গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:১২

হেঁচকি তুলে কাঁদছি আর জুতো খুলছি।উমান গাড়ি পার্ক করে এসে আমার পেছনে দাঁড়ালেন।আমি দ্রুত জুতো খুলে র্যাকে রেখে নিজের রুমে আসতে লাগলাম।উমান পেছন থেকে রাগী কন্ঠে বললেন,

‘দুমিনিটে চেন্জ করে ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিবি।’

আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে রুমে আসলাম।খুব কান্না পাচ্ছে।ওই ছেলেটিকে আধমরা বানিয়ে তারপর গাড়িতে এসে আমাকে বকতে শুরু করেছিলেন।পুরো রাস্তা আমার উপর রাগারাগি করেছেন আর জোরে জোরে ধমক দিয়েছেন।আর আমাকে কান খুলে শুনে নিতে বলেছেন উনার সব কথা যেন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি নাহলে আমাকেও ওই ছেলের মতো মাইর দিবেন।

হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে গায়ে ওড়নাটা চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম।হালকা শীত করছে।মাথাটা ভার ভার লাগছে সাথে নাকও বন্ধ হয়ে আসছে।বৃষ্টিতে ভিজে আর অনেকক্ষণ ভেজা পোষাকে থাকায় ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।ক্লান্ত লাগছে,জ্বর আসতে পারে তাই বিছানায় গিয়ে শুলাম।কম্বল মুড়ি দিতে না দিতেই উমানের ডাক শুনতে পেলাম,

‘মিতি?কাম হেয়ার।’

আমি একটু বিরক্ত হলাম কিন্তু উনার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে বাইরে আসলাম।কিচেন থেকে উনার কথা বলার আর পানি পরার আওয়াজ আসছে তাই কিচেনে গেলাম।উমান সিংকে হাত ধুচ্ছেন আর কাঁধের সাহায্যে কানে ফোন ধরে রেখে কথা বলছেন।আমি মুখ মলিন করে বললাম,

‘ডেকেছেন?’

উমান ভ্রু কুচকে পেছনে তাকালেন।টাওয়ালে হাত মুছে ফোন হাতে নিয়ে কানে ধরে মুচকি হেসে বললেন,

‘কথা বলো ওর সাথে।’

উনি আমার সামনে এসে আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আম্মুর সাথে কথা বল।’

আমি তো মহা খুশি।উনার হাত থেকে ফোনটা একরকম কেড়েই নিলাম।উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলাম কিন্তু ফোনের ওপাশের মানুষের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল কারন আমি ভেবেছিলাম উমান আমার আম্মুর কথা বলছিলেন কিন্তু এখন কথা শুনে বুঝতে পারছি এটা উমানের আম্মু,আমার বড়াম্মু।উনি আমার খোঁজ খবর নিলেন।মিনির সাথে আর উর্মি আপুর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিয়ে বড়াম্মু কল কেঁটে দিলেন।আমি মন খারাপ করে আবার কিচেনে ফিরে আসলাম।উমানের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম,

‘আপনার ফোন।’

উনি তরকারি রান্না করছেন তাই ব্যস্ত হয়ে বললেন,

‘রাখ ওখানে।’

আমি উনার ফোন কেবিনেটের উপর রেখে দিলাম।কিচেনের দরজার কাছে আসতেই উমান ডাকলেন,

‘ওই।’

আমি পেছনে ঘুরে উনার দিকে তাকালাম।উনি প্যানে ঢাকনা বসিয়ে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন।চোখের ইশারায় আমাকে উনার কাছে ডাকলেন।আমি বিলম্ব না করে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম।উনি ভ্রু কুচকে আমার গালে কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘এমন ফ্যাকাশে মুখ করে ঘুরছিস কেন?’

তারপরই চেচিয়ে বললেন,

‘জ্বর এসেছে,ভেরি গুড।এখনও বৃষ্টি হচ্ছে।তখন ভেজা কম হয়েছে,এখন আবার ভিজবি।ছাদে চল।’

আমি গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বললাম,

‘জ্বর আসেনি,এমনি একটু শীত করছে।’

উনি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন।আমি মাথা নিচু করে আড় চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি সসপ্যানে পানি ঢেলে আরেকটা স্টোভে বসিয়ে দিলেন।স্টোভের আচ বারিয়ে দিয়ে আমার একবাহু শক্ত করে চেপে ধরে টানতে টানতে আমাকে রুমে নিয়ে আসলেন।আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে আর শাসিয়ে আমাকে চুপ করে বসে থাকতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা তাই মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম কি করতে চলেছেন উনি!

একটু পর উমান রুমে ঢুকলেন।আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কপাল টিপছিলাম উনাকে আসতে দেখেই সোজা হয়ে বসলাম।উনার কাঁধে একটা সাদা টাওয়াল ঝুলানো আর হাতে একটা কাচের বাটি।উনি বাটিটা আমার সামনে রেখে আমার পাশে বসলেন।বাটিতে ধোঁয়া উঠা গরম পানি।এটা কি উনি আমাকে খেতে বলবেন নাকি!!ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে উমানের দিকে তাকালাম।উনি ট্রাউজারের পকেট থেকে ভিক্স ভাপোরাবের নীল কৌটটা বের করে আঙুলের ডগায় কিছুটা ভিক্স নিয়ে পানির মধ্যে দিলেন।আমার মাথায় টাওয়াল দিতেই আমি বুঝে গেলাম আমাকে এখন কি করতে হবে।

প্রায় পাঁচমিনিট ধরে গরম পানির ভাব নিয়ে এখন একটু স্বস্তি বোধ করছি।বন্ধ নাক খুলে গিয়েছে।টাওয়াল দিয়ে মুখের উপরের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে উমানের দিকে তাকালাম।উনি আমার কাঁধে হাত রেখে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘ফিলিং বেটার নাউ?’

আমি মাথা নাড়ালাম।উনি ডান হাতের তর্জনী আঙুলে কিছুটা ভিক্স নিয়ে আমার কপালে মালিশ করতে করতে বললেন,

‘শুয়ে পড়,আমি খাবার নিয়ে আসছি খেয়ে ঘুমাবি।’

আমি মিনমিন করে বললাম,

‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’

উনি কিছু বললেন না।গরম পানির বাটি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে আসলাম।বাইরে এখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে।ব্যালকনির গ্রীলে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে আছে।আমি সেগুলো হাত দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছি।মিনি এখানে থাকতে এই পানি গুলো আঙুলের ডগায় নিয়ে ওর মুখে ছিটিয়ে দিতাম আর ও আম্মুর কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ করতো।কত দুষ্টু মিষ্টি ছিল সেই দিন গুলো ভাবতেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে আসলাম।উমান ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আমার প্লেটে ভাত বাড়ছেন।আমি গিয়ে পেছন থেকে উনাকে জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

‘মিতি?হোয়াট হ্যাপেন্ড?শরীর খারাপ লাগছে?’

আমি উনার পেটের কাছে টিশার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,

‘ওদের কথা মনে পরছে,সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।’

উমান আমার হাত থেকে উনার টিশার্ট ছাড়িয়ে নিলেন।আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দুইগালে হাত রেখে চোখ মুছে দিয়ে মুখ মলিন করে বললেন,

‘ডোন্ট ওয়ারি,সামনের উইক রাজশাহী ফিরে যাব।এখানে একা একা তাই ভাল লাগছেনা।ওখানে গেলেই ভাল লাগবে দেখিস।এখন খাবি চল।’

উনি টেবিল থেকে আমার প্লেট হাতে নিয়ে আমাকে একপাশ থেকে জরিয়ে ধরে ড্রইং রুমে আসলেন।টিভি অন করে সোফায় বসে আমার হাতে রিমোট দিয়ে উনি প্লেটে ভাত মাখাতে লাগলেন।আমি মুখ ফুলিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্কে দিয়ে সোফায় পা তুলে বসলাম।উমান আমার মুখে খাবার তুলে দিতেই আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।উনি রেগে গেলেন।ওই ছেলের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমি আর কথা বাড়ালাম না।উনার হাতে গপাগপ খেতে লাগলাম।উমানও আমার সাথে খেয়ে দুপুরের খাবারের পর্ব মিটিয়ে নিলেন।রুমে এসে আমাকে একটা প্যারাসিটামল দিলেন উনিও একটা নিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আপনারও জ্বর এসেছে?’

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম উমান আমাকে কোলে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘না আমার মহারাণীর জ্বর হয়েছে।আমারও যেন না হয় সেজন্য আগেই মেডিসিন নিলাম।’

আমি উনার গলা জরিয়ে ধরে ভীত কন্ঠে বললাম,

‘আমার জ্বর হয়নি,কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?লাগছে,নামিয়ে দিন।’

উনি হাঁটতে হাঁটতে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘এখনও ব্যথা আছে?’

‘একটু একটু।’

উনি আমার গালে কিস করে বললেন,

‘গেট ওয়েল সুন।’

আমি উপরের ঠোঁট মুখের মধ্যে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম।উমান আমাকে নিয়ে বাবার ঘরে আসলেন।আমাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আমার গালে গাল ঠেকিয়ে বললেন,

‘এটা সুখ আর ভালোবাসার ঘর।দুঃখ এখান থেকে নির্বাসিত।আগে একটা ঘুম দিয়ে নিই তারপর তোর ক্লাস নিব।’

আমি একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘কিসের ক্লাস?’

উনি আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘ভালোবাসা শিখানোর ক্লাস।’

আমি চোখ গোল গোল করে বললাম,

‘না।’

উনি আমার পেট জরিয়ে ধরে বললেন,

‘কিসের না?আমার ভেতরের ভালোবাসা জানতে ইচ্ছে করেনা তোর?আমি তোর মতো পুডিংহেড আর পিচ্চি মেয়েকে কেন বিয়ে করলাম জানতে ইচ্ছে করেনা?’

আমি উনার দিকে পাশ ফিরে কৌতূহলি হয়ে বললেন,

‘কেন?’

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে আমার ওড়না চোখের উপর দিয়ে বললেন,

‘ভালোবাসি তাই।’

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘পুডিংহেড মানে কি উম ভ..।’

জিভে কামড় দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।ভাইয়া বলা যাবেনা।উনি ঘুমানোর চেষ্টা করে বললেন,

‘পুডিংহেড মিনস আমার মনের মহারাণী,এটায় জানিস না গাধি একটা।’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,

‘আমি ইংলিশ বেশি জানিনা।বাবা বলেছে এসএসসি শেষ হলে যখন ছুটি থাকে তখন ইংলিশ সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবে। তখন অন্য পড়া থাকবেনা তাই ভাল করে ইংলিশ শিখা যাবে।’

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।চোখের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে আবার আমাকে জরিয়ে ধরে বিরবির করে বললেন,

‘আ’ম সরি,পুডিংহেড মানে হাবাগোবা।আর বলবোনা সরি।’

কি?আমি হাবাগোবা?মনে মনে কথাটা বলেই আমি নড়েচড়ে উঠে মুখ ফুলিয়ে বললাম,

‘সরুন,আপনি একটা গুন্ডা,মহাগুন্ডা।’

উনি এক ধমক দিয়ে বললেন,

‘শাট আপ!ঘুমোতে দে আর তুইও ঘুমা নাহলে আমাকে চিনিস?হেব্বি গরম রক্ত আমার।’

উনার গরম রক্তের কথা শুনে রাস্তায় ওই ছেলেটির কথা মনে পড়তেই শুকনো কাশি দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে কাঁপা গলায় বললাম,

‘ঘুমোচ্ছি ঘুমোচ্ছি,রেগে যাবেননা প্লিজ!’

মৃদু হাসির শব্দ কানে আসলো।লজ্জা পেয়ে ঠোঁট উল্টে একহাতে মুখ ঢেকে অন্যপাশ ফিরে শুলাম।চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছি উমান উঠে বসে কম্বলের ভাজ খুলে কম্বল গায়ে দিয়ে আবার শুয়ে পরলেন।একটু পর উনি আমাকেও কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন।কিছুক্ষণ আমার চুলের মধ্যে মুখ গুজে থেকে তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

‘নাইস ফ্রেগরেন্স।’

আমি বুঝতে পারলাম না ফ্রেগরেন্স মানে কি।তবে ধারণা করলাম চুলের গন্ধ টন্ধ হবে হয়তো।উনি আমাকে মাথামোটা বলবেন সেজন্য উনাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলাম না।তারপরও সঠিক অর্থ জানার জন্য মনে মনে ভাবলাম পরে একসময় ইংলিশ ডিকসনারীতে দেখে নিব।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here