#ভেজাগোলাপ❤️
#লেখিকা-মালিহা খান❤️
#পর্ব-১
ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে নীরাদ।একবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল।ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই।আকাশে মেঘ ডাকছে।হয়তো বৃষ্টি নামবে।মা হয়তো তার অপেক্ষায় এখনো না খেয়ে আছে।অফিসে একটা জরুরি মিটিং ছিল।নয়তো দশটার আগেই বাড়ি ফেরে সে।
রাস্তা ফাঁকা মানুষজন নেই তেমন এই রাস্তায়।আনমনে গাড়ি চালাতে চালাতেই হঠাৎই ব্রেক কষে সে।
দ্রুত গাড়ি থেকে নামে।একটা গাড়ি এক্সিড্যানট হয়ে পড়ে আছে রাস্তার পাশে।অথচ কেউ ধরেনি পর্যন্ত।
অবশ্য এখানে মানুষজন নেই।গাড়ির সামনে যায় নীরাদ।ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জালিয়ে দেখে একটা যুবক কিছুটা আহত।তবে মাথায় আঘাতের ফলে অজ্ঞান হয়ে গেছে।আর কিছু না ভেবে তাকে নিজের গাড়িতে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলে।
বারবার ভাইকে কল দিয়ে যাচ্ছে রোদ্রি।এত দেরি তো হয়না ভাইয়ার বাসায় ফিরতে।ফোন রিং হচ্ছে ঠি ক ই তবে ওপাশ থেকে রিসিভ হচ্ছে না।ভাইয়ায় চিন্তার ভাবির অবস্থা প্রায় কাঁদোকাঁদো।
-তুমি এত চিন্তা করোনাতো ভাবি।হয়তো ভাইয়ার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছে অথবা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।সে জন্যই ধরতে পারছেনা।
ভাবি এবার কেঁদেই দিলো।হেঁচকি তুলে বললো।
-ফোন হারালে কি হয়েছে?এত দেরি তো ওর হয়না।ও তো অনেক আগেই চলে আসে।তোর কি মনে হয় ও এখন রাস্তায় রাস্তায় ফোন খুঁজে বেরাচ্ছে?
ভাবির কথার কি উওর দিবে বুঝতে পারেনা রোদ্রি।আরো কয়েকবার ফোন করে রিদান এর ফোনে কিন্তু না একবারও রিসিভ হলোনা।
-আমি বরং ম্যানেজার আঙ্কেল কে একটা ফোন দেই।
-দে।তারাতারি দে।
ম্যানেজারের নাম্বারে ডায়াল করার আগমুহূর্তে রিদানের কল আসে।
“ভাইয়া ফোন দিয়েছে”বলে দ্রুত রিসিভ করে রোদ্রি।প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে বলে রোদ্রি,
-হ্যালো,ভাইয়া?কোথায় তুমি?ফোন ধরছিলে না কেন?কখন আসবে?এত দেরি হচ্ছে কেন?ঠি ক আছোতো তুমি?ভাইয়া?
একসাথে এতগুলা প্রশ্ন শুনে হচকচিয়ে যায় নীরাদ।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
-আপনি একটু শান্ত হোন মিস।আপনার..
নিজের ভাইয়ের ফোনে অন্য মানুষের গলা শুনে বেশ অবাক হয় রোদ্রি।মুহুর্তেই রাগে দপ করে জ্বলে উঠে।
এতক্ষনের উৎকন্ঠামিশ্রিত গলায় মুহুর্তেই রাগি ভাব চলে আসে।
-এই কে আপনি?চোর নাকি?ভাইয়ার ফোন চুরি করেছেন তাইনা?এই একমিনিট..আপনি আবার ভাইয়াকে কিডন্যাপ করেননিতো?হ্যাঁ?
-আরে কি সব উল্টা পাল্টা বকছেন আপনি?মি.রিদান মানে আপনার ভাইয়ার গাড়ি এক্সিডেনট হয়েছে।..
-কিহ্?ভাইয়া কোথায়?বলতে বলতে কথার মাঝেই কেঁদে দিল রোদ্রি।
মেয়েটার এমন হঠাৎ কান্নায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো নীরাদ।মেয়েটার কান্না শুনে কেন জানি প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর।সে নিজেও জানেনা কেন?নরম গলায় বলল,
-কাঁদবেননা মিস।আপনার ভাইয়ার কিছু হয়নি,উনি ঠিক আছেন।আপনি বা উনার ফ্যামিলির কেউ একটু হসপিটালে আসুন।
হসপিটালে পৌঁছে তড়িঘড়ি করে দোতালায় ছুটলো রৌদ্রি।ফোনের লোকটার লা কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে।একটা লোক..নাহ লোক বলা উচিত না।একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে উল্টোদিকে ফিরে।ফোনে কথা বলছে।
সামনে এগোতেই কিছু কথা কানে এলো ওর।
-হ্যালো,মা তুমি খেয়ে নাও।আমার ফিরতে দেরি হবে।একটা জরুরি কাজে আছি।তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।নয়তো কিন্তু অসুস্থ হয়ে পরবে।ওষুধ গুলোও খেয়ে নিও মনে করে।
ওপাশ থেকে কি বললো বুঝতে পারলোনা রোদ্রি।
-আমি এসে খেয়ে নিবো।তুমি ঘুমিয়ে যেও।জেগে থেকোনা।
-এক্সকিউস মি?আপনিই কি ফোন দিয়েছিলেন?
পিছন থেকে কারো মিষ্টি গলার ডাক শুনে ভ্রু উচিয়ে পিছনে ফিরে নীরাদ।
-আচ্ছা রাখছি।শুভরাত্রি।বলে ফোনটা কেটে দেয়।
সচেতন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়।মেয়েটার পরণে একেবারেই সাদামাটা একটা সালোয়ার কামিজ।মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া।গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা।চোখদুটো লাল হয়ে আছে কান্না করার কারণে।
-জি আমিই ফোন দিয়েছিলাম।আপনার ভাইয়া কেবিনে আছে।ডকটরের সাথে কথা হয়েছে আমার।তেমন গুরুতর কিছু হয়নি উনার।মাথায় হাল্কা আঘাত পেয়েছে।আর হাতে একটু কেটে গেছে।ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে।আপনারা ভেতরে গিয়ে দেখা করে আসেন।
-জি আচ্ছা,ধন্যবাদ।
ভাইয়ের সাথে দেখা করে ক্যাবিন থেকে বেড়িয়ে এলো রোদ্রি।ভাবি এখনও ভেতরে আছে।
ডকটরের সাথে কথা বলছিলো নীরাদ।রোদ্রিকে বের হতে দেখে একবার তাকিয়ে কথায় মনোযোগী হয়।
রোদ্রি ধীরপায়ে যেয়ে নীরাদ এর পাশে দাঁড়ায়।লোকটাকে তখন কতকিছু বলেছে?অথচ এই লোকটাই ওর ভাইকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।নিজের মধ্যেই একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।
রোদ্রিকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নীরাদই বলে উঠে,
-কিছু বলবেন?
নীরাদের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে রোদ্রি।আমতা আমতা করে সে।কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।
নীরাদ নি:শব্দে হাসে।মেয়েটাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে এখন।
-আপনার ভাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।ঠিকমতো যত্ন নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে।আর এইযে এটা নিন।
বলে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল রোদ্রির দিকে।
রোদ্রি প্যাকেটটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
-এটার মধ্য মেডিসিন আছে।সাথে প্রেসক্রিপসন ও।টাইমলি খাইয়ে দিবেন।
এবার আরো একটু কাঁচুমাচু হয়ে যায় রোদ্রি।এই অসম্ভব ভালো লোকটাকে সে কিনা চোর বলে দিল?
-আসলে তখন..
-তখনকার কথায় আমি কিছু মনে করিনাই।আপনি নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে।না বুঝে বলে ফেলেছেন।বাচ্চাদের কথা ধরতে নেই।সো ইটস্ ওকে।
বলে একটা মিষ্টি হাসি দিলো নীরাদ।
হাসিটা মিষ্টি হলেও রোদ্রির কাছে সেটা গা জালানো মনে হলো।লোকটা তাকে ঠান্ডা মাথায় অপমান করে দিলো?
-আপনার আমাকে বাচ্চা মনে হচ্ছে?(দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলল)
-আপনি কি নিজেকে কোনোভাবে বয়সক প্রমান করতে চান?ওকে ফাইন।যান আপনি বাচ্চা নন একজন বয়সক মহিলা।এবার খুশি?
রাগে এবার কান্না পেয়ে গেল রোদ্রির।নীরাদ আবারও অপ্রস্তুত হয়ে যায়।মেয়েটা কখন কি করে বোঝা যায় না।
যখন তখন কান্না করে,রেগে যায়।আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।সে তো একটু মজা করছিলো।কিন্তু মেয়েটা যে সিরিয়াসলি নিবে বুঝতে পারে নাই।
-আরে,আমি মজা করছিলাম।আপনি কাঁদছেন কেন?কাঁদবেন না প্লিজ।কাঁদলে কিন্তু আপনাকে সত্যিই বাচ্চা মনে হবে।
জোর গলায় চেচিয়ে উঠে রোদ্রি,
-কাঁদছিনা আমি।
বলে কেবিনের দিকে হনহন করে হেটে যায়।
রোদ্রির পিছে পিছেই কেবিনে ঢুকে নীরাদ।রিদানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-চলুন আপনাদের বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।
রিদান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোদ্রি বললো,
-আমরা একাই যেতে পারবো।
রোদ্রির কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নীরাদ বললো-এত রাতে সিএনজি পাবেননা ভাইয়া।
-তোরা গাড়িতে আসিসনি?
-নাহ্।আঙ্কেল তো ছুটিতে।
-ওহ্।
-নীরাদ,তুমিই তাহলে একটু পৌছে দিয়ে আসো।আমাদের বাসা কাছেই।
-জি ভাইয়া অবশ্যই।আপনারা আসুন।
রোদ্রিদের বাসার সামনে থামল নীরাদের গাড়ি।ভাবি আর ভাইয়া উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে চলে গেল।রোদ্রি গাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনই নীরাদ ডাকল,
-মিস.রোদ্রি?
-জি?
-আপনার ভাইয়ার ফোন আর ওয়ালেট।উনার পকেটে পেয়েছিলাম।আর তখনের জন্য সরি।আমি আপনাকে কাঁদাতে চাইনি।আপনি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে।ভাইয়ার খেয়াল রাখবেন।আল্লাহ হাফেজ।
বলে একটা মুচকি হাসি দিলো নীরাদ।চেহারায় সারাদিনের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে।
কিছুক্ষন আগে যতটা অসহ্যকর লাগছিলো লোকটাকে এখন ঠ ক ততোটাই ভালো লাগছে।কি চমৎকার অমায়িক হাসি।অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছিলো তবে কিছুই বলতে পারলোনা।
-আল্লাহ হাফেজ।
নীরাদ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।রোদ্রিও ভেতরে ঢুকে গেইট লাগিয়ে দিল।এটাই কি শেষ দেখা? নাকি কেবলই শুরু?আকাশে এখনো মেঘ ডাকছে।হয়তো জানান দিচ্ছে শুভসুচনার।