#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
কলিং বেল বেজে উঠল। খানিক পর আহনাফের মা এসে দরজা খুলে দিলেন। কামরুল, চিত্রা, দিহান ও বাঁধন একসঙ্গে সালাম করল। আহনাফের মা মিসেস শেখ হাসিমুখে সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে ঘরে প্রবেশ করালেন। আহনাফের মা বলেন,
–’ এত রাতে তোমরা? ‘
কামরুল উত্তর দিল,
–’ আহনাফের জ্বর শুনে এসেছি। ‘
–’ ভালো করেছ। আহনাফ ঘরেই আছে। চলে যাও। ‘
বলার সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা একপ্রকার দৌঁড়ে গেল আহনাফের ঘরে। আহনাফের মা সেদিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলেন। চিত্রার এহেন কাজে সবাই কিছুটা বিব্রত হল। দিহান বলল,
–’ আসলে…. চিত্রা…’
আহনাফের মা আটকে দিলেন। বললেন,
–’ থাক। কৈফিয়ত দিতে হবে না। আহনাফের ঘরে যেতে পারো তোমরা। ‘
কামরুল বলল,
–’ ধন্যবাদ, আন্টি। ‘
সবাই দরজা ঠেলে আহনাফের ঘরে ঢুকল। বিছানার উপর অবসন্ন দেহে শুয়ে আছে আহনাফ। কপালে জলপট্টি রাখা। চিত্রা আহনাফের চুলে হাত বুলিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। আহনাফ দু একবার উত্তর দিলেও এখন আর কথা বলছে না। কথা বলার শক্তি ওর মধ্যে আর একটুও অবশিষ্ট নেই। সবাই আহনাফের পাশে বিছানায় বসল। আহনাফ বন্ধুদের দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। চিত্রা দ্রুত বলল,
–’ দাড়া, আমি ধরছি। ‘
চিত্রা আহনাফকে ধরে উঠে বসাল। পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসল আহনাফ। ক্লান্ত চোখে সবাইকে নিরীক্ষণ করে বলল,
–’ কি ব-ব্যাপার? স-সব একসাথে? ‘
দিহান আহনাফের পায়ে আঙ্গুল খুঁচা দিয়ে বলল,
–’ শুনলাম বৃষ্টিতে ভিজে তুমি নাকি আল্লাহ পেয়ারা হয়ে যাচ্ছ। তাই ভাবলাম পেয়ারা গাছকে দেখে আসি একটু। তা মাম্মা, কার সাথে ভিজলা? আমাদের জানাও। আমরাও শুনে একটু রোমান্টিক-রোমান্টিক খেলা খেলি। ‘
চিত্রার বুক জ্বলে উঠল। আভা কি আবার আহনাফের জীবনে এসেছে? দিহান অনুমানের ভিত্তিতে ভুল কিছু বলে নি নিশ্চয়ই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে। চিত্রা কাতর চোখে চেয়ে আছে আহনাফের দিকে। না বোধক উত্তর শুনার জন্যে তার হৃদয় ব্যাকুল। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে চাইল। কোনপ্রকার উত্তর দিতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
–’ তোদের মাথা। কার সাথে ভিজব? বাইকে বাসায় আসার সময় ভিজেছি। ‘
চিত্রার বুকে পানি এল। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ল। যাক, আভা ছিল না। কামরুল বলল,
–’ কিছু খেয়েছিস? ‘
আহনাফ মৃদু কন্ঠে বলল,
–’ মা ফল কেটে দিয়েছিল। ‘
–’ ভাত খাবি? ‘
ভাতের কথা শুনে আহনাফের পেট গুলিয়ে আসতে লাগল। মুখের ভেতর টক স্বাদ অনুভব করতে লাগল। বলল,
–’ না। ‘
–’ স্পেশাল তরকারি আছে। ‘
–’ স্পেশাল মানে? ‘
আহনাফের বিরক্ত প্রশ্ন। কামরুল হাসল। আহনাফের কানের কাছে বিড়বিড় করে শুনাল,
–’ আভা টমেটোর তরকারি রেঁধে পাঠিয়েছে। এবারেও কি খাবি না?’
আহনাফের চক্ষু বিশাল আকার ধারণ করল। ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ ঝরঝরে হল। আভা রান্না করে পাঠিয়েছে? অর্থাৎ আভা জানে আহনাফ অসুস্থ! শিট! আহনাফের কল করার কথা ছিল। অসুস্থতার কারণে মোবাইল হাতে নেওয়ার শক্তি হয় নি। নিশ্চয়ই আভা অপেক্ষা করেছে। আহনাফের কল না পেয়ে নিজেই কল দিয়েছে। কে রিসিভ করেছে? মা? মা আবার চিনে ফেলে নি তো? মাকে এখনি সব বলার সময় হয় নি। সময় হলে আহনাফ নিজে জানাবে তার মা-বাবাকে। কিন্তু এখন না।
বাঁধন কিছুক্ষণ সন্দেহবাতিক চোখে কামরুল ও আহনাফকে দেখে গেল। অতঃপর কামরুলের পিঠে ভয়ানক এক থাবা বসিয়ে বলল,
–’ ওই ব্যাটা? কানে কানে কি কস? আমাগোও কইলে বউ ভাইগা যাইব তোর? ‘
আহনাফের সকল বন্ধুরা সবসময় খাঁটি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু যখন তাদের রাগ উঠে কিংবা মজা করতে ইচ্ছে হয় তখন সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বাঁধনের এখন রাগ উঠছে নাকি মজা করছে বোঝা মুশকিল। কামরুল পিঠে হাত ঘষে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,
–’ হাত না দানব। আমার বউ ভাগার আগে আমি তোর বউকে ভাগাই নিয়ে যাব। শালা, হাত চলে ক্যান এত? ‘
বাঁধন আরো একটা ঘা বসাল কামরুলের পিঠে। চিত্রা বাধনকে আটকাল। বলল,
–’ মারামারি করার সময় না এখন। আহনাফ অসুস্থ। দেখছিস না? ওকে খাওয়াতে হবে কিছু। ‘
কামরুল সোজা হয় বসল। একের পর এক থাপ্পর খাবার দরুন পিঠ বেকে আসছে তার। কামরুল গলা কেশে বলল,
–’ ওয়েট। আমি টিফিনে খাবার এনেছি। ‘
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–’ তুই রেধেছিস? ‘
–’ আব.. না। হোটেল থেকে আনিয়েছি। ‘
দিহান চিত্রার মাথায় চাটা দিল। চিত্রা বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ঘষে দিহানের দিকে চাইল। দিহান বলল,
–’ এত প্রশ্ন কেন করিস? তোর প্রশ্ন শুনে আহনাফের পেট ভরবে? চুপ করে বসে থাক। ‘
কামরুল রুদ্ধশ্বাস ফেলল। টিফিন খুলে একে একে তরকারি আর ভাত বের করো। তরকারি ঘ্রাণে ঘর ম-ম করতে লাগল। দিহান বলল,
–’ ভাই, কোন হোটেল থেকে খাবার এনেছিস? এত সুন্দর ঘ্রাণ! ‘
কামরুল আড়চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে হেসে বলল,
–’ আহনাফের পার্সোনাল হোটেল। ‘
সবাই অবাক হল। আহনাফ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কামরুলের মাথায় চাটা দিয়ে বলল,
–’ বেশি কথা না বলে খাবার সার্ভ কর। ‘
কামরুল মাথায় হাত ঘষে বলল,
–’ করতেসি তো। মারস ক্যান? ‘
বাঁধন ভ্রু বাকাল। বলল,
–’ ওয়েট, ওয়েট, কামরুল। আহনাফের পার্সোনাল হোটেল মানে? ‘
কামরুল দ্বিধায় পড়ে গেল। মজা করতে গিয়ে কি থেকে কি বলে ফেলল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আহনাফ বলল,
–’ আমার প্রিয় হোটেল বুঝিয়েছে। নূর দাদীর হোটেলের তরকারি এসব। ‘
দিহান ওহ বলে টানা স্বর তুলল। বাঁধন বলল,
–’ তাই বলি, এত ঘ্রাণ কেন? নূর দাদুর হাত ছাড়া কারো রান্নায় এত ঘ্রাণ আসে না। আমারও খেতে ইচ্ছে করছে। ‘
কামরুল বলল,
–’ আহনাফ খেয়ে তরকারি থাকলে খাবি। ‘
টমেটো দিয়ে মাছ আর ভাত প্লেটে রেখে আহনাফের দিকে এগিয়ে দিল। আহনাফ লোকমা নিউজ নিজের মুখে তুলল। প্রথম খাবার মুকুর দিয়ে চোখ বুজে ফেলল। প্রিয়তমার হাতের রান্না সকল প্রেমিকের কাছেই কি অমৃত মনে হয়? এত সুস্বাদু খাবার মায়ের পরে আহনাফ এই প্রথম খেল। আহনাফ খাবার চিবুতে চিবুতে বন্ধুদের দিকে চাইল। সবাই মুগ্ধ চোখে আহনাফের খাওয়া দেখছে। আহনাফের মা দরজা থেকে আহনাফকে খেতে দেখে শান্তি পেলেন। রাতভর মুখে কিছু তুলে নি ছেলেটা। দু টুকরা আপেল জোর করে খাওয়াতে পারলেও আর কিছু মুখে দিতে পারেন নি। এখন এত মজা করে ভাত খাচ্ছে দেখে আহনাফের মায়ের বুকে পানি এল। আহনাফ আরো এক লোকমা তৈরি করে চিত্রার মুখে এগিয়ে দিল। চিত্রা খুশিতে পাগল হল। আহনাফের হাত থেকে লোকমা মুখে নিয়ে সুখী মনে চিবুতে লাগল। একে একে আহনাফ নিজের হাতে বাঁধন, কামরুল আর দিহানকেও খাইয়ে দিল। মিলেমিশে সবাই আহনাফের হাতে ভাত খেল। বন্ধুদের সাথে থেকে আহনাফের জ্বর কোথাও যেন পালিয়ে গেল। সুখী সুখী হাসছে আহনাফ। বন্ধুদের এমন মিল দেখে আহনাফের মায়ের চোখে জল ভরে। মনে পড়ে যায়, নিজের এক বন্ধুগোষ্ঠীর কথা। একসময় এমনই এক দৃশ্যের সৃষ্টি তিনিও করেছিলেন। ছেলের আচরণে নিজেকে দেখতে পারছেন মিসেস শেখ।
#চলবে