#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ৬

আতাউর রহমানের ঘুম খুবই হালকা। আশেপাশে একটু আওয়াজ হলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। বয়সের দোষে কি না জানা নেই তবে একসময় যুবক বয়সে তিনি প্রচুর ঘুমোতে পারতেন। হলে থাকতে বন্ধুমহলে তার নাম ডাকা হতো ঘুমপাগলা।
ফোনের রিং দুই থেকে তিনবার বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। ভোর প্রায় হয়েই এসেছে৷ এত সকালে কেউ কাউকে কল করে বলে আতাউর রহমানের জানা ছিল না। তবে কারো বিপদ আপদ হলো কিনা এই ভাবনায় তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে পাশের টি টেবিল থেকে ফোন তুলে নিলেন। কল করেছে মিলি।
কল ব্যাক করতে না করতেই মিলি ফোন ধরলো।
“বাবা!”
আতাউর রহমানের বুক ধক করে উঠলো। মিলির কন্ঠ ভেজা, কেঁদেছে হয়তো অনেকক্ষণ।
তিনি বললেন,

“কী হয়েছে বুড়িমা? কাঁদছিস কেনো?”

মিলি নাক টানলো।
“সেসব কথা পরে বলবো। আগে তোমায় একটা প্রশ্ন করি, উত্তর দাও!”

“বল বুড়িমা, কী প্রশ্ন?”

আতাউর রহমানের উদ্দিগ্ন গলা শোনা গেলো।
মিলি বলল,
“সিয়ামের সাথে আমার বিয়ে কেনো দিলে?”

“মানে?”

“সিয়াম সাহেব বিবাহিত লোক, আমার চেয়ে বয়সও তার অনেক বেশি। তার বউ তাকে ধোকা দিয়েছে কী দেয়নি সেটা আমরা ভালোভাবে জানি না। উনারা এ বিষয়ে যা বলেছেন তাই জেনেছি। এক্ষেত্রে সিয়াম সাহেবেরও দোষ থাকতে পারে তাই না? তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন হাতে গোনা কয়েকবার। তোমার সাথে সৌজন্য মুলক কথা ছাড়া কখনও বাড়তি কথাও হয়নি। তাছাড়া তার স্বভাব সম্পর্কেও তুমি জানো, কম কথা বলা, উগ্র মেজাজী মানুষ।
তারপরও আমার বিয়ে ভাঙার সাথে সাথে তার সাথেই কেনো আমার বিয়ে দিলে? তাকে এত ভরসা করার কারণ কী?”

আতাউর রহমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি ভেবেছিলেন কী না কী।
বললেন,
“সিয়ামের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”

“উহু।”

“তবে?”

“সে আমার সাথে খুবই রুড ব্যবহার করেছে বাবা, খুব বেশি। অথচ এমন ব্যবহার করার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। আমি তার বিয়ে করা বউ, তার জন্য চিন্তা করার অধিকার কী আমার নেই?”

আতাউর রহমান হাসলেন,
“অবশ্যই আছে।”

মিলি গম্ভীর গলায় বলল,
“হাসবে না বাবা, বিষয়টা খুব সিরিয়াস।
আমি সিয়াম সাহেবের উপর খুব রেগে আছি। তাকে খুব খারাপ ভাবছি। কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই, আমার বাবার কেনো তাকে এত পছন্দ? তার কী এমন গুন আছে যা আমার চোখে পড়েনি অথচ তোমার চোখে পড়লো?

আতাউর রহমান মৃদু গলায় বললেন,
” ভালবাসার গুন।”

“ভালবাসার?”

“তোর মনে আছে বুড়িমা, নীরার বিয়ের মাস দুয়েক পরের কথা? তুই তখন হোস্টেলে থাকতি! আমি একবার হাসপাতালে গেলাম সিয়ামের জন্য? মনে আছে তোর?”

“হ্যাঁ বাবা, লোকটা অসুস্থ হয়েছিলো বোধহয় তাই না?”

“অসুস্থই বলা যায় তবে কেনো হয়েছিলো জানিস?”

“আমি কিভাবে জানবো?”

“সিয়ামের প্রথম স্ত্রী আরিয়া যেদিন তাকে ছেড়ে চলে গেলো সেদিন সারাটা বেলা পাগলের মতো তাকে খুজেছিল সিয়াম জানিস? অথচ আরিয়া নামক মেয়েটা কিন্তু চিঠিতে স্পষ্ট লিখে দিয়েছিলো, সে সিয়ামের বন্ধু ইশতিয়াকের হাত ধরে পালাচ্ছে। সিয়াম কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি সে কথা। কী পাগলের মতো কেঁদেছিল ছেলেটা। একসময় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এডমিট হয়েছিলো। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রনায় ছটফট করতে দেখেছিলাম তাকে। প্রচন্ড ভালবাসতো সে আরিয়াকে।
সেদিন কেনো যেন আমার মনে হয়েছিল ছেলেটা ভালবাসতে জানে, নিজের চেয়েও বেশি।
তবে তার ভালবাসা সে অপাত্রে দান করেছিলো।

তোর বিয়ে ভাঙার পর যখন নীরা আর তার শাশুড়ী প্রস্তাবটা দিলো, আমি সাথে সাথে লুফে নিলাম। তোর জন্য সাথে সিয়ামের জন্যও।
আমি জানি আমার মেয়েটা একসময় ঠিক সিয়ামের সুপ্ত ভালবাসাকে নিজের দখলে নিতে পারবে, আর ঐ যে ছেলেটা? তাকে আবার বিশ্বাস করতে শেখাবে।”

মিলি অভিমানী গলায় বলল,
“তবুও আমি তার উপর রেগে আছি বাবা, সে আমার সাথে কেনো ওমন ব্যবহার করলো?”

আতাউর রহমান এবার শব্দ করে হাসলেন,
“বুড়িমার রাগ ভাঙাতে কী করতে হবে বল? ফুচকা কিনে পাঠাবো?”

মিলি উত্তর দিতে পারলো না। পিছনে সিয়াম এসে দাড়িয়েছে।
মিলি বলল,
“পরে কথা বলছি, রাখো।”

সিয়াম বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটালো।
নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“স্যরি।”

মিলি সেকথার ধারে কাছেও গেলো না। বলল,
“আমাকে আপনার অপছন্দ কেনো? আমি দেখতে খারাপ? অসুন্দর? ”

“মানে?”

মিলি সরু চোখে তাকালো।
“সোজা সাপটা কথা বলুন, বিয়েটা কী এগিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে আপনার?”

“থাকবে না কেনো?”

“কোনো চেষ্টাই তো দেখতে পাই না।”

সিয়ামের গলার স্বর নমনীয় হলো,
“মিলি, তুমি তো জানো আমি এরকমই।”

“কেমন?”

সিয়ামের অসস্থি লাগছে। সে ভেবেছিলো এসে স্যরি বলেই চলে যাবে। তখন ওভাবে কথা বলায় পরবর্তীতে তার নিজেরই খারাপ লেগেছে, কেমন কাদছিলো মেয়েটা! স্যরি বলতে এসে নিজেই ফেসে যাবে ভাবেনি।

মিলি আবার বলল,
“আমি আপনার কী হই বলুন তো?”

সিয়াম ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
“তোমাকে দেখলে খুব শান্ত শিষ্ট মেয়ে মনে হতো মিলি, কিছুটা ভীতু ধরনের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি পুরো উল্টোটা।”

মিলি মৃদু হাসলো।
“আসলেই ভীতু মেয়ে আমি। আপনাকে প্রথম প্রথম কী যে ভয় পেতাম!”

“এখন পাও না?”

মিলি উত্তর না দিয়ে আবারও হাসলো। বলল,
“তখনকার প্রশ্নের উত্তর বললেন না?”

এবার সিয়াম হাসলো। তার হাসিমুখ এই প্রথম দেখলো মিলি। বেশ মিষ্টি লাগে তখন দেখতে।
সিয়াম বলল,
“কাল ফুচকা খেতে নিয়ে যাবো, তাহলে চলবে?”

ঘুম থেকে উঠে মিলি টেবিলের উপর একটা খাম দেখতে পেলো। সিয়াম রেখে গেছে। তার হাতের লেখা অত্যাধিক ভালো। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলো। রেনু বেগম বলেছিলেন একদিন।
অন্যদিকে মিলি মোটামুটি ধরনের ছাত্রী। যেমন তেমন টেনে টুনে পাশ করে এসেছে। হাতের লেখা কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং।
সিয়ামের হাতের লেখা দেখেই মিলির হিংসে লাগলো।
চিঠিতে কোনো সম্মোধন নেই। সে লিখেছে,

তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো সেটা আমি জানি না। তবে এ’কদিনে এটুকু নিশ্চয় জেনেছো আমি সহজে কারো সাথে মিশতে পারি না, মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারি না।
কাল হাজার চেষ্টা করেও আমি নিজের জমিয়ে রাখা কথাগুলো বলতে পারনি। কিন্তু তোমার জানাটা দরকার। তুমি আমার স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী, আমরা মানি বা না মানি।
আরিয়ার কথাটা হয়তো তুমি শুনেছো। আমার মায়ের পছন্দের মেয়ে, হুট করে বিয়ে, সংসার তারপর….কিন্তু সবার জানার বাইরেও আরো কথা আছে।
আরিয়ার সাথে বিয়েটা আমার এরেন্জ ম্যারেজ ছিলো না।
আমরা তখন সবে ভার্সিটিতে উঠেছি। আমার শত গম্ভীরতা, ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলো দু’টো মানুষ, আরিয়া আর ইশতিয়াক।
ভার্সিটির প্রতিটা মানুষের মুখে মুখে তখন আমাদের বন্ধুত্বের কথা ঘুরে বেড়ায়। এরফাকে হঠাৎ আমার আর আরিয়ার প্রণয়ের গল্পের শুরু হলো। ইশতিয়াক নিজেও সাহায্য করতো।
ভার্সিটি শেষে ইশতিয়াক গেলো আমেরিকা, হায়ার স্টাডির জন্য। আমার বাবা তখন সবে গত হয়েছেন।সংসারে টানাপোড়েন। বিদেশ যাবার কথা থাকলেও বাবার মৃত্যুতে সে ইচ্ছেও বাবার সাথে দাফন করতে হলো। বাবার ব্যবসার হাল ধরলাম, পড়াশোনাও চালিয়ে ছিলাম।
আরিয়ার সাথে সম্পর্ক তখন জোয়ার ভাটার মতো। কখনও রাগ, ঝগড়া, অভিমান আবার ক্ষনেই সব ঠিক।
দেখতে দেখতে সময় গড়ালো। আমার নিষেধ সত্বেও মা আমার জন্য মেয়ে দেখতে গেলো। কাকতালীয় ভাবে সেই মেয়েটা ছিলো আরিয়া। বিয়ে উপলক্ষে যখন ইশতিয়াক দেশে এলো আমি এক মুহূর্তেও ভাবিনি সে আমার জীবনে বন্ধুর বেশধারী শত্রু হবে।
তারপরের গল্পটা খুব সাদামেটা। বিয়ে, সংসার, বিশ্বাস ভাঙন। ব্যাস, সব শেষ।
আমি নিজেই আর নতুন করে শুরু করতে চাইনি। তবে করতে হলো। ভাগ্যের খেলই বলতে পারো। আমি জানি সবাই আরিয়া হয় না, আমি জানি সবাই বিশ্বাস ভাঙে না। তবুও ভয় হয়।
তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে চাই মিলি কিন্তু কোথায় যেনো বাঁধা। শক্ত পোক্ত বাঁধাটাকে আমি কিছুতেই ডিঙোতে পারছি না। তুমি কী সাহায্য করবে মিলি?

,
,
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here