মুনিয়ার পৃথিবী
বড় গল্প (৪র্থ পর্ব)
নাহিদ ফারজানা সোমা

“মুনিয়া, এই বাসায় তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না?”

“মাথা কি পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেলো তোমার? বাপি-মামনি-ছোট ভাইয়া সবাই আমাকে মাথায় করে রাখেন,জানো?”

” আমি না থাকলে তখন কি করেন?”

“তুমি বাসায় থাকলেও যা,না থাকলেও ঠিক একই আচরণ করেন। তুমি উনাদের সন্দেহ করলে? আমি বলার পরেও?এটা খুব অন্যায় করলে।”

“তুমিতো দুনিয়ার সবার সম্পর্কে সবসময় বাড়িয়ে কথা বলো,সবাই ফেরেশতা তোমার চোখে। ”

“আমি বাড়িয়ে বলিনা। তবে আমি অন্যের নামে পিছন কথাও বলতে পছন্দ করিনা। রীতিমতো ঘৃণা করি।”

“তাইতো বলছিলাম আমি। যদি তুমি টর্চার্ডও হও, তাও আমাকে মুখ ফুটে বলবেনা।”

“তোমাকে বলবো কেন?আমার ব্যবস্থা আমি নিজে করে নিবো।”

“উঁহু,তুমি তা করোনা। আমার সামনেই আমার ফ্যামিলি মেম্বারস তোমাকে অনেক ইনসাল্ট করেছে,তুমি কিচ্ছু বলোনি।”

“আমার সম্মান এতো ঠুনকো নয় যে তা সামান্য টোকাতেই ভেঙে যাবে। আমার সাথে বাপি-মামনি-ছোট ভাইয়া,
দুই দুলাভাই সবার অনেক সুন্দর সম্পর্ক। মানিয়ে নেয়ার জন্য
সবাইকেই সময় দিতে হয়। আর ধরো,একান্তই যদি মামনি-বাপি আমাকে এখনো সহ্য করতে না পারতেন, আমি নিজের পথ বেছে নিতাম।”

“আমাকে তোমার সাথে নিতে না?”

” তোমার সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হতো। সবাই যার যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক যদি সেটা অনিষ্টকর না হয়।”

আজ রাতে চেম্বার থেকে ফেরার পথে শায়লার সাথে মন্জুরও এসেছে সিনথিয়াকে নিতে।প্রায় প্রতিদিন একই ঘটনা।সিনথিয়া মামীকে ছেড়ে যাবে না।মামীর কাছে রাতে ঘুমাবে। এ নিয়ে হৈ চৈ,সিনথিয়ার গলা ছেড়ে কান্না।

শায়লার মেজাজ আজ খুব গরম। তার এক রোগীর অবস্থা বেশ খারাপ। অপারেশনের দরকারই ছিলো না রোগীর। কিন্তু শায়লা মোটামুটি সব রোগীকেই অপারেশন করতে বাধ্য করে,মিষ্টি করে বুঝিয়ে, রোগীর জন্য নানা ভাবে উৎকন্ঠা প্রকাশ করে।

ডাঃ কানিজ এর ঘোর বিরোধী। শায়লারই কলেজ ও ইয়ারমেট তিনি। বন্ধুর দালাল প্র্যাকটিস, রোগীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অপারেশন সবই তিনি বোঝেন। শুধু তিনি কেন,ক্লিনিকের সবাই বুঝে। বন্ধুকে অনেক বুঝিয়েছেন ডাঃ কানিজ। বিনিময়ে অপমান জুটেছে।শায়লা কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। আজ জরুরি অবস্থায় পড়ে নাকানিচুবানি খেতে খেতে সেই কানিজেরই শরনাপন্ন হতে হলো। কানিজ দক্ষ হাতে সবকিছু ম্যানেজ করলেন ঠিকই, কিন্তু তারপরে শায়লাকে চেম্বারে ডেকে যা যা শোনালেন, তাতে অপমানে,রাগে শায়লার গা এখনো কাঁপছে।

সায়মা বললেন,”খেতে বস্। সব রেডি।”

শায়লা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,”খেতে আসিনি। যার জন্য এসেছি, তাকে নিয়ে চলে যাবো।”

“বলিস কি! মন্জুর এসেছে এতোদিন পরে। ও খালিমুখে যাবে? অতো ছটফট করেনা,যাও, হাতমুখ ধুয়ে আসো।”

শায়লা তার বদলে সিনথিয়ার হাত ধরে দিলো একটা হ্যাঁচকা টান। সিনথিয়া চেঁচিয়ে উঠলো। মুনিয়া সিনথিয়ার পেছনেই ছিল। সে একটু কড়া গলায় বললো,”ওর হাত ছাড়ো। এমন বিহেভ ওর চরম ক্ষতি করবে। একটা রাত তো নানার বাড়িতে থাকতেই পারে।”

“মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি হলে তাকে ডাইনি বলে।তুমিতো মাসীও না। উড়ে এসে জুড়ে বসে আছো, আবার আমাকে চোখ রাঙাও। কেরানির মেয়ের সাহস কত?”

“এতো বড় সাহস তোর? আমার সামনে তুই আমার ওয়াইফকে অপমান করিস?ক্ষমা চা। ওর কাছে ক্ষমা চাইবি তুই। তার আগে এখান থেকে যেতে পারবি না।”

একই সাথে অনেকগুলো মন্তব্য।

মোর্শেদ সাহেব মেয়েকে বললেন,”মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ। এরপর থেকে এই বাড়িতে আসতে হলে বদমেজাজ বাইরে রেখে আসবে।সিনথির হাত ছাড়ো।নয়মাস পেটে ধরলেই মা হওয়া যায়না।”

সায়মা বললেন,” মাথা কি পুরোপুরি গেছে তোমার? সমস্যা থাকলে সেটা শেয়ার করো,সবার সাথে তেজ দেখাচ্ছ কেন? যে মেয়েটা তোমার মেয়েকে এতোটা সুস্হ করে তুললো,তার ব্যাপারে কৃতজ্ঞতার লেশটুকু নেই তোমার?”

শায়লা সিনথিয়াকে আবার হ্যাচকা টান মেরে বললো,”চল্ আজকে।এ বাড়িতে আর তোর-আমার আসা লাগবেনা।আজ বঁটি দিয়ে তোকে আমি টুকরো টুকরো করবো।এসব পাগল-ছাগল দিয়ে কি করবো আমি?রোজ রোজ একই অশান্তি। নিয়ে এসে পালবে,আবার ডেইলি কথাও শোনাবে।খুন করে আজ জেলে যাবো আমি।”

মন্জুর হিংস্র গলায় বললো,”চুপ! একদম চুপ! ”

সিনথিয়া প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে। ভয়ার্ত চোখে তাকাচ্ছে এদিক -ওদিক। মুনিয়ার বুক মুচড়ে উঠলো সিনথির আর্ত চাহনি দেখে। সে শায়লার ধাক্কাধাক্কি, টানা হ্যাঁচড়া উপেক্ষা করে সিনথিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো,ছাড়িয়ে নিলো শায়লার কাছ থেকে। সিনথিকে বুকে চেপেই সে দৃঢ় গলায় বললো,”আপনারা বড় আপিকে কেউ কিছু বলবেন না,প্লিজ।আপির নিশ্চয় বড় কোন সমস্যা হয়েছে। তাই তার মেজাজের আউটবার্স্টিং হয়েছে। রাগ কি মানুষ বাইরের কাউকে দেখায়?আপনজনদেরই দেখায়। প্লিজ, এই প্রসঙ্গে কোনো কথা নেই। আপি, তুমি একটু বসো,রেস্ট নাও,কিছু খাও,তোমার সব কথা বাপি-মামনি-মন্জুর ভাই বা তোমার দুই ভাইকে শেয়ার করো। সবচেয়ে ভালো হয়,রাতে থেকে যাও। আর সিনথি আজ আমার কাছে থাক। আমি হাতজোড় করছি আপি।”

শায়লা কোন কথা না বলে সোজা বের হয়ে গেলো। গাড়ির স্টার্ট নেওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। মন্জুর মাথার চুল খামচে সোফায় বসে পড়লো। আবরার বললো,”মন্জুর,তুমি থেকে যাও। ”
মন্জুর উঠে দাঁড়ালো। বের হয়ে যাওয়ার আগে বললো,”স্যরি ভাবী। স্যরি সিনথি মা।”

মুনিয়া কাতর স্বরে বললো, “মন্জুর ভাই, প্লিজ, এগুলো নিয়ে আপিকে কিছু বলবেন না। আজ আপি মেন্টালি খুব ডিস্টার্বড কোন কারণে। তার এই অবস্থায় মমতা নিয়ে তার পাশে দাঁড়ান, প্লিজ। ”

আবরার গাড়ির চাবি নিয়ে নিচে নামলো।

“চলো মন্জুর, তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।”

যেতে যেতে মন্জুর বললো,”আপনার বোন রুগী নিয়ে আজ কোন সমস্যা পাকিয়েছে বড় ভাইয়া, বুঝলেন?”

“তাতো মাঝে মধ্যে একটু -আধটু হতেই পারে।”

“সেটা জানি ভাইয়া। কিন্তু আপনার বোন ম্যালপ্র্যাকটিস করে,এটা মানতে আমার খুব কষ্ট হয়।আমাদের কিসের অভাব
বলেনতো? দুজন মিলে ভালো আয় করি। রুগী ভাগিয়ে আনা,গড়ে সবার অপারেশন, দরকার আছে ভাই বলেন? আমার বৌ আর শালি দুজনেই একাজ করে। ভালো ভাবে কি থাকা যায়না?ডাঃ কানিজ,ডাঃ ফরিদা, ডাঃ মাহমুদা সবাই একই হাসপাতালে কাজ করে।কি অনেস্ট! কি ফেয়ার! ওদের দেখে কি আপনার বোন এতোটুকু ইনসপায়ারড হয়না?”

“তুমি বোঝাও না?”

” বুঝাতে বুঝাতে মুখে ফেনা উঠে গেছে। মাঝখান থেকে যে নোংরা নোংরা কথা শুনতে হয়,ইউ ক্যান’ট ইমাজিন।”

আবরার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”আসলে আমরা খুব আবনফরচুনেট। ভালো হবো কি করে বলো?বাপি সেক্রেটারি ছিলেন। অথচ ঢাকার এমন অভিজাত এলাকায় আমাদের এতো বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়া আরও একটা চারতলা ফ্ল্যাট, ভাড়া দেওয়া। গাজীপুরে বাগানবাড়ি।শানশওকতের সাথে দিন যাপন,সেই ছোটবেলা হতে।”

“তাতে কি হলো,ভাইয়া? আপনি আর ছোট ভাইয়াতো করাপ্টেড হোন নি। আমার বাপতো আপনার বাবার সাতগুণ বেশি। আইজি সাহেবের সম্পত্তির পরিমাণ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমরা ভাইবোনেরা কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হইনি। বরং মাথাটা কেমন নিচু নিচু লাগে। শুধু আব্বু আর মা খুব গর্বিত।

সিনথিয়া গুণে গুণে সাত দিন কাটালো তার মামীর সাথে। এই সাত দিনেই এতো উন্নতি হলো তার যে ডাক্তারও অবাক হয়ে গেলেন।

“অনেক বাচ্চারই অনেক উন্নতি দেখেছি, তবে এতো উন্নতি দেখিনি। সুস্থ বাচ্চার সাথে তেমন পার্থক্যতো দেখছিনা। আলহামদুলিল্লাহ। নিয়মগুলো সব মেনে চলবেন। বাচ্চার যত্ন খুব ভালো হচ্ছে। আজ ওর বাবা-মা আসলেন না?”

“সিনথি কয়েকদিন হলো আমাদের বাসায় এসেছে বেড়াতে,তাই আমরাই নিয়ে এলাম।”

ফেরার সময় মোর্শেদ সাহেব ড্রাইভ করছিলেন। তাঁর পাশে সায়মা। পেছনের সীটে মুনিয়ার গায়ে হেলান দিয়ে সিনথিয়া।

মোর্শেদ সাহেব আর সায়মার মেজাজ দুর্দান্ত ভালো। অতি আদরের নাতনির জন্ম থেকে অসুস্থতা তাঁদের বড্ড কষ্ট দিতো।

আজ শ্বশুর বললেন বৌমাকে,” মুনিয়া,আমাদের পরিবারে তুমি আশীর্বাদ হয়ে এসেছো মা। তোমার জন্য অনেক দোয়া রইলো।”

“বাপি,সিনথি আমার কেউ নয়? ও তো আমার জান।”

“মাগো,ননদের বাচ্চার জন্য কেউ এতো স্যাক্রিফাইস করে তা আমার জানা ছিলোনা।”

মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।তারপরে বললো,”আমার আর আপনার ছেলের ইচ্ছা, স্পেশাল চিলড্রেন’স হোম বানানো। সেখানে বাবুদের আমরা অনেক স্নেহে-যত্নে বড় করবো,উন্নত খাবারের ব্যবস্থা থাকবে,প্রোপার এডুকেশন দিব,প্রোপার ট্রিটমেন্ট। নিম্নবিত্তদের প্রায়োরিটি বেশি থাকবে।
আমরা এদের স্কিল্ড ম্যানপাওয়ারে কনভার্ট করবো,এদের নিয়ে আমাদের বড্ড স্বপ্ন। এটা একটা ইনস্টিটিউট টাইপ হবে আরকি। আমরা নামও ঠিক করে ফেলেছি,”সিনথিয়ার ফুলের বাগান।” আপনারা ইচ্ছা করলে নাম দিতে পারেন বাপি-মামনি,তবে সিনথিয়া সোনার নামে। সিনথিকে সুস্থ করে তোলাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।”

“এতো টাকা কোথায় পাবে?”

সায়মা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। মোর্শেদের কম টাকা নাকি?দরকার হয়,সায়মা নিজের নামের সব সম্পত্তি, সব গয়না বড় বৌমার হাতে তুলে দিবেন।

” আপনার ছেলে প্রতি মাসে বেতনের একটা বড় অংশ এই কারণে জমায়। আমিও বিজনেস শুরু করেছি। টাকা উঠে যাবে নিশ্চয়।বিয়েতে আপনারা আমাকে অনেক গয়না দিয়েছিলেন বাপি-মামনি। আপনাদের পক্ষ হতে প্রায় পঞ্চাশ ভরি,আমাদের বাসা হতে পাঁচ ভরি। ওগুলো বিক্রি করলে…”

“চুপ করো মামনি।” এই প্রথম মোর্শেদ সাহেব বৌমাকে আদরের সম্বোধন করলেন। “আমি বেঁচে থাকতে আমার মা গয়না বেচবে? কেন,আমরা তোমাদের এই কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারিনা?”

শ্বশুরের আদরমাখা কথায় মুনিয়ার খুব কান্না পেলো। সে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলোনা।”চোখের পানি আড়াল করা যায়,গলা স্বাভাবিক করা যায়না। ভাবতে না চাইলেও শ্বশুর -শাশুড়ির বলা কতো কটু কথা,তাঁদের তৈরি কতো অপ্রীতিকর মুহূর্ত কানে ও চোখে ভাসতে লাগলো। আজ সে তাঁদের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছে। সম্পূর্ণ নিজের
যোগ্যতায়। এটাও একটা বড় অর্জন নয় কি? আবরারের বাবা-মায়ের ভালোবাসা না পেলে এমন কোন ক্ষতি তার হতো না। কিন্তু অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করে, ভদ্রতা-নম্রতা -সহনশীলতা শতভাগ বজায় রেখে,নিজ নীতিতে অটল থেকে, নিজের দায়িত্বে অবিচল থেকে ভালোবাসা দিয়ে সে ভালোবাসা জিতে নিয়েছে। এই প্রাপ্তির আনন্দ অনেক।

“আপনাদের সাহায্য অবশ্যই লাগবে বাপি-মামনি,দরকার পড়লে আপনাদের বলবো না তো কাদের বলবো? আমাদের নেক্সট প্রজেক্ট ওল্ড হোম।”

” আমাদের জন্য বুঝি?”

সায়মা হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু সেই হাসির সাথে অস্বস্তিও মিশে ছিল।

“মামনি,আপনাদের ছেলেমেয়েরা বাপ-মাকে কতো ভালোবাসে,আপনারা টের পান না? আপনি আর বাপি হলেন সিনথির বড় মামার পৃথিবী। ছোট ভাইয়ার কাছেও আপনারা সব। আপিরাও আপনাদের না দেখে কয়েকদিনও থাকতে পারেন না।”

“সে তো আমরা সুস্থ, সবল আছি বলে। কাউকে আমাদের জন্য খাটতে হয়না বলে। যখন মুখ থুবড়ে পড়বো, প্যারালাইজড হয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবো,তখন ছেলেমেয়েদের আসল ভালোবাসা বুঝা যাবে।”

সায়মার কথা শুনে মোর্শেদ সাহেব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। সেই সায়মা। প্রথম দেখে তিন রাত ঘুমাতে পারেন নি তিনি। এতো সুন্দর মানুষ হয়? সায়মা কি আসলে মানুষ না পথ হারানো কোন ডানাকাটা পরী?

এখনো সায়মা যথেষ্ট সুন্দর। খুব বেশি বয়সতো আর হয়নি, চামড়া এখনো মোটামুটি টানটান, চুল পাতলা বলা যাবেনা, ফিগারও কন্ট্রোলে রেখেছেন। আগে খুব দাপুটে ছিলেন, অহংকারী ও গর্বিত ছিলেন নিজের চেহারা, মেধা,স্বামীর পেশা,পরবর্তীতে সন্তানদের সাফল্যের জন্য, মুনিয়া আসার পর থেকে ধীরে ধীরে তাঁর স্বভাব পাল্টে যাচ্ছে। অহংকারের লেশমাত্র নেই। আগের করা নানা দুষ্কর্মের জন্য মোর্শেদ সাহেবের সামনে হা-হুতাশ করেন,আল্লাহর কাছে মাফ চান,কাউকে দোষারোপ করেন না। আগে গৃহকর্মীরা দিনে একবার হলেও পিটানি খেতো কোন না কোন কারণে, এখন বানু,মিনারা, সখিনা,আলম, নিজামের খুব সুখে দিন কাটছে।
তাদের পরিবারকেও নানারকম সাহায্য করেন সায়মা। অনুশোচনার ফল।

অনেকদিন ধরেই মোর্শেদ সাহেবকে খোঁচাচ্ছেন সায়মা, ছেলেমেয়ে আর নিজেদের জন্য কিছু রেখে সব টাকাপয়সা,ধনসম্পত্তি বেনামে বিভিন্ন কল্যাণমূলকপ্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিতে। মনস্হির করে ফেললেন মোর্শেদ সাহেব, মুনিয়ার ড্রিম প্রোজেক্টকে সফল হতে সাহায্য করবেন তিনি, “সিনথিয়ার ফুলের বাগান” আর “ওল্ড হোম।”

এসব কিছু করেও অনুতাপ কমবে কি? কিছুক্ষণ পরপরই
চোখের সামনে ভেসে উঠে তরুণী মায়ের হাসিমাখা মুখ, ছেলের ইন্জিনিয়ারিং ফাইনালে রেকর্ড নম্বর পাওয়ার কথা শুনে শিশুদের মতো বাবার উচ্ছ্বাস, শুকিয়ে আমসি হয়ে যাওয়া মায়ের মরা মুখখানা, মৃত্যুর সাতদিন আগে ছেলেমেয়েদের মিটিংয়ে বুড়ো বাবার হাউমাউ করে কান্না,লালঝোল মাখা অপমানিত মুখ। সহায়-সম্পত্তি তো দূরের কথা, নিজের জীবনের বিনিময়েও বাবা-মাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবেনা।
মুনিয়া -আবরারের তত্ত্বাবধানে যে ওল্ড হোম হবে, সেখানে নিশ্চয়ই সুখে-শান্তিতে, স্বাধীনতা ও সম্মানের সাথে জীবনের
শেষ দিনগুলো কাটাবেন নিজ বাড়িতে নড়বড়ে অবস্থায় থাকা বৃদ্ধ -বৃদ্ধারা। আবরার-মুনিয়া বলে কথা।

সাতদিন থেকে সিনথিয়াকে চলে যেতে হলো নিজেদের বাসায়।মন্জুর এসে নিয়ে গেল। মেয়ে ছাড়া তার থাকতে খুব কষ্ট হয়।শায়লাও কান্নাকাটি করছে। দিনের বেলায় কাজে ব্যস্ত থাকে,রাত হলে বাড়ি ফিরে মেয়ের জন্য কান্না লাগে। শায়লার ধৈর্য খুব কম। স্পেশাল অ্যানজেলের একগুঁয়েমি, জিদ সে কয়েক মিনিটের বেশি সহ্য করতে পারেনা। ফলে মেয়েটা প্রায় মারধোর আর বকাঝকার শিকার হয়। পরে খুব খারাপ লাগে।
এবারে বাপের বাড়িতে রীতিমতো নাটক করে এসেছে শায়লা। জেদ করেই মেয়েকে আনতে যায়নি সে। এখন মেয়ের জন্য মন পুড়ছে। বাপ-মায়ের কোলের কাছে বসে গল্প করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু যখন মনে হয়,একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের হয়ে বাপি-মামনি-বড়দা সবাই তাকে বকেছে,তখন রাগে গা ঝিমঝিম করতে থাকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here