#মন_নিয়ে_খেলা(১১)
**********************
বোনের সঙ্গে কথা শেষ করে, পূনম কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তিনি অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। সিনথি একটু আগে যা বললেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই কথার মানে দাঁড়াল, অরণী, সাদমানের সঙ্গে প্রেম করছে। অরণীর মুখটা কল্পনা করে, পূনম মনে মনে হেসে উঠলেন। অরণীর পক্ষে কিছুতেই প্রেম করা সম্ভব না। অরণী খুব ভালো করেই জানে, প্রেম জিনিসটা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। আরও অনেক আগেই, দুই মেয়েকেই পুঁথি পড়নোর মতোন করে এই বিষয়টা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মেয়েরা আর যা-ই করুক না কেন, অন্তত প্রেমের পথে হাঁটবে না। এতটা দুঃসাহস ওদের এখনও হয়নি।
নিজের মনকে প্রবোধ দিলেও, সুক্ষ্ম একটা কাঁটা পূনমের মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না, তাঁর মেয়ে এমন করতে পারে; কিন্তু অবচেতন মন, কিসের যেন অশনি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে! অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। তিনি কী করবেন এখন? অরণীকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, সাদমানের সঙ্গে ওর আদতেই কোনও সম্পর্ক আছে কি না? দরজায় টোকা পড়লে, পূনম ভেতরে আসতে বললেন। পুতুল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। পূনম বাসায় থাকলে, প্রতিদিন রাতের এই সময়টায় আধঘন্টা করে, পুতুল তার মাথা মাসাজ করে দেয়। পুতুল টিউব লাইটের সুইচ অফ করে দিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। পূনম জিজ্ঞেস করলেন, এখনও বৃষ্টি হচ্ছে?
জি ম্যাডাম।
একারণেই গরমটা কমেছে। নিম্নচাপ এখনও চলছে বোধহয়। জানালার পর্দা সরিয়ে দে। ঘরে বাতাস আসুক।
পুতুল দখিন দিকের জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে, জানালার নেট একপাশে সরিয়ে দিতে, ঠান্ডা বাতাস, রুমের পুরোটা দখল করে নিল। দুইদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। কখনও ঝিরিঝিরি, তো কখনও মুশলধারে পড়ছে তো পড়ছেই। পূনম মাথার নীচে দু’টো বালিশ দিয়ে শোয়ার পর, পুতুল তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ধীরে, ধীরে চুলে বিলি কাটতে লাগল। সিনথির কথাগুলো ভুলে থাকার জন্য পূনম মোবাইলে চোখ রাখলেন। পুতুল মাথা মাসাজ শুরু করতেই, পূনমের খুব আরাম লাগল। মেয়েটা এই কাজটা খুব ভালো পারে। মোবাইলটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে, পূনম চোখ বুঁজে, মাসাজের আবেশ নিতে, নিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পুতুল তার কাজ শেষ করে, জানালার নেট টেনে দিল। তারপর পর্দা টেনে দিয়ে, রুম থেকে বের হয়ে গেল।
**************
এদিকে সারাদিন কথাটা নিজের ভেতর চেপে রাখলেও, রাতেরবেলা অরণী, কথাটা বলার জন্য নীলোর্মির রুমে এল। নীলোর্মি অটোক্যাডে ড্রইং করছিল। বোনকে দেখে কাজ থামিয়ে বলল, আজকে তোমরা কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে, আপু?
আজকে ঘুরতে যাইনি। যমুনায় গিয়েছিলাম কেনাকাটা করতে। নীলোর্মি, আজ একটা কান্ড হয়েছে?
কেউ তোমাদের দেখে ফেলেছে?
তুমি কী করে বুঝলে!
তোমার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে। এরপর নীলোর্মি হেসে বলল, কার কাছে ধরা খেয়েছ, আপু?
বড়ো খালামনি।
বড়ো খালামনির কাছে! কথা হয়েছে, নাকি পালিয়ে বেঁচে গেছ?
কথা হয়েছে, মানে কী? এক লিফটে উঠলাম। তারপর খালামনি জোর করে কেএফসিতে নিয়ে গেলেন৷ সারাও ছিল খালামনির সঙ্গে।
শেষ, আপু, তুমি তো শেষ। আম্মুর রুমে তোমার এখনও ডাক পড়েনি?
না।
সে কী! আম্মু তো বাসায়ই আছেন। আম্মুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি আজকে?
দেখা হবে না কেন? একটু আগে ডাইনিং টেবিলেই তো দেখা হল। এটা আবার তোমার কেমন প্রশ্ন?
সে কারণেই তো প্রশ্নটা করলাম। আম্মুর সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার পরও, আম্মু তোমাকে কিছু বলেননি, এটাতে ভীষণ অবাক লাগছে!
আচ্ছা নীলোর্মি, বড়ো খালামনি কী আম্মুকে কথাটা বলতে ভুলে যেতে পারে?
উঁহু। বড়ো খালামনি অন্যকিছু ভুললেও, ভুলতে পারেন; কিন্তু তোমাকে কারও সাথে দেখবেন আর ঐ কথা আম্মুকে বলতে ভুলে যাবেন, এটা অসম্ভব। একেবারেই অসম্ভব।
আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
বড়ো খালামনিকে তুমি কিছু বলোনি?
কী বলব?
বলোনি কেন, সাদমান ভাইয়া তোমার ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য কিছুই না।
বলেছি; কিন্তু খালামনির চাহুনি দেখে মনে হল, উনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কী করব, বলো তো? খালামনিকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করব, কথাটা যেন আম্মুকে না বলেন।
না, আপু। তাহলে খালামনি আরও বেশি সন্দেহ করবেন। আম্মু যখন নরমাল আছেন, তার মানে খালামনি আম্মুকে কিছু বলেনি। খালামনি হয়ত বিষয়টা ভুলেই গেছেন। তুমিও ভুলে যাও, আপু।
অরণীর কাছেও মনে হল, সিনথি হয়ত বিষয়টা ভুলেই গেছেন। আর সে কি না আকাশ-পাতাল ভেবে, খামোখাই এতক্ষণ ভয়ে অস্থির হয়েছিল। নীলোর্মির সঙ্গে কথা বলার পর তার মনটা স্থির হল।
*************
পূনম ক্লান্ত ছিলেন বলেই বোধহয় একটানা এতক্ষণ ঘুমালেন। নতুবা এতক্ষণ তিনি কখনোই ঘুমান না। দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই পূনম প্রথমে বুঝতে পারলেন না, এখন সকাল ছয়টা বাজছে নাকি সন্ধ্যা ছয়টা? বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকার পর, পূনমের মনে পড়ল, রাতেরবেলায় পুতুল মাথা মাসাজ করার সময়ই, আরাম পেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তারপরই সিনথির বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। এই কথাগুলো নিয়ে এখন কিছু ভাবতে চাচ্ছেন না। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে যা করার করবেন।
নাস্তার টেবিলে কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, কোনোদিন তিনি নাস্তা খেতে নামার আগেই মেয়েরা বেরিয়ে যায়। আজ পূনম মেয়েদের সঙ্গে নাস্তা খেতে বসলেন। পূনম খুব স্বাভাবিকভাবে দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদের খাবারের মাঝখানে ফাহাদও এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। পূনম লক্ষ্য করলেন, অরণী আজকে তাঁর চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলছে। সে খুব চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার; কিন্তু পূনমের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না। পূনম অপেক্ষা করছিলেন, অরণী হয়ত সিনথির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা তাঁকে বলবে; কিন্তু অরণী সেই বিষয়ে কোনও কথাই বলল না। নাস্তা শেষ করে অরণী আর নীলোর্মি ওপরে চলে যাওয়ার পর, পূনম ফাহাদের সঙ্গে গল্প করতে, করতে খাওয়া শেষ করলেন।
দুই মেয়ে এবং স্বামী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পূনম অপেক্ষা করলেন। এরপর ফোন করে অখিলকে ওপরে আসতে বললেন।
পূনম, ফ্যামিলি লিভিংয়ে অখিলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অখিল আসার পর বললেন, বসো।
নাস্তা করেছ?
জি, আপা।
অখিল একটা কাজ করতে হবে।
বলেন আপা।
অরণী একদিন রাতে ওর এক বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিল। তোমার মনে আছে?
বন্ধুর জন্মদিনে? পার্টি কোথায় ছিল আপা?
সেগুনবাগিচায়। তুমি গিয়েছিলে সাথে?
ও আচ্ছা। আমি যাইনি, আপা। হারুন গিয়েছিল।
ছেলেটার নাম হচ্ছে সাদমান। সেগুনবাগিচায় থাকে। ছেলের সম্বন্ধে যা কিছু জানা সম্ভব, সব তথ্য আমাকে জানাও। এ সপ্তাহের ভেতর জানাবে।
জি আপা। ঠিক আছে।
আরেকটা কথা, এই বিষয়টা যেন তোমার আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমি যে ঐ ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছি, এটা যেন অরণী, নীলোর্মি বা ফাহাদ না জানে।
অবশ্যই আপা। আপনার বলতে হবে না। কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
অখিল চলে গেলে, পূনম লেডিস ক্লাবে ফোন করলেন। আজ তাঁদের ক্লাব থেকে একটা এতিমখানায় যাওয়ার কথা আছে। এতিম বাচ্চাদের জন্য প্রচুর গিফট কেনা হয়েছে। নয়টার সময় তাঁদের বেরোনোর কথা; কিন্তু এখন পূনমের যেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। পূনম ফোন করে বললেন, আজকের আয়োজনটা যেন দুইদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়। দু’টো পত্রিকার সাংবাদিকদের যাওয়ার কথা আছে নিউজ কাভার করার জন্য। তাদেরকেও ফোন করে আসতে নিষেধ করলেন। আজ তিনি কোথাও যাবেন না। তাঁর রুম থেকেও বের হবেন না। আজ তাঁর কাছে সবকিছু বড্ড অসহ্য লাগছে।
**************
সাদমান বলল, তোমার বাসায় কিছু হয়েছে? তোমার আন্টি কী বলে দিয়েছেন আমাদের কথা?
না।
দেখেছ, উনি বুঝতেই পারেননি আমাদের ব্যাপারটা আর তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছিলে? আমি তোমাকে তখনই বলেছি। শুধু শুধু কেন যে এত টেনশন করো সবসময়, বুঝি না।
কেন টেনশন করি, সেটা তুমি বুঝবে না। তুমি আমার আম্মুকে চেনো না।
আমি অবশ্য চাইছিলাম, তোমার আন্টি, আমাদের কথাটা তোমার বাসায় জানিয়ে দিক।
কেন!
কেন আবার? জানিয়ে দিলে, আমাদের জন্য ভালো হত। আন্টি, আংকেল আমাদের বিষয়টা জেনে যেতেন। তাঁরা একদিন তো জানবেনই, তাই না? তুমি তো নিজে থেকে বলতেই পারবে না কোনোদিন।
আমি চাই না বাসায় এখন জেনে যাক।
কেন চাও না? লাইফ নিয়ে কী তোমার অন্য কোনও প্ল্যান আছে? মানে, তোমার লাইফে অন্য কারও আসার সম্ভাবনা…..
তুমি কী উলটোপালটা কথা বলছ? আমার লাইফে অন্য কেউ আসবে কেন?
বাসায় জানানোর কথা উঠলে, তুমি কেমন যেন ঘাবড়ে যাও। তাই ভাবলাম তোমার অন্য কোন প্ল্যান আছে কি না।
এমন কথা আর কখনও বলবে না, সাদমান।
আমি তো তোমার কথা খুব সহজেই মা’র কাছে বলেছি। আমাদের বাসায় সবাই তোমার কথা জানে আর সবাই তোমাকে খুব পছন্দও করে।
তোমার আর আমার বাসা এক না। আর কিছুদিন যাক। সময় হলে, আমি আম্মু আর বাবার সঙ্গে কথা বলব। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না সাদমান।
আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি, অরণী। আমি শুধু ভয় পাই। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। জানি না কেন, হঠাৎ, হঠাৎ আমার মনে হয়, তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। এটা মনে হলে, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। তোমাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনাই করতে পারি না। তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমি….
অরণী, সাদমানের হাত ধরে বলল, আর কখনও এই কথা বলবে না। তোমাকে ছেড়ে, আমি কখনও, কোথাও যাব না।……………………