#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-০২]
#আফরোজা_আনজুম

সকালে ছাদে সাধারণ জ্ঞান বইটা নিয়ে বসেছিলাম একটু মনযোগ দিয়ে পড়বো বলে। তা আর হলো না। খানিক দূরে আরিফ ভাইয়ার মুখে ‘বাবু’, ‘বাবু’ শুনতে শুনতে মনযোগটা সেদিকে চলে গেলো।হাঁটুর উপর বইটা রেখে তাদের ঝগড়া শুনছিলাম। আরিফ ভাইয়া বড় চাচার ছোট ছেলে। আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে। আরিফ ভাইয়া তার গার্লফ্রেন্ডকে বলছে, ” বাবু, তোমাকে তো রাতে বলেছিলাম যে আমি সকালে বাড়ি আসবো।বলিনি?”

ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলছে, ” তোকে বলেছি বাসা থেকে বের হলে ফোন করবি।করেছিস? ”

” বলে কী হতো, বাবু? তুমি তো আর আমায় এগিয়ে দিতে আসতে পারতে না।”

কথাটা যতটা নরম সুরে বলেছে তার মুখভঙ্গিটা ঠিক ততটাই কঠিন। ওপাশের মানুষটা না দেখলেও আমি ঠিকই দেখতে পাচ্ছি কতটা রাগ, বিরক্তি তার চোখে-মুখে। কিন্তু তা প্রেমিকাকে বুঝতে দিচ্ছে না। বেশ উপভোগ করছি আমি। আমার পাশে বসা নাহিদ বই থেকে মুখ উঠিয়ে বললো, ” ভাইয়া, দয়া করে অন্য কোথাও গিয়ে বাবুর সাথে কথা বলো। এখানে আমাদের পড়ার ডিস্টার্ব করছো কেন? ”

আরিফ ভাইয়া রাগী চোখে তাকালো একটু। নাহিদ ক্লাস টেনে পড়ে। ভীষণ পড়ুয়া সে। তাকে আমি ভীষণ ভয় পায়। তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। পাশে থাকলেই এক একটা প্রশ্ন করে আমাকে বিপদে ফেলে দেয়। আমার মতো পড়াচুরের এমন জ্ঞানী মানুষের আশেপাশে থাকা বিপদজনক। ভীষণ বিপদজনক।

” কে বলেছে আসতাম না!আমি তো রাতেই ভেবে রেখেছিলাম সকালে দেখা করবো। তোর আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই সেটা বল। ফোন রাখ তুই। ”

আরিফ ভাই বাবু,বাবু শুনো বলতে বলতে কল নিজেই কেটে দিল।কল কেটেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঠিক তখনই নিঠুল ভাই কোত্থেকে এসে আরিফ ভাইয়ার মাথায় চড় মেরে বললো,” বাবু টাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে আসলেই পারতি। এতো বাবু বাবু করিস কেন? ”

আরিফ ভাইয়া বিরক্তিকর গলায় বললো, ” কী এক প্রেম করতেছি ভাই! বাবু ডাকতে ডাকতে আমার দিন যায়। বাবু না ডাকলে বলে তাকে আর ভালোবাসি না। কী যে প্যারা দেয়!খাইতে গেলে তাকে বলে যাইতে হয়,হাগতে গেলে বলে যাইতে হয়।”

আহারে! তার দুঃখী মুখ দেখে আমারও কষ্ট লাগলো। কষ্টটা প্রকাশ করলাম ফিক করে হেসে দিয়ে। আরিফ ভাইয়া করুন চোখে তাকালো আমার দিকে। নিঠুল ভাইও তাকালো আমার দিকে। বললো, ” এসব কেমন প্রেম আবার? প্রেম করলে করবি আমাদের মতো। দুজন দুজনকে ভালোবাসবো। কিন্তু কাউকে বলবো না। দুজন দুজনের সাথে প্রেম করবো কিন্তু কেউ বুঝতে দেবো না। লুকোচুরি প্রেম। ”

আরিফ ভাই অবাক হয়ে বললো, ” তোমরা এখনো কেউ কাউকে বলো নি যে ভালোবাসো! কিন্তু ছবি দেখে তো এটা মনে হয় নি। সুইটির সাথে তোমার কত ক্লোজ ক্লোজ ছবি দেখেছি। ”

আমার কান্না আসছে এই মুহূর্তে। নিঠুল ভাইয়ের সাথেই পড়ে সুইটি। অনেকবার শুনেছি তার কথা। সেদিন আরিফ ভাইয়া বললো তার মোবাইলে নাকি সুইটি নামের মেয়েটার সাথে ছবি দেখেছে অনেকগুলো।সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারা বের করলো যে এ-ই নিঠুল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। খুবই সুন্দরি নাকি। আমাকে দেখতে বললেও আমি দেখি নি। তবে আমার বিশ্বাস হয় নি সেটা। বইয়ে মুখ ডুবিয়ে কান খাঁড়া করে রেখেছি নিঠুল ভাইয়ের উত্তর শোনার জন্য।

” এই তোরা আমার মোবাইল নিয়েছিস কবে? বেয়াদব, এভাবে অন্যের মোবাইলে হাত দেওয়া অভদ্রতা জানিস না? ”

” সেদিন ভুলে মোবাইল রেখে কোথাও গিয়েছিলে। ভাগ্যিস লক খোলা ছিল। আগেই জানতাম কেউ ছিলো তোমার মনে।সেই ‘কেউ’ টা কে তা জানার খুব আগ্রহ ছিলো আমাদের। তাই সুযোগটা হাত ছাড়া করলাম না। তোমার পাশে সেই মানাইছে ভাই সুইটি আপাকে।”

“তোদের কে বলেছে সুইটিকে ভালোবাসি। ”

” এই যে, এই যে তুমি হাসছো।আবার মিথ্যে বলো আমাদের। আমাদের চোখে ফাঁকি দিতে পারবে না ব্রো। ছবিতে দুজনকে দেখেই ধরে ফেলেছিলাম,” বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলছে আরিফ ভাইয়া।

ততক্ষণে রিনি আপু এসে দাঁড়িয়েছে। আরিফ ভাইয়া তাকে জিজ্ঞেস করলো, ” আপু, নিঠুল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডকে দেখেছো?”

” উহুম। তবে জানি যে তার মনে কেউ আছে। কিছুদিন আগে ওর রুমে একটা মেয়ের ঘড়ি আর…”

আর কি বলতে দিল না নিঠুল ভাই।বললো,” ভাবী, এখানে দুটো পিচ্চি আছে। তোমরা ওদের সামনে কি নিয়ে আলোচনা করছো?”

আমার আর ওখানে থাকতে ইচ্ছে হলো না। যেই উঠে যাবো অমনি চুলে টান পড়ে।নিঠুল ভাই আমার ভেজা চুল টেনে বললো,” সকাল সকাল গোসল করেছিস কেন? হিসু করে দিয়েছিস নাকি বিছানায়? ”

কথাটা বলে হাসতে হাসতে আবারো বললো,” আগে বিছানায় হিসু করে সকালে উঠে গোসল করে ফেলতো।তারপর দোষ দিতো দাদির।মনে আছে ভাবী তোমার? আজকেও ঐ কাণ্ডটা ঘটিয়েছে মনে হয়। ”

রিনি আপু হাসতে হাসতে বললো,” আজকে বেড়াতে যাবে ও।তাই সকাল সকাল গোসল সেরে বসে আছে। আর হিসু দাদি’ই করতো।করে ওর নাম দিতো। সেজন্যই তো ওকে সাথে রাখতো যাতে দোষটা ওর ঘাড়ে চাপাতে পারে।”

“মৃত মানুষের উপর এতো বড় অপবাদ দিও না। ও-ই করতো আমি জানি।”

আরিফ ভাইয়া আর নাহিদও হাসছে। শুধু ওরা নয় পরিবারের সবারই হঠাৎ হঠাৎ এটা মনে পড়ে আর হাসাহাসি করে। এবার আমার সত্যিই কান্না চলে এসেছে। দৌড়ে চলে আসলাম সেখান থেকে।
.
.
আব্বুকে গতকাল রাতে বলেছিলাম খালামনির বাসায় যাবো।একটানা ঘরে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি। তাই খালার বাসায় কয়েকদিন ঘুরে আসবো। আব্বু বিকালে নিয়ে যাবেন বলেছেন। নিঠুল ভাই তা শুনে বললো, ” ভার্সিটি পরীক্ষা কিছুদিন পর। না পড়ে বেড়ানোর চিন্তা করছিস! কতবড় কলিজা তোর!”

আমি রেগে বললাম, ” একনাগাড়ে পড়তে পড়তে আমি বোর হয়ে গেছি।এইচএসসি পরীক্ষাসহ কোচিংয়ে কত কত পরীক্ষা দিয়েছি।তাই একটু রিলাক্স করার জন্য যাচ্ছি। ”

নিঠুল ভাই তার বাণী শুনিয়ে দিলো। ” তোর রিলাক্সের দরকার নেই। তুই পরীক্ষা দিস’ই তো রিলাক্স মুডে।পরীক্ষা নিয়ে তোর ভয়ডর ছিলো নাকি কখনো?ঘুমিয়ে, হেলেদুলে পরীক্ষা দিস।তোকে নিয়ে নাকি আঙ্কেল স্বপ্ন দেখে ভার্সিটিতে পড়বি তুই।অথচ পড়ালেখার অবস্থা দেখ তোর।আমার সময় তো আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে রাতদিন এক করে পড়েছি। আমি যত লেখাপড়া করেছি তুই তার এক পার্সেন্ট পড়িস না।”

আব্বু আম্মুকে শুনিয়েই বলেছে এসব। আড়ালে আমাকে বলে,” নানার বাড়ি,খালার বাড়ি ছাড়া কিছু চিনিস না? ওগুলো কী রিলাক্স করার জায়গা নাকি! তোর বেয়াদব খালাতো ভাইটাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যায়। অ্যাই, তার সাথে তোর কিনা চলছে না তো!

মানে রাগের মধ্যে আরো উস্কে দেওয়া। আব্বুকে বললে আব্বু না করে দেয়।বলে,” ভর্তি পরীক্ষাটা দিয়ে দাও। এরপর যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও।”

কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করার পর তা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর খুবই মন খারাপ হয়, রাগ লাগে। আমিও রাগে,দুঃখে কেঁদে দিলাম। এখানে যাওয়া মানা,ওখানে যাওয়া মানা। চিৎকার করে বললাম, ” আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। বিয়ের পর ইচ্ছেমতো বেড়াবো আমি। কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। ”

অন্যরা হাসছে। বড় চাচি হাসতে হাসতে বললো,” আচ্ছা,শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি। তারপর ইচ্ছেমতো বেড়াস।”

আম্মু বললো,” দেখেছো ভাবী, কতবড় বেয়াদব!”

ধুপধাপ শব্দ করে রুমে চলে আসলাম। ইচ্ছে মতো গালি দিলাম ঐ বজ্জাতকে। আমার সবকিছুতে তার এত সমস্যা কেন বুঝি না। বিকালে রেবা আন্টি বললো নিলু আপুর শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে। ওর দেবর এসেছে নাকি বিদেশ থেকে। আমি না করে দিলাম। পরে জোরাজোরিতে রাজি হই। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিতে বললো, ” নিঠু তোর ভালোর জন্যই বলেছে। এখন তো বেড়ানোর সময় না। যা তৈরি হয়ে নে।একটু পরেই গাড়ি নিয়ে আসবে নিঠুল।

কোনোরকম সাজগোছ ছাড়া তৈরি হলাম।গাড়ি আসলে বেরুতেই আম্মু রাগী গলায় বললো,
” কীভাবে যাচ্ছিস? এভাবে পাগলের মতো গেলে নিলুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কী বলবে? একটু সাজগোছ করে যা।”

আমি বললাম, ” দরকার নেই। এমনিতেই ঠিক লাগছে।”

অমনি নিঠুল ভাই বললো, ” ওরে! আসছে বিশ্ব সুন্দরী। আমাকে এমনিতেই ঠিক লাগছে। হুহ! মানুষ দেখলে মনে করবে তোকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেছে আম্মা।”

আমি কিছু বললাম না। আন্টি রেগে বললো,” তুই সবসময় ওর পেছনে লাগিস কেন নিঠু? ”

আম্মু বললো,” ঠিকই তো বলেছে ও। এভাবে গেলে ওরা কী বলবে?”

আন্টিরা প্রতিবার আসার সময় গাড়ি নিয়ে আসে। এবার আনেনি। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো আঙ্কেল গাড়ি নিয়ে কোনো কাজে শহরের বাইরে গেছে। নিঠুল ভাই বললো,” তোর কন্জুস বাপকে বলতে পারিস না একটা গাড়ি কিনতে? চলাফেরার জন্য একটা গাড়ি তো লাগে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি, সিএনজি,টেম্পো নিয়ে সব ভাড়ায় দিয়ে রাখছে। এতো টাকা! তাও এতো হিসাবি তোর বাপ।”

সে আমাকে রাগাতে চাইছে। আব্বুর সম্পর্কে এসব বললে আমি কেঁদে দিই তা জেনেও এমন করে।

” আমার আব্বু মিতব্যয়ী।আর সেটাই ভালো। ”

নিঠুল ভাই কথার জবাব দিবে তার আগেই আমি আন্টির ডাকে গাড়িতে উঠে গেলাম।নিলু আপুর শ্বশুরবাড়িতে সবার সাথে আনন্দে কাটালেও বেশিক্ষণ তা টিকে নি।নিলু আপুর ছেলে দৌড়ে আসতে তার সাথে ধাক্কা লেগে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে যায়। অনেকদিন পর বেড়াতে এসেও এক রুমে বসে থাকতে হচ্ছে। রাতে দেখলাম নিঠুল ভাই এসেছে। সে বোনের বাসায় খুব কমই আসে। তার কারণ হচ্ছে নিলু আপুর ননদ দিশা। দিশা আপু যে নিঠুল ভাইয়ের জন্য পাগলামি করে তা সবারই জানা। আমার মাধ্যমেই নিঠুল ভাইকে প্রেমপত্র দিয়েছিল। সুইসাইড করবে এমন হুমকিও দেয়। সিয়াম ভাইয়াদের সাথে গল্প করছিলাম এমন সময় নিঠুল ভাই রুমে ঢুকে। সিয়াম ভাইয়ের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর বিছানায় চুপচাপ বসে। আসার পর থেকেই সিয়াম ভাইয়া সঙ্গ দিচ্ছে আমায়। ভীষণ ভালো মানুষ আর মিশুক তিনি। এইবার-ই প্রথম দেখা। নিঠুল ভাইকে কেমন যেন বিরক্ত দেখাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সবাই রুম থেকে চলে গেলেও দিশা আপু যায় নি।নিঠুল ভাইয়ের দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। নিঠুল ভাই হালকা কেশে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,” কী খবর দিশা? কেমন আছো? ”

দিশা আপু চমকে উঠে। পরমুহূর্তে নিঠুল ভাইয়ের কথায় মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলে, ” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”

” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি,” বলে নিঠুল ভাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত দেখায়। কারণ দিশা আপু ইতোমধ্যে তার পাশে গিয়ে বসেছে। নিঠুল ভাই পাশ ফিরতেই তাকে এতো কাছে দেখে ভড়কে যায়। দিশা আপু আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিঠুল ভাইয়ের উরুতে হাত রাখতেই একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোক হওয়ায় বেচারা সরাসরি কিছু বলতেও পারে না।

” এক গ্লাস পানি আনো তো দিশা।পানির পিপাসা পেয়েছে।”

” এখনই আনছি,” বলে দিশা আপু পানি আনতে বেরিয়ে যায়।নিঠুল ভাই দরজা লক করে দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আরে দরজা লক করেছো কেন?”

” দিশা আসবে তাই।এই গায়ে পড়া মেয়েটার জ্বালায় আসি না।আজকে তোর জন্য আসতে হলো। দুই ঘন্টায় ঠ্যাং ভেঙ্গে বসে আছিস। ”

” এসেছো কেন? আমি আসতে বলেছি না কি?”

” আমার বোনের শ্বশুরবাড়িতে আমি যখন খুশি তখন আসবো। তুই বলার কে?” বাঁকা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

আবার বলে,” সিয়াম ভাইয়ের সাথে তো আজকেই প্রথম পরিচয় হলো তোর আর আজকেই এতো ভাব। পারছে না যেন তোকে কোলে নিয়ে নেয়।”

আমি রেগে বললাম, ” আর দিশা আপু পারছে না যেন তোমার কোলে উঠে বসে থাকে। ”

সাথে সাথে আমার পা চেপে ধরে যেটা মচকে গেছে।আমি ব্যাথায় আহ্ করে উঠলেও ছাড়ে নি। দেখি কেমন ব্যাথায় পেয়েছিস বলে পায়ের পাতা ধরে জোরে মুচড়ে দেয়। ব্যাথায় চিল্লিয়ে উঠি আমি।চোখে পানি চলে এসেছে। নিঠুল ভাই হেসে বললো,” দেখি বিছানা থেকে নাম।”

আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ” এতো নিষ্ঠুর, এতো খারাপ কেন তুমি? সবসময় আমার সাথে এমন করো।”

নিঠুল ভাই আমাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ” এবার হাঁট।”

আমি প্রথমে রেগে কিছু বলতে গেলে বুঝতে পারি আমি হাঁটতে পারছি এবং ব্যাথাও হচ্ছে না। বুঝতে পারলাম সে পা ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্যই অমন করেছিল। নিঠুল ভাই পা নামিয়ে বিছানায় শুয়ে বললো,” দিশা আসলে বলবি আমি রুমে নেই। বেরিয়ে গেছি।”

তখনই দিশা আপু বাইরে থেকে দরজায় টোকা দেয়। নিঠুল ভাই আমাকে ইশারা করে যাতে দরজা না খুলি। আমি দরজা খুলে দিয়ে দিশা আপুকে যেতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পেছনে দেখলাম নিঠুল ভাই নিলু আপুকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেছে। আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালে তাড়াতাড়ি পালালাম সেখান থেকে।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে নিঠুল ভাই বলে আমাকেও নিয়ে যাবে। আন্টি না করে দেয়।নিঠুল ভাই বলে আব্বু নাকি চিন্তা করছে,চলে যেতে বলেছে। আসার সময় দরজার সামনে দিশা আপু এসে নিঠুল ভাইয়ের হাত ধরে বলে, ” আবার এসো।তোমার অপেক্ষায় থাকবো।”

ঘর থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ভালোই জ্বালিয়েছে দিশা আপু তাকে। নিঠুল ভাইয়ের বিরক্তিকর মুখটা দেখে শান্তি লাগছে। ঘরে যাওয়ার পর আব্বু আমাকে দেখে বললো,” কী রে, চলে এসেছিস আব্বু? থাকার কথা ছিলো না? ”

নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সে আমাকে ইচ্ছে করে নিয়ে এসেছে তাহলে। আব্বু বলে নি। নিঠুল ভাই দাঁত বের করে হাসছে।তা দেখে রাগে গা জ্বলছে আমার।
সকালে শুনলাম নিঠুল ভাই বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে। আমাকে ডেকে বলে, ” রোজ, ভাবীর কাছ থেকে আমার ব্যাগটা এনে দে।”

শুনেও যেন শুনলাম না এমন করে সেখান থেকে চলে আসলাম।আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। এদিকে সে বন্ধুদের নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। নিঠুল ভাই বারবার রোজ রোজ বলে ডেকেই চলছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিনি আপুর কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে গেলাম। শুনলাম নিঠুল ভাই ফোনে বলছে, ” সুইটি আধ ঘন্টা ওয়েট করো। এর মধ্যেই আসছি আমি।”

ফোন রেখে আমাকে দেখে হাসলো। কালো জিন্সের সাথে ধূসর রঙের শার্ট পরেছে।শ্যাম বর্ণের হলেও মুখ মায়ায় পরিপূর্ণ। আমার দেখা সবচেয়ে মায়া পূর্ণ পুরুষটি সে।

” খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। যাবি? তুই তো আবার নানার বাড়ি, খালার বাড়ি ছাড়া কিছু চিনিস না। ”

আমি ব্যাগটা টেবিলে রেখে উঁচু গলায় বললাম, ” বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাওয়ার নাম করে গার্লফ্রেন্ডের সাথে যাচ্ছো!”

নিঠুল ভাই ভ্রু-কুচকে তাকালো আমার দিকে। আমি আবার বললাম, ” আন্টিকে বলবো আমি। এতো খারাপ তুমি! একা একটা মেয়ের সাথে…।”

নিঠুল ভাই আমার কাছে এসে ঝুঁকে বললো, ” আমি একা একটা মেয়ের সাথে যেতেই পারি।আমার ইচ্ছে। তাতে তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন হ্যা? কাঁদছিসও মনে হচ্ছে। ”

না কাঁদলেও একটু পর চোখে পানি চলে আসবে এমন অবস্থা আমার। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিঠুল ভাই আমার আরো কাছে চলে এসেছে। চমকে আমি দূরে সরে গেলাম। নিঠুল ভাই চট করে আমার হাত দুটো ধরে নরম স্বরে বললো,” আম্মাকে বলিস না রোজ। আম্মা শুনলে অনেক কষ্ট পাবে।”

ফোনটা আবার বাজছে। সে আমার হাত ছেড়ে আবারও মনে বললো যেন আন্টিকে না বলি। তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ঐখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। নিঠুল ভাই এই কাজটা কীভাবে করতে পারছে। সুইটি নামের মেয়েটাকে সত্যিই ভালোবাসে! তাই তার সাথে বিয়ের আগেই এখানে ওখানে ঘুরতে যাচ্ছে! শুধু কী ঘুরতে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যখন থেকে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই তাকে গোপনে ভালোবেসেছি আর ভালোবাসছি। নিঠুল ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষ আছে তা অন্যরা বললেও আমার কেন যেন বিশ্বাস হতো না।
ফোন আসার শব্দে কেঁপে উঠলাম। ফোনটা বিছানার উপরই রেখে চলে গেছে তাড়াহুড়ায়। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম সুইটি লেখা। রিসিভ করে সুইটির কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে হলো। কেমন হবে নিঠুল ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষটির কণ্ঠ! দেরি করার অপরাধে নিশ্চয়ই মেয়েটা তার নামের মতো মিষ্টি করে বকে দেবে। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই বুক ধক করে উঠলো।

” এ্যাই শালা এ্যাই, এতক্ষণ লাগে নাকি আসতে? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। আজকে আয় তুই..।”

কান থেকে নামিয়ে নিলাম ফোনটা। কোথায় ভাবলাম মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠ শুনবো। তা না একটা ছেলের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনেই ভয় পেয়ে গেছি। নিঠুল ভাই তো শুধু সুইটির সাথে যাচ্ছে। তাহলে ছেলেটা কোত্থেকে!আবার বললো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশের মানুষটা বকেই যাচ্ছে।

” আমি রোজা। নিঠুল ভাই তো বেরিয়ে গেছে। ফোন নিতে ভুলে গেছে,” সুন্দর করে বললাম আমি।

আমার কণ্ঠ শুনে থামলো ছেলেটা। বললো,” ওহ্ রোজা! আমি মিরাজ। নিঠুলের বন্ধু। ভালো আছো?”

” জ্বি। ”

” অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছি আমরা। এখন তো দেখছি ফোনও নিয়ে যায় নি। ”

” তার কাছে তো দুইটা ফোন আছে। অন্যটা নিয়ে গেছে মনে হয়। ”

” আচ্ছা, ওটাতেই করছি। রাখছি আর ভালো থেকো।”

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,” ভাইয়া আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”

” খাগড়াছড়ি। কেন ও বলে নি?”

” না মানে আমি জানতাম না। কে কে যাচ্ছেন আপনারা? ”

” আমরা দশ -বারো জন ফ্রেন্ড মিলে যাচ্ছি। ”

” ওহ্। আচ্ছা রাখি।”

নিঠুল ভাই আমাকে এতো বড় মিথ্যে বললো! আবার নাটক করে বলেছে আম্মাকে বলিস না, কষ্ট পাবে। তবে নিঠুল ভাই তো বলে নি যে সে সুইটির সাথে যাচ্ছে। কথা শুনে আমিই বেশি বুঝে নিয়েছি।আর সে আমার ভুলটা না ভাঙ্গিয়ে উল্টো এমন মজা করেছে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here