে। অথচ মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করলে যে, মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের অধিক মাত্রায় কান্নাকাটির জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।[১]বুখারী-১২২৬ নম্বর হাদিস
এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় মৃত ব্যক্তির জন্য কাঁদলে মৃত ব্যক্তিকেই শাস্তি দেয়া হবে। যখন কোনো জীবিত ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে কান্না করে, তখন এই জীবিত মানুষদের কি শাস্তি দেয়া হবে, এ ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হজরতে আবু মালিক আশইয়ারী (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে চারটি জাহিলিয়াতের অভ্যাস রয়েছে, যা তারা ত্যাগ করবে না। আর তা হচ্ছে, স্বীয় বংশের গৌরব করা, অন্যের বংশকে দোষারোপ করা, তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করা। এই হাদিসের শেষ অংশে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে ক্রন্দনকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করলে কিয়ামতের দিন তাকে দুর্গন্ধযুক্ত পায়জামা এবং শরীরের পচন সৃষ্টিকারী পোশাক পরানো হবে।[২]মুসলিম: কিতাবুল জানায়েজ
এছাড়াও রাসূল (সা.) আরো বলেছেন,‘যারা মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে গাল চাপড়ায়, জামার বোতাম ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলিয়াতের যুগের মতো চিৎকার করে কান্না করে। তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’ [৩]বুখারি, হাদিস নং-১২২০
এই হাদিস দু’টি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যারা আহাজারি করে মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করবে তারা রাসূল (সা.) এর দলভুক্ত না। মৃত্যুর ওপর বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করে, তাহলে তাকে কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় উত্থান করা হবে যে, তার ওপর আলকাতরাযুক্ত ও মরিচাযুক্ত পোশাক থাকবে।[৪]মুসলিম,হাদিস নং-৯৩৪
পৃথিবী থেকে আপনজনের বিদায় কতটা ব্যথার আমরা সবাই বুঝি। রাসূল (সা.) অশ্রু গড়িয়ে পড়া নিয়ে কখনোই বাঁধা দেননি এবং এর ফলে আপনার কিঞ্চিত পরিমানও গুনাহ হবে না। কারণ অশ্রু থামানোর ক্ষমতা সব মানুষের নেই। অশ্রু তো ঝরে পড়বেই। এই হাদিস দ্বারা সেই ব্যক্তিদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যাদের চোখে অশ্রু থাকুক বা না থাকুক চিৎকার-চেঁচামেচি করে, চারপাশের পরিবেশ অশান্ত করে ফেলেন অথবা হামাগুড়ি দিয়ে নিজের শরীর চাপড়াতে থাকে। সেই সব ব্যক্তিদের প্রতি অভিশাপ দেয়া হয়েছে। যারা নীরবে- নিভৃতে মৃত ব্যক্তির জন্য চোখের অশ্রু ঝরায়। তাদের ব্যাপারে কোরআন এবং সুন্নায় কোনো গুনাহের কথা বলা নেই। তবে চেষ্টা করতে হবে ধৈর্য ধারণ করার জন্য। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,’হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।[৫]সূরা বাকারা,আয়াত:১৫৩
—
রাবেয়াকে শেষ গোসল দিয়ে জান্নাত নিজেও গোসল করে নিলো। সিজদায় লুটিয়ে পড়লো। মনের যত কথা ছিলো সব তার প্রভুকে বললো। জমির মিয়া স্ত্রীর মৃত্যুতে কিছুটা ভেঙে পরলেন। রাবেয়াকে দাফন করা হলে জান্নাত দূরের সড়কে দাঁড়িয়ে তার মায়ের কবরটা দেখে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে। তার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। তার দুঃখগুলো শোনার মতো আর কোনো আপনজন রইলো না। এখন আর কেউ তাকে শান্তনা দিয়ে বলবে না,”জান্নাত সবর কর মা। আল্লাহ তো আছেনই তোর সাথে!” জান্নাত মৃদুস্বরে মাগো বলে আঁতকে উঠলো।
—
জান্নাতের মাকে হারানোর সেই বেদনা আজো সমান ভাবে বুকের গহীনে বাজে। নিরন্তর সেই বোবা কষ্ট তাকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি দেয়। এছাড়াও বোনদের অবহেলা, স্বার্থান্বেষী আচরণ তাকে পীড়া দেয়। সে ঠিক করলো এখানে আর থাকবে না। এতদিন মায়ের জন্য সব কষ্ট মুখ বুঁজে সহ্য করে গেছে। আর কার জন্য সে কষ্ট করবে, খাটবে? সে তো ডিভোর্সিও নয়। এমন পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে পড়ে জান্নাত বিধবা, ডিভোর্সি নারীদের কষ্ট উপভোগ করতে পারলো। তার তো ডিভোর্স হয়নি ইচ্ছা করলে আবারও স্বামীর গৃহে চলে যেতে পারবে। কিন্তু বিধবা বা ডিভোর্সি নারী কি সেটা পারবে? পারবে না। জান্নাত তার বোনদের রূঢ় আচরণে অতিষ্ঠ। ওরা তো তার আপন হয়েও আপন রইলো না। সে চোখের জল মুছে মনকে শক্ত করলো। আজ একজনের সাথে যোগাযোগ করবে। তারপর শীগ্রই এ বাড়ি ছেড়েও সে চলে যাবে। ফোনটা বের করে…..
চলবে……..
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। জানিনা কতটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে পেরেছি। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভুল দেখতে পেলে তা উল্লেখ করে দিবেন। উহিব্বুক ফিল্লাহ।❤️