#মন_নিয়ে_খেলা(১)
*******************
হ্যালো শমী….
কংগ্রাচুলেশনস, পূণম।
হঠাৎ কংগ্রচুলেশন কেন! পূনম একটু অবাক হলেন বন্ধুর কাছ থেকে অভিনন্দন পেয়ে।
শমী বললেন, তুমি কী মনে করেছ, তুমি না জানালে, আমি জানতে পারব না?
কোন বিষয়ে কথা বলছ, বলো তো? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
দুই কন্যার গর্বিত জননী। এক মেয়ে বুয়েটে পড়ছে। অন্যজনও বুয়েটে চান্স পেয়ে গেল। কপাল বটে তোমার।
পূনম হাসলেন। ও আচ্ছা এই কথা। আমি ভাবলাম কী না কী নিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছ। পূনম মনে মনে ভেবেছিলেন, তিনি লেডিস ক্লাবের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায়, শমী কংগ্রাচুলেট করতে ফোন করেছেন।
মানে কী! এটা কী তোমার কাছে বড়ো কোনও বিষয় না?
পূনম কাষ্ঠ হেসে বললেন, অবশ্যই বড়ো বিষয়।
শমী বললেন, আমাকেই দেখো না, কত চেষ্টা করলাম; কিন্তু আমার তিন ছেলের একজনও বুয়েটে চান্স পেল না। যখন, যেখানে পড়তে চেয়েছে, যতরকম ভর্তি কোচিং, সবই তো করিয়েছিলাম; কিন্তু রেজাল্ট শেষমেশ জিরোই আসলো। তুমি বিশ্বাস করবে না, আমার যে কী ইচ্ছা ছিল, ছেলেদেরকে বুয়েটে পড়ানোর। অন্তত একজন যদি ওখানে পড়তে পারত!
আহা, তুমি আফসোস করছ কেন? তোমার ছেলেরা কেউ কী খারাপ কোথাও পড়ছে নাকি? দুইজন নর্থ সাউথে পড়ছে আর ছোটোজন কোথায় যেন পড়ছে?
ছোটোটা গত বছর ব্র্যাকে ভর্তি হল। আমি তো এখনই ছোটোটাকে বকা দিয়ে আসলাম। বললাম, ‘দেখ, দেখ মেয়ে মানুষ হয়ে কী সুন্দর দুই বোনই বুয়েটে চান্স পেয়ে গেল। বাবা-মা’র টাকাও বেঁচে গেল আবার সন্মানও বাড়ল। আর তোরা তিনজন, সারাক্ষণ জোঁকের মতো আমাদের পয়সা শুষে নেওয়ার তালে আছিস।’
তুমি ছেলেদের এই কথা বলেছ!
কোন কথা?
জোঁকের মতো পয়সা শুষে নেওয়ার কথা।
বলব না কেন? তিনটার পেছনে মাসে কত টাকা খরচ হয়, শুনবে?
উহ, ঐ শুরু হয়ে গেল! পয়সার ঝনঝনানি শোনাবে এখন। পূনম, শমীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শমী আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। লায়ন আঞ্জুমান আপা ফোন করছেন। ওনার ফোনটা বেশি জরুরি।
ওকে, ওকে। বাই।
পূনম, ‘বেশি জরুরি’ কথাটা ইচ্ছা করেই বললেন। যাতে শমী বুঝতে পারে, তাঁর লাইফে আরও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা শমীর চাইতে ইম্পর্ট্যান্ট। যত্তসব রাবিস! আজকের যুগে এসে শমীর মতো মানুষরা, ছেলে আর মেয়ে নিয়ে কম্পেয়ার করার কথা কী করে ভাবতে পারে! মহিলা সুযোগ পেলেই পূনমকে ছোটো করার চেষ্টা করেন। শমী বারবার ভুলে যান, তিনি যে পূনম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছেন। সেই পূনম চৌধুরী, যার বাবা মন্ত্রী ছিলেন আর যাঁর স্বামী ফাহাদ, দেশের প্রথম সারীর বিজনেস ম্যান। শমীর কী করে সাহস হয়, পূনম চৌধুরীর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার! বন্ধু হয়েছে বলে কী সবকিছুর সীমা অতিক্রম করে যেতে হবে নাকি? এখন তো মনে হচ্ছে, কিছু মানুষকে হাতে ধরে, নতুন করে জীবন পথের সীমারেখা বুঝিয়ে দিতে হবে। ধ্যাত, শমীর সাথে কথা বলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। পূনম অন্য মোবাইলে লায়ন আঞ্জুমানের ফোন রিসিভ করে বললেন, স্লামালেকুম, আপা। কেমন আছেন?
ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তো আছি। ভীষণ ব্যস্ততা যাচ্ছ। আচ্ছা শোনো, ক্লাব থেকে তোমাকে ফোন করেছিল?
না তো, আপা। কোন বিষয়ে বলেন তো?
আমাদের লেডিস টিম সার্ক দেশের ট্যুরে যাচ্ছে। এবার আমরা মালদ্বীপ, শ্রীলংকা আর ভুটান যাচ্ছি। মোট দশদিনের ট্যুর। কিছু ওয়েলফেয়ারের কাজও করা হবে।
বাহ, খুব ভালো।
আমি কিন্তু লিস্টে তোমার নাম দিয়ে দিয়েছি৷
পূনম খুশি হলেন আঞ্জুমানের কথা শুনে। বিগলিত হয়ে বললেন, আবার আমি কেন, আপা? আমি তো মাত্রই থাইল্যান্ড আর লাওস থেকে ঘুরে এসেছি।
না, না, পূনম। তোমার কোনও ‘না’ আমি শুনবই না। তোমাকে যেতেই হবে। আমি জানি, তুমি খুব ব্যস্ত; কিন্তু তোমাকে আমরা চাই। তোমার মতো একজন চার্মিং লেডি দলে থাকা মানে, পুরো দলটাই চাঙা হয়ে থাকা। প্লিজ পূনম, তুমি মানা করো না।
পূনম এমনিতেও যেতেন। আঞ্জুমান আপার এত সাধাসাধি করার দরকার ছিল নয়। তিন মাস অন্তর একবার বিদেশ না ঘুরলে, পূনমের মাথা ঘুরতে থাকে। তিন মাসে তাঁকে একবার রিল্যাক্স করতে, দেশের বাইরে যেতেই হয়। সে যেভাবেই হোক না কেন। আঞ্জুমানের আন্তরিকতায়, পূনম খুশি হলেন। বললেন, আপা আপনি নিজে ফোন করেছেন, আমি অবশ্যই যাব। আমার যতই কাজ থাকুক না কেন, আপনার জন্য আমি সময় বের করবই।
আমি জানতাম, তুমি আমাকে না করবে না। ঠিক আছে তাহলে। তেইশ তারিখ বিকেলে আমাদের ফ্লাইট। আমি তোমাকে সমস্ত ডিটেইল আর প্রোগ্রাম সিডিউল পাঠিয়ে দিচ্ছি।
থ্যাংকস, আপা।
থ্যাংকস তো আমি বলব। তোমার বিজি টাইম থেকে আমাদের জন্য এতটা সময় বের করে দিলে। থ্যাংকস পূনম।
মোস্ট ওয়েলকাম, আপা।
আঞ্জুমানের ফোন রেখে, পূনম মনে করতে চেষ্টা করলেন, তেইশ তারিখ থেকে পরবর্তী দশদিন তাঁর জরুরি কোনও কাজ আছে কি না। তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। মোবাইলের নোটে ঢুকে চেক করলেন। সেখানে আগে থেকে কিছু টুকে রেখেছেন কি না, দেখে নিলেন। নাহ, এই সময়ের মধ্যে তেমন জরুরি কোনও কাজ নেই। শুধু তাঁর ফুপাতো বোন, ডলি আপুর ছেলের বিয়ে আছে ত্রিশ তারিখে। সেটা তার কাছে এমন জরুরি কোনও প্রয়োজন না। লেডিস টিমের সাথে নিশ্চিন্তেই যাওয়া যাবে।
পূনম ঘড়ির দিকে তাকালেন। এখন বাজে সাড়ে চারটা। ছয়টার সময় গুলশানের ক্লিওপেট্রা লাউঞ্জে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে। আজ তিনি অক্সি-হাইড্রা ফেসিয়ালের সাথে হেয়ার স্পা আর পেডিকিউর-ম্যানিকিউর করাবেন। ফেসিয়ালে তাঁকে রশ্নি নামের একটা মেয়ে সবসময় অ্যাটেন্ড করে। তিনি ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন, রশ্নি আছে কি না। আগেরবার পার্লার থেকে তাঁকে কনফার্ম করার পরও তিনি গিয়ে রশ্নিকে পাননি। রশ্নির ঐদিন ছুটি ছিল, এই কথাটা পার্লার থেকে তাঁকে জানানো হয়নি৷ পরে অবশ্য পার্লারের ওনার জাবিন অনেকবার সরি বলেছে।
কুলসুম ফ্রুট জুস রেখে গেছে। তিনি ফোনে ব্যস্ত ছিলেন দেখে, সে জুস রেখে নিঃশব্দ বেরিয়ে গেছে। পূনম জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন৷ এই জুসটা কুলসুম খুব ভালো বানায়। মাল্টার মধ্যে মিন্ট আর বিটলবন দেয়। তাছাড়াও তার নিজস্ব বানানো একটা মশলা আছে। গোলমরিচ, শুকনো আদা কুচি আর একটুখানি জিরের গুঁড়ো। চমৎকার হয় খেতে।
জুস শেষ করে পূনম, দেওয়াল জুড়ে সেঁটে থাকা বিশাল আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে দেখলেন। আসছে ডিসেম্বরে তাঁর বয়স হবে ঊনপঞ্চাশ বছর। অথচ তাঁকে দেখতে নাকি বড়োজোর পঁয়ত্রিশ লাগে। সবাই তো এটাই বলে। তাঁর নিজের কাছে তো আরও কম মনে হয়। এখনও তিনি চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। শরীরে এতটুকু মেদের বাহুল্য নেই। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটাই রয়েছে। তারুণ্যের দিনে তিনি ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এমন সৌন্দর্য কমই দেখা যায়। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ আর শ্যওলা সবুজ চোখের মনি, সাথে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা, এমন মেলবন্ধন বাঙালি মেয়েদের সচরাচর হয় না। তাঁর যে তেইশ আর আঠারো বছর বয়সী দুই মেয়ে আছে, এটা তাঁকে দেখে কিছুতেই বুঝা যায় না। এখনও অনেকে দুই মেয়েকে, পূনমের বোন ভেবে ভুল করে। পূনম বিষয়টা খুব উপভোগ করেন। বড়ো মেয়ে অরণী বুয়েটে, কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে। ছোটো মেয়ে নীলোর্মি এবার আর্কিটেকচারে চান্স পেয়েছে। আগামী সপ্তাহে ওকে ভর্তি হতে হবে।
দরজায় টোকা পড়তেই, পূনম আয়নার সামনে থেকে সরে এসে, ইজি চেয়ারে বসে বললেন, এসো। তাঁর ঘরে কারও হুট করে ঢোকার পারমিশন নেই। মেয়েদেরকে তিনি ছোটোবেলা থেকেই কঠিন নিয়মানুবর্তীতার ভেতর দিয়ে বড়ো করেছেন। কোনও নিয়মের ব্যত্যয় হলে, বাসায় আগুন লেগে যায়। মেয়েরারও বড়ো হতে, হতে পূনমের তৈরি করা নিয়মে, চাবি দেওয়া পুতুলের মতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পূনমের পারমিশনের বাইরে ওরা যেন হাসতেও ভয় পায়।
দরজা ঠেলে নীলোর্মি রুমে ঢুকল। রুমটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। নীলোর্মি এসির দিকে তাকিয়ে দেখল, টেম্পারেচার ১৬ তে দেওয়া আছে। পূনম বললেন, কিছু বলবে?
জি আম্মু।
বলো।
নীলোর্মি কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। তার এতটা সাহসই নেই, কথাটা বলার মতো। সে দাঁড়িয়ে থেকে ইতস্তত করতে লাগল। পূনম মোবাইল থেকে চোখ তুলে বললেন, কী বলবে, বলো?
আম্মু, আমি বুয়েটে পড়তে চাই না।
পূনমের হাত থেমে গেল। তিনি মোবাইল থেকে চোখ না তুলে বললেন, তোমার কথা বুঝতে পারিনি। আবার বলো।
নীলোর্মির বুকের ভেতর হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। তবুও সে সাহস করে কথাটা আবার উচ্চারণ করল। আমি বুয়েটে পড়ব না।
পূনম পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখলেন। তারপর বললেন, রবিবারে তোমার ভর্তি। মনে থাকে যেন।
আম্মু প্লিজ, আমি ওখানে ভর্তি হব না।
মেয়ের সাহস দেখে পূনম চমৎকৃত হলেন। এইচএসসি পাশ করতে না করতেই, নিজের দাবি জানাতে শিখে গেছে! তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি কোথায় পড়তে চাচ্ছ?
মম, আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে চাই। ইকনোমিকসে।
পূনম বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে, নিজের ভেতর ধৈর্য ধারণ করলেন। তারপর বললেন, যতসব রাখাল-চন্ডালদের সঙ্গে গিয়ে, নিজেও রাখাল হতে চাও, তাই না?
নিলোর্মি ভীষণ অবাক হল, রাখাল-চন্ডাল! এ কেমন কথা? নীলোর্মি কী এমন ভয়াবহ কিছু বলেছে, যাতে পূনম, রাখাল-চন্ডাল কথাটা উচ্চারণ করলেন? নীলোর্মি কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। পূনম প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পালটে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চুলে মিল্ক রিবন্ডিং করিয়েছিলে?
আমি না। আপু করিয়েছিল।
মিল্ক রিবন্ডিংটা কোথায় যে ভালো করায়?
আপুকে জিজ্ঞেস করব?
না। আজকে ক্লিওপেট্রাতে খোঁজ নিতে হবে। মেয়েকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, পূনম জিজ্ঞেস করলেন, অরণী কোথায়?
আপু এখনও ফেরেনি।
নিজের রুমে যাও। আর মাথার ভেতর যত অদ্ভুত বাজে চিন্তা আছে, সেসব বের করে দাও। তুমি বুয়েটেই পড়বে। এটাই ফাইনাল। এই বিষয়ে যেন আর একটা কথাও না বলতে হয়। বুঝতে পেরেছ?
জি, আম্মু।
নীলোর্মি মাথা নীচু করে রুম থেকে বেরিয়ে এল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে। মা নামক এই মানুষটিকে তার কাছে মাঝে মাঝে অসম্ভব পাষাণ মনে হয়। এই মানুষটা তাদের দুই বোনের সঙ্গে মাসে একবারও মনে খুলে কথা বলেন না। ছোটোবেলা থেকে সে দেখে এসেছে, বন্ধুদের সঙ্গে তাদের মায়েদের কত চমৎকার সম্পর্ক। কারও, কারও মা তো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পুরো বন্ধুর মতো আচরণ করেন আর তাদের মা? তাদের মা অদৃশ্য এক দেওয়াল দিয়ে মেয়েদের সঙ্গে নিজের একটা অকাট্য দুরত্ব তৈরি করে রেখেছেন। নীলোর্মির ধারণা, এই দেওয়াল কোনোদিনও ভাঙবে না।…………………….…