#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
আর তিনমাস পর আভার ভর্তি পরীক্ষা। এইচএসিতে পরীক্ষা শেষ করে মস্তিষ্ক ঝরঝরে করতে দুদিনের ট্রিপে সাজেক গিয়েছিল। মস্তিষ্ক ঝরঝরে হয়েছে বটে তবে মস্তিষ্কের ভেতর লবণাক্ত সমুদ্রের ন্যায় প্রবাহিত হচ্ছে প্রেমের ঢেউ। বয়স আঠারো পেরিয়ে গেলেও মেধা-মনন এখনো চঞ্চল কিশোরীর ন্যায়। উড়ে বেড়াতে চায়, হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে চায়, ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে রাস্তা পেরুতে চায়। এমন হাজারো কৈশোরী ইচ্ছে ডানা ঝাপটায় আভার ছোট্ট হৃদয়ে। সেই ফলস্বরূপ এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাবার কাছে বায়না ধরেছে, সাজেক যাবে। ছোট্ট মেয়ে। জুনায়েদ একা দিতে চান নি। এর আগে বহু জায়গায় ঘুরতে গেছে। একা একা। কখনো স্কুল কিংবা কলেজের পিকনিকে কিংবা একা ট্যুর টিমের সাথে। আভা বরাবরই একা ট্রাভেল করতে ভালোবাসে। কিন্তু আদরের মেয়ে তো। ভয় হয় আভার বাবার। তাই মেয়েকে বড্ড জোর করে ক্যারাটে শিখিয়েছেন। ভবিষ্যতে যেন নিজের রক্ষা নিজে করতে পারে। আজকাল যে যুগ এসেছে। কখন কে ক্ষতি করে বসে ইয়ত্তা নেই।

আভা পড়তে বসেছে। পড়তে ভালো লাগছে না। ক্যালকুলেটর নিয়ে অযথাই খুঁচিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল আভার, আহনাফের বয়স কত? আভার সাথে তার বয়সের পার্থক্য কত? আভা অনুমানের ভিত্তিতে কিছুক্ষণ ক্যালকুলেটার চাপল। না, অনুমানের ভিত্তিতে বয়স দেখা ঠিক হচ্ছে না। আভা ঠোঁট কামড়ে কয়েক পল বসে রইল। হঠাৎ মনে পড়ল, সেদিন কামরুল বলছিলে আহনাফরা আর এক বছর পড়লেই মেডিকেল পাশ করবে। তবে আভার বয়স এখন আঠারো। মেডিকেল পাশ করতে লাগবে পাঁচ বছর। আহনাফরা চতুর্থ বছরে পড়ছে। তাহলে আহনাফের বয়স বাইশ কিংবা তেইশ বছরের কাছাকাছি। আভার সাথে তার বয়সের পার্থক্য চার থেকে পাঁচ বছরের। আভার মুখে অন্ধকার নেমে এল। চার কিংবা পাঁচ বছরের পার্থক্য কি খুব বেশি? আহনাফের পাশে আভা কে কি খুব বাচ্চা দেখাবে? আহনাফের সাথে আভাকে মানাবে না? আভা ছোট বলে কি আহনাফ তাকে ছেড়ে দিবে? বলবে, যাও তো মেয়ে। তোমার সাথে আমার যাচ্ছে না।

আভার মনে ঝড় বইয়ে গেল। ছোট্ট মন ভেঙে গুড়িয়ে যেতে লাগল। আভা টেবিলে ঢলে পড়ে বসে রইল। অযথাই খাতায় আঁকিবুকি করল কিছুক্ষণ। লিখল এটাসেটা। গান লিখল, ছন্দ লিখল, আহনাফের নাম লিখে আস্ত দু পেইজ ভরিয়ে ফেললো। অথচ মনের জ্বালা মিটল না।
এই আহনাফটা বড্ড খারাপ। এই যে আভার রাতের ঘুম কেড়ে নিল, মনের শান্তি শুষে নিল। আভা খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে। বারবার তার কথা মনে পড়ে কষ্ট পায়। অথচ তাকে দেখো? এখন অব্দি একটা কল করে নি। তার কি আভার কথা মনে পড়ছে না? খারাপ লোক।

–’ চান্দের রাইত? টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন? ‘
মিনহাজের ভরাট কণ্ঠ শুনে আভা ধড়ফড়িয়ে বসে পড়ল। আহনাফের নাম লেখা খাতা চট করে বন্ধ করে ফেলল। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বলল,
–’ ভাই, ভেতরে আসো। ‘
মিনহাজ শার্টের টাই ঢিলে করতে করতে আভার পাশের চেয়ারে এসে বসল। সারা বেলা কাজ করে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে মিনহাজের। তবুও বোনের পাশে বসে কিছুক্ষণ এটাসেটা নেড়ে বলল,
–’ ঘুমাচ্ছিস কেন? দুদিন পর পরীক্ষা, ভুলে গেছিস? ‘
–’ না, ভুলি নি। মনে আছে। ‘
–’ তাহলে পড়ছিস না কেন? ‘
–’ পড়ছি ত। এই দেখো, ফিজিক্সের অঙ্ক করছিলাম। অথচ একটা অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছি না। তাই টেবিলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। ‘
–’ কোন অঙ্ক? দেখা। ‘
আভা চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কোন অঙ্ক দেখাবে সে? আভা ত মাত্রই পড়তে বসল। একটা পড়া পড়েনি। মিনহাজ ভাইকে কি দেখাবে? আভা ঠোঁট ভেঙে হেসে বলল,
–’ তোমার কষ্ট করে দেখান লাগবে না, ভাই। গাইড আছে7। আমি দেখে নিব। সমস্যা হবে না। ‘
মিনহাজ অবশ্য শুনল না। বরং ধমক দিয়ে বলল,
–’ দেখা বলছি। আমি করে দিব। তুই করতে পারলে, এতক্ষণে করে নিতি। পারিস নি, সারারাতেও পারবি না। দেখা এখন। ‘
আভা বই খুললো। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা কঠিন অঙ্ক বের করে মিনহাজকে দেখাল। মিনহাজ অঙ্ক দেখে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর চট করে আভাকে অঙ্ক করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল। আভা অবাক। মিনহাজ বরাবরই মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনয়ারিং নিয়ে পড়ে এখন ভালো চাকরি করছে। তার পক্ষে ফিজিক্সের অঙ্ক করা হাতের চুটকির সমান। মিনহাজ প্রশ্ন করল,
–’ আর কোনো সমস্যা আছে? ‘
–’ না, নেই। ‘
–’ সমস্যা হলে বলবি। আমি সলভ করে দিব। ‘
মিনহাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আভার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে আভার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আভা মাথা ঘষে ভাইকে গালি দেয়। এতক্ষণ কত সুন্দর ব্যবহার করছিল। অথচ যাওয়ার আগে ভালো ব্যবহারের উপর গো মুত্র ছেড়ে গেল। সব জলে গেল। খারাপ ভাই!

মিনহাজ নিজের কক্ষে প্রবেশ করার আগে মাকে চিৎকার করে চায়ের কথা জানাল। নিজের কক্ষে প্রবেশ করে প্রথমেই জামা কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল মিনহাজ। সারা গা ঘেমে বিচ্ছিরি অনুভব হচ্ছে। ঠাণ্ডা জলের নিচে না দাড়ালে গরমে এই মুহূর্তেই যেন লুটিয়ে পড়বে মিনহাজ।

বিছানায় বসে চা খাচ্ছি মিনহাজ। ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ রিং বাজল। অতঃপর ওপর পাশের মানুষ কল ধরল।
–’ হ্যালো। ‘
–’ এতক্ষণ লাগে কল রিসিভ করতে? ‘
–’ বাসায় মানুষ ছিল।’
–’ ওহ। কি করছিলে? ‘
–’ জিজ্ঞেস করবে না কে এসেছে? ‘
আরোহীর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে গেল মিনহাজের। সে কণ্ঠে খাদে নামিয়ে থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
–’ কে? ‘
–’ পাত্রপক্ষ। ‘
–’ তোমার বোনকে দেখতে? ‘
–’ না। আমাকে। ‘
–’ হোয়াট? ‘
মিনহাজ কিছুটা বিস্মিত হয়ে পড়ল। আরোহীর ভেজা কণ্ঠ শুনে বুঝতে বাকি রইল না মিনহাজের কিছু। মিনহাজ শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করল,
–’ বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে? ‘
–’ না, আমার মতামত নিয়ে ঠিক হবে। ‘
–’ তা, তোমার মতামত কি? ‘
মিনহাজের সোজাসাপ্টা স্পষ্ট প্রশ্ন। আরোহী এবার কেঁদেই ফেলল। আর আটকে রাখা সম্ভব হল না চোখের জল। মুক্তোর ন্যায় চোখের সমুদ্র থেকে ঝরে পড়তে লাগল বৃত্ত-জল। মিনহাজের আর শোনার প্রয়োজন পড়ল না আরোহীর উত্তর। সে নিভল খানিক। গলার স্বর থৈথৈ সমুদ্রের গভীরতায় ঢেলে জিজ্ঞেস করল,
–’ আমায় বিয়ে করবে, আরোহী? ‘
আরোহী থমকাল। কান্না থেমে গেল চকিতেই। আরোহী আর ভাববার অবকাশ পেল না। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে হেসে জবাব দিল,
–’ হ্যাঁ। বিয়ে করব। একশোবার করব, হাজার বার করব। ”
মিনহাজ মৃদু হেসে উঠে। আরোহী বিয়ের কথা শুনে পাগল হয়ে গেছে। আরোহী বরাবরই মিনহাজ বলতে উন্মাদ। প্রেমের শুরুটা মিনহাজের দ্বারা হলেও, প্রেমটা জমে উঠেছে আরোহীর কারণে। মিনহাজের মাঝেমধ্যে মনে হয়, মিনহাজের জন্যে আরোহী সঠিক। আরোহী ছাড়া মিনহাজকে আর কেউ ভালো বুঝতে পারে না। মিনহাজ হাসল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ আমি আসব। তোমায় বাম পাঁজরের হাড় বানানোর জন্যে আমাকে যে আসতেই হবে। অপেক্ষা করবে? ‘
–’ সারাজীবন অপেক্ষা করব। ‘
মিনহাজ হাসে। চায়ের স্বাদ আজ একটু বেশি ভালো লাগছে। চারপাশ এত মধুর ন্যায় মনে হচ্ছে কেন? আরোহীকে নিজের করে পাবে বলে কি এত সুখ?
____________________________________
আহনাফ বসে আছে বারান্দার মেঝেতে। আকাশের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল। আজ আকাশের অত্যন্ত সুন্দর এক চাঁদ উঠেছে। বাঁকা চাঁদ। যেন চাঁদের দুহাত দুদিকে মেলে রেখেছে, কোমড় দুলিয়ে নৃত্য করছে। চাঁদ যেন আজ খুব খুশি। এত খুশি কেন সে? সেও কি নিজের প্রিয় মানুষ পেয়েছে?
আহনাফ গিটার নিয়ে বসল। গিটারে টুংটাং সুর তুলল। আজ কণ্ঠে গান আসছে না। গলাটা কেমন যেন বসে আছে। আহনাফের আকাশ আজ বিষন্ন। আভার আকাশ কেমন?
আভা কি আহনাফের জন্যে খুব ছোট নয়? আভা মাত্র কলেজে পড়ে। আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহনাফের প্রতি ভালো লাগা তার আজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। আহনাফ যদি আভার ক্ষণিকের মোহ হয়? জীবনের কোনো এক পর্যায়ে অলস বিকেলে বারান্দায় কেদারায় বসে বিবশ মনে আভার যদি মনে হয়, আহনাফ আভার জন্যে শ্রেষ্ট পছন্দ ছিল না? কি করবে আহনাফ? আভাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আভার অপছন্দ হয়ে বেচেও থাকতে পারবে না। আভা কি আদৌ বুঝে, ভালোবাসা কি? তার যন্ত্রণা পুষে রাখা কতটা কষ্টের? আভা ভালোবাসতে জানে। অথচ যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে জানে না। ভালোবাসার অপর নাম কষ্ট। কষ্ট ছাড়া ভালোবাসা সম্ভব নয়। আভার মন কি কষ্ট সহ্য করতে সক্ষম? আহনাফ দ্বিধায় জড়াল। কি সিদ্ধান্ত নিবে ঠাহর করতে পারল না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here