#মুনিয়ার_পৃথিবী
বড় গল্প (পর্ব ২)
নাহিদ ফারজানা সোমা

“তোমাকে সবাই সবসময় অপমানের মধ্যে রাখে,তাইনা?একদম যে বুঝিনি,তা নয়,তবে এতোটা, তা বুঝিনি। সারাদিন কাটে বাইরে, তুমি নিজেও কিছু বলোনা,কি করে বুঝবো বলো? আমি বাসা দেখা শুরু করবো কাল থেকেই। ”

“প্রশ্নই উঠে না। আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। ”

“মুনিয়া, তুমি কি মনে করছো সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে?বাপি-মামনি তোমাকে আম্মু আম্মু করে মাথায় তুলে রাখবে?নায়লা-শায়লারা ভাবী ভাবী বলে অস্হির হয়ে যাবে?কিছুই হবেনা। দিন দিন অত্যাচার বাড়বে। আমি তোমার স্বামী। বাপ-মার অপমান যেমন ছেলের গায়ে লাগে,স্ত্রীর অপমানও স্বামীর গায়ে লাগে।”

” আমার লড়াই আমাকে লড়তে দাও। দেখো,সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা -ভাবনা আছে,আমার কিছু “আমিত্ব” আছে। আমি মনে করি,”Love conquires all.” আমি সেটা প্রমাণ করবো। তুমি মনে করছো,আমার খুব অপমান হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে? যদি হয়েও থাকে,সেটা থেকে নিজেকে রক্ষা আমি নিজেই করতে পারবো।”

এদিকে কথার কথা বলে ফেলেছিলেন মোর্শেদ সাহেব। এখন খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আবরার তাঁর নয়ন মনি। সায়মারও প্রথম সন্তানের উপর টান অন্যদের থেকে সামান্য হলেও বেশি এটা তিনি বেশ বুঝতে পারেন। সেই আবরার আলাদা থাকবে,তা ভাবতেও পারেন না মোর্শেদ। আবরার-মুনিয়া ড্রইং রুম ছেড়ে যাওয়ার পরে নায়লা বলে উঠলো,”বাপি,দাদাকে কি বললে তুমি? স্যরি বলে ফেলো,প্লিজ। দাদা অন্য বাসায় থাকবে,বাসায় আসলে আমরা দাদাকে দেখতে পাবোনা,এটা আমি ভাবতেই পারিনা। প্লিজ বাপি,দাদাকে স্যরি বলো।”

সায়মা শুধু বললেন,”আমার ছেলে এই বাড়ি থেকে যেন না যায়,যাওয়ার চিন্তাও যেন না করে,সেই দায়-দায়িত্ব এখন তোমার।”

রাতে খাওয়ার টেবিলে মোর্শেদ সাহেব ইগো বিসর্জন দিয়ে বললেন,” আবরার,বাপ,বুড়ো মানুষ, কি বলতে কি বলে ফেলেছি মনে রাখিস না। আজকে এমনিই একটু শরীরটা খারাপ লাগছিলো। এই বাড়িতো তোদের চারজনের জন্যই। বুড়ো বাপের কথায় আবার বাড়ি খুঁজতে বের হোস না।”

আবরার মাথা নিচু করে খেতে লাগলো। উত্তর দিলো মুনিয়া।
“না বাপি,আপনাদের ফেলে আমরা কোথাও যাবো না।”

সায়মা-নায়লা চোখাচোখি করলেন।এই চোখের ভাষার অর্থ সবার কাছেই খুব স্পষ্ট ছিল, “এই শানশওকত ছেড়ে মেয়ে তুমি নড়বে? তোমার মতো চালাক মেয়েরা এ বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে।”

দিন যেতে থাকলো। মোর্শেদ -সায়মা দম্পতি চোখের সামনে বৌমার কর্মকাণ্ড দেখতে থাকেন, হাসছে, গায়ে পড়ে গল্প করছে, ঘর সাজাচ্ছে, নিত্যনতুন আইটেম বানাচ্ছে, শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে বাপের বাড়ি, মামা-চাচার বাড়ি,ননদদের বাড়ি যাচ্ছে। মেহমান এলে আদর আপ্যায়ন করছে। শায়লা-নায়লার চার ছেলেমেয়ে মামীমনি বলতে অজ্ঞান। এই চার বাচ্চার নানাবাড়িতে মূল আকর্ষণ এখন মামীমনি। নন্দাই দু’জনও ঠারেঠুরে মুনিয়ার প্রশংসা করে শ্বশুর -শাশুড়ির সামনে। শায়লাও অনেকটা নমনীয়। তার বড় মেয়েটা মানসিক প্রতিবন্ধী। বাচ্চাটাকে তার মামী রোজ এই বাসায় নিয়ে আসে,তার খাওয়া-পরা-গোসল করানো-টয়লেট ট্রেনিং সব মুনিয়া নিজের হাতে করে। এতো আদরের সাথে,এতো নিখুঁত ভাবে, শায়লার মনে হয় সে নিজের মেয়ের কাজ এতো ধৈর্য ধরে কখনো করেনি। সিনথিয়াও মামীকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চায়না। রোজ রাতেই বিদায়ের সময় সিনথিয়ার আহাজারিতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মুনিয়া শায়লাকে প্রস্তাব
দেয়,”সিনথিকে আমার কাছেই রাখো না। ওর কোন অযত্ন হবেনা। আমার কাছে ঘুমাবে। ” শায়লার মন দ্রবীভূত হয়,কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মুনিয়াকে ভাবীর সম্মান, ভালোবাসা দেয়ার মানসিকতা তার নেই, তাই সে বলে,”সারাদিন বাচ্চার দেখা পাইনা, রাতটুকুতেই শুধু বাচ্চাদুটোর দেখা আমি আর তার বাবা পাই। এখানে রেখে যাবো কেন? আর আপনিই বা পরের বাচ্চার জন্য কেন এতো করেন, আমি ঠিক বুঝিনা। লাভ কি আপনার? সবাই ভালো বৌ বলবে,আমরা গলে হালুয়া হয়ে যাবো, তাই?বাই দ্য বাই, আপনাকে মেনি থ্যাংকস, আমার মেয়ের হয়ে।”

সায়মা মোর্শেদ সাহেবকে প্রায় বলেন,” মেয়েটাকেতো ভালোই মনে হয়, তাইনা?”

” ভালোই তো মনে হয়।এ পর্যন্ত খারাপ কিছু তো দেখলাম না।”

“বেশি চালাকও হতে পারে, পারে না?”

“সেরকমতো মনে হয়না। আমার কাছেতো জেনুইন ই লাগে।”

“ওর মা মাঝেমধ্যে ফোনে আমার সাথে কথাবার্তা বলে,ভালোই তো লাগে। ”

“ফ্যামিলিটাকে ভদ্রইতো মনে হয়।”

সায়মা মাঝেমধ্যেই মুনিয়ার চোখের দিকে তাকান। ঝকঝকে, নিষ্পাপ দৃষ্টি। খুশি হলেও বোঝা যায়,দুঃখ পেলেও বোঝা যায়।

এর মধ্যে ঘটলো এক বিপর্যয়। আশরাফের অ্যাকসিডেন্ট হলো। প্রবল ব্যক্তিত্বশালী প্রাক্তন সেক্রেটারি বাবা তখন কেবলই সন্তানের চিন্তায় কাতর,ব্যাকুল,অসহায় এক পিতা, সায়মা পাগলপ্রায়, বোনেরা ডাক্তার হলেও সেই সময়ে অনেকটা বোধবুদ্ধিহীন, চার ভাই -বোনে বড্ড টান, বলতে গেলে একহাতে সব সামলালো মুনিয়া। দুষ্প্রাপ্য গ্রুপের রক্ত, চার ব্যাগের মধ্যে দুই ব্যাগ দিলো মুনিয়া আর তার সেজ বোন। আশরাফের বন্ধুরা ম্যানেজ করলো বাকিটা।বাসায় নিয়ে আসার পরেও দেবরের পরিচর্যার ভার মুনিয়া অনেকটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

” বয় তো আছেই, নার্সও আসে ড্রেসিং এর জন্য, তোমার নিজের এতো ছোটাছুটির দরকার কি?”

“সেবা করতে আমার খুব ভালো লাগে মামনি। সে যেই হোক। সেখানে ছোট ভাইয়াতো আমার দেবর,নিজের দেবর। ”

” রক্ত কি এই প্রথম দিলে?”

“না মামনি,এই নিয়ে তিরিশ বার। প্রতি চারমাস পরপরই দিই,আঠারো বছর বয়স হতে। আব্বু -আম্মুর অনুরোধে চার বোনই রক্ত দিই। আব্বু -আম্মুও দিতেন,এখন বয়সের কারণে দিতে পারেন না। আমার বড় বোনের ছেলেটা না মামনি,এই আঠারো বছর বয়স হলো সেদিন, বড় আপা ঐদিনই ছেলেকে দিয়ে রক্ত ডোনেট করিয়েছে, পুড়ে যাওয়া এক রোগির জন্য।”

“তুমি ব্লাড ডোনেট করেছো চারমাস পরপর,টের পাইনিতো কখনো?”

“ওমা! টের পাওয়ার কি আছে? এটা কি এমন ব্যাপার?”

“তিরিশ বার রক্ত দিয়েছো,আর দিওনা মা।”

মুনিয়া চমকে শাশুড়ির দিকে তাকায়। এমন স্নেহার্দ্র গলায় কথা সায়মা তার সাথে কখনো বলেন নি।

“কেন মামনি?কেন দিবো না?”

“তোমার নিজের গায়ে কয় ছটাক রক্ত? নামেও পাখি,খাওয়াও পাখির মতো।”

শাশুড়ির মুখে এই প্রথম স্নেহের কথা। এই যে শুরু হলো,এটা আর শেষ হবেনা। মুনিয়া ভালো করে জানে সে কথা,ছোটবেলা হতেই জানে,ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়।ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়। তাছাড়া আব্বু -আম্মু সেই ছোট্ট বেলা থেকে শিখিয়েছেন, “কে তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করলো সেটা দেখার আগে তুমি কার সাথে কেমন ব্যবহার করছো সেটা দেখো। কেউ যদি অকারণে তোমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে, সেটা তার শিক্ষার অভাব,কিন্তু তুমি কেন নিজেকে সেই স্তরে নামাবে? যদি একান্তই কারো সাথে না মিলে, তার থেকে সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রাখবে।”

বাবা-মায়ের কথা ও জীবনদর্শন সবসময় নিষ্ঠার সাথে পালন করে এসেছে মুনিয়া। শ্বশুরকুলের পরিবেশ তার অনুকূল হবেনা,তা বুঝতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয়না। আবার শ্বশুরবাড়ি যে তার জন্য প্রাণঘাতী হবে না,এটাও সে ভালোই বুঝতে পেরেছিলো। বাকি রইলো সবার ব্যবহার। এই ব্যবহার তার নিজের ব্যবহার দিয়ে, সৌজন্যবোধ দিয়ে পাল্টে দিতে পারবে,এই আত্মবিশ্বাস নিজের উপর শতভাগ ছিল মুনিয়ার।তাছাড়া নিজের কাজকর্ম নিয়ে সে এতো ব্যস্ত থাকে যে অন্যের দুর্ব্যবহার নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকার সময় কোথায় তার?

**********************************************************
ডাইনিং টেবিলে কথা হচ্ছে দু’জনের।

” তোমার দাদি তোমাদের বাসাতেই থাকেন?”

“জ্বী মামনি।”

“তোমার তো বোধ হয় দুই চাচা আর এক ফুপু আছেন,তাইনা?”

“জ্বী।”

“তোমার দাদি উনাদের বাসায় যান না?সবসময় শুনি,তোমাদের বাসায়।”

“কিভাবে যাবে মামনি?দাদিতো চলতে ফিরতে পারেন না।”

“বাথরুম? ”

“আব্বু বা আম্মু ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়,কমোডে বসিয়ে হাত ধরে রাখে, টুলে বসিয়ে গোসল করিয়ে দেয়, মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়।তাছাড়া আমরা চারবোন,চাচু-ফুপু যে যখন পারি,করি। ”

“শুধু এক ছেলের উপর চাপ কেন?তোমার চাচা-ফুপুরা মাঝে মধ্যে নিতে পারেন না?”

” চাচু-ফুপুর দোষ নেই, মামনি। উনারা নিয়ে যেতে চান,যথেষ্ট করেন। আব্বু-আম্মুই দাদীকে ছাড়েন না। বলেন, মা ভাগাভাগির জিনিস না।”

“তোমার বাবার না হয় নিজের মা, তিনি মায়ের জন্য যা করার করুন,কিন্তু বৌকে খাটাচ্ছেন কেন?”

“মামনি, আমার মা আর দাদির সম্পর্ক অসাধারণ। মা যেমন বিয়ের পর থেকে দাদা-দাদির সেবাযত্ন করেছেন, সম্মান করেছেন,আমার দাদা-দাদিও তা শতভাগ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমার নানাতো অনেক আগে মারা গেছেন,নানু যখন সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গেলেন, দাদা-দাদি বাবাকে বললেন নানুকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে। আমার তিন মামা আর দুই খালা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তখন মিটিং করে দাদা-দাদি আমার
মামাদের বললেন,বাবাজিরা,তোমরা সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকো,রাতে বাড়ি ফিরো, মায়ের উপযুক্ত দেখাশোনা করতে পারবেনা। বৌমারা খুব ভালো,তাঁরা নিশ্চয় শাশুড়ির দেখভাল করবেন। কিন্তু তাঁরাতো তোমাদের মায়ের সন্তান নন। তোমাদের মায়ের সন্তান তোমরা। আমাদের বৌমা তাঁর বড় মেয়ে। বেয়ানের শতভাগ অধিকার আছে মেয়ের বাসায় থাকার।আমরা তিন বুড়ো-বুড়ি গল্পগুজব করে দারুণ সময় কাটাবো। আমার ছেলে-বৌমা আর চার নাতনি আমাদের সেবা যত্ন করবে। তোমরাও যে যার সাধ্যমতো করবে। আম্মু খুব কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন দাদা-দাদির প্রতি। দাদা তখন বললেন, আম্মা, কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই ওঠেনা। আমরা আমাদের ছেলের বাড়িতে থাকতে পারি,বেয়ান মেয়ের বাড়িতে থাকতে পারেন না? বেশি করে মায়ের সেবা করো। আব্বুও নানুকে মায়ের মতো দেখতেন। আমরা চারবোনও নিয়ম করে নানুকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতাম,সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিতাম, নখ কেটে দিতাম, গল্প করতাম। দাদা-দাদি বলতেন,লেখাপড়া যেমন জরুরি, আপনজনের দুঃসময়ে তাঁকে দেখাশোনা করা আরও অনেক জরুরি। দাদা নানু বেঁচে থাকতেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তার কয়েক মাস পরে নানু। দাদি অসুস্থ হওয়ার পরে আম্মু বললেন,”আমার মা’কে আমি কারোর কাছে দিবোনা।”

“একজন নার্স রাখলেতো তোমার মায়ের উপর চাপ কমে যায়।”

“চাচু-ফুপু বলেছিলেন তো। আম্মু রাজি না। তাছাড়া আম্মুকে সবাই হেল্প করে। আব্বু, আপারা,আপাদের বাচ্চারা,আমি যখন যাই আমি। চাচা-চাচী -ফুপু-ফুপা প্রায় দিন আসেন,উনারাও অনেক সাহায্য করেন। শারীরিক, আর্থিক। জানেন মামনি,আপনাকে আমার বোনের ছেলের কথা বললাম না যার আঠারো বছর বয়স হলো,সে তো দাদিকে খাইয়ে দেয়, কোলে করে নিয়ে হাঁটে, সেও বাথরুম করাতে পারে, ছোট আপার সাত বছরের ছোট্ট মেয়েও দাদির চুলে বেনি করে দেয়, পা টিপে দেয়। অসুবিধা হয় না মামনি।”

সায়মা অবাক হয়ে শোনেন। অতীতের অনেক কথা মনে পড়তে
থাকে। তাঁর বৃদ্ধ বাবার অসহায় মুখ,ঘরের মধ্যে বিকট গন্ধ, ভাই বৌএর কঠিন চেহারা, তাঁদের বোনদের সাথে ভাইদের কথা কাটাকাটি, মায়ের একমাস হাসপাতালে থাকা, রাতে হাসপাতালে থাকা নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে নীরব কাইজা,
মোর্শেদ সাহেবের বাবা-মায়ের থাকার ব্যবস্থা নিয়ে দফায় দফায় ভাইবোনদের মিটিং, সায়মার অপমানিত শ্বশুরের হাউমাউ করে কান্না পরিবারের সবার সামনে আর তারপরে সপ্তাহ খানিক অস্বাভাবিক নীরবতার পরে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু,গ্রামের বাড়িতে আবরারের দাদির একা মরে পড়ে থাকা _অনেক কিছু এক এক করে মনে পড়তে থাকে সায়মার। তাঁর কান্না আসতে চায়। শুয়ে থাকার নাম করে বেডরুমে যেয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন তিনি, অবহেলায় মরে যাওয়া বাপ-মা-শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য। বহু বছর পরে।

একদিন মোর্শেদ সাহেব খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,”তোমার ফিউচার প্ল্যান কি?”

মুনিয়া মন দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা চিবাচ্ছিল। শ্বশুর তার সাথে কথা বলেন কম। এড়িয়ে যান,গম্ভীর হয়ে থাকেন। আজ তাঁর আচমকা প্রশ্নে মুনিয়া থতমত খেয়ে গেলো।

“আমাকে বলছেন,বাপি?”

“হ্যাঁ। ”

“ফিউচার প্ল্যান? ওভাবে এখনও কিছু ভাবিনি।”

“মানুষ ক্লাস থ্রী-ফোর থেকে ভাবে,আর তুমি এখনও কিছু ভাবোনি? চাকরি-বাকরির ইচ্ছা আছে? ”

মুনিয়া মাথা চুলকে বললো,” না,বাপি।”

“এ পরিবারের মেয়ে -বৌরা সবাই সার্ভিস হোল্ডার, আমার দুই মেয়েই এতো বড় ডাক্তার, আমার আর আবরারের মায়ের ভাগ্নি-ভাইঝি,ভাগ্নে বৌ-ভাস্তে বৌ কেউ ঘরে বসে নেই। ওদের মধ্যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার -ব্যাংকার-টিচার সবই আছে। যে যার জায়গায় খুবই সফল। সেখানে তুমি বেকার বসে থাকবে?”

“উনাদের সাথে আমার পার্থক্য আছে বাপি। আমার রেজাল্ট
সাধারণ। ”

” তোমার জন্য বলে ফেলা সোজা,আমার পক্ষে হজম করা কঠিন। আবরারের বৌ কি হবে ভেবেছিলাম আর সেখানে…
বাই দ্য বাই, বিভিন্ন কোর্স করে নিজেকে একটু ইম্প্রুভ করার ট্রাই করো। ”

সায়মা হঠাৎ বললেন,”আর কারো থেকে ওই বা কম কিসে?
ওর মতো গান আমাদের মধ্যে গাইতে পারে কেউ? ওর মতো রান্না আর কেউ করুকতো দেখি? এইযে শায়লার বাচ্চাকে মায়ের চেয়েও বেশি মমতায় ও পালছে,আর কেউ পারবে এরকম?”

“আমি অ্যাকাডেমিক সাইডটার কথা বলছি।”

“সেটাই বা কম কি? মাস্টার্স করা মেয়ে।”

“কোথা থেকে?”

“সেটাতো মানুষ জিজ্ঞেস করে বেড়াবে না। গলায়তো সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে কেউ ঘোরেনা।”

“বাপি,আমার শিক্ষা নিয়ে আপনি লজ্জিত হবেন না,প্লিজ। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত একজন মেয়ে। আমার কতোগুলো ইচ্ছে বা স্বপ্ন আছে,সেগুলো ইনশাআল্লাহ বাস্তব করবো। আর আপনার যদি কোন উপদেশ থাকে, অবশ্যই আমাকে বলবেন বাপি।”

সায়মা ঠান্ডা গলায় বললেন,”আমি ঢাকা ভার্সিটির মেয়ে,গোল্ড মেডেলিস্ট। আমাকে চাকরি করতে দাও নি কেন? বিয়ে করেছিলে সবার কাছে গর্ব করতে পারবে বলে?”

“তা কেন?তোমার শিক্ষা পরিবারের কাজে লেগেছে। চার ছেলে-মেয়ের চারটাই রত্ন হয়েছে। ”

“ডাক্তার -ইন্জিনিয়ার হলেই সে মানুষ হয়ে যায়না।আর তারা ভালো ফল করেছে আমার জন্য না, টিউটরদের জন্য।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here