#মায়ার-সংসার (গল্প )
#পর্ব-২
শুভর সাথে মেয়েটিকে দেখে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটি খুব সুন্দরী। টানটান উত্তেজনা নিয়ে পরের ছবিগুলো দেখছি। একসাথে দু’জনের বেশ
কিছু ছবি,শুভর সিঙ্গেল ছবি,ডিপার্টমেন্টের বন্ধু,স্যারদের সাথে গ্রুপ ছবি। লালমাই পাহাড় দেখে
বুঝতে পারলাম ছবিগুলি স্টাডি ট্যুরের। গ্রুপ ছবিতে অনেক মেয়ে বান্ধবী থাকলেও দু’জনের ছবিতে শুভর সাথে শুধুমাত্র একটা মেয়েকেই দেখছি। তাহলে কি
দু’জনের মধ্যে কোনো রিলেশন ছিল? বিয়ে হলো না কেন? মনের ভিতর প্রশ্ন দানা বাঁধতে লাগলো। সব ছবি রেখে কেবল দু’জনের ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছি। হাসি-খুশিতে থাকা উৎফুল্ল মনটা হঠাৎ খারাপ
হয়ে যায়। শুভ ওয়াশরুম থেকে শোবার ঘরে আসলে
ওর দিকে না তাকিয়ে ছবিই দেখছি। দ্রুত গা ঘেঁষে বসে আমার মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে উপুর হয়ে সেও ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। খানিক সময় পর আমার মুখের দিকে চেয়ে বললো,
-দেখছো তোমার জামাইকে কেমন হ্যান্ডসাম লাগছে?
ছবির দিকে চোখ রেখেই বললাম,
-বান্ধবীটি এখন কোথায় আছে?
– ফ্লোরিডাতে থাকে। হাজব্যান্ডসহ ঐখানেই সেটেল্ড।
-বান্ধবীর নাম?
-নিরা
-খুব সুন্দর নাম। দেখতেও খুব সুন্দরী।
শুভ হেসে বলল,
-নিশ্চয়ই আমার বউয়ের চেয়ে সুন্দরী না। বিয়ের পর বান্ধবী চ্যাপ্টার বাদ। ছবিগুলো রেখে দাও। দাওয়াতে যাবো। গুছানোর কাজ অন্যদিন করো। যতটুকু করেছো
এখানেই রেখে দাও।
শুভর কথা শুনে মুচকি হাসলাম। শ্বশুর-শাশুড়ির ছবি চারটি আলাদা রেখে অ্যালবাম যেখানে ছিল রেখে দিলাম। বান্ধবীটির সম্পর্কে আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করলেও যেহেতু শুভ এড়িয়ে গেল তাই আর কোনো প্রশ্ন করিনি। শুভকে শুধু বললাম,
-মা,বাবার ছবি দেখার জন্যই অ্যালবামটা হাতে নিয়েছি।
ছবি চারটি আলাদা করে রেখেছি। তুমি স্টুডিও থেকে ভালো দুটো ছবি বড় করে বাঁধিয়ে আনবে। এভাবে পড়ে থাকলে আস্তে আস্তে স্মৃতিচিহৃটুকু নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের বাচ্চারা যখন দাদা,দাদি সম্পর্কে জানতে চাইবে,ওনাদের দেখতে চাইবে তখন কি বলবো? তাই আমার ইচ্ছে মা,বাবার ছবিগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করবো। দু’জনে দেখবো বাচ্চাদেরও দেখাবো। বাচ্চাদের আমরা যা শিখাবো পরবর্তীতে আমাদের জন্যও তারা তাই করবে। যদিও মৃত ব্যক্তির ছবি বাঁধিয়ে রাখার চেয়ে তাঁদের জন্য বেশি বেশি দোয়া,দান খয়রাত করাই উত্তম।
প্রত্যেক মা,বাবা সন্তানের কাছে এটাই প্রত্যাশা করেন। মৃত্যুর পর যেন ওনাদের জন্য বেশি বেশি দোয়ার মাধ্যমে স্মরণ করি। কোনো মা,বাবাই ধন,সম্পদ সাথে করে কবরে নিয়ে যান না। সবই সন্তানের জন্য রেখে যান। সন্তানের জন্য মা,বাবার মতো নিঃস্বার্থ এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার আর কেউ না। অথচ আমরা সন্তানেরা মা,বাবাকে ভুলে যাই। বিনাকারণে কষ্ট দেই,বৃদ্ধবয়সে ওনাদের পাশে থাকি না। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেই। নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি তাদের জন্য কিছু সময় রাখি না,তাদের মনের কথা,ইচ্ছের কথা কখনো জানতে চাই না। অথচ বৃদ্ধকালটা প্রত্যেকের জীবনেই আসে। সেটা আমাদের মনে রাখা উচিত।
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-তোমার সাথে আমার অনেক কিছুতেই মিল খুঁজে পাই।
জানো মায়া,একটা আকাঙ্ক্ষা সব সময়ই আমার ভিতর থেকে যায়। মাবাবার জন্য একটা টাকাও ব্যয় করার সুযোগ পেলাম না। ছোট সময় দেখেছি মা বেশিরভাগ সময়ে গোলাপি রঙের শাড়ি পরতেন। গোলাপি রঙটা মনে হয় মায়ের পছন্দের রঙ ছিল। ইচ্ছে ছিল প্রথম
উপার্জনের টাকায় মায়ের জন্য পাঁচটা গোলাপি শাড়ি কিনবো। দেখ কেমন কপাল আমার সেই ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেল। তবে চাকরি পাওয়ার পর থেকে মৃত মাবাবার আত্মার শান্তির জন্য সাধ্যমতো করার চেষ্টা করি। আল্লাহ্ কবুল করে মাবাবাকে যেন জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন। ছবিগুলো এখনি তোমার ব্যাগে রেখে দাও। লাভলীর বাসা থেকে ফেরার সময় স্টুডিওতে দিয়ে আসবো।
বেলা বেড়ে ঘড়ির কাঁটা দুপুর প্রায় একটা বেজে পাঁচ মিনিট। দু’জনেই ওযু করে একসাথে যোহরের নামাজ
পড়ে নিলাম। অনেকগুলো শাড়ি থেকে শুভ মেরুন রঙের জামদানি শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-এইটা পরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। সময় বেশি নেই। সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস,হাতভর্তি চুড়ি পরো।
হেসে বললাম,এতকিছু কি করে জানো? বোন তো নেই?
শুভ জিন্স পরতে পরতে বলল, ভাবিদের শাড়ি পরতে, সাজগোজ করতে দেখিনি? ভাবিদের কাছেই তো বড় হয়েছি। চুলে চিরুনি দিতে দিতে বললাম, সত্যিই তোমার সবদিকেই নজর। আমি যে তোমাকে সারাজীবন এমনই চাই এবং চাইবো। শুভ বলল, বেশি টাকা দিয়ে সুখ দিতে না পারলেও কখনোই কষ্টে রাখবো না।
দুপুর দুটো বাজার আগেই লাভলীর বাসায় হাজির হই।
গিয়ে দেখি বাসায় আরও মেহমান আসছে। লাভলী
সবার সাথে পরিচয় করে দিল,’আমার নতুন ভাবি।’
শুনেছে নিউ কাপল। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। ক’ভাই
বোন,কোন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি,মা,বাবা বেঁচে আছেন কিনা থেমে থেমে টুকটাক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সবার মুখে নিজের সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে খুব লজ্জা লাগছিল। লাভলীর টুইন দুটো মেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুধু আমাকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই পর্দার আড়ালে লুকাচ্ছিল। কাছে ডাকি লজ্জায় আসে না। সবার সাথে খাবার খেয়ে কিছু সময় গল্প করে বিদায় নিয়ে আসার সময় টুইন মেয়ে দুটোর হাতে কিটকেট চকলেট দিতেই খুশিতে দু’জনেই হেসে টা টা বলে দিল।বিকেলেই লাভলীর বাসা থেকে বের হয়ে আসি।
শ্বশুর-শাশুড়ির ছবি বাঁধাই করতে দিয়ে শুভ আমাকে নিয়ে রিকশা করে চলে আসলো সংসদ ভবন এলাকায়।
বিকেল তখন পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। সূর্য ডুবে সন্ধ্যার আঁধার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ফুরফুরে শীতল এলোমেলো বাতাস বারবার শরীর,মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। শুভ আমার হাত ধরে আছে। ধীর পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। ময়লা জামা গায়ে ছোট্ট একটা মেয়ে পিছন থেকে দৌড়ে সামনে এসে বলল, স্যার,আফারে একটা ফুল কিইন্না দেন। শুভ দুষ্টুমি করে বলল, আগে বল্ তোর আফা দেখতে কেমন? মেয়েটি দাঁত বের করে হাসলো। ‘আফা দেখতে খুব সুন্দর! এই নেন দুইডা গোলাপ। আফার খোঁপায় দিয়া দেন।’ শুভ সাথে সাথেই মেয়েটির হাত থেকে ফুল নিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল। মানিব্যাগ থেকে নতুন একশো টাকার নোট মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,টাকা ফেরত দিতে হবে না। পুরোটাই তোর। রেখে দে! মেয়েটা একশো টাকা পেয়ে প্রাণখোলা হাসি দিল। ‘স্যার,খুব উপকার করলেন। ঘরে অসুস্থ বাপ। আম্মা আর আমি সংসার চালাই। আল্লাহ আফনের ভালা করুক।’ আমিও ব্যাগ থেকে একশো টাকা মেয়েটির হাতে দিলাম। খুশিতে মেয়েটির চোখ দুটো চিকচিক করছে। দূর থেকে সমবয়সী আর একটা মেয়ে ডাক দিলে পিছন ফিরে তাকালো।
বকুল,বেলি ফুলের মালা আর কিছু গোলাপ,রজনীগন্ধা, কাঠগোলাপ হাতে নিয়ে মেয়েটি হনহন করে সামনের
দিকে এগিয়ে গেল।
শুভ তার মোবাইলের রিংটোন শুনে ফোন রিসিভ করলো। কথা না বলে শুধু অপর পাশ থেকে কথার জবাবে হু হা বলে যাচ্ছে। তেমন কোনো কথা না বলে ‘ঠিক আছে রাখছি। সব জানিও। আমি বাইরে আছি।’ বলেই ফোনের লাইন কেটে দিল। আমি জানতে চাইলাম,কে ফোন দিয়েছিল? শুভ হেসে বলল,সবাইকে তুমি চিনবে? আস্তে আস্তে সব জানবে,চিনবে,আমাকে বুঝবে। বাইরের কোনো কথা বলে কখনোই দু’জনের সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করবো না। কথাগুলো বলেই শুভ
আমাকে কাছে টেনে অনেকগুলো সেলফি তুললো।
আস্তে আস্তে লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। ভিড়ের
ভিতর হেঁটে আগের মতো ভালোও লাগছে না। এদিকে
মাগরিবের আযানের ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে।
দু’জনে ঝালঝাল চটপটি খেয়ে বাসায় চলে আসলাম।
পরদিন সকালে শুভ বাজার থেকে বড় দুটো রুই মাছ বড় একহালি ইলিশমাছ,অনেক পদের মিষ্টি নিয়ে বাসায় আসতেই কলিং বেলের আওয়াজে আবার গেইটের কাছে গেল। আমি চৌধুরিকে নিয়ে সকালে নাস্তা বানাচ্ছি। ছেলেটা রুটি বেলে দিচ্ছে আমি সেঁকে হটপটে রাখছি। টুকটাক কথা বলছি। মামি,আপনের খোকা,খুকি হলে কিন্তু আমি ইসকুলে নিয়া যাবো। আগেই কয়ে রাখলাম। আচ্ছা,মনে থাকবে। এখন ঝটপট কাজ শেষ কর। শুভ ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে
রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল,মায়া,আমাদের কপাল খুলে গেছে! আজও দাওয়াত আছে। আহারে! একমাস যদি
এভাবে দাওয়াত খেয়ে খেয়ে চলে যেতো তাহলে বাজারের কত টাকা বেচে যেতো। হটপট টেবিলে রেখে
বলি,দাওয়াত দিল কে? আজ না আমাদের বাসায় যাওয়ার কথা? বাড়িওয়ালা ভাই দুপুরে খেতে বললেন। সমস্যা নাই দুপুরে ঐখানে খেয়ে-দেয়ে বিকালে পাঠাও
নিয়ে একমাত্র ভাইগ্না চৌধুরিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি
চলে যাবো। কি বলিস চৌধুরি? শুভর কথা শুনে চৌধুরি মিটমিট চোখে হাসছে। খেতে বসে শুভকে বললাম,
দ্বিরাগমনে মাছ নিয়ে যেতে হয় জানো কি করে?
ভাইদের দ্বিরাগমনে সাথে কতবার ভাবির বাপের বাড়ি গেলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম মাছ নিতে হবে। কালকে বড় ভাবি ফোন দিয়ে মনে করিয়ে দিল। বলল, শুভ মায়াকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাওয়ার সময় সাথে বেশি করে মাছ,মিষ্টি,পান সুপারি নিয়ে যাবি। ভুলে যাসনে আবার। জানো মায়া,বড় ভাবি আমাকে অনেক ছোট পেয়েছে। যখন ভাবি বউ হয়ে আমাদের বাড়িতে আসে
তখন আমি হাফপ্যান্ট পরি। শুভর কথা শুনে দু’জনেই হাসলাম।
সব গুছিয়ে সেজেগুজে বাড়িওয়ালার বাসায় দাওয়াত খেয়ে রওয়ানা দিলাম বাবার বাড়ি। শুক্রবার রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। খুব তাড়াতাড়ি মায়ের বাসায় চলে আসলাম। শুভকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে এই বাড়ির নতুন জামাই।
এসেই আম্মা,আব্বার পা ছুঁয়ে সালাম করে আব্বার সাথে গল্পের আসর জমিয়ে দিয়েছে। নতুন জামাই, মেয়েকে পেয়ে আম্মার ব্যস্ততা বেড়ে গেল দ্বিগুণ। তাঁর একমাত্র মেয়ের জামাইয়ের জন্য নানা পদের খাবার,
বাহারি পিঠা,পায়েস বানাতে সারাক্ষণ রান্নাঘরেই দিন পার করছেন। শুভ জোর করে আম্মাকে রান্নাঘর থেকে বের করে খাটে ফ্যানের নীচে বসিয়ে দিল। নিজেও আম্মার পাশে বসে বলল,রান্না নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনার সাথে কথা বলার সুযোগই পাচ্ছি না। আমাকে মেয়ের জামাই না ভেবে ছেলে ভাবলেই বেশি খুশি হবো আম্মা। মা,বাবাকে হারিয়েছি অনেক বছর আগে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বিয়ের পর শ্বশুর- শাশুড়িকে নিজের মা,বাবা মনে করবো। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। আম্মা শুভর কথা শুনে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, খুব খুশি হয়েছি বাবা! তুমি সারাজীবন আমার আর একটা ছেলে হয়েই থাকবে। আল্লাহ্ যেন তোমার সকল বিপদ,আপদ দূর করে দেন বাবা। আমি দূর থেকে জামাই,শাশুড়ির আবেগমাখা কথা শুনে হাসছি আর শরবতে চিনি ঢেলে নাড়ছি। ট্রে করে তিনগ্লাস শরবত নিয়ে ড্রইং রুমে আব্বাকে এক গ্লাস দিয়ে আম্মার কাছে আসলাম। নাও,এবার দু’জনে শরবত গিলে গলা ভিজিয়ে নাও। শুভ শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,
আব্বাকে দিয়েছো? তোমার গ্লাস কই? বললাম,আমি
একটু আগে তেঁতুলের চাটনি খেয়েছি। আম্মা শরবত গিলে আবার রান্নাঘরে দৌড় দিল। শুভ অর্ধেক শরবত গিলে গ্লাসটা আমার মুখের সামনে ধরলো। হা করো।
একজন খাবে আর একজন কষ্ট করে বানিয়ে এনে শুধু
চেয়ে থাকবে তা তো হতে পারে না। ওর হাত ধরেই বাকি
শরবতটুকু গিলে নিলাম। শুভ বলল, এবার রান্নাঘরে যাও। আম্মাকে হেল্প করো। ওনার একটু পরিশ্রম কম হবে। আমরা আসার পর এই যে রান্নাঘরে ঢুকেছে। একটার পর একটা আইটেম তৈরি করেই যাচ্ছে।
ওনার রেস্ট হচ্ছেই না। আমি বললাম, আপনি বলার আগেই আমি আম্মাকে হেল্প করতে গেছি। আম্মা ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জামাইয়ের কাছে যা। গিয়ে গল্প কর। শুভ হেসে বলল,মায়েরা মনে হয় এমনই।
দুপুরে শুভ আম্মা,আব্বাকে সাথে নিয়ে খাবার খেলো। রাতেও ওনাদের নিয়ে খেতে বসে বলল,আম্মা সকালে মায়াকে নিয়ে চলে যাবো। প্রাইভেট জব করি।বেশি ছুটি পাই না। সব সময় আপনাদের দেখতে আসা সম্ভব হবে না। তার জন্য আগেই স্যরি বলে নিচ্ছি আম্মা! মাঝে মাঝে দু’জনেই চলে আসবেন বাসায়। নিজেদের খেয়াল রাখবেন।সকালে নাস্তা করে শুভ আমাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো। পরদিন শুভর অফিস। চৌধুরিকে নিয়ে দু’জনেই ঘর গোছানোর কাজ করে দুপুরের রান্না শেষ করি। সন্ধ্যায় দু’জনে কড়া কফি খেতে খেতে মুভি দেখতে বসলাম। শুভর ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করে কেন জানি বারান্দায় চলে গেলো। কিছুই বুঝলাম না। শুভ কি কিছু লুকাচ্ছে আমার কাছে? কি ঘটেছে?
জানতে চাইলেও এড়িয়ে যাচ্ছে। গায়ে পড়ে জোর করে জানতে চাওয়া কি উচিত হবে। থাক ওর যখন বলতে ইচ্ছে করবে সেইদিন শুনবো। দশমিনিট পর শুভ বারান্দা থেকে চলে আসলো। জিজ্ঞেস করলাম,হঠাৎ
বারান্দায় গেলে কেন? এখানেই কথা বলতে পারতে?
টিভির সাউন্ডে ভালো করে কথা বুঝা যাবে না তাই।
তাছাড়া যার সাথে কথা বলেছি ওনি আস্তে কথা বুঝেন না। শুভ প্রতিবারই সুন্দর করে তার মতো বুঝিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে কথা বলে। আমি পাল্টা আর কিছুই বললাম না।
মুভি শেষ করার পর খুব মাথা ব্যথা শুরু হয়। কোনো রকম এশার নামাজ শেষ করে চৌধুরিকে বললাম,
খাবার গরম করে টেবিলে দে! আমি এখনি ঘুমাবো। আর তোকে আজ মশারি বাঁধা শিখিয়ে দিব। আমি যেভাবে টানাবো প্রতিদিন সেভাবেই টানিয়ে ঘুমাবি।
মশারি না টানালে মশা কামড়াবে। পরে অসুখ বাঁধিয়ে বাড়ি যাবি তোর মা বলবে তোকে মশারি ছাড়া ঘুমাতে দিয়েছি। তোকে আদর যত্ন করি নাই। আরও কতকিছু বলবে তোর মা। চৌধুরি ফ্লোরে তার তোষক,চাদর বিছিয়ে মশারি বের করলো। চাদর বিছিয়ে বলল,
না এই কথা বলবো না। আপনেরা আমারে কত আদর করেন। সাথে করে আপনের বাপের বাড়ি নিয়া গেছেন।
আপনের মা নানি আদর করে আমারে কত পিঠা,পোলাউ,ইলিশ মাছের খণ্ড,মাংস খাইতে দিছেন।
জীবনেও সেই খাবার খাই নাই। সিলেট যেই বাসায় কামে ছিলাম ঐখানে আমারে নিয়া চারজন কামের মানুষ থাকতো। চারজনের আলাদা রান্না করা খাবার থাকতো। সব সময় ডাইল,আলু ছানা, শাক,ছোট মাছ
খাইতে দিত। কামের কিছু ভুল পাইলে ম্যাডাম খুব মাইর দিত। একদিন রাইতে আমার ঘুম আসে না। ম্যাডামকে না বলে ফ্রিজ থেকে ছ’টা ডিম নিয়ে সিদ্ধ করে খাই। পরদিন সকালে আমারে সবাই খুব মাইর দিল। ঐদিনই আমার জ্বর আসলো। মা’রে খবর দিয়ে আমাকে বাড়িতে পাঠাইয়া দিল।
মামি,আমারে আপনে কখনো বাড়িতে পাঠাইয়েন না।
বাড়িতে খাওনের খুব কষ্ট। ভালা খাওন তো দূরের কথা দুই বেলায় ভাত পাই না। আমি চুপ করে শুনে বললাম,
ঠিক আছে জানলাম তোর কষ্টের কথা। এখন যা বলছি শোন্ মশারির দুটো কোণা দুই জানালার গ্রিলে আর দুটো বাঁধবি চেয়ারে। এখন বাঁধার দরকার নাই। যখন ঘুমাবি তখন বাঁধবি।
শুভকে বললাম,খুব মাথা ধরেছে। আমি এখনি ঘুমাবো।
চল্ রাতের খাবার খেয়ে নেই। শুভ বলল,সহ্য করতে না পারলে ভাত খেয়ে একটা পেইন কিলার খেয়ে নিতে পারো। আমি বললাম,ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। দু’জনে
খেয়ে নিলাম। চৌধুরিকে বললাম,তুই খেয়ে সব গুছিয়ে রাখিস। শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। শুভ এসে আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। আমার পাশে বসে মাথার তালুতে তেলের সাথে অল্প পানি দিয়ে আস্তে আস্তে চুল টেনে দিচ্ছে,কপাল টিপে দিচ্ছে। পরম মায়া,
ভালোবাসার হাতের স্পর্শ মুহূর্তের মধ্যে যেন স্বর্গীয় সুখ এনে দিয়েছে। নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আছি। শরীরের সাথে সাথে মনটাও খারাপ। শরীর,মন একে অন্যের পরিপূরক। একটা অসুস্থ হলে অন্যটিও অসুস্থ হয়ে যায়। শুভ অন্য রকম হতেই পারে না। শুভর কোনো কিছুই খারাপ হতে পারে না। কিছু লুকিয়ে যদি ভালো থাকতে পারে দেখি কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারে। আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইবো না। কিছু বলছি না দেখে বলল,জেগে আছো? শান্তস্বরে বললাম,হুমম। কথা বলতে হবে না। ঘুমাও।
শুভকে নিয়ে এলোমেলো ভাবনায় কখন চোখে ঘুম আসে জানি না। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। টের পাই আস্তে ভলিউম দিয়ে টিভি চলছে। বুঝলাম শুভ এখনও টিভি দেখছে। হাতে মোবাইল। মেসেজের টুং টাং শব্দ আসছে। শুভ বুঝতে পারে নি আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আমিও নড়াচড়া করলাম না। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করি। মাথায় যে ব্যথা ঝেঁকে বসেছিল তা মোটামুটি উধাও। মাথাটা ফ্রেশ লাগছে। শুভ মোবাইল বালিশের উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। আবার দুইবার মেসেজ সেন্ড করার শব্দ কানে বাজলো। কি মনে করে মোবাইলের স্কিনে চোখ রাখলাম। একটার পর একটা মেসেজ পড়া শুরু করলাম,
-আমাকে মনে করিস?
-হুমম,মনে করি।
-আমি তোকে সব সময় মনে করি।
-এখন সব সময় মনে করে কোনো লাভ আছে? তুই তো বিয়ে করে আমেরিকা পাড়ি জমালি। আমার কোনো দোষ ছিল?
-না,তোর দোষ নেই।
-???
-কি হলো রিপ্লাই দিচ্ছিস না কেন?
বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই
মোবাইল যেভাবে রাখা ছিল ঠিক সেভাবে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করি। ঘুম তো আর আসে না। আসছে শুধু বাঁধভাঙা কান্না। নিঃশব্দে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছি। শুভ টিভি বন্ধ করে একগ্লাস পানি খেয়ে মোবাইল হাতে নিল। দু’মিনিট পর মোবাইল চার্জে দিয়ে আমার পাশে শুয়ে মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে তার ডান হাতটা আমার শরীরের উপর রাখলো। শুভ জানে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন…….
—চলবে