#ভালোবাসাটা_আমার
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব_০৭

তোহার সাথে কথা বলা শেষ হলে বাড়িতে ফিরে আসে নিতু।তখন প্রায় সন্ধা।হালকা আঁধারো নেমেছে চারপাশে। নিতু পুকুর ঘাট পেরিয়ে ওর ভাবীর ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে ভাবীর রাগী গলার স্বর শুনতে পায়।তাতে পাত্তা দিতে চাইলো না নিতু। ভাই-ভাবীর মাঝে কথার মনোমালিন্যতা হতেই পারে।কিন্তু ব্যাপারটা যখন তাকে নিয়ে গড়ালো তখনই নিতুর পায়ের গতি শ্লথ হয়ে যায়।নিতু কান জোড়া ক্ষিণ করে।

“তোমার বাবা উনার দোকানের সব আয় নিতুকে দিয়ে দেয়।তার থেকে একটা কানাকড়ি আমাদের দেয়না।উল্টো আমাদের ঘাড়ের উপর বসে বসে খায়।বলি কি এভাবে আর কয়দিন?আমাদের কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই?সামনে আমাদের বাচ্চা হবে।কি রেখেছো তারজন্যে?তার কি ভবিষ্যত নেই?”
“বৈশাখী চুপ করো!উনারা আমার মা-বাবা।উনাদের দেখাশোনা করা আমার কর্তব্য। কারণ আমি উনাদের ছেলে!আর নিতুর পড়াশুনার খরচ বাবা দেয়।আমি তো দিই না!”
“তাই বলে বাবা সব টাকা ওকে দিয়ে দেবে?তুমিও তো উনার ছেলে!উনিতো কোনোদিন দেখি নি তোমাকে একটা কড়িও দিতে!”
“নিতুর খরচ যা আসে বাবা তাই দিচ্ছে ওকে।এখন ওকে খরচ না দিলে ও পড়াশুনা করবে টা কীভাবে!”
“এই তোমার বোনকে নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখো না সবাই?একদিন দেখবে তোমাদের মুখে কালি দিয়ে এ কোনো ঢাকার ছেলের সাথে ভাগছে!”
“আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো ত!সারাদিন কানের পাশে এই ঘ্যানঘ্যান না করা ছাড়া আর কোনো কথা নেই তোমার!?”

নিতু দাঁড়ালো না।চোখের উপর ওড়না চেপে ধরে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে এলো।বিছানায় এসে বসতে নিতুর মা অমনি ভেতর ঢোকেন।মেয়েকে শ্বাসিত গলায় বলে উঠেন,
“সেই দুপুরের পর গেলি আর সন্ধে এলি?এতটা সময় বাইরে কি করেছিস তোহার সাথে?”

নিতু কিছু বললো না। নিতুর মা গলার স্বরটা এবার নিচু করে ফেলেন।নরম গলায় বলেন,
“তোর বাবা তোরজন্যে আসরের নামাজ পড়ে আসার সময় ঝালমুড়ি, পুরী এবং মোগলাই এনেছে।ঠান্ডা হয়ে গেছে সব।সব তুই।চুলা থেকে গরম করে নিয়ে আসি।”

বলে নিতুর মা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ান।নিতু পেছন থেকে,
“মা!”

নিতুর মা আবার পেছন ঘুরতে নিতু বিছানা থেকে উঠে গিয়ে হঠাৎ করে মাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।আকস্মিক মেয়েকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে বলেন,
“কিরে পাগলী মেয়ে?কী হয়েছে?”

নিতু কোনো শব্দ করলো না।চুপচাপ ওভাবেই থাকলো!নিতুর মা আবার বলেন,
“এই নিতু?”

নিতু এবার নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।বামহাত দিয়ে চোখের কোণের পানি মুছে নিয়ে মার কাঁধ থেকে মাথা তুলে হাসলো।মেকি হাসি ছিলো।নিতুর মা তা ধরতে পারেননি।তিনিও মেয়ের তালে হেসে উঠেন।

১৭.
পরদিন সকালে নিতু ঢাকায় ফিরতে ব্যতিব্যস্ততুর হয়ে যায়।ব্যাগপ্যাগ সব গুছিয়ে নেয়।লুৎফর আলী মেয়েকে যেতে দিতে চাচ্ছেন না এখন।আসলো তো মাত্র পরসু।আর কয়দিন থাকুক তারপর নাহয় যাক।নিতুর মাকেও তা বলেছেন।কিন্তু নিতু মানতে রাজি না।সে আজকেই যাবে!লুৎফর আলী মেয়ের কথায় বাধ্য হয়ে ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে বাইরে আসেন।বাইরে নিতুর মা,মিতা,ভাই এবং ভাবীও ছিলেন।নিতু সবাইকে বিদেয় বাবার সাথে বাসস্ট্যান্ডে আসে।বাসে উঠার আগ মুহূর্তে নিতু একফোঁড় বাবার দিকে তাকায়।বলে,

“বাবা দোয়া করো!তোমাদের স্বপ্ন যেনো আমি পূরণ করতে পারি!”

মেয়েকে বিদেয় দেওয়া মুহূর্তে মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে লুৎফর আলীর চোখজোড়া পানিতে চিকচিক করে উঠলো।তিনি অতি সংযতে নিজেকে ধাতস্থতা করে মেয়েকে বুকে আলতো টেনে নেন।বলেন,
“মা রে,তোর প্রতি আমাদের দোয়া সবসময়!”

১৮.
নিতু পড়ছে।প্রিয়া ওর বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে আর কিছুক্ষণ বাদে বাদে আড়নয়নে নিতুর দিকে তাকাচ্ছে।প্রিয়া ইদানীং নিতুর মাঝে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে।নিতু যখন তখন বই নিয়ে পড়তে বসে।সময় নষ্ট করতে চায় না একদম।সময়ের সবকিছু সময়েতে করে।ভার্সিটিতে ফর্মালভাবে যায়।এখন আর প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন কথা বলে না।তার সাথেও না!আগের থেকে কেমন যেনো গম্ভীরা হয়ে গেছে।ওর এই পরিবর্তনগুলো গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে।প্রিয়া মোবাইলটা পাশে রাখে এবার।নিতুকে উদ্দেশ্য করে,

“তুমিতো সেমিস্টারে এবার মনে হয় প্রথম হবে!”

নিতুর পড়াতে মনোযোগ দেওয়ায় প্রিয়ার কথা তার তেমন বোধগম্য হলো না।চোখমুখ কুঁচকে প্রিয়ার দিকে ফিরে বলে,
“স্যরি?”
“নাহ কিছু না!”

বলে প্রিয়া ফোন আবার হাতে তুলে নেয়।নিতু বইয়ে মুখ গুঁজে ফেলে।প্রিয়া ফস করে এবার একটা শ্বাস ছাড়ে-কেন যে আবার এ’কথা বলতে গেলো!”

১৯.
দেয়ালে রেজাল্ট শিটে নিজেকে সবার মধ্যে দ্বিতীয় পজিশনে দেখে নিতু চমকালো।ল!৩.৯৮ পেয়েছে সে!অর্থাৎ সেকেন্ড হয়েছে।আর প্রথম হয়েছে একটা ছেলে।তার মার্কস-৩.৯৯!আর সেও আরেকটু চেষ্টা করলেই ওই ছেলেকে টপকাতে পারতো!নিতুর তা নিয়ে এখন একদম মাথাব্যথা নেই।সে যা পেয়েছে তাতেই খুশি।শুধু খুশি না।একটু বেশিই খুশি।খুশির তাড়নে একটা চিৎকার মেরে লাফ দিয়ে বলে উঠে”ইয়েস”!নিতুর আশপাশে থাকা সবাই তা দেখে!ওরা কেউ কেউ বলে,”এক্কেরে পাইছে!ভাব টা দেখো!”

আরেকজন বলে উঠে,
“গিয়া দ্যাখ।নকল করছে।নাহলে এরকম মেয়ে এই রেজাল্ট!হাহাহাহা হাহাহা! ”

এছাড়াও আরো অনেক মেয়ে হাসিঠাট্টা মূলক কথা বলে।নিতু তার কিছুটা শুনেছে বৈকি!পাত্তা দিলো না!এরকম নিন্দুকের কাজই তো হলো আরেকজনকে নিয়ে নিন্দা করা!নিতু ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে ভাবীর ফোনে কল করে বাবাকে তার রেজাল্টের কথা জানাতে।ভাবী কল রিসিভ করতেই বলে,
“ভাবী?বাবা কোথায়?বাবাকে একটু দাও তো?”
“বাবা বাড়িতে নেই।দোকানে।”
“তাহলে মাকে দাও।”
“মা পাশের বাড়িতে গেছেন পাটি দিতে!”
“ভাইয়া আছে?”
“কেউ নেই।কি বলবা বলো।”
“ভাবী আমি এই সেমিস্টারে ৩.৯৮ পেয়েছি।সবার দ্বিতীয় হয়েছি।”
“ওহ।”
“তা তোমার রেজাল্টের কথা বলবো।এই তো?”
“নাহ, ভাবী তোমাকে বলতে হবে না।বাবা,মা,ভাইকে সারপ্রাইজ টা আমিই দেব।”
বলে নিতু হেসে দেয়।
“আচ্ছা। তাহলে রাখলাম।”
“ভাবী তুমি খুশি হয়েছো?”
“হলাম!”

“হলাম”-কথাটা কেমন নিরস নিরস শুনালো!তারপরও নিতু হেসে দিয়ে বললো,
” ধন্যবাদ,ভাবী।রাখলাম।”

কল রাখার পর নিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো!বিয়ের পর থেকেই নিতুর ভাবী যেনো কেমন।ওদের কাউকেই খুব বেশি সহ্য করতে পারে না।সেদিন সন্ধেই তো ভাইয়াকে কত কথা শুনালো! মা-বাবা,নিতুকে নিয়ে কত কথা বললো!যদিও এসব কথা তাদের কাউকে সরাসরি কখনো কিছু বলার সাহস পায়নি ভাইয়ার ভয়ে।তবে,ভাইয়ার উস্কানী পেলে মুখের উপর সবাইকে ঠিকই কথা শুনিয়ে দিত।

২০.
নিতু হলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে শুয়ে যায়।এই ছয়টা মাস ঘুমাতে পারে নি ভালো করে।রাতের পর রাত জেগে থেকেছিলো পড়াশুনার জন্যে।এখন ঘুমাবে খুব করে।পরিক্ষার পর যেই ব্রেকটা ছিলো। সেই ব্রেকে টেনশনে ঘুমাতে পারে নি।চোখ লেগে আসলেই চোখের সামনে দেখতো,পরিক্ষার রেজাল্ট শিটে নামের পাশে বড় বড় দুটো শূন্য লেখা।ওমনি ঘুম ছুটে যেতো নিতুর।আর ঘুম আসতো না।এখন রেজাল্ট পেয়েছে।ভালো সিজিপিএ তুলেছে।বিন্দাস লাইফ।ঘুম আর ঘুম!

নিতু একদম রাত দশটার দিকে জাগে।তাও চোখ থেকে ভালো করে ঘুম যায় নি।ঝাপসা চোখে দেখে প্রিয়া পুরো রুমে হাঁটতেছে!এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে নিতুর।নিতু কাঁপা হাতে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলে নেয়।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,
“নিতু মা?বল?কেনো তখন কল করেছিলি?”

নিতুর ওমনি ভারী চোখ হালকা হয়ে যায়।সে তরতর করে উঠে বসে।
“বাবা?কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ,ভালো আছি মা।”
“বাবা..?”
“হু,বল!”

নিতু থেমে যায়।রেজাল্টের কথা বলবে বাবাকে এখন।কিন্তু বলতে পারছে না।জিহ্বাটা ভারী খুব!এরকমটা অতি খুশিতে নাকি নিতুর?প্রিয়া পাশে ছিলো।সে সব শুনছিলো।বলে উঠলো,
“বলো বাবাকে!যে দ্বিতীয় হয়েছো!”

নিতু সাথে সাথে বলে উঠে,
“বাবা আমি এই সেমিস্টারে দ্বিতীয় হয়েছি!এটা আমার জীবনের সেরা রেজাল্ট! ”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here