গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:-১০
সকালের নাস্তা খেয়েই গমের চারাগুলো দেখতে উমানের সাথে ছাদে এসেছি।ছাদে প্রায় পনেরোটা টবে আমার বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে।কোনো টবেই গমের গাছ বা চারা খুঁজে পেলাম না।পুরো ছাদ ভাল করে দেখে উমানের পাশে এসে দাঁড়ালাম।উনি ছাদের রেলিংয়ে বসে আছেন আর আমাকে দেখছেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘গমের চারাগুলো কোথায়?’
উনি মুচকি হাসলেন।রেলিং থেকে নেমে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
‘তোকে দেখাতে ইচ্ছে করছেনা।তাছাড়া দেখালেও দেখতে পাবিনা।’
আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অবাক হয়ে বললাম,
‘ওগুলো দেখা যায় না?অদৃশ্য?’
উনি পেছনে ঘুরে তাকালেন।আবার আমার কাছে আসতে আসতে বললেন,
‘না অদৃশ্য নয়।বাদ দে ওসব কথা।চল নিচে যাই,বাইরে যেতে হবে আমার।তুইও যাবি।ব্যথা কমেছে এগুলোর?’
আমি গলায় হাত দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কমেছে কিন্তু বাইরে কেন যাব?যেতে ইচ্ছে করছেনা।’
উনি সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন,
‘একা বাসায় থাকতে পারবি?আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।’
একা আমি কিছুতেই থাকতে পারবোনা।আমি উনার পেছনে যেতে যেতে বললাম,
‘একা থাকতে পারবোনা।আপনি কোথায় যাবেন?আমিও যাব কিন্তু চারাগুলো তো দেখায় হল না।’
উনি নিচে যেতে যেতেই বললেন,
‘ওসব ভুলে যা না।তুই ওসব দেখে কি করবি?’
আমি আবার জেদ ধরলাম।উনি আমার কোন কথা শুনলেন না।নিচে এসে উনি আমাকে রেডি হতে বলে পাশের রুমে চলে গেলেন।আমি দ্রুত একটা নীল জিন্স আর সাদা-কালো ঢোলা টপস পরে নিলাম।চুল গুলো চিড়ুনি করে হালকা ওজনের একটা ওড়না গলায় জড়াতেই আমার ডাক পরে গেল।উমানকে আসছি বলে আরও দশমিনিট ধরে সাজুগুজু করে তবেই ড্রইং রুমে আসলাম।উনি সোফায় বসে ভ্রু কুচকে ফোন টিপছেন।আমি তো উনাকে দেখেই এক দৌঁড়ে রুমে চলে বসলাম।আরও সাজতে হবে।কালো শার্টে উনাকে যা হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে উনার সাথে এভাবে বাইরে গেলে আমাকে সবাই উনার বাসার কাজের বেটি ভাববে।আমি রুমে আসতেই উনি আবার ডাকতে লাগলেন।আমি রুম থেকে চেঁচিয়ে বললাম,
‘যাচ্ছি,যাচ্ছি,ওয়েট করুন একটু।’
বাইরে থেকে উনি তাড়া দিয়ে বললেন,
‘এখনই চলে আয় নাহলে যাবার দরকার নেই তোর,লেইট লতিফ একটা!’
আমি ঝটপট আলমারি খুলে গাউনের মধ্যে কিছু ড্রেস চুজ করতে লাগলাম কিন্তু কোনটা পড়বো বুঝতেই পারছিনা।সারাজীবন বাইরে যাওয়ার আগে আম্মুই আমাকে ড্রেস চুজ করে দেয় তাই আজ একা একা চুজ করতে প্রবলেম হচ্ছে।আমি আলমারির দরজা খুলে আলমারির ভেতর প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলাম।কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে লাফিয়ে উঠে উমান ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করলাম।উমানের কন্ঠ শুনতে পেলাম।উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
‘উফ্ কানের পোকা মেরে দিয়েছিস একদম।এমনিতে তো ধাক্কা দিলেই উল্টে পরে যাস,গলায় এত জোর আসে কোথায় থেকে হুম?’
আমি আশেপাশে দেখে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে ভীত কন্ঠে বললাম,
‘আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটা আবার এসেছে।’
উনি আমার একগাল টেনে আমার কথায় ব্যঙ্গ করে বললেন,
‘আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটা আবার এসেছে।’
বলেই উনি আমার হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বললেন,
‘ওই লোকটা বেঁচে থাকলে তো আসবে নাকি?ও সেদিনই মরে গিয়েছে।সাক্ষাৎ মৃত্যু বুঝিস?….এখন সাদও নেই সাদের ভূতও নেই।’
আমি ভীত কন্ঠে তুতলিয়ে বললাম,
‘মমমানে?কককি বলছেন?’
উনি টেবিল থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে মেইন গেটের কাছে এসে স্যান্ডেল খুলে সাদা কেডস পরতে পরতে বললেন,
‘মানে বুঝিসনি?মরে গেছে ও।আর কখনও আসবেনা।’
‘ক ক ককিভাবে মারা গেল?’
উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘জুতোটাকি পরিয়ে দিতে হবে তোকে?’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে জুতো পরতে পরতে আবার একই কথা জিজ্ঞেস করলাম।উনি দরজা খুলে বললেন,
‘অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে।দয়া করে চলুন এবার।এসে নাহয় জমিয়ে গল্প করা যাবে।’
ঠোঁট উল্টে উনার সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম।গাড়িতে বসে কম করে হলেও একশোবার উনাকে জিজ্ঞেস করেছি কিছু বলেননি।আধ ঘন্টা পর উনি আমাকে নিয়ে উনার একটা মেয়ে ফ্রেন্ডের বাসায় আসলেন।উনার এই ফ্রেন্ডকে আমি চিনি।বিয়ের দিন দেখেছিলাম।আপুটার নাম সৌরভী।উমান আপুটাকে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে বিরবির করে কি যেন বললেন।তারপর আমাকে আপুর কাছে থাকতে বলে কালো শার্ট খুলে আমার মুখে ছুড়ে বললেন,
‘রাখ এটা।’
তারপর উনি শপিং ব্যাগ থেকে একটা নীল টিশার্ট বের করে পরলেন।মাথার চুল উল্টে-পাল্টে মুখে কালো মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস পরে বাসার ভেতর দিকে কোথাও চলে গেলেন।আমি সোফায় বসে ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।সৌরভী আপুও উনার পেছন পেছন চলে গেলেন।আমি উনার শার্ট সোফায় রেখে একা একা বসে থাকলাম।মন খারাপ লাগছে।উনি আমাকে এখানে একা রেখে সৌরভী আপুকে নিয়ে ভেতরে গেলেন কেন?মনের মধ্যে এমন প্রশ্নের উদয় হতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম।গুটি গুটি পায়ে ভেতরের দিকে যেতেই সৌরভী আপু ফিরে আসলেন।আমাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বললেন,
‘মিতি,চলো আমরা গল্প করি।’
আমি কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘উমান ভাইয়া কোথায় গেলেন আপু?’
সৌরভী আপু আমাকে নিয়ে সোফায় বসে বললেন,
‘ওর একটু কাজ আছে।বাহিরে গেল,কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।বাই দ্যা ওয়ে,তুমি এখনও ওকে ভাইয়া বলে ডাকো?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘মাঝে মাঝে..’
সৌরভী আপু ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘তুমি বসো আমি তোমার জন্য একটু নাস্তা নিয়ে আসি।’
আমি আপুর হাত ধরে আটকিয়ে দিয়ে বললাম,
‘না না আপু,আমি নাস্তা করে এসেছি এখন আর কিছু খেতে পারবোনা।আপনি ফ্রি থাকলে আমার কাছে একটু বসুন না।আপনাকে একটা কথা বলবো।’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘একটু বসো,আসছি আমি।’
সৌরভী আপু উনার খোলা চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।একটু পর ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন।আমাকে খেতে বলে বললেন,
‘বল না,কি বলবা?’
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,
‘মানে আমি উনার সম্পর্কে একটু জানতে চাই,আপনি উনার ফ্রেন্ড নিশ্চয় উনাকে খুব ভাল করে জানেন।’
সৌরভী আপু মুচকি হেসে বললেন,
‘উমানের সম্পর্কে যাই বলিনা কেন কম বলা হবে।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘মানে?’
আপু সোফায় পা তুলে বসলেন।কোলের উপর কুশন নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘মানে তোমার বর সাধারন কেউ নয়।তুমি তো ওর ব্যাপারে কিছুই জানোনা।উমান আর সাদের সাথে আমাদের পরিচয় আমরা যেদিন প্রথম কলেজে গেলাম সেদিন।প্রথম দিনই সিনিয়রদের সাথে মারামারি করে ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল ভেঙ্গে কি অবস্থা করেছিল ওরা।প্রায় একমাস আমরা ভয়ে কেউ ওদের সাথে কথা বলিনি।ওরা নিজের মতো আসতো,ক্লাস করতো চলে যেতো আর কেউ ওদের নামে উল্টা-পাল্টা কিছু বললে মাইর শুরু।সিনিয়ররা প্রতিদিন ওদের জন্য কত প্ল্যান-প্লটিং করতো তার কোনো হিসেব নেই।প্রতিদিন এই বিচার সেই বিচার লেগেই থাকতো।উমানের দাদুর অনেক পাওয়ার তাই ওদের কলেজ থেকে বের করে না দিয়ে সবাইকে বলে দেওয়া হল এই দুইজন মহা গুন্ডা,কেউ ওদের সাথে মিশবেনা,ওদের থেকে দূরে থাকবে সবাই।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘গুন্ডা?মহাগুন্ডা?’
সৌরভী আপু মৃদু হেসে বললেন,
‘তার থেকেও বেশি কিছু।সেসব কথা থাক।আমি তোমাকে এসব বলছি উমান জানতে পারলে রাগারাগি করবে।একটুতেই অনেক রেগে যায়।ওর ব্যাপারে আর কি জানবা?পড়াশুনায় ভাল।অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।টরেন্টোতে একটা ফিজিক্স রিসার্চ ইন্সটিটিউটে জব করত।এখন বেকার।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘বেকার?উনি না বিজনেস করেন?’
‘আরে না।বিজনেস করবে কেন?এমনি দেশে এসে আঙ্কেলের দিকটা একটু দেখে।সায়েন্টিস্ট ও।বিগ ব্যাং রিলেটেড কি যেন নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে প্রবলেম হয়েছে।ওকে আর সাদকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছে।দেশে আসার পর সাদকে কারা যেন কিডন্যাপ করেছে।উমান এখন কি যেন করছে।আমি অত জানিনা।তোমার বাবাও তো এসবের সাথে জড়িত।উনি কিসের যেন সিডস্ নিয়ে কাজ করছিলেন।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘গমের না?’
আপু সোফার নিচে দুই পা নামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘জানিনা কিসের।তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না।আইসক্রিম খাবা?আনছি আমি।’
আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে তাও ভদ্রতার খ্যাতিরে বললাম,
‘না না আপু আনতে হবেনা,খাবনা আমি।’
আপু আমার কথায় কান দিলেননা।উনি আইসক্রিম নিতে চলে গেলেন।আমি ভ্রু কুচকে আশেপাশে খেয়াল করতে লাগলাম।এত বড় দোতলা একটা বাসায় আপুটা একা থাকে কি করে!আপু আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসতেই বললাম,
‘আপু,আপনি এত বড় বাসায় একা থাকেন?’
আপু আমার হাতে একবাটি আইসক্রিম দিয়ে আমার পাশে বসে বললেন,
‘একা থাকিনা তো।শাশুড়ি,ভাশুর,দেবর,ননদ,আর তোমার ভাইয়াকে নিয়ে থাকি।ওরা কেউ বাসায় নেই।দেবর আর ননদ ভার্সিটে গিয়েছে।শাশুড়ি মা উনার বোনের বাসায় গিয়েছেন আর আমার ভাশুর তোমার ভাইয়ার সাথে থানায়।তুমি মনে হয় আমাকে এখনও চিনোনা।নাসিরকে চিনো?আমি নাসিরের ওয়াইফ।’
আইসক্রিম খাচ্ছিলাম।আপুর কথা শুনে আইসক্রিম শ্বাসনালীতে উঠে গেল।কাশতে কাশতে আপুর দিকে তাকাচ্ছি।এই মেয়ে বলে কি!নাসির ভাইয়া কবে বিয়ে করলো!নিষাদ ভাইয়াও কি বিয়ে করেছে!
চলবে….