#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – শেষ পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________
মিনহাজ এই মুহূর্তে বাবার ঠিক মুখোমুখি বসে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। বুকে পুষে রেখেছে কনফিডেন্স। প্রিয়তমাকে নিজের করে পাওয়া তীব্র ইচ্ছা। জুনায়েদ গম্ভীর চোখে ছেলেকে আগাগোড়া লক্ষ্য করে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
‘ মেয়েটার নাম কি?
মিনহাজ ঢোক গলাধঃকরণ করে মিহি স্বরে বলল,
‘ আ-আরোহী। ‘
‘ কোথায় থাকে?
‘ আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে। ‘
‘ তুমি তাহলে এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাও? ‘
‘ হ্যাঁ। যদি তোমাদের মত থাকে। ‘
‘ আমরা মত না দিলে? ‘
‘ ভাবব, আমার চাওয়ার মধ্যে ভুল ছিল। ‘
জুনায়েদ হাসেন। মিনহাজকে অবাক করে দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
‘ বিয়ের প্রস্তুতি নাও। আগামী মাসে বিয়ে হচ্ছে। ‘
মিনহাজ বিস্ময় নিয়ে চায় বাবার পানে। বাবা এত সহজে আরোহীকে মেনে নিবেন ভাবতে পারেনি মিনহাজ। মিনহাজের চোখের কোনায় জল জমে। হুট করে জড়িয়ে ধরে বাবার গা। জুনায়েদ মুচকি হেসে ছেলের পিঠে হাত রেখে দোয়া পড়েন। জুনায়েদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলে মিনহাজ মায়ের পাশে এসে বসে। সাহারা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘ মেয়েটা কি ভীষন সুন্দরী রে, মিনহাজ? ‘
মিনহাজ হাসে। বলে,
‘ একদম তোমার মত সুন্দর। ‘
সাহারা খাতুনের মন প্রাণ ভরে যায়। ছেলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। রাজা ছেলে তার!
___________________________
অতঃপর মিনহাজের বিয়ে হয় ভীষন ধুমধামে। কবুল বলার সময় আরোহীর কান্না সবার মন খারাপ করালেও মিনহাজের কবুল বলার নির্লিপ্ততা সবাইকে ভীষন হাসিয়েছে।
আভা বাসর ঘরে তার সদ্য ভাবীকে এনে বসায়। আরোহী লজ্জায় নেতিয়ে। চোখ তুলে তাকাবার জো হচ্ছে না তার। লজ্জায় যেন দম বন্ধ লাগছে। আভা আরোহীর লেহেঙ্গা ঠিক করে দেয়। বলে,
‘ ভাবি, তোমার জামা কাপড় সব ভাইয়া আগেই আলমারি ভর্তি করে রেখেছে। গরম লাগলে গোসল করে নিবে। একদিন দুইবার গোসল করবে। কি আর করার। বাসর ঘর বলে কথা। ‘
ইশ,ইশ! আরোহী ম’রে যাচ্ছে এসব কথা শুনে। আভা মেয়েটা এত ঠোঁটকাটা কেন? একদম ভাইয়ের মুখ পেয়েছে। মিনহাজও এমন ঠোঁটকাটা। যখন তখন লাগামহীন কথা বলে আরোহীকে লজ্জা দেয়। ভাইবোন সব এক ধাচের। আভা আরোহীকে প্রয়োজনীয় সব কথা বলে। আরোহী মন দিয়ে শুনে। মিনহাজ এসে সোফার উপর বসে। আরোহী আড়চোখে তাকায়। মিনহাজের গায়ে শেরওয়ানি নেই। মাত্রই গোসল সেরে এসেছে। চুল ভেজা, কপালে এখনো পানির বিন্দু লেগে আছে। মিনহাজ চোখ টিপ্পনী দেয়। আরোহী লজ্জায় আর তাকাতে পারে না। চোখ সরায়। আভা আরোহীকে ছেড়ে ভাইয়ের সামনে এসে দাড়ায়।
আভা হেসে ভাইয়ের দিকে হাত পাতে। মিনহাজ ভ্রু উচুঁ করে বলে,
‘ ভিক্ষা নেই, যা। ‘
‘ ভিক্ষা চাইছে কে? আমি বখশিশ চাইছি। পাঁচ হাজার টাকা বের করো ঝটপট। ‘
‘ পাঁচ হাজার টাকা? ওই, টাকা কি গাছে ধরে? ‘
‘ না, গাছে ধরে না। পকেটে ধরে। বের কর জলদি। ‘
‘ টাকা নেই, ফুট। ‘
‘ আছে। তুমি কি বের করবে? ‘
‘ বললাম না নেই। ‘
আভা ভাইয়ের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলে। মিনহাজও নাছোড়বান্দার ন্যায় তর্ক করে যায়। একপর্যায়ে আরোহী বলে,
‘ আভা, আমি দিচ্ছি টাকা। আসো এদিকে। ‘
আভা মিনহাজের দিকে চোখ রাঙিয়ে চেয়ে ভাবির দিকে যায়। আরোহী তার ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আভার হাতে ধরিয়ে দেয়। মিনহাজ আসার সময় দিয়েছিল এই টাকা সবাইকে দেওয়ার জন্যে। আভা হেসে উঠে আরোহীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরোহী হাসে। ভাই-ভাবীকে বাসর ঘরে একা রেখে আভা দরজা ভিড়িয়ে চলে যায়।
মিনহাজ সোফা থেকে উঠে। আরোহীর দিকে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে। আরোহী জমে যায় সেখানেই। একহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে রাখে। বুক ক্রমশ উঠানামা করছে। যেন এক্ষুনি মিনহাজের এমন বেহায়া চাওনিতে ম’রণ হল তার। মিনহাজ আরোহীর পাশে এসে বসে। আরোহীকে গহীন চোখে পরখ করে। আরোহীর ঠোঁট কাপছে। মিনহাজ এগিয়ে এসে আরোহীর কপালে চুমু খায়। গভীর করে ঠোঁট ঠেসে রাখে আরোহীর কপালে। শিহরণে আরোহীর চোখ খিঁচে ফেলে। মিনহাজ মৃদু স্বরে বলে,
‘ আমার অর্ধাঙ্গিনী। ‘
ইশ, আরোহী এবার সত্যি সত্যি ম’রে গেল।
____________________________________
আভা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে আজ প্রায় চার বছর। প্রতিদিন মেডিকেলে যাওয়া আসার কারণে শরীর প্রায় নেতিয়ে। আইটেম, কার্ড ,ভাইভা এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছে প্রায়। আহনাফের পড়াশোনা শেষ। এখন চাকরি করছে। সম্পর্কটা ভালোই চলছে দুজনের। একে অপরকে চোখে হারায়। আভা সেই আগের ন্যায় আহনাফকে ছাড়া এক বিন্দু কিছু ভাবতে পারে না। আহনাফের বুকেই তার সকল সুখ! আহনাফ এখনও অবাক হয়, একটা মেয়ে আহনাফের ন্যায় সাধারণ এক পুরুষে এত মজল কিভাবে? আভার ভালোবাসা আহনাফকে ছাড়িয়ে চলে যায় বহুদূর, বহুদূর এবং বহুদূর!

সময়ের ঘন্টা এগিয়ে চলেছে সামনে। আভা আহনাফের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে এ মাসের দশ তারিখ। আভার খুশি আর দেখে কে? খুশিতে যেন নেচে উঠছে সে। আহনাফকে জ্বালাচ্ছে ক্রমাগত। বিয়ের পর এই করবে, সেই করবে! কতশত কথা তার। স্বপ্নেরা উকিঝুকি দিচ্ছে মনের আঙিনায়। আহনাফও বাধ্য প্রেমিকের ন্যায় আভার সকল জ্বালাতন সহ্য করছে। আর মাত্র কটা দিন। তারপরই তার ঘরের লক্ষ্মী তার ঘরে আলতা রাঙা পা রাখবে। মুখরিত করবে সারা বাড়ি। ক্লান্ত বিকেলে এক কাপ চায়ে দুজন দুজনার মধ্যে হারাবে। ধোঁয়া উঠা গরম ভাত একে অপরের মুখে তুলে দেবে। ইশ! সময়টা এত সুন্দর কেন? জীবন এত মুগ্ধময় কেন? একটা নারীকে ঘিরে এত সুখ কেন?

বিয়ের সানাই বাজল অবশেষে। আভা বধূ সেজে আহনাফের পাশে বসে আছে। আভার গায়ে লাল বেনারসি, পা ভর্তি আলতার লাল রঙ, গায়ে গহনা! সবই আহনাফের পছন্দের। আহনাফ নিজ হাতে বিয়ের সব বাজার করেছে। আভাকে অবাক চোখে চেয়ে দেখছে আহনাফ। বিয়ের সাজে আভাকে সবসময় কল্পনা করত আহনাফ। আজ আভাকে বধূ বেশে তার কল্পনার থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে। আভার চোখে সুখের ঝলক। যেন অতি সুখে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। আহনাফ সবার অলক্ষে শক্ত করে আভার কোমড় চেপে ধরে। কানের কাছে বিড়বিড় করে সুধায়,
‘ বউরে, আজ তুমি শেষ! ‘
আভা লজ্জা পায়। লজ্জায় কথা বলতে পারে না। মৃদু স্বরে বলে,
‘ অসভ্য কোথাকার। ‘
আহনাফ হাসে। বলে,
‘ পাঁচ পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছি। অসভ্য হতে ইচ্ছে করলেও বৈধ নই বলে করিনি। এখন তুমি আমার জন্যে বৈধ। এবার আর তোমার রক্ষে নেই। এখন থেকে আমি তোমায় লজ্জা দিয়ে দিয়েই মে’রে ফেলব। ‘
আভা শিউরে উঠে। গা কাঁপে। এত ভয়ংকর কথা সে কখনো শুনে নি। আহনাফের হাতে আভার মরন! ইশ, ইশ, ইশ! এত সুখ সইবে তো কপালে? আভা আহনাফের গা ঘেঁষে বসে। আহনাফ লক্ষ করে, আভার গা গরম হচ্ছে। লজ্জায় নাকি ভয়ে, বুঝতে পারল না সে।

পুনশ্চ…
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আভা এবং আহনাফ। আভাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আহনাফ। আভার ঘাড়ে আহনাফের চিবুক। আভার পেটে বিচরন করছে আহনাফের দুষ্ট হাত। বিয়ের এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আহনাফের দুষ্ট হাতের স্পর্শ নিতে অক্ষম আভা। এখনো আহনাফের ঠোঁটের স্পর্শে আভা লজ্জায় আলুথালু হয়ে পড়ে। গায়ে ভয়ংকর কাঁপুনি শুরু হয়। লোকটা এত ভয়ংকর প্রেমিক কেন? তার বুকেই এত সুখ কেন? সেই সুখে ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় আভার। আহনাফ মৃদু স্বরে বলে,
‘ বউরে, ভালোবাসি। ‘
বিয়ের পর আহনাফ শতবার আভাকে ভালোবাসি বলেছে। তবুও যেন আভা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয় না। এখনি সেই কথাটা শুনলে বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে উঠে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় একসাথে হাতে হাত রেখে।
‘ বন্ধু, প্রেম পড়ে করো। গিটার নিয়ে এসেছি। গান করব। চল। ‘
কামরুলের কথা শুনে আভা আহনাফের বাহুবন্ধনে ছটফট করে উঠে। বন্ধুদের সামনে প্রেম করতে লজ্জা হয়। আহনাফ মৃদু হেসে আভাকে ছেড়ে দেয়। আভা একপাশে এসে দাঁড়ায়। চিত্রা আভাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সাগর পাড়ে বসে। কামরুল, দিহান, বাঁধন ও আহনাফ একসঙ্গে গান ধরে।

আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
এই সাগর পাড়ে আইসা আমার
মাতাল মাতাল লাগে
এই রুপ দেখিয়া মন পিঞ্জরায়
সুখের পক্ষী ডাকে (২ বার)
পারতাম যদি থাইকা যাইতে
এই সাগরের পাড়ে
ঝিনুক মালা গাইথা কাটায়,
দিতাম জীবনটা রে
আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
এই নীল জলেতে ভাসায় দেবো
মনের দুঃখ যতো
আর জল দিয়া পূরন করিবো
হাজার শুকনো ক্ষত (২ বার)
পারতাম যদি থাইকা যাইতে
এই সাগরের পাড়ে
ঝিনুক মালা গাইথা কাটায়,
দিতাম জীবনটা রে
আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে।।

বন্ধুরা সব হেলেদুলে বেশ উচ্ছল কণ্ঠে গান করছে। পাখিরা সব ভিড় জমিয়েছে আকাশে। মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। গা ছুঁয়ে বইছে সাগরের শীতল বাতাস। গায়ের জামা দেহ ছুঁয়ে উড়ে যেতে চাইছে। ভালোবাসাগুলো ডানা মেলছে। আভা পেরেছে আহনাফের মন ছুঁতে। এই মুহূর্তে আভার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম আমি। ‘
আহনাফের ভালোবাসাময় চোখ আভার পানে। আভার চোখে লজ্জা! বাঁধনের চোখে কিছু একটা ভাসছে। কি ভাসছে? নতুন কেউ নাকি পুরনো এক অসহ্য প্রেম?
চিত্রার চোখে জল। তার দৃষ্টি আহনাফের মধ্যে আবদ্ধ। আভা দেখে চিত্রাকে। চিত্রার কষ্ট দেখে তারও কষ্ট হয়। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা কতটা কঠিন সেটা হয়ত আভা জানে না। কিন্তু চিত্রাকে কাঁদতে দেখে সেটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে আভা। চিত্রার জীবনেও যেন আহনাফের চেয়েও ভালো এক পুরুষ আসুক! আভা মন থেকে সেই দোয়া করে।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here